alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের তারুণ্য : দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনা ও শঙ্কার ক্রসরোডে

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

: বৃহস্পতিবার, ০১ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশের তারুণ্য এক অসামান্য ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। আমাদের তরুণরা মায়ের ভাষাকে রক্ষা করেছে বিজাতীয় শোষকদের হাত থেকে। এই ঘটনায় সারা বিশ্বে তরুণ ভাষা শহীদরা অমর। শিক্ষাকে রক্ষা করেছে এই তরুণরা ষাটের দশকে বাষট্টির শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে। সিয়াটো-সেন্টো চুক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ৬৯’র জানুয়ারিতে তরুণ আসাদ শহীদ হয়ে যে গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটিয়েছিলেন, তা ভাসিয়ে দিয়েছিল সামরিক-সিভিল স্বৈরাচারকে। তৈরি হয়ে গিয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তারুণ্যের জয়-জয়কার, অস্ত্র হাতে এই তারুণ্যই নয় মাস যুদ্ধ করেছে প্রবল প্রতিপক্ষ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে-স্বাধীন করেছে দেশ।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত টগবগে তারুণ্যের বিপথগামীতা ও অধঃপাতে যাত্রাটি শুরু হয় স্বাধীনতার পর থেকেই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারত প্রত্যাগত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার মুক্তিযুদ্ধের মূলগত চেতনা উপলব্দিতে সফল হয়েছিলেন- এ নিয়ে আলোচনা বিস্তর। তারা অনেক কিছুই বিবেচনা করছিলেন দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার চেষ্টা ও ব্যক্তিকে সর্বোত্তম করে তোলার প্রচেষ্টায় ক্ষমতাসীনরা জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চেতনা হিসেবে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছিলেন বটে, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ ছিল বিপরীত। অচিরেই মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকার একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের মূলগত আকাক্সক্ষায় কুঠারাঘাত হানে এবং রাষ্ট্রকে সামরিকীকরনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন অনুসন্ধানী রিপোর্টার জ্যাক এন্ডারসন ১৯৭৩ সালে এন্ডারসন পেপার নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন, যাতে ৭১’র যুদ্ধ ছাড়াও তৎকালীন বিশ্বের বিভিন্ন ফ্রন্টে নিক্সন প্রশাসনের গোপন কার্যক্রম বিধৃত হয়েছিল। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিক্সন-কিসিঞ্জার ‘অীরং ড়ভ ঊারষ’-এর পরাজয়ের পূর্বাভাসে ওয়াশিংটন মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই পরাজয়ের বিপক্ষে একটি কন্টিজেনসি প্ল্যান এবং প্রতিশোধের পথ খুঁজতে বাংলাদেশে তাদের পরবর্তী পলিসি এবং সে সময়ের স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন স্বার্থ অব্যাহত রাখতে যুদ্ধকালেই কিসিঞ্জার ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সূচনা করেন।

পেপারে উল্লেখ করা হয়, ‘নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে একটি দুষ্ট নক্ষত্রের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন, যে রকম অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক গংদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের যোগাযোগ-যড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কিসিঞ্জারের জন্য এই গোপন বিকল্প ছাড়া উপায় ছিল না। দুরদর্শী কিসিঞ্জার অনুধাবন করতে সক্ষম ছিলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি শক্তিশালী ও অঙ্গীকারাবদ্ধ তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি করছে, যা ধ্বংস করা না গেলে দেশটি ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং উপমহাদেশে এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরিস্থিতি মেনে নেয়ার জন্য সত্তরের ক্রান্তিকালে মার্কিনারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না।’

যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার পরে অদৃশ্য যুদ্ধের কৌশল এই বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলবে, যেটি প্রতিরোধের কৌশল তরুণ প্রজন্মের যোদ্ধাদের বা জাতীয় নেতৃবৃন্দের ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পরে বিশ্বের অন্যান্য ফ্রন্টের মতো কিসিঞ্জার এখানকার পরিকল্পনা অনুযায়ী অদম্য যুবশক্তির মধ্যে অপশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরই বিভিন্ন ফর্ম বা রূপের একটি আমরা দেখেছি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে একটি দলের আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকাশের ধরন ও পন্থা থেকে শুরু করে এই দলের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে এ রুঢ় বাস্তবতার প্রমাণ মিলবে। দলটির মূলধারার নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের সিংহভাগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে শতভাগ সততা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলাকালে বা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু পরে নেতৃত্বের একজন বিশেষ ব্যক্তি, যিনি দলকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, তার সঙ্গে কিসিঞ্জার নেটওয়র্কের একটি ডিল হয়েছিল বলে।

যে তরুণ চল্লিশের শেষে ও পঞ্চাশ দশকে ভাষা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, ষাট দশকজুড়ে লড়াই করেছে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকেছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, যাদের কাছে রাজনীতি ছিল আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে অকাতরে, বর্তমান উৎসর্গ করেছে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য-স্বাধীন দেশে সেই তারুণ্যই জড়িয়ে পড়ে অস্ত্র, খুনোখুনি ও নষ্টামির সঙ্গে। এর মূল কারণ ছিল স্বপ্নভঙ্গ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। সেজন্যই পরবর্তীকালে তারা ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক নষ্টামিসহ সব অনৈতিক কর্মকা-ে। তারপরেও আশির দশকে এই তারণ্যই সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নব্বই সালে আরেকটি মাইলফলক স্থাপন করেছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার আকাক্সক্ষায় পুনর্বার বলি হতে হয় তারুণ্যকে।

‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামক তরুণদের শাহবাগকেন্দ্রিক একটি সমাবেশ ক্রমশ: হুমকি হয়ে উঠছিল। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সমবেত কিছু তরুণ ব্লগার সম্ভবত: শুরুতে বুঝতে পারেনি, তাদের দাবি তো বটেই, এরসঙ্গে সবরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণ সমবেত হতে থাকবে। শাহবাগের দৃশ্যপট প্রতিদিন পাল্টাচ্ছিল। গণজাগরণ মঞ্চ হয়ে উঠছিল আগুনে প্রতিবাদের মঞ্চ। ঠিক তখনই মঞ্চের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় রাজনৈতিক কূটচাল ও বিভাজন। এভাবেই অমিত তেজ ও সম্ভাবনায় দীপ্ত গণজাগরণ মঞ্চ রাজনৈতিক কূটিলতায় খাবি খেতে খেতে এখন প্রায় বিলীন।

২০২১ সালে এসে জনসংখ্যার কাঠামোগত জায়গায় বাংলাদেশ এগিয়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে, অনেক দেশকে পেছনে ফেলে। এই দেশের জনসংখ্যার ৪৫% এখন তরুণ। এদের বয়স ১০ থেকে ২৪ বছর। তরুণ কর্মযোগীদের সংখ্যাটিও চমকে দেবার মত, ৪ কোটি ৭৬ লাখ। জাতিসংঘ জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১৪ জানাচ্ছে, তরুণদের সংখ্যাপুষ্ট দেশ আছে মাত্র ৬টি। ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। তরুণ জনগোষ্ঠীর মানে যদি হয় কর্মশক্তি তাহলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সুস্থিত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় এই অপার সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের মতো বিপদগামী হবার আলামতগুলো কি দেখতে পান আমাদের শাসকরা, নীতি-নির্ধারকরা?

রাজনীতিবিদ, শাসকশ্রেণী এবং নীতি-নির্ধারকরা কি ভাবছেন অপার সম্ভাবনাময় এই তারুণ্যকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে? আমাদের জানা নেই। প্রতি বছর মেধাক্ষী শিক্ষার্থীরা পাড়ি দিচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্যে। গড়ে উঠছে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে। উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মেধার জোরে চমকিত করছে। মিডিওকার তরুণরা দেশের সীমানা ছাড়াচ্ছে, অমানবিক পরিশ্রমে দেশের রোমিট্যান্স বাড়াচ্ছে। বড় অবদান রাখছে জাতীয় রিজার্ভে। গণতন্ত্রহীন দেশে রাজনীতিবিমুখতা থাকলেও প্রবাসে দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। হুজুগে মাতছে নাকি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রবাসী আকাক্সক্ষা স্বপ্ন দেখছে, তা কি তারা নিজেরাও জানেন! এটি যদি হয় সম্ভাবনার দিক, অন্যপথে হাজার হাজার তরুণ যুক্ত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে।

লাখ লাখ তরুণ মাদককে বেছে নিচ্ছে জীবনযাপনের একমাত্র পথ হিসেবে। মানব পাচারকারীদের কবলে পড়ে বেপথু তরুণ ভাসছে সাগরে, ঠাঁই হয়েছে গণকবরে, কঙ্কালসার একদল ঘুরে মরছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার গভীর অরণ্যে। প্রতিপক্ষকে বিনাশ করতে রাজনীতিবিদরা তরুণদের হাতে তুলে দিচ্ছে প্রাণঘাতী অস্ত্র। কর্তৃত্ববাদিতা ও শক্তি প্রয়োগের শাসন জন্ম দিচ্ছে একরৈখিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। মত প্রকাশে বাধা, স্বৈরশাসন উসকে দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। তারুণ্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে বিনাশী যাত্রায়।

কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে? একদিকে সম্ভাবনা অপার, অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে বদলাচ্ছে রাজনীতির ভাষা। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে চলছে তারুণ্য বিনাশের হোলি উৎসব! ইসলামিক স্টেট, বোকো হারাম, আল-কায়দা, তালেবানের মতো বহুজাতিক গোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে জেএমবি, হুজি, হিজবুত তাহেরি, অনসারুল্লাহ্ বাংলাটিম, আল্লাহ্র দলসহ অনেকগুলো নিষিদ্ধ সংগঠন জানা আরও অনেক গোষ্ঠী। এদের সবার টার্গেট তরুণ ও কিশোররা।

বাংলাদেশ এখন নানা ফর্মে সন্ত্রাসবাদের কবলে। এর চেহারায় ধরনে রকমের আছে। কখনও ধর্মীয় চরমপন্থার নামে, সমাজ বদলের নামে, কখনও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-অনাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মাথাচাড়া দিচ্ছে সন্ত্রাস। আবার ক্ষমতাসীনদের মদতপুষ্ট গডফাদাররা স্রেফ আর্থিক সাম্রাজ্য ও এলাকা দখলে রাখতে গড়ে তুলছে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এইসব বাহিনী পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের। এদের সবার টার্গেট তরুণ জনগোষ্ঠী। এসব প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসবাদে যুক্ত হচ্ছে তরুণরা। আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক অন্যায্যতা-অবিচারের বিরুদ্ধে তারা সন্ত্রাসবাদকে শ্রেয়তর মনে করছে। এই তরুণদের বড় একটি অংশ আসছে দারিদ্র্যর মধ্যে বেড়ে ওঠা সামাজিক পরিবেশ থেকে। কারও আগমন ঘটছে স্বচ্ছল-শিক্ষিত পরিবার থেকে। রাজনীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদ এদর সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহী করে তুলছে।

স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরেই বাংলাদেশের তারুণ্য হয়ে পড়েছিল হতাশাগ্রস্ত ও বিপথগামী। প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির বৈপরীত্য এবং সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে দেশ গঠনে কোন ভূমিকা না থাকায় তারা হতাশার গহবরে নিমজ্জিত হয়। ফলে অচিরেই তারা জড়িয়ে পড়েছিল হাইজ্যাক, ডাকাতি, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসসহ নানা বিনাশি কর্মকা-ে। রাজনৈতিক দলের অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে তরুণরা ব্যবহৃত হচ্ছিল প্রতিপক্ষ বিনাশে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছিল অকাতরে। ৭২ ও ৭৩ সালে অনেক তরুণ হাইজ্যাকার সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল উন্মত্ত জনতার প্রতিহিংসায়। পরবর্তীকালে সামরিক সরকারগুলো তরুণদের নষ্ট-ভ্রষ্ট সময়ের হাত ধরিয়ে দেয়। আশির দশকে সন্ত্রাসী হিসেবে তারকা খ্যাতি অর্জন করা অভি-নীরুর মতো মেধাবী তরুণরা হারিয়ে যায় নষ্ট সময়ের হাত ধরে।

তরুণ জনগোষ্ঠীর মানে যদি হয় কর্মশক্তি তাহলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সুস্থিত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় এই অপার সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের মতো বিপদগামী হওয়ার আলামতগুলো কি দেখতে পান আমাদের শাসকরা, নীতি-নির্ধারকরা?

চলতি শতকের দু’দশক পার হওয়ার পরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে? ‘অল্প-স্বল্প গণতন্ত্র, সুশাসনহীনতা বিশেষত: আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিসহ নির্বাচন ব্যবস্থার একমুখীনতা গড়ে উঠেছে। দশকের পর দশক ব্যক্তির ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টি কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এর অনিবার্যতায় ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বিস্তৃত হচ্ছে এবং তরুণরা যুক্ত হয়ে পড়ছে। এই সন্ত্রাস ভৌগলিক সীমানা ছাড়াচ্ছে। অর্থনীতিতে সৃষ্ট চাপ উদ্বুদ্ধ করছে চরমপন্থায় এবং রাষ্ট্র সেদিকেই যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ থেকে সৃষ্ট ভয়ের সংস্কৃতি স্থায়ীকরণে নাকি ভয় তাড়াতে রাষ্ট্র এই প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে? যাই ঘটুক, এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর, দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনা ও শঙ্কার ক্রসরোডে?

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্র্মী]

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের তারুণ্য : দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনা ও শঙ্কার ক্রসরোডে

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

বৃহস্পতিবার, ০১ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশের তারুণ্য এক অসামান্য ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। আমাদের তরুণরা মায়ের ভাষাকে রক্ষা করেছে বিজাতীয় শোষকদের হাত থেকে। এই ঘটনায় সারা বিশ্বে তরুণ ভাষা শহীদরা অমর। শিক্ষাকে রক্ষা করেছে এই তরুণরা ষাটের দশকে বাষট্টির শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে। সিয়াটো-সেন্টো চুক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ৬৯’র জানুয়ারিতে তরুণ আসাদ শহীদ হয়ে যে গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটিয়েছিলেন, তা ভাসিয়ে দিয়েছিল সামরিক-সিভিল স্বৈরাচারকে। তৈরি হয়ে গিয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তারুণ্যের জয়-জয়কার, অস্ত্র হাতে এই তারুণ্যই নয় মাস যুদ্ধ করেছে প্রবল প্রতিপক্ষ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে-স্বাধীন করেছে দেশ।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত টগবগে তারুণ্যের বিপথগামীতা ও অধঃপাতে যাত্রাটি শুরু হয় স্বাধীনতার পর থেকেই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারত প্রত্যাগত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার মুক্তিযুদ্ধের মূলগত চেতনা উপলব্দিতে সফল হয়েছিলেন- এ নিয়ে আলোচনা বিস্তর। তারা অনেক কিছুই বিবেচনা করছিলেন দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার চেষ্টা ও ব্যক্তিকে সর্বোত্তম করে তোলার প্রচেষ্টায় ক্ষমতাসীনরা জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চেতনা হিসেবে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছিলেন বটে, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ ছিল বিপরীত। অচিরেই মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকার একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের মূলগত আকাক্সক্ষায় কুঠারাঘাত হানে এবং রাষ্ট্রকে সামরিকীকরনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন অনুসন্ধানী রিপোর্টার জ্যাক এন্ডারসন ১৯৭৩ সালে এন্ডারসন পেপার নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন, যাতে ৭১’র যুদ্ধ ছাড়াও তৎকালীন বিশ্বের বিভিন্ন ফ্রন্টে নিক্সন প্রশাসনের গোপন কার্যক্রম বিধৃত হয়েছিল। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিক্সন-কিসিঞ্জার ‘অীরং ড়ভ ঊারষ’-এর পরাজয়ের পূর্বাভাসে ওয়াশিংটন মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই পরাজয়ের বিপক্ষে একটি কন্টিজেনসি প্ল্যান এবং প্রতিশোধের পথ খুঁজতে বাংলাদেশে তাদের পরবর্তী পলিসি এবং সে সময়ের স্নায়ুযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন স্বার্থ অব্যাহত রাখতে যুদ্ধকালেই কিসিঞ্জার ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সূচনা করেন।

পেপারে উল্লেখ করা হয়, ‘নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে একটি দুষ্ট নক্ষত্রের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন, যে রকম অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক গংদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের যোগাযোগ-যড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কিসিঞ্জারের জন্য এই গোপন বিকল্প ছাড়া উপায় ছিল না। দুরদর্শী কিসিঞ্জার অনুধাবন করতে সক্ষম ছিলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি শক্তিশালী ও অঙ্গীকারাবদ্ধ তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি করছে, যা ধ্বংস করা না গেলে দেশটি ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং উপমহাদেশে এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরিস্থিতি মেনে নেয়ার জন্য সত্তরের ক্রান্তিকালে মার্কিনারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না।’

যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার পরে অদৃশ্য যুদ্ধের কৌশল এই বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলবে, যেটি প্রতিরোধের কৌশল তরুণ প্রজন্মের যোদ্ধাদের বা জাতীয় নেতৃবৃন্দের ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পরে বিশ্বের অন্যান্য ফ্রন্টের মতো কিসিঞ্জার এখানকার পরিকল্পনা অনুযায়ী অদম্য যুবশক্তির মধ্যে অপশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরই বিভিন্ন ফর্ম বা রূপের একটি আমরা দেখেছি, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে একটি দলের আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকাশের ধরন ও পন্থা থেকে শুরু করে এই দলের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে এ রুঢ় বাস্তবতার প্রমাণ মিলবে। দলটির মূলধারার নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের সিংহভাগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে শতভাগ সততা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলাকালে বা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু পরে নেতৃত্বের একজন বিশেষ ব্যক্তি, যিনি দলকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, তার সঙ্গে কিসিঞ্জার নেটওয়র্কের একটি ডিল হয়েছিল বলে।

যে তরুণ চল্লিশের শেষে ও পঞ্চাশ দশকে ভাষা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, ষাট দশকজুড়ে লড়াই করেছে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, অঙ্গীকারাবদ্ধ থেকেছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, যাদের কাছে রাজনীতি ছিল আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে অকাতরে, বর্তমান উৎসর্গ করেছে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য-স্বাধীন দেশে সেই তারুণ্যই জড়িয়ে পড়ে অস্ত্র, খুনোখুনি ও নষ্টামির সঙ্গে। এর মূল কারণ ছিল স্বপ্নভঙ্গ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। সেজন্যই পরবর্তীকালে তারা ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক নষ্টামিসহ সব অনৈতিক কর্মকা-ে। তারপরেও আশির দশকে এই তারণ্যই সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নব্বই সালে আরেকটি মাইলফলক স্থাপন করেছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার আকাক্সক্ষায় পুনর্বার বলি হতে হয় তারুণ্যকে।

‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামক তরুণদের শাহবাগকেন্দ্রিক একটি সমাবেশ ক্রমশ: হুমকি হয়ে উঠছিল। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সমবেত কিছু তরুণ ব্লগার সম্ভবত: শুরুতে বুঝতে পারেনি, তাদের দাবি তো বটেই, এরসঙ্গে সবরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণ সমবেত হতে থাকবে। শাহবাগের দৃশ্যপট প্রতিদিন পাল্টাচ্ছিল। গণজাগরণ মঞ্চ হয়ে উঠছিল আগুনে প্রতিবাদের মঞ্চ। ঠিক তখনই মঞ্চের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় রাজনৈতিক কূটচাল ও বিভাজন। এভাবেই অমিত তেজ ও সম্ভাবনায় দীপ্ত গণজাগরণ মঞ্চ রাজনৈতিক কূটিলতায় খাবি খেতে খেতে এখন প্রায় বিলীন।

২০২১ সালে এসে জনসংখ্যার কাঠামোগত জায়গায় বাংলাদেশ এগিয়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে, অনেক দেশকে পেছনে ফেলে। এই দেশের জনসংখ্যার ৪৫% এখন তরুণ। এদের বয়স ১০ থেকে ২৪ বছর। তরুণ কর্মযোগীদের সংখ্যাটিও চমকে দেবার মত, ৪ কোটি ৭৬ লাখ। জাতিসংঘ জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১৪ জানাচ্ছে, তরুণদের সংখ্যাপুষ্ট দেশ আছে মাত্র ৬টি। ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। তরুণ জনগোষ্ঠীর মানে যদি হয় কর্মশক্তি তাহলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সুস্থিত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় এই অপার সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের মতো বিপদগামী হবার আলামতগুলো কি দেখতে পান আমাদের শাসকরা, নীতি-নির্ধারকরা?

রাজনীতিবিদ, শাসকশ্রেণী এবং নীতি-নির্ধারকরা কি ভাবছেন অপার সম্ভাবনাময় এই তারুণ্যকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে? আমাদের জানা নেই। প্রতি বছর মেধাক্ষী শিক্ষার্থীরা পাড়ি দিচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্যে। গড়ে উঠছে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে। উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মেধার জোরে চমকিত করছে। মিডিওকার তরুণরা দেশের সীমানা ছাড়াচ্ছে, অমানবিক পরিশ্রমে দেশের রোমিট্যান্স বাড়াচ্ছে। বড় অবদান রাখছে জাতীয় রিজার্ভে। গণতন্ত্রহীন দেশে রাজনীতিবিমুখতা থাকলেও প্রবাসে দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। হুজুগে মাতছে নাকি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রবাসী আকাক্সক্ষা স্বপ্ন দেখছে, তা কি তারা নিজেরাও জানেন! এটি যদি হয় সম্ভাবনার দিক, অন্যপথে হাজার হাজার তরুণ যুক্ত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে।

লাখ লাখ তরুণ মাদককে বেছে নিচ্ছে জীবনযাপনের একমাত্র পথ হিসেবে। মানব পাচারকারীদের কবলে পড়ে বেপথু তরুণ ভাসছে সাগরে, ঠাঁই হয়েছে গণকবরে, কঙ্কালসার একদল ঘুরে মরছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার গভীর অরণ্যে। প্রতিপক্ষকে বিনাশ করতে রাজনীতিবিদরা তরুণদের হাতে তুলে দিচ্ছে প্রাণঘাতী অস্ত্র। কর্তৃত্ববাদিতা ও শক্তি প্রয়োগের শাসন জন্ম দিচ্ছে একরৈখিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। মত প্রকাশে বাধা, স্বৈরশাসন উসকে দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। তারুণ্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে বিনাশী যাত্রায়।

কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে? একদিকে সম্ভাবনা অপার, অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে বদলাচ্ছে রাজনীতির ভাষা। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে চলছে তারুণ্য বিনাশের হোলি উৎসব! ইসলামিক স্টেট, বোকো হারাম, আল-কায়দা, তালেবানের মতো বহুজাতিক গোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে জেএমবি, হুজি, হিজবুত তাহেরি, অনসারুল্লাহ্ বাংলাটিম, আল্লাহ্র দলসহ অনেকগুলো নিষিদ্ধ সংগঠন জানা আরও অনেক গোষ্ঠী। এদের সবার টার্গেট তরুণ ও কিশোররা।

বাংলাদেশ এখন নানা ফর্মে সন্ত্রাসবাদের কবলে। এর চেহারায় ধরনে রকমের আছে। কখনও ধর্মীয় চরমপন্থার নামে, সমাজ বদলের নামে, কখনও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-অনাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মাথাচাড়া দিচ্ছে সন্ত্রাস। আবার ক্ষমতাসীনদের মদতপুষ্ট গডফাদাররা স্রেফ আর্থিক সাম্রাজ্য ও এলাকা দখলে রাখতে গড়ে তুলছে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। রাজনীতির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এইসব বাহিনী পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের। এদের সবার টার্গেট তরুণ জনগোষ্ঠী। এসব প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসবাদে যুক্ত হচ্ছে তরুণরা। আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক অন্যায্যতা-অবিচারের বিরুদ্ধে তারা সন্ত্রাসবাদকে শ্রেয়তর মনে করছে। এই তরুণদের বড় একটি অংশ আসছে দারিদ্র্যর মধ্যে বেড়ে ওঠা সামাজিক পরিবেশ থেকে। কারও আগমন ঘটছে স্বচ্ছল-শিক্ষিত পরিবার থেকে। রাজনীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদ এদর সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহী করে তুলছে।

স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরেই বাংলাদেশের তারুণ্য হয়ে পড়েছিল হতাশাগ্রস্ত ও বিপথগামী। প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির বৈপরীত্য এবং সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে দেশ গঠনে কোন ভূমিকা না থাকায় তারা হতাশার গহবরে নিমজ্জিত হয়। ফলে অচিরেই তারা জড়িয়ে পড়েছিল হাইজ্যাক, ডাকাতি, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসসহ নানা বিনাশি কর্মকা-ে। রাজনৈতিক দলের অস্ত্রধারী ক্যাডার হিসেবে তরুণরা ব্যবহৃত হচ্ছিল প্রতিপক্ষ বিনাশে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছিল অকাতরে। ৭২ ও ৭৩ সালে অনেক তরুণ হাইজ্যাকার সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল উন্মত্ত জনতার প্রতিহিংসায়। পরবর্তীকালে সামরিক সরকারগুলো তরুণদের নষ্ট-ভ্রষ্ট সময়ের হাত ধরিয়ে দেয়। আশির দশকে সন্ত্রাসী হিসেবে তারকা খ্যাতি অর্জন করা অভি-নীরুর মতো মেধাবী তরুণরা হারিয়ে যায় নষ্ট সময়ের হাত ধরে।

তরুণ জনগোষ্ঠীর মানে যদি হয় কর্মশক্তি তাহলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সুস্থিত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় এই অপার সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের মতো বিপদগামী হওয়ার আলামতগুলো কি দেখতে পান আমাদের শাসকরা, নীতি-নির্ধারকরা?

চলতি শতকের দু’দশক পার হওয়ার পরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে? ‘অল্প-স্বল্প গণতন্ত্র, সুশাসনহীনতা বিশেষত: আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিসহ নির্বাচন ব্যবস্থার একমুখীনতা গড়ে উঠেছে। দশকের পর দশক ব্যক্তির ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টি কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এর অনিবার্যতায় ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বিস্তৃত হচ্ছে এবং তরুণরা যুক্ত হয়ে পড়ছে। এই সন্ত্রাস ভৌগলিক সীমানা ছাড়াচ্ছে। অর্থনীতিতে সৃষ্ট চাপ উদ্বুদ্ধ করছে চরমপন্থায় এবং রাষ্ট্র সেদিকেই যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ থেকে সৃষ্ট ভয়ের সংস্কৃতি স্থায়ীকরণে নাকি ভয় তাড়াতে রাষ্ট্র এই প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে? যাই ঘটুক, এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর, দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনা ও শঙ্কার ক্রসরোডে?

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্র্মী]

back to top