alt

opinion » post-editorial

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

সাদিয়া সুলতানা রিমি

: বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫

গণিতকে প্রায়শই শুধুমাত্র একটি তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা কেবল কাগজে-কলমে জটিল সমীকরণ সমাধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি কোণে, বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, মহাকাশ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রগুলোতে গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য। এই ক্ষেত্রগুলো গণিতের বিভিন্ন শাখা, যেমন- ক্যালকুলাস, লিনিয়ার অ্যালজেব্রা, পরিসংখ্যান, এবং অ্যালগরিদম থিওরির ওপর নির্ভর করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং গণিত : এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক

কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মূল ভিত্তিই হলো গণিত। কম্পিউটার একটি বাইনারি (০ এবং ১) সিস্টেমে কাজ করে, যা সরাসরি বুলিয়ান অ্যালজেব্রার একটি বাস্তব রূপ। যেকোনো প্রোগ্রাম লেখার জন্য, প্রোগ্রামারকে সমস্যাটিকে এমনভাবে ভেঙে ফেলতে হয় যাতে তা গাণিতিক যুক্তি এবং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

অ্যালগরিদম এবং ডেটা স্ট্রাকচার : একটি অ্যালগরিদম হলো কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ধাপে ধাপে নির্দেশিকার একটি সেট। এই অ্যালগরিদমগুলো গাণিতিক যুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। যেমন- একটি অ্যারেতে সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি খুঁজে বের করার জন্য একটি সাধারণ অ্যালগরিদম হলো প্রতিটি সংখ্যাকে একে অপরের সাথে তুলনা করা। এই তুলনার প্রক্রিয়াটি হলো এক ধরনের গাণিতিক অপারেশন। ডেটা স্ট্রাকচার, যেমন- অ্যারে, লিঙ্কড লিস্ট, এবং ট্রি, ডেটাকে দক্ষতার সাথে সংগঠিত করতে সাহায্য করে। এই ডেটা স্ট্রাকচারগুলোর কার্যকারিতা এবং পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে গণিতের ধারণা, বিশেষ করে অ্যাসিম্পটোটিক অ্যানালাইসিস ব্যবহার করা হয়।

মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হলো মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই ক্ষেত্রগুলো পুরোপুরি গণিতের ওপর নির্ভরশীল। পরিসংখ্যান এবং সম্ভাব্যতা এখানে ডেটা বিশ্লেষণ এবং মডেল তৈরির জন্য অপরিহার্য। একটি মেশিন লার্নিং মডেল ডেটা থেকে প্যাটার্ন শিখতে বিভিন্ন গাণিতিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। ক্যালকুলাস মডেলের প্যারামিটারগুলো অপটিমাইজ করতে এবং ত্রুটি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। লিনিয়ার অ্যালজেব্রা নিউরাল নেটওয়ার্কের মতো জটিল মডেলের সাথে কাজ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউরাল নেটওয়ার্কের প্রতিটি স্তরকে একটি ম্যাট্রিক্স অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যা ইনপুট ডেটাকে প্রক্রিয়াজাত করে।

মহাকাশ বিজ্ঞান এবং গণিত : ব্রহ্মা-ের ভাষা

মহাকাশ বিজ্ঞান হলো গণিতের আরেকটি বড় ক্ষেত্র, যেখানে জটিল গণনা ছাড়া এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। গ্রহ, উপগ্রহ এবং মহাকাশযানের গতিবিধি বোঝার জন্য গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য।

ক্যালকুলাস এবং নিউটনীয় বলবিদ্যা : স্যার আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এবং গতিসূত্রের মাধ্যমে মহাকাশ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই সূত্রগুলো ক্যালকুলাস ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। গ্রহ, উপগ্রহ বা কোনো মহাকাশযানের গতিপথ গণনা করতে ক্যালকুলাস ব্যবহার করা হয়। একটি রকেটকে চাঁদে পাঠানোর জন্য, তার গতিবেগ, দিক এবং প্রয়োজনীয় জ্বালানির পরিমাণ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে গণনা করতে হয়, যা ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন ব্যবহার করে করা হয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ত্রিকোণমিতি : গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব এবং আকার পরিমাপ করতে ত্রিকোণমিতি এবং জ্যামিতি ব্যবহার করা হয়। প্যারালাক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে দূরবর্তী তারার দূরত্ব পরিমাপ করা হয়, যা ত্রিকোণমিতির একটি উন্নত ব্যবহার। এছাড়া মহাকাশে কোনো বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি ব্যবহার করা হয়।

অর্থনীতি এবং গণিত : বাজারের ভাষা বোঝা

অর্থনীতিতে গণিতের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল ব্যবসার হিসাব-নিকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জটিল অর্থনৈতিক মডেল তৈরি, বাজার বিশ্লেষণ, এবং পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য গণিতের বিভিন্ন শাখা ব্যবহার করা হয়।

ক্যালকুলাস এবং ম্যাক্রোইকোনমিক্স : ম্যাক্রোইকোনমিক্স হলো অর্থনীতির সেই শাখা যা একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে। এখানে জাতীয় আয়, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, ইত্যাদি বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এই চলকগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য ক্যালকুলাস ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি দেশের জিডিপি কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা বোঝার জন্য ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশন ব্যবহার করা হয়।

পরিসংখ্যান এবং ইকোনোমেট্রিক্স : পরিসংখ্যান অর্থনীতির ডেটা বিশ্লেষণ করার জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। ইকোনোমেট্রিক্স হলো অর্থনীতির এমন একটি শাখা যা পরিসংখ্যান এবং গণিত ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো পরিমাপ করে। যেমন- কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তার চাহিদা কতটা কমে, তা বোঝার জন্য রিগ্রেশন অ্যানালাইসিস ব্যবহার করা হয়, যা পরিসংখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ধরনের বিশ্লেষণ সরকারকে নীতি প্রণয়নে সাহায্য করে।

ফিন্যান্সিয়াল ম্যাথমেটিক্স : শেয়ারবাজার, বন্ড এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণগুলো বিশ্লেষণ করতে ফিন্যান্সিয়াল ম্যাথমেটিক্স ব্যবহার করা হয়। এখানে সম্ভাব্যতা, পরিসংখ্যান এবং ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশনের উন্নত ব্যবহার দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, অপশন প্রাইসিং মডেল, যেমন- ব্ল্যাক-স্কোলস মডেল, গাণিতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এই মডেলগুলো ভবিষ্যতের ঝুঁকির পূর্বাভাস দিতে এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

গণিত কেবল একটি তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এটি আধুনিক বিশ্বের চালিকাশক্তি। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো প্রতিটি আধুনিক ক্ষেত্রেই গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য। এটি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি যৌক্তিক কাঠামো সরবরাহ করে এবং জটিল ধারণাগুলোকে একটি সরল এবং কার্যকরী রূপ দেয়। গণিতের এই ব্যাপক ব্যবহারগুলোই প্রমাণ করে যে কেন এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। গণিতকে বাদ দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের এই অগ্রগতিগুলো কল্পনা করাও অসম্ভব। গণিত আমাদের চারপাশের জগতকে বোঝার এবং তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

[লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

প্রসঙ্গ : পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস

ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : রাজনৈতিক বিভেদের অমোচনীয় ক্ষত

ছবি

আলফ্রেড সরেন হত্যা : বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

কারাম উৎসব : বাংলার প্রাচীন কৃষি ও সংস্কৃতির ধারক

ছবি

আলাস্কা বৈঠক : শান্তির দেখা কি মিলল?

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কতদূর?

মবের উন্মাদনা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার

জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাগুলোই এগিয়ে দেয় জীবনকে

রাজনৈতিক কর্মসূচি, যানজট ও আচরণগত অর্থনীতি

সম্পদের অভিশাপ : সিলেটের সাদাপাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার জরুরি

ছবি

সাদাপাথরের নীলাভ দেশ : ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য ও সংকট

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমাজতত্ত্ব

বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির নতুন ভূরাজনীতি

মব ও জাস্টিস

ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এক জগাখিচুড়ি!

নারীর সমঅধিকার : সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি

জ্ঞানের মঞ্চ এখন সার্কাস, গবেষণা সেখানে নীরব দর্শক

ছবি

ভরা শ্রাবণে স্বদেশ-ভাবনা

নারীর প্রতি সহিংসতা : বাস্তবতা, আইন ও প্রতিরোধের জরুরি দিকনির্দেশনা

ছাত্র রাজনীতি : নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?

ছবি

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

ছবি

উন্নয়ন ও প্রকৃতি

ছবি

কৃষকের চেয়ে বড় উদ্যোক্তা আর কে আছে

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

সব অর্জনে কৃতিত্ব নিতে নেই

নাগাসাকি দিবস : পারমাণবিক বোমার অপপ্রয়োগ বন্ধ হোক

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

অদৃশ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই : উষ্ণ বাংলাদেশে জলবায়ু-প্রসূত স্বাস্থ্য সংকট

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

tab

opinion » post-editorial

গণিতের বহুমুখী ব্যবহার : আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি

সাদিয়া সুলতানা রিমি

বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫

গণিতকে প্রায়শই শুধুমাত্র একটি তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা কেবল কাগজে-কলমে জটিল সমীকরণ সমাধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি কোণে, বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, মহাকাশ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রগুলোতে গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য। এই ক্ষেত্রগুলো গণিতের বিভিন্ন শাখা, যেমন- ক্যালকুলাস, লিনিয়ার অ্যালজেব্রা, পরিসংখ্যান, এবং অ্যালগরিদম থিওরির ওপর নির্ভর করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং গণিত : এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক

কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মূল ভিত্তিই হলো গণিত। কম্পিউটার একটি বাইনারি (০ এবং ১) সিস্টেমে কাজ করে, যা সরাসরি বুলিয়ান অ্যালজেব্রার একটি বাস্তব রূপ। যেকোনো প্রোগ্রাম লেখার জন্য, প্রোগ্রামারকে সমস্যাটিকে এমনভাবে ভেঙে ফেলতে হয় যাতে তা গাণিতিক যুক্তি এবং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

অ্যালগরিদম এবং ডেটা স্ট্রাকচার : একটি অ্যালগরিদম হলো কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ধাপে ধাপে নির্দেশিকার একটি সেট। এই অ্যালগরিদমগুলো গাণিতিক যুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। যেমন- একটি অ্যারেতে সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি খুঁজে বের করার জন্য একটি সাধারণ অ্যালগরিদম হলো প্রতিটি সংখ্যাকে একে অপরের সাথে তুলনা করা। এই তুলনার প্রক্রিয়াটি হলো এক ধরনের গাণিতিক অপারেশন। ডেটা স্ট্রাকচার, যেমন- অ্যারে, লিঙ্কড লিস্ট, এবং ট্রি, ডেটাকে দক্ষতার সাথে সংগঠিত করতে সাহায্য করে। এই ডেটা স্ট্রাকচারগুলোর কার্যকারিতা এবং পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে গণিতের ধারণা, বিশেষ করে অ্যাসিম্পটোটিক অ্যানালাইসিস ব্যবহার করা হয়।

মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হলো মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই ক্ষেত্রগুলো পুরোপুরি গণিতের ওপর নির্ভরশীল। পরিসংখ্যান এবং সম্ভাব্যতা এখানে ডেটা বিশ্লেষণ এবং মডেল তৈরির জন্য অপরিহার্য। একটি মেশিন লার্নিং মডেল ডেটা থেকে প্যাটার্ন শিখতে বিভিন্ন গাণিতিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। ক্যালকুলাস মডেলের প্যারামিটারগুলো অপটিমাইজ করতে এবং ত্রুটি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। লিনিয়ার অ্যালজেব্রা নিউরাল নেটওয়ার্কের মতো জটিল মডেলের সাথে কাজ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউরাল নেটওয়ার্কের প্রতিটি স্তরকে একটি ম্যাট্রিক্স অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যা ইনপুট ডেটাকে প্রক্রিয়াজাত করে।

মহাকাশ বিজ্ঞান এবং গণিত : ব্রহ্মা-ের ভাষা

মহাকাশ বিজ্ঞান হলো গণিতের আরেকটি বড় ক্ষেত্র, যেখানে জটিল গণনা ছাড়া এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। গ্রহ, উপগ্রহ এবং মহাকাশযানের গতিবিধি বোঝার জন্য গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য।

ক্যালকুলাস এবং নিউটনীয় বলবিদ্যা : স্যার আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এবং গতিসূত্রের মাধ্যমে মহাকাশ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই সূত্রগুলো ক্যালকুলাস ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। গ্রহ, উপগ্রহ বা কোনো মহাকাশযানের গতিপথ গণনা করতে ক্যালকুলাস ব্যবহার করা হয়। একটি রকেটকে চাঁদে পাঠানোর জন্য, তার গতিবেগ, দিক এবং প্রয়োজনীয় জ্বালানির পরিমাণ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে গণনা করতে হয়, যা ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন ব্যবহার করে করা হয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ত্রিকোণমিতি : গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব এবং আকার পরিমাপ করতে ত্রিকোণমিতি এবং জ্যামিতি ব্যবহার করা হয়। প্যারালাক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে দূরবর্তী তারার দূরত্ব পরিমাপ করা হয়, যা ত্রিকোণমিতির একটি উন্নত ব্যবহার। এছাড়া মহাকাশে কোনো বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি ব্যবহার করা হয়।

অর্থনীতি এবং গণিত : বাজারের ভাষা বোঝা

অর্থনীতিতে গণিতের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল ব্যবসার হিসাব-নিকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জটিল অর্থনৈতিক মডেল তৈরি, বাজার বিশ্লেষণ, এবং পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য গণিতের বিভিন্ন শাখা ব্যবহার করা হয়।

ক্যালকুলাস এবং ম্যাক্রোইকোনমিক্স : ম্যাক্রোইকোনমিক্স হলো অর্থনীতির সেই শাখা যা একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে। এখানে জাতীয় আয়, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, ইত্যাদি বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এই চলকগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য ক্যালকুলাস ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি দেশের জিডিপি কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা বোঝার জন্য ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশন ব্যবহার করা হয়।

পরিসংখ্যান এবং ইকোনোমেট্রিক্স : পরিসংখ্যান অর্থনীতির ডেটা বিশ্লেষণ করার জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। ইকোনোমেট্রিক্স হলো অর্থনীতির এমন একটি শাখা যা পরিসংখ্যান এবং গণিত ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো পরিমাপ করে। যেমন- কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তার চাহিদা কতটা কমে, তা বোঝার জন্য রিগ্রেশন অ্যানালাইসিস ব্যবহার করা হয়, যা পরিসংখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ধরনের বিশ্লেষণ সরকারকে নীতি প্রণয়নে সাহায্য করে।

ফিন্যান্সিয়াল ম্যাথমেটিক্স : শেয়ারবাজার, বন্ড এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণগুলো বিশ্লেষণ করতে ফিন্যান্সিয়াল ম্যাথমেটিক্স ব্যবহার করা হয়। এখানে সম্ভাব্যতা, পরিসংখ্যান এবং ডিফারেনসিয়াল ইকুয়েশনের উন্নত ব্যবহার দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, অপশন প্রাইসিং মডেল, যেমন- ব্ল্যাক-স্কোলস মডেল, গাণিতিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এই মডেলগুলো ভবিষ্যতের ঝুঁকির পূর্বাভাস দিতে এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

গণিত কেবল একটি তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এটি আধুনিক বিশ্বের চালিকাশক্তি। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো প্রতিটি আধুনিক ক্ষেত্রেই গণিতের ব্যবহার অপরিহার্য। এটি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি যৌক্তিক কাঠামো সরবরাহ করে এবং জটিল ধারণাগুলোকে একটি সরল এবং কার্যকরী রূপ দেয়। গণিতের এই ব্যাপক ব্যবহারগুলোই প্রমাণ করে যে কেন এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। গণিতকে বাদ দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের এই অগ্রগতিগুলো কল্পনা করাও অসম্ভব। গণিত আমাদের চারপাশের জগতকে বোঝার এবং তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

[লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top