আনোয়ারুল হক
২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুই প্রধান দলের মধ্যে তৈরি হয় তিক্ততার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ চার জাতীয় নেতাকে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় এবং দেশের দ্বিতীয় সেনাপ্রধান, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেক্টর কমান্ডার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাতের আঁধারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এ দুই হত্যাকা- রাতের আঁধারে হলেও ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪ জনকে হত্যা এবং ৩০০ জনের অধিককে আহত করা হয়। একটা ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চ থেকে বক্তৃতা শেষে তিনি ট্রাক থেকে নিচে নেমে আসতে থাকার সময়ে মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন।
এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরে শেখ হাসিনার মনে এমন এক ধারণার সৃষ্টি হয় যে, বিরোধীদের হাতে তার জীবন বিপন্ন। তার পিতামাতাসহ প্রায় পুরো পরিবার হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ায়, তার উপরও একাধিকবার হত্যা প্রচেষ্টা হওয়ায় এবং হত্যা প্রচেষ্টার যথাযথ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর না হওয়ায় এ ধারণা তার বিশ্বাসে পরিণত হয়। কার্যত ধীরে ধীরে তিনি ‘ট্রমাটাইজড’ হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, কর্তৃত্ববাদও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ ঘটনা অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে এই মামলায় দ-িত সব আসামি খালাস পেলেন। মামলার রায়ের পরে সাংবাদিক মাসুদ কামাল যথার্থই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তা হলে কি ২১ আগস্ট কোন গ্রেনেড হামলা হয়নি? আইভী রহমান কি ডায়রিয়ায় মারা গেছেন?’ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবশ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে মামলা দুটি তদন্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রায়ের অনুলিপি পাঠাতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপরে নয় মাস পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। ভাবখানা এমন যে, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে’ হত্যা করা জায়েজ। বরং সেদিন তাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতের ‘উচিত ছিল’ গ্রেনেড হামলাকারীদের তিরস্কার ও জরিমানা করা!
২০০৪ সালের এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই হামলার নিন্দা এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি বিধানের অঙ্গীকার করলেও পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা নিজেই গ্রেনেড হামলার নাটক সাজিয়েছেন। তৎকালীন শাসক দলের কোন কোন নেতা বক্তৃতায় বলেন শেখ হাসিনা তার ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন। এসব বক্তব্য এবং বহুল আলোচিত জজ মিয়া নাটক বিএনপি আমলের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে তৈরি হয়েছিল তিক্ততার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল, যা অতিক্রম করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছিল।
১৯৯১ সাল থেকে দ্বিদলীয় রাজনীতির মেরুকরণ এমনটাই হয়েছিল যে এক টার্ম বিএনপি তো পরের টার্ম আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীনদের সাজানো সংসার ওলটপালট হয়ে যায়। বিরোধী দল ‘বাই ডিফল্ট’ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। খালেদা জিয়া ২০০৬ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে মনোনীত করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়ে দেশের বুকে এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। এবং কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেন। খালেদা জিয়ার গোটা রাজনৈতিক জীবনের সাহসিকতা ও আপোষহীনতার সঙ্গে ওই সিদ্ধান্ত যায় না। কার বা কাদের পরামর্শে খালেদা জিয়া সেদিন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইতিহাসবিদদের তা বের করা উচিত।
এর পরে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনসহ নানা ঘটনাবলি ও সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরণে যে সরকার আসীন হয় সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেনাবাহিনী। সেনাসমর্থিত সরকার হিসেবে বা সংক্ষেপে ১/১১-র সরকার নামে তা পরিচিতি অর্জন করে। তৎকালীন সামরিক নেতৃত্ব উগ্র কর্তৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাওভাবে চড়াও হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের সে উদ্যোগকে ঠিক এবারের মতোই নাগরিক সমাজের অনেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন করলেও মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে খ্যাত বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কার উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও কিন্তু ওই সময়ে ১/১১-র সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র ক্ষেত্রে মনোভাব পরিবর্তন করায় দ্রুত তিনি দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসেন।
সেনা সমর্থিত সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় এসে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ নির্বাচন করে বিদায় হয়। আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হলেও নানা রাজনৈতিক সমীকরণে ১৯৯১ থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণে প্রধান দুই দল পালাক্রমে সরকার পরিচালনার সময়ে সীমিত অর্থে যতটুকু গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল তাও ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। নির্বাচনে দলীয় সুবিধা পেতে জনমতকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করার ব্যবস্থা করেন এবং দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য তিন তিনটি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখেন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বিদ্রোহীদের মদদ দেয়া, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া এবং পাকিস্তানের আইএস ও চীনের সঙ্গে তাদের সংযোগ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সমর্থন ও সহযোগিতার অভিযোগ ভারত করে আসছিল। সে দিক থেকে আওয়ামী শাসন আমলে এ ধরনের কোন শংকা না থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসাবাণিজ্যে বাড়তি সুবিধা পেয়ে ভারতবর্ষের শাসকগোষ্ঠী যেনতেন ভাবে শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে আসছিল।
ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন আরও দুর্বিনীত। আর ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির এ ধরনের দেউলিয়াত্ব বাংলাদেশে উগ্র ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে। বিশেষত বিজেপি ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা বৃদ্ধি ও মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিও তাদের রাজনীতি প্রসারে উর্বর জমিন পেয়ে যায়। নিজেদের রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ শক্তির বাড় বাড়ন্তকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার নৈতিক শক্তি হারিয়ে শেখ হাসিনা কখনও শক্তি প্রয়োগ করে, কখনও নীতিগত ছাড় দিয়ে আবার কখনও ওই সব গোষ্ঠীর নেতাদের পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তাদের বশে রাখেন। এতে করে সরকার সাময়িক সুবিধা পেলেও ভেতরে ভেতরে উগ্রবাদী গোষ্ঠী আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যার প্রকাশ হাসিনা পতনের পরে এখন খুবই দৃশ্যমান।
অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের পরে এবারের আন্দোলন দমনে যে নির্বিচার হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে কিছু কিছু বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা বারবার ঘোষণা করেছেন তারা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু এ কেমন আইনের শাসন যে বিচার কার্যক্রম দেখলে মনে হয় বিগত দেড় দশকে দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি। বিগত দেড় দশকের সব মামলা বাতিল, সব আসামি খালাস। নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত সবই হাসিনা আমলের মতো চলছে। কোনো পরিবর্তন নেই। রাগ অনুরাগের ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহভাবে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত না হলে জনসাধারণ অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার ব্যবস্থার ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলবে যা নতুন সংকট সৃষ্টি করবে।
গণআন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের হত্যার হুকুম দেয়ার অপরাধে শেখ হাসিনার বিচারকে সর্বগ্রহণযোগ্য করার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের এবং এর পেছনের কুশীলবদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই যদি চলতে থাকে তবে সরকারের ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বুলি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়বে। সব আসামিরই বেকসুর খালাস ইতোমধ্যে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রধান উপদেষ্টার মামলাসহ অনেক মামলাই তো অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নিষ্পত্তি করেছে। গ্রেনেড হামলা মামলা ও বর্বর হত্যাকা-ের বিষয়েও দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নিশ্চয়ই সবার স্মরণে আছে সেনাবাহিনীর একাংশ ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সংঘটিত করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও পরবর্তীতে তার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমদসহ চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের খন্দকার মোশতাক দেশের ‘সূর্য সন্তান’ আখ্যা দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে বলেই কি তার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যাকারীরা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষিত হবে!
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা ]
আনোয়ারুল হক
২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুই প্রধান দলের মধ্যে তৈরি হয় তিক্ততার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল।
বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ চার জাতীয় নেতাকে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় এবং দেশের দ্বিতীয় সেনাপ্রধান, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সেক্টর কমান্ডার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাতের আঁধারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এ দুই হত্যাকা- রাতের আঁধারে হলেও ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৪ জনকে হত্যা এবং ৩০০ জনের অধিককে আহত করা হয়। একটা ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চ থেকে বক্তৃতা শেষে তিনি ট্রাক থেকে নিচে নেমে আসতে থাকার সময়ে মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন।
এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরে শেখ হাসিনার মনে এমন এক ধারণার সৃষ্টি হয় যে, বিরোধীদের হাতে তার জীবন বিপন্ন। তার পিতামাতাসহ প্রায় পুরো পরিবার হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ায়, তার উপরও একাধিকবার হত্যা প্রচেষ্টা হওয়ায় এবং হত্যা প্রচেষ্টার যথাযথ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর না হওয়ায় এ ধারণা তার বিশ্বাসে পরিণত হয়। কার্যত ধীরে ধীরে তিনি ‘ট্রমাটাইজড’ হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, কর্তৃত্ববাদও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ ঘটনা অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে এই মামলায় দ-িত সব আসামি খালাস পেলেন। মামলার রায়ের পরে সাংবাদিক মাসুদ কামাল যথার্থই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তা হলে কি ২১ আগস্ট কোন গ্রেনেড হামলা হয়নি? আইভী রহমান কি ডায়রিয়ায় মারা গেছেন?’ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবশ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে মামলা দুটি তদন্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রায়ের অনুলিপি পাঠাতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপরে নয় মাস পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। ভাবখানা এমন যে, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে’ হত্যা করা জায়েজ। বরং সেদিন তাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতের ‘উচিত ছিল’ গ্রেনেড হামলাকারীদের তিরস্কার ও জরিমানা করা!
২০০৪ সালের এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই হামলার নিন্দা এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি বিধানের অঙ্গীকার করলেও পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা নিজেই গ্রেনেড হামলার নাটক সাজিয়েছেন। তৎকালীন শাসক দলের কোন কোন নেতা বক্তৃতায় বলেন শেখ হাসিনা তার ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন। এসব বক্তব্য এবং বহুল আলোচিত জজ মিয়া নাটক বিএনপি আমলের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে তৈরি হয়েছিল তিক্ততার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল, যা অতিক্রম করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছিল।
১৯৯১ সাল থেকে দ্বিদলীয় রাজনীতির মেরুকরণ এমনটাই হয়েছিল যে এক টার্ম বিএনপি তো পরের টার্ম আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীনদের সাজানো সংসার ওলটপালট হয়ে যায়। বিরোধী দল ‘বাই ডিফল্ট’ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। খালেদা জিয়া ২০০৬ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে মনোনীত করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়ে দেশের বুকে এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। এবং কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেন। খালেদা জিয়ার গোটা রাজনৈতিক জীবনের সাহসিকতা ও আপোষহীনতার সঙ্গে ওই সিদ্ধান্ত যায় না। কার বা কাদের পরামর্শে খালেদা জিয়া সেদিন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইতিহাসবিদদের তা বের করা উচিত।
এর পরে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের আন্দোলনসহ নানা ঘটনাবলি ও সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরণে যে সরকার আসীন হয় সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেনাবাহিনী। সেনাসমর্থিত সরকার হিসেবে বা সংক্ষেপে ১/১১-র সরকার নামে তা পরিচিতি অর্জন করে। তৎকালীন সামরিক নেতৃত্ব উগ্র কর্তৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাওভাবে চড়াও হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের সে উদ্যোগকে ঠিক এবারের মতোই নাগরিক সমাজের অনেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন করলেও মাইনাস টু ফর্মুলা হিসেবে খ্যাত বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কার উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও কিন্তু ওই সময়ে ১/১১-র সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র ক্ষেত্রে মনোভাব পরিবর্তন করায় দ্রুত তিনি দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসেন।
সেনা সমর্থিত সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় এসে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ নির্বাচন করে বিদায় হয়। আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হলেও নানা রাজনৈতিক সমীকরণে ১৯৯১ থেকে দ্বিদলীয় মেরুকরণে প্রধান দুই দল পালাক্রমে সরকার পরিচালনার সময়ে সীমিত অর্থে যতটুকু গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল তাও ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। নির্বাচনে দলীয় সুবিধা পেতে জনমতকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করার ব্যবস্থা করেন এবং দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য তিন তিনটি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখেন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বিদ্রোহীদের মদদ দেয়া, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া এবং পাকিস্তানের আইএস ও চীনের সঙ্গে তাদের সংযোগ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সমর্থন ও সহযোগিতার অভিযোগ ভারত করে আসছিল। সে দিক থেকে আওয়ামী শাসন আমলে এ ধরনের কোন শংকা না থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসাবাণিজ্যে বাড়তি সুবিধা পেয়ে ভারতবর্ষের শাসকগোষ্ঠী যেনতেন ভাবে শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে আসছিল।
ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন আরও দুর্বিনীত। আর ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির এ ধরনের দেউলিয়াত্ব বাংলাদেশে উগ্র ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে। বিশেষত বিজেপি ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা বৃদ্ধি ও মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিও তাদের রাজনীতি প্রসারে উর্বর জমিন পেয়ে যায়। নিজেদের রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ শক্তির বাড় বাড়ন্তকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার নৈতিক শক্তি হারিয়ে শেখ হাসিনা কখনও শক্তি প্রয়োগ করে, কখনও নীতিগত ছাড় দিয়ে আবার কখনও ওই সব গোষ্ঠীর নেতাদের পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তাদের বশে রাখেন। এতে করে সরকার সাময়িক সুবিধা পেলেও ভেতরে ভেতরে উগ্রবাদী গোষ্ঠী আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যার প্রকাশ হাসিনা পতনের পরে এখন খুবই দৃশ্যমান।
অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের পরে এবারের আন্দোলন দমনে যে নির্বিচার হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে কিছু কিছু বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা বারবার ঘোষণা করেছেন তারা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু এ কেমন আইনের শাসন যে বিচার কার্যক্রম দেখলে মনে হয় বিগত দেড় দশকে দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি। বিগত দেড় দশকের সব মামলা বাতিল, সব আসামি খালাস। নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত সবই হাসিনা আমলের মতো চলছে। কোনো পরিবর্তন নেই। রাগ অনুরাগের ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহভাবে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত না হলে জনসাধারণ অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার ব্যবস্থার ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলবে যা নতুন সংকট সৃষ্টি করবে।
গণআন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের হত্যার হুকুম দেয়ার অপরাধে শেখ হাসিনার বিচারকে সর্বগ্রহণযোগ্য করার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের এবং এর পেছনের কুশীলবদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই যদি চলতে থাকে তবে সরকারের ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বুলি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়বে। সব আসামিরই বেকসুর খালাস ইতোমধ্যে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রধান উপদেষ্টার মামলাসহ অনেক মামলাই তো অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নিষ্পত্তি করেছে। গ্রেনেড হামলা মামলা ও বর্বর হত্যাকা-ের বিষয়েও দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নিশ্চয়ই সবার স্মরণে আছে সেনাবাহিনীর একাংশ ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সংঘটিত করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও পরবর্তীতে তার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমদসহ চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের খন্দকার মোশতাক দেশের ‘সূর্য সন্তান’ আখ্যা দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে বলেই কি তার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যাকারীরা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষিত হবে!
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা ]