alt

উপ-সম্পাদকীয়

মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

: রোববার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১

যে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে ব্যবহার করে কোন একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত হতে পারে তাই কারিগরি শিক্ষা। এসব শিক্ষা ব্যবস্থায় তত্ত্বীয় পড়াশুনার চেয়ে ব্যবহারিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছোট এই ভূখন্ডে বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে নবরূপে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই এটা সবার ভাবনা। সাধারণ শিক্ষা মানুষকে যেমন নির্দিষ্ট কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখে তার বিপরীতে কারিগরি শিক্ষা কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে খুব কম সময়ের মধ্যেই মানুষ পেশা জগতে সম্পৃক্ত হতে পারে এবং যার ফলে মানুষ জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে সক্ষম হয় এবং উপার্জনের সক্ষমতা অর্জন করে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষাকে মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করেছে এবং কলেজ পর্যায়ে কারিগরি ট্রেড খোলার জন্য সরকারের নির্দেশনা রয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। বাজেটে বরাদ্ধ বৃদ্ধিসহ কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মুজিবর্ষে এসব কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে সরকার।

এ কারণে একদিকে যেমন ঝড়ে পড়া হ্রাস পাচ্ছে অন্যদিকে কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করে কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হচ্ছে। ব্যানবেইসের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৩৫টি। এরমধ্যে সরকারি ৮৬৬টি ও বেসরকারি ৫ হাজার ৯৯৯টি। শিক্ষার্থী ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ জন। এতে যুক্ত করা হয়েছে ৬ মাস মেয়াদি বিভিন্ন শর্ট কোর্স। এ কোর্সের আওতাধীন ২ হাজার ৬০০টি ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব কোর্স পরিচালনা হচ্ছে তা থেকে কতটুকু কারিগরি জ্ঞান অর্জন করতে পারছে শিক্ষার্থীরা তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে যায়। কাগজপত্রে এসব প্রতিষ্ঠান মান অর্জন করলেও বাস্তবে বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠানই মান অর্জন করতে পারেনি। প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে দক্ষ শিক্ষকের সংকট। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি শিক্ষকের সংখ্যা।

অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দেওয়ায় দিন দিন তৈরি হচ্ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। সাধারণ শিক্ষায় পড়াশুনা করা শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছোট এ জনসংখ্যাবহুল দেশে কখনও সম্ভব নয়। এছাড়াও বৈশ্বিক চাহিদার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষা অনেকটাই প্রতিযোগিতাহীন। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থী কেবল চাকুরির নেশায় ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ছে। তরুণরা হয়ে পড়ছে বিপথগামী। এতে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। পৃথিবীতে যত দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমবৃদ্ধি অর্জন করেছে তার বেশির ভাগই অর্জিত হয়েছে কারিগরি শিক্ষার ফলের মাধ্যমে।

শিল্পের দিকে যত ধাবিত হবে দেশ ততই প্রয়োজন হবে কারিগরি শিক্ষা। পৃথিবীর সব দেশেই কারিগরি শিক্ষায় যে শ্রমিক যত বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে তার সুফলও তত বেশি হয়েছে। আমাদের দেশ থেকে যেসব মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে তারাও বিদেশে গিয়ে খুব একটা আয় রোজগারের পথ খুঁজে পাচ্ছে না বলেই জানা যায়। দেশে-বিদেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জনবলকাঠমো গড়ে তুলতে পারছিনা।

প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে এ কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে বা সফলতার মুখ দেখছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কারিগরি শিক্ষাটাও সার্টিফিকেট সর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠছে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান বেশি হলে সুফল পাবে শিক্ষার্থীরা একথা সত্য। তবে এসব প্রতিষ্ঠান হতে হবে মানসম্মত। মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনবে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

কীভাবে চলছে কে চালাচ্ছে সেগুলো শুধুই কাগজপত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছয় মাসের কম্পিউটার কোর্স করা শিক্ষার্থীরা কিংবা দুই বছরের বিএম কোর্স করা শিক্ষার্থীরা কোন দিন কম্পিউটার অনই করেনি কিন্তু ফলাফল এ প্লাস। কী বিচিত্র বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে? প্রশ্ন হলো এসব কেন হচ্ছে? যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা, পরিদর্শনের দুর্বলতা, একটিমাত্র বোর্ডের ওপর এতসব কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব, বোর্ডের জনবল কম থাকা, সিলেবাসগত জটিলতা, পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি মূলত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক ফল না পাওয়ার কারণ।

২০০৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রথম ও দ্বিতীয় পালায় পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিন্তু প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে শিক্ষক সংকট। তাহলে প্রশ্ন হলো আসন বৃদ্ধি করে আমরা কেমন শিক্ষা দিতে যাচ্ছি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় উন্নত দেশগুলো অনেক এগিয়ে গেছে। সেই তুলনায় বলা যায়, বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে বহু দিক থেকে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং মানসম্মত কারিগিরি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হলে একটি সঠিক নীতিমালা প্রয়োজন। যখন তখন এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নীতি পরিবর্তনের ফলে তৈরি হচ্ছে হ-য-ব-র-ল পদ্ধতি।

চলতি বছরে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা; যা বিগত বছরের তুলনায় ৮৮৪ কোটি টাকা বেশি। বিভিন্ন সময় সুশীল সমাজ এবং শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাকে একটি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়েছে; যার ফলে এ শিক্ষায় গুরুত্ব কম পাচ্ছে এ কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আর বাজেটের যে অর্থ থাকে তার বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণে; যার ফলে শিক্ষার মান উন্নয়নে এত অল্প বাজেট কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

শিক্ষার মান বাড়াতে বাজেট বরাদ্দ যেমনি বৃদ্ধি করতে হবে তেমনি এ বাজেট যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা। সরকারের উচিত কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে আগ্রহী করে তোলা। না হলে বাজেট যতই বৃদ্ধি করা হোক না কেন তা কোন কাজে আসবে না।

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা হলেও বিভন্ন কারণে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগামীর পৃথিবী হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবর্তনমুখী। তাই দেশকে সাজাতে হলে এবং পৃথিবীর সাথে টিকে থাকতে হলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে করতে সময় উপযোগী। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে যে পরিমাণ দক্ষ জনবল প্রয়োজন তা আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না; তাই এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যে, হাতেকলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবন পরিবর্তন ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবো। আর এ কারিগরি শিক্ষা ২০৪১ সালের উন্নত রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যেতে পারে।

[লেখক : প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও

বাণিজ্যিক কলেজ]

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

রোববার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২১

যে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে ব্যবহার করে কোন একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত হতে পারে তাই কারিগরি শিক্ষা। এসব শিক্ষা ব্যবস্থায় তত্ত্বীয় পড়াশুনার চেয়ে ব্যবহারিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছোট এই ভূখন্ডে বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে নবরূপে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই এটা সবার ভাবনা। সাধারণ শিক্ষা মানুষকে যেমন নির্দিষ্ট কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখে তার বিপরীতে কারিগরি শিক্ষা কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে খুব কম সময়ের মধ্যেই মানুষ পেশা জগতে সম্পৃক্ত হতে পারে এবং যার ফলে মানুষ জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে সক্ষম হয় এবং উপার্জনের সক্ষমতা অর্জন করে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষাকে মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করেছে এবং কলেজ পর্যায়ে কারিগরি ট্রেড খোলার জন্য সরকারের নির্দেশনা রয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। বাজেটে বরাদ্ধ বৃদ্ধিসহ কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মুজিবর্ষে এসব কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে সরকার।

এ কারণে একদিকে যেমন ঝড়ে পড়া হ্রাস পাচ্ছে অন্যদিকে কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করে কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হচ্ছে। ব্যানবেইসের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৩৫টি। এরমধ্যে সরকারি ৮৬৬টি ও বেসরকারি ৫ হাজার ৯৯৯টি। শিক্ষার্থী ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ জন। এতে যুক্ত করা হয়েছে ৬ মাস মেয়াদি বিভিন্ন শর্ট কোর্স। এ কোর্সের আওতাধীন ২ হাজার ৬০০টি ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব কোর্স পরিচালনা হচ্ছে তা থেকে কতটুকু কারিগরি জ্ঞান অর্জন করতে পারছে শিক্ষার্থীরা তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে যায়। কাগজপত্রে এসব প্রতিষ্ঠান মান অর্জন করলেও বাস্তবে বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠানই মান অর্জন করতে পারেনি। প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে দক্ষ শিক্ষকের সংকট। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি শিক্ষকের সংখ্যা।

অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দেওয়ায় দিন দিন তৈরি হচ্ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। সাধারণ শিক্ষায় পড়াশুনা করা শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছোট এ জনসংখ্যাবহুল দেশে কখনও সম্ভব নয়। এছাড়াও বৈশ্বিক চাহিদার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষা অনেকটাই প্রতিযোগিতাহীন। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থী কেবল চাকুরির নেশায় ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ছে। তরুণরা হয়ে পড়ছে বিপথগামী। এতে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। পৃথিবীতে যত দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমবৃদ্ধি অর্জন করেছে তার বেশির ভাগই অর্জিত হয়েছে কারিগরি শিক্ষার ফলের মাধ্যমে।

শিল্পের দিকে যত ধাবিত হবে দেশ ততই প্রয়োজন হবে কারিগরি শিক্ষা। পৃথিবীর সব দেশেই কারিগরি শিক্ষায় যে শ্রমিক যত বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে তার সুফলও তত বেশি হয়েছে। আমাদের দেশ থেকে যেসব মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে তারাও বিদেশে গিয়ে খুব একটা আয় রোজগারের পথ খুঁজে পাচ্ছে না বলেই জানা যায়। দেশে-বিদেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জনবলকাঠমো গড়ে তুলতে পারছিনা।

প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে এ কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে বা সফলতার মুখ দেখছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কারিগরি শিক্ষাটাও সার্টিফিকেট সর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠছে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান বেশি হলে সুফল পাবে শিক্ষার্থীরা একথা সত্য। তবে এসব প্রতিষ্ঠান হতে হবে মানসম্মত। মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনবে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

কীভাবে চলছে কে চালাচ্ছে সেগুলো শুধুই কাগজপত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছয় মাসের কম্পিউটার কোর্স করা শিক্ষার্থীরা কিংবা দুই বছরের বিএম কোর্স করা শিক্ষার্থীরা কোন দিন কম্পিউটার অনই করেনি কিন্তু ফলাফল এ প্লাস। কী বিচিত্র বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে? প্রশ্ন হলো এসব কেন হচ্ছে? যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা, পরিদর্শনের দুর্বলতা, একটিমাত্র বোর্ডের ওপর এতসব কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব, বোর্ডের জনবল কম থাকা, সিলেবাসগত জটিলতা, পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি মূলত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক ফল না পাওয়ার কারণ।

২০০৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রথম ও দ্বিতীয় পালায় পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিন্তু প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে শিক্ষক সংকট। তাহলে প্রশ্ন হলো আসন বৃদ্ধি করে আমরা কেমন শিক্ষা দিতে যাচ্ছি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় উন্নত দেশগুলো অনেক এগিয়ে গেছে। সেই তুলনায় বলা যায়, বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে বহু দিক থেকে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং মানসম্মত কারিগিরি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হলে একটি সঠিক নীতিমালা প্রয়োজন। যখন তখন এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নীতি পরিবর্তনের ফলে তৈরি হচ্ছে হ-য-ব-র-ল পদ্ধতি।

চলতি বছরে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা; যা বিগত বছরের তুলনায় ৮৮৪ কোটি টাকা বেশি। বিভিন্ন সময় সুশীল সমাজ এবং শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাকে একটি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়েছে; যার ফলে এ শিক্ষায় গুরুত্ব কম পাচ্ছে এ কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আর বাজেটের যে অর্থ থাকে তার বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণে; যার ফলে শিক্ষার মান উন্নয়নে এত অল্প বাজেট কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

শিক্ষার মান বাড়াতে বাজেট বরাদ্দ যেমনি বৃদ্ধি করতে হবে তেমনি এ বাজেট যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো দক্ষ জনবল কাঠামো গড়ে তোলা। সরকারের উচিত কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে আগ্রহী করে তোলা। না হলে বাজেট যতই বৃদ্ধি করা হোক না কেন তা কোন কাজে আসবে না।

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা হলেও বিভন্ন কারণে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগামীর পৃথিবী হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবর্তনমুখী। তাই দেশকে সাজাতে হলে এবং পৃথিবীর সাথে টিকে থাকতে হলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে করতে সময় উপযোগী। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে যে পরিমাণ দক্ষ জনবল প্রয়োজন তা আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না; তাই এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যে, হাতেকলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবন পরিবর্তন ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবো। আর এ কারিগরি শিক্ষা ২০৪১ সালের উন্নত রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যেতে পারে।

[লেখক : প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও

বাণিজ্যিক কলেজ]

back to top