আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের ভাবমর্যাদা বহন করে। বিমানবন্দর হলো এমন একটি স্থান, যেখানে একজন যাত্রী প্রথম পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই সে দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি, শৃঙ্খলা এবং আধুনিকতার একটি ধারণা পেয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণকারীরা সাধারণত বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে দেশের প্রতি প্রথম ইমপ্রেশন তৈরি করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের প্রধান বিমানবন্দরটি যাত্রীসেবা, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে- কেন এমন হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজলে সামনে আসে কয়েকটি কারণ। প্রথমত, বিমানবন্দরে পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতার অভাব প্রকট। যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার মতো যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে। দ্বিতীয়ত, নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্য চালু থাকায় যোগ্যতার বদলে আর্থিক লেনদেনই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এর ফলে একদিকে পেশাগত দক্ষতা কমেছে, অন্যদিকে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় গভীর হয়েছে। তৃতীয়ত, মনিটরিং ও জবাবদিহিতার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় অনিয়ম, ঘুষ, লাগেজ বাণিজ্য, যাত্রী হয়রানিÑসবই প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এ নিয়ে বলার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। আমি প্রায় অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছি, বিভিন্ন দেশে বিমানবন্দরের ভেতরকার কর্মকা- দেখেছি। বর্তমানে কর্মরত আছি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কিন্তু বাংলাদেশের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো বিশৃঙ্খল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও যাত্রী হয়রানিমূলক পরিবেশ পৃথিবীর আর কোথাও চোখে পড়েনি। বিদেশে দেখা যায়Ñএকজন যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে যায়, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লাগেজ পরীক্ষা হয়, কাস্টমস প্রক্রিয়ায় হয়রানি হয় না। অথচ আমাদের বিমানবন্দরে একটি যাত্রাকে বারবার দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, লাগেজ খোলা হয় অকারণে বেল্ট-মানিব্যাগ-ল্যাপটপÑমোবাইল সব খুঁটিয়ে দেখা হয়, যেন যাত্রী কোনো অপরাধী।
সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলোÑএই যাত্রীদের একটি বড় অংশ হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিক, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি সচল। তারা বছরের পর বছর বিদেশে থেকে শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করেন, অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরে থেকে কষ্ট করেন। দেশে ফেরার পথে আশা থাকে পরিবারের কাছে যাবেন, প্রিয়জনদের বুকে ফিরবেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমেই তাদের মুখোমুখি হতে হয় অনাকাক্সিক্ষত হয়রানি, দুর্ব্যবহার ও ঘুষের দাবির। যেন দেশের মাটিও তাদের প্রতি শত্রুতার চোখে তাকায়।
এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নরওয়ে প্রবাসী এক যাত্রীকে বিমানবন্দরে মারধরের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। এর বাইরে নিয়মিতভাবে প্রবেশদ্বার বন্ধ রেখে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড় করানো, লাগেজ বিলম্বিত বা হারিয়ে ফেলা, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণÑসবই শাহজালালের নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। অনেকে আবার অভিযোগ করেন, পরিকল্পিতভাবে ‘লাইন বাণিজ্য’ চালানো হয়, যাতে অর্থের বিনিময়ে দ্রুত সেবা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে বিমানবন্দরের কাস্টমস বিভাগকে ঘিরে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ ও পণ্য দেশে প্রবেশ করে, যার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলোÑতাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা খুব কমই নেওয়া হয়। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তারা আবারো স্বাভাবিক কর্মে ফিরে যায়। এর ফলে সৎ কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যায় এবং অনিয়ম যেন দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এই চিত্র শুধু প্রবাসী বা সাধারণ যাত্রীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বিনিয়োগকারী, বিদেশি উদ্যোক্তা, পর্যটক, এমনকি কূটনীতিকরাও এই অব্যবস্থাপনার শিকার হন। একটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর যদি এভাবে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, তবে সেটি দেশের ভাবমর্যাদার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির গল্প প্রচার করলেও বাস্তবে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অবস্থাই তুলে ধরে।
এখন প্রশ্ন হলোÑএর সমাধান কী? কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়, বিমানবন্দরের সেবার মানোন্নয়ন করতে হলে নীতিগত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, বিমানবন্দরের প্রতিটি প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করতে হবে। কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল হলে ঘুষ ও অনিয়ম কমবে, যাত্রীদের অকারণ হয়রানি বন্ধ হবে। একইসঙ্গে একটি অনলাইন অভিযোগ পোর্টাল থাকতে হবে, যেখানে যাত্রীরা তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং সেই অভিযোগের অগ্রগতি দেখতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাত্রীসেবা ও নৈতিকতা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নির্দিষ্ট পোশাক ও পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাত্রী হয়রানির অভিযোগে দ্রুত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভিজিলেন্স টিম গঠন করে নিয়মিত তদারকি চালাতে হবে।
তৃতীয়ত, যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। লাগেজ হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়া দ্রুত ও নির্ভুল করতে হবে। বিলম্বিত লাগেজ যাত্রীদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার মতো আধুনিক সেবা চালু করতে হবে। বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত হেল্পডেস্ক, তথ্যকেন্দ্র, এবং জরুরি হেল্পলাইন নিশ্চিত করতে হবে। শুল্কমুক্ত পণ্যের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদর্শন করতে হবে।
চতুর্থত, স্বচ্ছ মনিটরিং ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার অভাব দূর করতে হবে। যাত্রীসেবার মান নিয়মিত নিরীক্ষা করতে হবে, যাত্রীদের কাছ থেকে মতামত নিতে হবে এবং সেই মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার চালু করতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আকস্মিক পরিদর্শন (Surprise Visit) বাড়াতে হবে, যাতে কর্মকর্তারা সর্বদা দায়িত্বশীল থাকেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑপ্রবাসীদের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। তারা কোনো অপরাধী নন; বরং তারা দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের নিরাপদ, সম্মানজনক ও হয়রানিমুক্ত যাতায়াত নিশ্চিত করা হলে কেবল প্রবাসীরা স্বস্তি পাবেন না, বরং দেশের ভাবমর্যাদাও বিশ্বে উজ্জ্বল হবে।
পরিশেষে বলব, বছরের পর বছর ধরে চলা অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দৃঢ়তা এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছতা একসঙ্গে কার্যকর করতে হবে। শুধু নতুন টার্মিনাল বানিয়ে হবে না, ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যাশাÑপ্রবাসীদের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক বিমানবন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা হবে, যাতে তারা দেশের উন্নয়নে আরও উৎসাহ নিয়ে অবদান রাখতে পারেন।
[লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী]
আবুল কালাম আজাদ
রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের ভাবমর্যাদা বহন করে। বিমানবন্দর হলো এমন একটি স্থান, যেখানে একজন যাত্রী প্রথম পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই সে দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি, শৃঙ্খলা এবং আধুনিকতার একটি ধারণা পেয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণকারীরা সাধারণত বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে দেশের প্রতি প্রথম ইমপ্রেশন তৈরি করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের প্রধান বিমানবন্দরটি যাত্রীসেবা, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে- কেন এমন হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজলে সামনে আসে কয়েকটি কারণ। প্রথমত, বিমানবন্দরে পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতার অভাব প্রকট। যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার মতো যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে। দ্বিতীয়ত, নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্য চালু থাকায় যোগ্যতার বদলে আর্থিক লেনদেনই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এর ফলে একদিকে পেশাগত দক্ষতা কমেছে, অন্যদিকে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় গভীর হয়েছে। তৃতীয়ত, মনিটরিং ও জবাবদিহিতার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় অনিয়ম, ঘুষ, লাগেজ বাণিজ্য, যাত্রী হয়রানিÑসবই প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এ নিয়ে বলার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। আমি প্রায় অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছি, বিভিন্ন দেশে বিমানবন্দরের ভেতরকার কর্মকা- দেখেছি। বর্তমানে কর্মরত আছি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কিন্তু বাংলাদেশের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো বিশৃঙ্খল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও যাত্রী হয়রানিমূলক পরিবেশ পৃথিবীর আর কোথাও চোখে পড়েনি। বিদেশে দেখা যায়Ñএকজন যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে যায়, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লাগেজ পরীক্ষা হয়, কাস্টমস প্রক্রিয়ায় হয়রানি হয় না। অথচ আমাদের বিমানবন্দরে একটি যাত্রাকে বারবার দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, লাগেজ খোলা হয় অকারণে বেল্ট-মানিব্যাগ-ল্যাপটপÑমোবাইল সব খুঁটিয়ে দেখা হয়, যেন যাত্রী কোনো অপরাধী।
সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলোÑএই যাত্রীদের একটি বড় অংশ হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিক, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি সচল। তারা বছরের পর বছর বিদেশে থেকে শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করেন, অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরে থেকে কষ্ট করেন। দেশে ফেরার পথে আশা থাকে পরিবারের কাছে যাবেন, প্রিয়জনদের বুকে ফিরবেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমেই তাদের মুখোমুখি হতে হয় অনাকাক্সিক্ষত হয়রানি, দুর্ব্যবহার ও ঘুষের দাবির। যেন দেশের মাটিও তাদের প্রতি শত্রুতার চোখে তাকায়।
এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নরওয়ে প্রবাসী এক যাত্রীকে বিমানবন্দরে মারধরের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনমনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে। এর বাইরে নিয়মিতভাবে প্রবেশদ্বার বন্ধ রেখে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড় করানো, লাগেজ বিলম্বিত বা হারিয়ে ফেলা, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণÑসবই শাহজালালের নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। অনেকে আবার অভিযোগ করেন, পরিকল্পিতভাবে ‘লাইন বাণিজ্য’ চালানো হয়, যাতে অর্থের বিনিময়ে দ্রুত সেবা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে বিমানবন্দরের কাস্টমস বিভাগকে ঘিরে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ ও পণ্য দেশে প্রবেশ করে, যার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলোÑতাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা খুব কমই নেওয়া হয়। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তারা আবারো স্বাভাবিক কর্মে ফিরে যায়। এর ফলে সৎ কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যায় এবং অনিয়ম যেন দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এই চিত্র শুধু প্রবাসী বা সাধারণ যাত্রীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বিনিয়োগকারী, বিদেশি উদ্যোক্তা, পর্যটক, এমনকি কূটনীতিকরাও এই অব্যবস্থাপনার শিকার হন। একটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর যদি এভাবে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, তবে সেটি দেশের ভাবমর্যাদার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির গল্প প্রচার করলেও বাস্তবে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অবস্থাই তুলে ধরে।
এখন প্রশ্ন হলোÑএর সমাধান কী? কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়, বিমানবন্দরের সেবার মানোন্নয়ন করতে হলে নীতিগত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, বিমানবন্দরের প্রতিটি প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করতে হবে। কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল হলে ঘুষ ও অনিয়ম কমবে, যাত্রীদের অকারণ হয়রানি বন্ধ হবে। একইসঙ্গে একটি অনলাইন অভিযোগ পোর্টাল থাকতে হবে, যেখানে যাত্রীরা তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং সেই অভিযোগের অগ্রগতি দেখতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাত্রীসেবা ও নৈতিকতা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নির্দিষ্ট পোশাক ও পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাত্রী হয়রানির অভিযোগে দ্রুত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভিজিলেন্স টিম গঠন করে নিয়মিত তদারকি চালাতে হবে।
তৃতীয়ত, যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। লাগেজ হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়া দ্রুত ও নির্ভুল করতে হবে। বিলম্বিত লাগেজ যাত্রীদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার মতো আধুনিক সেবা চালু করতে হবে। বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত হেল্পডেস্ক, তথ্যকেন্দ্র, এবং জরুরি হেল্পলাইন নিশ্চিত করতে হবে। শুল্কমুক্ত পণ্যের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদর্শন করতে হবে।
চতুর্থত, স্বচ্ছ মনিটরিং ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার অভাব দূর করতে হবে। যাত্রীসেবার মান নিয়মিত নিরীক্ষা করতে হবে, যাত্রীদের কাছ থেকে মতামত নিতে হবে এবং সেই মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার চালু করতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আকস্মিক পরিদর্শন (Surprise Visit) বাড়াতে হবে, যাতে কর্মকর্তারা সর্বদা দায়িত্বশীল থাকেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑপ্রবাসীদের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। তারা কোনো অপরাধী নন; বরং তারা দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের নিরাপদ, সম্মানজনক ও হয়রানিমুক্ত যাতায়াত নিশ্চিত করা হলে কেবল প্রবাসীরা স্বস্তি পাবেন না, বরং দেশের ভাবমর্যাদাও বিশ্বে উজ্জ্বল হবে।
পরিশেষে বলব, বছরের পর বছর ধরে চলা অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দৃঢ়তা এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছতা একসঙ্গে কার্যকর করতে হবে। শুধু নতুন টার্মিনাল বানিয়ে হবে না, ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রত্যাশাÑপ্রবাসীদের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক বিমানবন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা হবে, যাতে তারা দেশের উন্নয়নে আরও উৎসাহ নিয়ে অবদান রাখতে পারেন।
[লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী]