alt

opinion » post-editorial

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫

ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা পৃথিবীর সব সভ্যতার তুলনায় প্রাচীন। ভারতীয় উপমহাদেশ বলতে বোঝায় ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এবং বার্মাকে। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে আজ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ বছর আগে এ উপমহাদেশে মানুষ বসবাস করত। প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে সিন্দু সভ্যতার উন্মেষ ঘটে, যা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর ধ্বংস নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা, আর্যরা এই সভ্যতা ধ্বংস করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল।

এ অঞ্চলের অনেক মানুষ সেই সময় পৃথিবীর নানা অংশে গমনাগমন করেছিলেন। এজন্য ধরে নেওয়া যায়, আমেরিকার আলাস্কায় প্রায় ২০-২৫ হাজার বছর আগে যে এশীয়রা বসতি গড়েছিল, তারা ভারতীয় উপমহাদেশেরই মানুষ ছিলেন। যাদেরকে বর্তমানে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বলা হয়। ব্রিটিশরা আমেরিকায় বসতি স্থাপন করার পর এই জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষকে দাস বানিয়েছিল।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনতম অভিবাসী জনগোষ্ঠী হলো সাঁওতালরা। সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে অনেকগুলি গোত্র রয়েছে। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব ভাষা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ধারা আছে। সাঁওতালরা অষ্ট্রিক ভাষাভাষী। অভিবাসন ও গমনাগমনের দিক থেকে সাঁওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বাসিন্দা। বহু ঐতিহাসিকের মতে, সাঁওতালদের বসতি স্থাপনের পর এই অঞ্চলে দ্রাবিড়দের আবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিকদের মতে, এ অঞ্চলের কৃষি চাষের প্রচলন শুরু করে সাওতালরাই।

ভারতীয় উপমহাদেশ নদীবাহিত উর্বর মৃত্তিকার অঞ্চল। এখানে ঋতু চক্র ঘটে দুই মাস অন্তর। উপমহাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এখানে বিভিন্ন ধরনের শস্যের আবাদ শুরু হয়। বীজ বনন ও আবাদ প্রথার সূচনা আদিবাসী সাঁওতালদের হাতে। বছরের বারো মাসেই কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হতো। তবে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলের ধরনে বৈচিত্র্য ছিল। শস্য মৌসুমকে কেন্দ্র করে উৎসবের রীতি গড়ে ওঠে।

বাংলা অঞ্চলটি উপমহাদেশের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলের মধ্যে একটি। এখানে বারো মাসই ফসল উৎপন্ন হতো। তাই বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ উদযাপিত হতো। প্রতিটি শস্য উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উৎসব মানুষের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াত। শস্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে যে উৎসবগুলো উদযাপিত হতো, তা ছিল সার্বজনীন, কারণ জীবনধারণের মূল উপাদান খাদ্য। এ উৎসবগুলোর মধ্যে ‘কারাম’ একটি প্রাচীন উৎসব, যা এখনও সাঁওতাল আদিবাসীরা পালন করে।

কারাম উৎসবকে বর্তমানে ধর্মের ফ্রেমে স্থাপন করা হয়েছে। শুধুমাত্র আদিবাসীরাই এই উৎসব পালন করেন। আর্যদের আগমনের পর বিভিন্ন ধর্মের প্রচলনের কারণে উৎসবগুলোর ধরন ও ধ্যানধারা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এই জনপদের মানুষ এখনো প্রাচীন সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ষপঞ্জিকাও তৈরি হয়েছে।

ভাদ্র মাসে আদিকালে এ অঞ্চলের মানুষ যে উৎসব পালন করত তা হলো কারাম পরব বা কারাম পূজা। এই পূজা আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে এখনও প্রচলিত। এটি মূলত কৃষিভিত্তিক উৎসব, যা ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয়। একে ভাতাই উৎসবও বলা হয়ে থাকে। করম পরব ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আসাম, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ ও নেপালে পালিত একটি ফসল কাটার উৎসব। এক সময় বাংলায় আউশ ধান চাষ হতো। আউশ ধান কাটার সময় ভাদ্র মাস। আউশ কাটার পর রোপা আমন চাষ শুরু হতো।

প্রাচীন বাংলার মানুষ এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করত অধিক ফলনের আশায়। করম দেবতা হলোÑ শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার কুড়মি, ভূমিজ, রাজপুত, চন্দ্রবংশী ক্ষত্রীয়, সরাক, লোহার, বাউরি, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবকে আরণ্যক ও কৃষিভিত্তিক লোকউৎসব হিসেবে পালন করে।

কারাম উৎসব একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব, যা প্রধানত ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে পালিত হয়। এই দিনে কারাম গাছের ডাল পুঁতে পূজা করা হয়। নৃত্য-গীতের মাধ্যমে প্রকৃতি ও ফসলের দেবতাদের আরাধনা করা হয়। বিশ্বাস ছিল, এতে ফসল বৃদ্ধি পায় এবং জীবন সমৃদ্ধ হয়। আধুনিক সময়েও আদিবাসীরা এটি ভালো ফসল, সমৃদ্ধি এবং বিপদ থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে উদযাপন করে।

কারাম উৎসবকে পরিবেশ রক্ষার উৎসব হিসেবেও ধরা যায়। কারণ ধরিত্রী রক্ষার মূল উপাদান গাছ এবং এই গাছ রোপণের কাজ উৎসবের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, বিহারের বিস্মম্ভরপুরে কুর্মী সেনা আয়োজিত করম মহোৎসবে ভারতের রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ নারায়ণ সিং বলেন, “করম উৎসব প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। আমরা যদি বিশ্বকে বাঁচাতে চাই, তাহলে আমাদের করম ও পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। বর্তমান প্রজন্ম যদি পাহাড়, নদী, গাছপালা এবং পরিবেশের অন্যান্য অংশ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, মানবতা রক্ষা করা অসম্ভব।’

প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব পালনের নির্ধারিত দিন নির্ধারণ করা হয়। উৎসবের সাতদিন আগে কুমারী মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে বীজ বোনা, তেল ও হলুদ মেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। পুরুষেরা শাল গাছের ডাল সংগ্রহ করে। গ্রাম্য বয়স্কদের নির্দিষ্ট স্থানে দুটি করম ডাল এনে পূজা করা হয়। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপবাসের পর সন্ধ্যায় ফুল, ফলসহ নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করেন। সারারাত নৃত্য-গান চলে। পরদিন সকালে অঙ্কুরিত বীজগুলো উপড়ে বাড়িতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং করম ডাল জলে ভাসানো হয়। মেয়েরা পরস্পরকে করম দোর বা রাখি পরিয়ে দেয়। এই উৎসবে মূলত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নেই। এটি ভাই-বোনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে মিলন ও ভালোবাসার উৎসব হিসেবেও পালিত হয়।

কারাম উৎসব ফসল কাটার মৌসুমকে কেন্দ্র করে উদযাপিত একটি উৎসব। এটি প্রকৃতি ও ফসলের গুরুত্বের প্রতি আলোকপাত করে। জীবন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে উৎসবটি মানুষের মধ্যে প্রাচীন আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভাগ করে নেয়। মূলত এটি কেবল উদযাপন নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক ও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যম।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

প্রসঙ্গ : পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : রাজনৈতিক বিভেদের অমোচনীয় ক্ষত

ছবি

আলফ্রেড সরেন হত্যা : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

ছবি

আলাস্কা বৈঠক : শান্তির দেখা কি মিলল?

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

ছাত্র রাজনীতি : নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?

ছবি

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

ছবি

উন্নয়ন ও প্রকৃতি

ছবি

কৃষকের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

সব অর্জনে কৃতিত্ব নিতে নেই

নাগাসাকি দিবস : পারমাণবিক বোমার অপপ্রয়োগ বন্ধ হোক

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

অদৃশ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই : উষ্ণ বাংলাদেশে জলবায়ু-প্রসূত স্বাস্থ্য সংকট

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

tab

opinion » post-editorial

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫

ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা পৃথিবীর সব সভ্যতার তুলনায় প্রাচীন। ভারতীয় উপমহাদেশ বলতে বোঝায় ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এবং বার্মাকে। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে আজ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ বছর আগে এ উপমহাদেশে মানুষ বসবাস করত। প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে সিন্দু সভ্যতার উন্মেষ ঘটে, যা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর ধ্বংস নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা, আর্যরা এই সভ্যতা ধ্বংস করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল।

এ অঞ্চলের অনেক মানুষ সেই সময় পৃথিবীর নানা অংশে গমনাগমন করেছিলেন। এজন্য ধরে নেওয়া যায়, আমেরিকার আলাস্কায় প্রায় ২০-২৫ হাজার বছর আগে যে এশীয়রা বসতি গড়েছিল, তারা ভারতীয় উপমহাদেশেরই মানুষ ছিলেন। যাদেরকে বর্তমানে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বলা হয়। ব্রিটিশরা আমেরিকায় বসতি স্থাপন করার পর এই জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষকে দাস বানিয়েছিল।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনতম অভিবাসী জনগোষ্ঠী হলো সাঁওতালরা। সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে অনেকগুলি গোত্র রয়েছে। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব ভাষা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ধারা আছে। সাঁওতালরা অষ্ট্রিক ভাষাভাষী। অভিবাসন ও গমনাগমনের দিক থেকে সাঁওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বাসিন্দা। বহু ঐতিহাসিকের মতে, সাঁওতালদের বসতি স্থাপনের পর এই অঞ্চলে দ্রাবিড়দের আবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিকদের মতে, এ অঞ্চলের কৃষি চাষের প্রচলন শুরু করে সাওতালরাই।

ভারতীয় উপমহাদেশ নদীবাহিত উর্বর মৃত্তিকার অঞ্চল। এখানে ঋতু চক্র ঘটে দুই মাস অন্তর। উপমহাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এখানে বিভিন্ন ধরনের শস্যের আবাদ শুরু হয়। বীজ বনন ও আবাদ প্রথার সূচনা আদিবাসী সাঁওতালদের হাতে। বছরের বারো মাসেই কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হতো। তবে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলের ধরনে বৈচিত্র্য ছিল। শস্য মৌসুমকে কেন্দ্র করে উৎসবের রীতি গড়ে ওঠে।

বাংলা অঞ্চলটি উপমহাদেশের সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলের মধ্যে একটি। এখানে বারো মাসই ফসল উৎপন্ন হতো। তাই বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ উদযাপিত হতো। প্রতিটি শস্য উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উৎসব মানুষের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াত। শস্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে যে উৎসবগুলো উদযাপিত হতো, তা ছিল সার্বজনীন, কারণ জীবনধারণের মূল উপাদান খাদ্য। এ উৎসবগুলোর মধ্যে ‘কারাম’ একটি প্রাচীন উৎসব, যা এখনও সাঁওতাল আদিবাসীরা পালন করে।

কারাম উৎসবকে বর্তমানে ধর্মের ফ্রেমে স্থাপন করা হয়েছে। শুধুমাত্র আদিবাসীরাই এই উৎসব পালন করেন। আর্যদের আগমনের পর বিভিন্ন ধর্মের প্রচলনের কারণে উৎসবগুলোর ধরন ও ধ্যানধারা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এই জনপদের মানুষ এখনো প্রাচীন সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ষপঞ্জিকাও তৈরি হয়েছে।

ভাদ্র মাসে আদিকালে এ অঞ্চলের মানুষ যে উৎসব পালন করত তা হলো কারাম পরব বা কারাম পূজা। এই পূজা আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে এখনও প্রচলিত। এটি মূলত কৃষিভিত্তিক উৎসব, যা ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয়। একে ভাতাই উৎসবও বলা হয়ে থাকে। করম পরব ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আসাম, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ ও নেপালে পালিত একটি ফসল কাটার উৎসব। এক সময় বাংলায় আউশ ধান চাষ হতো। আউশ ধান কাটার সময় ভাদ্র মাস। আউশ কাটার পর রোপা আমন চাষ শুরু হতো।

প্রাচীন বাংলার মানুষ এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করত অধিক ফলনের আশায়। করম দেবতা হলোÑ শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার কুড়মি, ভূমিজ, রাজপুত, চন্দ্রবংশী ক্ষত্রীয়, সরাক, লোহার, বাউরি, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবকে আরণ্যক ও কৃষিভিত্তিক লোকউৎসব হিসেবে পালন করে।

কারাম উৎসব একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব, যা প্রধানত ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে পালিত হয়। এই দিনে কারাম গাছের ডাল পুঁতে পূজা করা হয়। নৃত্য-গীতের মাধ্যমে প্রকৃতি ও ফসলের দেবতাদের আরাধনা করা হয়। বিশ্বাস ছিল, এতে ফসল বৃদ্ধি পায় এবং জীবন সমৃদ্ধ হয়। আধুনিক সময়েও আদিবাসীরা এটি ভালো ফসল, সমৃদ্ধি এবং বিপদ থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে উদযাপন করে।

কারাম উৎসবকে পরিবেশ রক্ষার উৎসব হিসেবেও ধরা যায়। কারণ ধরিত্রী রক্ষার মূল উপাদান গাছ এবং এই গাছ রোপণের কাজ উৎসবের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, বিহারের বিস্মম্ভরপুরে কুর্মী সেনা আয়োজিত করম মহোৎসবে ভারতের রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ নারায়ণ সিং বলেন, “করম উৎসব প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। আমরা যদি বিশ্বকে বাঁচাতে চাই, তাহলে আমাদের করম ও পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। বর্তমান প্রজন্ম যদি পাহাড়, নদী, গাছপালা এবং পরিবেশের অন্যান্য অংশ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, মানবতা রক্ষা করা অসম্ভব।’

প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব পালনের নির্ধারিত দিন নির্ধারণ করা হয়। উৎসবের সাতদিন আগে কুমারী মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে বীজ বোনা, তেল ও হলুদ মেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। পুরুষেরা শাল গাছের ডাল সংগ্রহ করে। গ্রাম্য বয়স্কদের নির্দিষ্ট স্থানে দুটি করম ডাল এনে পূজা করা হয়। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপবাসের পর সন্ধ্যায় ফুল, ফলসহ নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করেন। সারারাত নৃত্য-গান চলে। পরদিন সকালে অঙ্কুরিত বীজগুলো উপড়ে বাড়িতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং করম ডাল জলে ভাসানো হয়। মেয়েরা পরস্পরকে করম দোর বা রাখি পরিয়ে দেয়। এই উৎসবে মূলত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নেই। এটি ভাই-বোনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে মিলন ও ভালোবাসার উৎসব হিসেবেও পালিত হয়।

কারাম উৎসব ফসল কাটার মৌসুমকে কেন্দ্র করে উদযাপিত একটি উৎসব। এটি প্রকৃতি ও ফসলের গুরুত্বের প্রতি আলোকপাত করে। জীবন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে উৎসবটি মানুষের মধ্যে প্রাচীন আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভাগ করে নেয়। মূলত এটি কেবল উদযাপন নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক ও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যম।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top