শিশির রেজা ও মতিউর রহমান
অতি সম্প্রতি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত তার প্রকাশিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র : ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক গ্রন্থে কৃষির রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন। গ্রন্থকার মনে করেন, লোনা পানিতে চিংড়ি চাষ ও সংশ্লিষ্ট শিল্প-বাণিজ্য বিষয়টি এ দেশে দারিদ্র্য-বঞ্চনার ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে।
আবুল বারকাত তার গ্রন্থে বলেন, এ দেশে ১ কোটি ৩২ লাখ মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য জল-জলাসংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মৎস্য খাতে সার্বক্ষণিক সরাসরি কাজ করছেন ১২ লাখ মানুষ, আর ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কাজ করছেন ঋতুভিত্তিক-সাময়িক। ১ কোটি ৩২ লাখ মৎস্যজীবীর ৮০ লাখই দরিদ্র। মৎস্যজীবী পরিবারে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি, যাদের অর্ধেকের বেশি যে কোন মাপকাঠিতেই দরিদ্র এবং যাদের দৈনন্দিন আয়প্রবাহ অতিমাত্রায় অনিশ্চিত। মৎস্যজীবী মানুষের দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতার প্রধান কারণ হলো জল-জলায় আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা। জলমহাল লিজ-চুক্তি আর্দ্র ভূমিতে তাদের আইনগত অধিকার ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করার প্রধান মাধ্যম। বাংলাদেশে মাছ বাজারজাতকরণ এক জটিল প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় থাকে কমপক্ষে ৬ ধাপের মধ্যস্বত্বভোগী। এসব মধ্যস্বত্বভোগী ‘ভ্যালু চেইনে’ তেমন কোন ভ্যালু সংযোজন করে না, অথচ অতি মুনাফার লোভে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের শোষণ করার মাধ্যমে তাদের আয়-রোজগার কমাতে ভূমিকা রাখে।
দেশে এখন ১ কোটি ৩২ লাখ মৎস্যজীবীর মাত্র ১০ শতাংশ এই পেশার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। জল-জলাসমৃদ্ধ বাংলাদেশে মৎস্য জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত মানুষের অনুপাত দ্বিগুণ-তিনগুণ বৃদ্ধি সম্ভব যদি দরিদ্র-অভিমুখী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যায়, যেখানে মূলনীতি হবে জাল যার জলা তার। এর ফলে জাতীয় উৎপাদনে মৎস্য খাতের ভূমিকা হতে পারে শস্য-কৃষির সমতুল্য, এবং আয়-খাদ্য-পুষ্টিসংক্রান্ত দারিদ্র্য যথেষ্ট মাত্রায় কমানো সম্ভব। এসবই মৎস্য খাতে ১ কোটি মানুষের দারিদ্র্য হ্রাসে নিয়ামক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
এ দেশে ১৫-২০ লাখ দরিদ্র শ্রমজীবী লোনা পানিতে চিংড়ি চাষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশের প্রায় ৩২ লাখ হেক্টর উপকূল অঞ্চলের ২০ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য। এসব অঞ্চলের বিস্তৃতি ১৫ জেলার ৯৮টি উপজেলায়। দেশের মোট ১৭ কোটি জনসংখ্যার ৩ কোটির বসবাস উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলের ১০ লাখ হেক্টর জমি এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসে প্রতিদিন জোয়ার-ভাটার আওতায় থাকে; শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বাড়ে; জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এসব কারণে উপকূল অঞ্চলে ফলনের তীব্রতা স্বল্প।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত উল্লেখ করেন, সুপার মুনাফার লোভে নির্বিচারে চিংড়ি চাষের আওতায় চলে এসেছে অতীতের সু-ফসলি ধানি জমিসহ উপকূলীয় এলাকার বাঁধের ভেতরের আর বাইরের সব জমি, লবণ উৎপাদনের জমি, পরিত্যক্ত ও প্রান্তীয় জমি, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, আর্দ্র ভূমি ইত্যাদি। অপরিকল্পিত ও বিস্ফোরণমূলক এই প্রবৃদ্ধি নির্বিচারে ধ্বংস করেছে প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ– সবকিছুই; পানির গুণমান লোপ পেয়েছে; জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়েছে; ঔষধি গাছগাছড়ার স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে; গাছপালা-ফলমূলের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে; লবণাক্ততা বিনষ্ট করেছে জমির প্রাকৃতিক গুণাবলি; হাঁস-মুরগিসহ গো-সম্পদ বিলুপ্ত প্রায় (এসবই প্রায় ৩ কোটি মানুষের খাদ্যাভাসে প্রোটিন ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে)।
জমিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি ফলন-বৃদ্ধি চক্রের ওপর মারাত্মক ঋতাত্মক প্রভাব ফেলেছে। শুধু একরপ্রতি ফলনই হ্রাস পায়নি, এমনও হয়েছে যখন পুরো ফসলই মার গেছে। ফারাক্কা বাঁধ আর সেইসঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির ক্রমাগত অনুপ্রবেশ উপকূলীয় কৃষিজমিতে অম্লের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে, লবণ পানির জলাবদ্ধতা বেড়েছে এবং কাদামাটির প্রাকৃতিক গুণাগুণ লোপ পেয়েছে। ফলে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। যার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা পড়েছে হুমকির মুখে। শুধু তাই নয়, চিংড়ি চাষের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে পানির ভৌত, রাসায়নিক, ও জৈবিক গুণাবলি এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যা বিপন্ন করছে হাজার বছরের প্রকৃতি ও পরিবেশ। এ বিপন্নতা অনবায়নযোগ্য সম্পদ বিনষ্ট করছে। এ বিপন্নতার ঋণাত্মক অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদি হতে বাধ্য।
আবুল বারকাত মনে করেন, চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও হিমায়িত কারখানায় আছে স্বল্পমজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, শিশুশ্রম, শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা। সুতরাং চিংড়ি চাষ ও বাণিজ্য একদিকে যেমন গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত ঘেরমালিক ও রপ্তানিকারকের আর্থিক ধন-সম্পদ বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে, আর অন্যদিকে ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জলা-জমির ওপর তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জীবন-জীবিকাকে করে তোলে অনিশ্চিত। আর প্রকৃতি তো গুরুতর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ উপকূলীয় ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তাসহ ব্যক্তিগত জীবনের নিরাপত্তার সকল শর্ত বিলুপ্ত করেছে।
বাণিজ্যিক চিংড়ির উৎপাদন ব্যয়ে যেসব ব্যয়-অভিঘাত কোনভাবেই দেখানো হয় না সেগুলো হলো: উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি অবকাঠামোর বিলুপ্তি, উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষয়-ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতির পরিমাণ ও অভিঘাত, পারিবারিক বন্ধনের বিচ্যুতি, ক্ষুধার্ত-অনাহারক্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, পানির দূষণ, নবায়নযোগ্য সম্পদের ক্ষয় এবং হারীর দলিলে ন্যায়-অধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন। এসব ব্যয়ের কোনটিই কল্পিত নয়, সবই বাস্তব। এসবের ব্যয়ভার বহন করছে ও করবে ভবিষ্যতের প্রজন্ম। সুতরাং বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ পরিবেশগতভাবে আত্মঘাতী, সামাজিকভাবে নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়ার অনুঘটক এবং অর্থনৈতিকভাবে অন্যায়।
[ লেখক : শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। ড. মতিউর রহমান গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা ]
শিশির রেজা ও মতিউর রহমান
রোববার, ০২ মে ২০২১
অতি সম্প্রতি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত তার প্রকাশিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র : ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক গ্রন্থে কৃষির রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন। গ্রন্থকার মনে করেন, লোনা পানিতে চিংড়ি চাষ ও সংশ্লিষ্ট শিল্প-বাণিজ্য বিষয়টি এ দেশে দারিদ্র্য-বঞ্চনার ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে।
আবুল বারকাত তার গ্রন্থে বলেন, এ দেশে ১ কোটি ৩২ লাখ মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য জল-জলাসংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মৎস্য খাতে সার্বক্ষণিক সরাসরি কাজ করছেন ১২ লাখ মানুষ, আর ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কাজ করছেন ঋতুভিত্তিক-সাময়িক। ১ কোটি ৩২ লাখ মৎস্যজীবীর ৮০ লাখই দরিদ্র। মৎস্যজীবী পরিবারে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি, যাদের অর্ধেকের বেশি যে কোন মাপকাঠিতেই দরিদ্র এবং যাদের দৈনন্দিন আয়প্রবাহ অতিমাত্রায় অনিশ্চিত। মৎস্যজীবী মানুষের দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতার প্রধান কারণ হলো জল-জলায় আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা। জলমহাল লিজ-চুক্তি আর্দ্র ভূমিতে তাদের আইনগত অধিকার ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করার প্রধান মাধ্যম। বাংলাদেশে মাছ বাজারজাতকরণ এক জটিল প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় থাকে কমপক্ষে ৬ ধাপের মধ্যস্বত্বভোগী। এসব মধ্যস্বত্বভোগী ‘ভ্যালু চেইনে’ তেমন কোন ভ্যালু সংযোজন করে না, অথচ অতি মুনাফার লোভে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের শোষণ করার মাধ্যমে তাদের আয়-রোজগার কমাতে ভূমিকা রাখে।
দেশে এখন ১ কোটি ৩২ লাখ মৎস্যজীবীর মাত্র ১০ শতাংশ এই পেশার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। জল-জলাসমৃদ্ধ বাংলাদেশে মৎস্য জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত মানুষের অনুপাত দ্বিগুণ-তিনগুণ বৃদ্ধি সম্ভব যদি দরিদ্র-অভিমুখী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যায়, যেখানে মূলনীতি হবে জাল যার জলা তার। এর ফলে জাতীয় উৎপাদনে মৎস্য খাতের ভূমিকা হতে পারে শস্য-কৃষির সমতুল্য, এবং আয়-খাদ্য-পুষ্টিসংক্রান্ত দারিদ্র্য যথেষ্ট মাত্রায় কমানো সম্ভব। এসবই মৎস্য খাতে ১ কোটি মানুষের দারিদ্র্য হ্রাসে নিয়ামক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
এ দেশে ১৫-২০ লাখ দরিদ্র শ্রমজীবী লোনা পানিতে চিংড়ি চাষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশের প্রায় ৩২ লাখ হেক্টর উপকূল অঞ্চলের ২০ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য। এসব অঞ্চলের বিস্তৃতি ১৫ জেলার ৯৮টি উপজেলায়। দেশের মোট ১৭ কোটি জনসংখ্যার ৩ কোটির বসবাস উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলের ১০ লাখ হেক্টর জমি এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসে প্রতিদিন জোয়ার-ভাটার আওতায় থাকে; শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বাড়ে; জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এসব কারণে উপকূল অঞ্চলে ফলনের তীব্রতা স্বল্প।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত উল্লেখ করেন, সুপার মুনাফার লোভে নির্বিচারে চিংড়ি চাষের আওতায় চলে এসেছে অতীতের সু-ফসলি ধানি জমিসহ উপকূলীয় এলাকার বাঁধের ভেতরের আর বাইরের সব জমি, লবণ উৎপাদনের জমি, পরিত্যক্ত ও প্রান্তীয় জমি, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, আর্দ্র ভূমি ইত্যাদি। অপরিকল্পিত ও বিস্ফোরণমূলক এই প্রবৃদ্ধি নির্বিচারে ধ্বংস করেছে প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ– সবকিছুই; পানির গুণমান লোপ পেয়েছে; জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়েছে; ঔষধি গাছগাছড়ার স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে; গাছপালা-ফলমূলের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে; লবণাক্ততা বিনষ্ট করেছে জমির প্রাকৃতিক গুণাবলি; হাঁস-মুরগিসহ গো-সম্পদ বিলুপ্ত প্রায় (এসবই প্রায় ৩ কোটি মানুষের খাদ্যাভাসে প্রোটিন ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে)।
জমিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি ফলন-বৃদ্ধি চক্রের ওপর মারাত্মক ঋতাত্মক প্রভাব ফেলেছে। শুধু একরপ্রতি ফলনই হ্রাস পায়নি, এমনও হয়েছে যখন পুরো ফসলই মার গেছে। ফারাক্কা বাঁধ আর সেইসঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির ক্রমাগত অনুপ্রবেশ উপকূলীয় কৃষিজমিতে অম্লের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে, লবণ পানির জলাবদ্ধতা বেড়েছে এবং কাদামাটির প্রাকৃতিক গুণাগুণ লোপ পেয়েছে। ফলে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। যার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা পড়েছে হুমকির মুখে। শুধু তাই নয়, চিংড়ি চাষের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে পানির ভৌত, রাসায়নিক, ও জৈবিক গুণাবলি এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যা বিপন্ন করছে হাজার বছরের প্রকৃতি ও পরিবেশ। এ বিপন্নতা অনবায়নযোগ্য সম্পদ বিনষ্ট করছে। এ বিপন্নতার ঋণাত্মক অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদি হতে বাধ্য।
আবুল বারকাত মনে করেন, চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও হিমায়িত কারখানায় আছে স্বল্পমজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, শিশুশ্রম, শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা। সুতরাং চিংড়ি চাষ ও বাণিজ্য একদিকে যেমন গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত ঘেরমালিক ও রপ্তানিকারকের আর্থিক ধন-সম্পদ বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে, আর অন্যদিকে ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জলা-জমির ওপর তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জীবন-জীবিকাকে করে তোলে অনিশ্চিত। আর প্রকৃতি তো গুরুতর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ উপকূলীয় ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তাসহ ব্যক্তিগত জীবনের নিরাপত্তার সকল শর্ত বিলুপ্ত করেছে।
বাণিজ্যিক চিংড়ির উৎপাদন ব্যয়ে যেসব ব্যয়-অভিঘাত কোনভাবেই দেখানো হয় না সেগুলো হলো: উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি অবকাঠামোর বিলুপ্তি, উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষয়-ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতির পরিমাণ ও অভিঘাত, পারিবারিক বন্ধনের বিচ্যুতি, ক্ষুধার্ত-অনাহারক্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, পানির দূষণ, নবায়নযোগ্য সম্পদের ক্ষয় এবং হারীর দলিলে ন্যায়-অধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন। এসব ব্যয়ের কোনটিই কল্পিত নয়, সবই বাস্তব। এসবের ব্যয়ভার বহন করছে ও করবে ভবিষ্যতের প্রজন্ম। সুতরাং বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ পরিবেশগতভাবে আত্মঘাতী, সামাজিকভাবে নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়ার অনুঘটক এবং অর্থনৈতিকভাবে অন্যায়।
[ লেখক : শিশির রেজা, সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। ড. মতিউর রহমান গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা ]