মোস্তাফা জব্বার
নয় ॥
রক্তে ভেজা বাংলা ভাষা
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা আমরা করেছি। সেই আলোচনার সূত্র ধরেই আমাদের নিবন্ধের শিরোনামের প্রতি সুবিচার করতে রক্তে ভেজা বাংলা ভাষার সময়টাকে আমাদের স্মরণ করতে হবে।
অমর একুশে : বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার অপপ্রয়াস বন্ধের দাবিতে ২১ ফেব্রুযারি ডাকা হরতালের প্রাক্কালে ২০ ফেব্রুযারি ঢাকায এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয। সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এই হরতাল আহ্বান করে। ২১ ফেব্রুযারি হরতাল ডাকা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাডা ঢাকা শহরের অন্যত্র অবস্থা শান্ত ছিল। ছাত্র ধর্মঘট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয়। কলা ভবনে ছাত্রদের সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও রাজশাহীসহ অনেক এলাকায হরতাল পালিত হয়। ঢাকায ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পডলে অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েটে, বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে। কল-কারখানা, রেল ও রিকশার চাকা বন্ধ হয়ে যায়। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিতে মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত ও রফিকউদ্দিন আহমদ মারা যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয় ।
সূত্র : আজাদ, ২২ ফেব্রুযারি, ১৯৫২
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের আহ্বানে ২২ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) ঢাকায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। দোকান, বাজার, অফিস বন্ধ ছিল। সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরাও মিছিলে নামে। সৈন্য তলব করা হয়। শহরে গুলিতে ১২ জন নিহত হয়। আহত শতাধিক। শহিদদের গায়েবি জানাজায় লক্ষাধিক লোক উপস্থিত হয়। ৭ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। ভাষা-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রদেশের সর্বত্র। ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পূর্ববঙ্গ সরকারের দেয়া প্রেসনোটে বলা হয়, নওযাবপুর রোড, কার্জন হল, হাইকোর্টসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি চালানোর পর আহত ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুজন নিহত হন। সূত্র : আজাদ, ২৩ ফেব্রুযারি ৫২
২৩ ফেব্রুযারি ঢাকায পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। রেল ধর্মঘট হয়। পরপর তিন দিন হরতাল হয়। দেশের অন্যান্য স্থানে হরতাল হয়। ঢাকার মহল্লার অভ্যন্তরেও দোকান খোলেনি। রেল, সাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকে। সেক্রেটারিয়েটে ও সকল ব্যাংকে ধর্মঘট হয়। সূত্র : ইনসাফ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ৫২
২৪ ফেব্রুযারি, রোববার ঢাকায রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি ছাডা অন্য যানবাহন চলেনি। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ থাকে। পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পরপর চারদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ ছাড়া কোনও অনুষ্ঠান প্রচার হয়নি। সূত্র : আজাদ, ২৫ ফেব্রুযারি ৫২
২৫ ফেব্রুযারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয, ক্রমাগত ধর্মঘট চলতে থাকলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা থাকে। তাই স্থির হয়েছে, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য ধর্মঘট স্থগিত থাকবে। প্রদেশব্যাপী ৫ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট হবে। সূত্র : আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫২
এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ গ্রেপ্তার ছাত্রনেতারা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালেন, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেড়িওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না।,’ ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই,’ ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক স্লোগান। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধুর জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোন স্লোগান দিচ্ছে না কেন তাই বঙ্গবন্ধুর মন খারাপ হলো? বঙ্গবন্ধু বলেন শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, বললেই তো হতো। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলেন তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। দুজন কয়েদি ছিল বঙ্গবন্ধুদের পাহারা দেবার এবং কাজকর্ম করে দেবার জন্য। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বললো, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরের দিন ৯-১০টার সময় বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল। শোভাযাত্রীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতেন তিনি, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্তু আমরা নিচের তলায়, হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। বঙ্গবন্ধদের জানবার জন্যই। কি হয়েছে ঢাকায় কিছু কিছু বুঝতে পারলেন বঙ্গবন্ধু। জেল কর্তৃপক্ষ কোন খবর দিতে চায় না। খবরের কাগজ একদিন পরে আসবে, ঢাকা থেকে। ২২ তারিখে সারাদিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চললো। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী একজায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এলো, কিছু কিছু খবর পেলেন তিনি। উত্তেজনা চলতে থাকে। ২৩ ও ২৪ তারিখও সরকারি দমননীতি অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কা ব্যক্ত করে গভর্নর ২৪ তারিখ আইন পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। ২৫ ফেব্রয়ারি কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন এবং ছাত্রদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করেন। অন্যদিকে ২৭ ফেব্রুয়ারি গণদাবির মুখে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল বেলা তারা অনশন ভঙ্গ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পান। মহিউদ্দিন আহমদ মুক্তি পান ১ মার্চ, ১৯৫২।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও পাকিস্তান সরকার তার ওপরে সার্বক্ষণিক নজর রাখতেই থাকে। অন্যদিকে এক নাগাড়ে প্রায় আড়াই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন জেলে বন্দী থাকার ফলে তার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বেশ কিছুদিন রক্ত আমাশায় ভুগেছেন। পূর্ববাংলার ফরিদপুর জেলা কারাগার থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ইংরেজিতে চিঠি লিখেন বঙ্গবন্ধু। অবশ্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা দপ্তর সে চিঠি জব্দ করে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে এক মাস ২০ দিন অবস্থান করতে হয়েছে। তিনি অসুস্থ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিকট লিখিত পত্রে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের জনবিরোধী কর্মকা-, সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা ও সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা এবং অবিলম্বে ঢাকায় আসার জন্য উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি ব্যক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক লিখিত অথবা মুজিবকে লিখিত পত্রসমূহ গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে কঠোরভাবে সেন্সর করা হতো। তফাজ্জল হসেন মানিক মিয়ার নিকট ২৮.৩.৫২ তারিখে লিখিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এরূপ একটি চিঠি (চিঠিটি গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ আটক করেছিল।) থেকে গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে যে, শেখ মুজিব শীঘ্রই ঢাকায় আসছেন। এই চিঠি ঢাকার জিপিও থেকে বাজেয়াপ্ত করার পরপরই গোয়েন্দা দপ্তর তৎপর হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু ১৯ এপ্রিল, ১৯৫২ রওনা হয়ে তিন দিনের মাথায় ২১ এপ্রিল, ১৯৫২ ঢাকায় পৌঁছেন।
২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৬টি জেলার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখা ভাষণ পাঠ করেন কমরুদ্দীন আহমদ। ওই প্রতিনিধিত্ব সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক বাংলাকে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের সুপারিশের বিরোধিতা করে সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু বলেন দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মাওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশিম ও অন্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাইনা। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই। ভাষা চাই মুসলিম লীগ সরকার আর ‘মর্নিং নিউজ’ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’
লক্ষণীয়, শেখ মুজিব তার নেতাকেও বাংলা ভাষা সম্পর্কে আঞ্চলিক ভাষা করার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধিতা করতে ছাড়েননি। এ থেকে শেখ মুজিবের দৃঢ়চিত্ততা ও নেতৃত্বের স্বাক্ষর মেলে।
গোপন সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে...
সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি দিয়ে বাংলাকে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের সুপারিশ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অন্যান্য শ্রমিকরাও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাদের মূল দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেন, আমি এ রাষ্ট্রভাষার বিতর্ককে অর্থহীন মনে করি। এটি পাকিস্তানকে বিভক্ত করবে। এটি বাদ দেয়া উচিত। না হয় আমরা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বাংলার জন্য বাংলা উর্দুর জন্য উর্দু ব্যবহার করি এবং আন্তঃঅঞ্চল ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে মাঝে মাঝে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করি। আমি বাংলার মুসলমানদের বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু শেখার পরামর্শ দেব। তারা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করে, আমি মনে করি তাদের কোন আপত্তি থাকবে না বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৃঢ়চিত্ততা লক্ষ্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে যে পত্র দেন সেটিও প্রণিধানযোগ্য। লক্ষণীয়, শেখ মুজিব ভাষার বিষয়ে যেমন, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কর্মকা-, দলীয় কাজকর্ম, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়েও সমানভাবে চিন্তা করতেন। তিনি এজন্য জেল-জুলুমের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতেন।
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।” বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ঢাকায় চিকিৎসার জন্য এলেও শেখ মুজিব ২১ ফেব্রুয়ারি উত্তর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং জাতীয় রাজনীতির ঘটনাবলীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ৫ ডিসেম্বর ১৯৫২ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সভা-সমিতির মাধ্যমে বন্দীমুক্তি দিবস হিসেবে প্রতিটি শাখাকে পালনের জন্য সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দেন। ওইদিন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে বিরাট জনসভা পরিষদের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে মওলানা ভাসানীসহ বহুকর্মী বিনাবিচারে জেলে আটক আছেন। ভাষার দাবিতে গোলাগুলি চলে কিংবা এরূপ বন্দী করা হয় এই দুনিয়ার ইতিহাসে এটাই তার প্রথম নজির। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ছাড়াও জনতার দাবি নিয়ে যারা সংগ্রাম করছিলেন তাদের অনেককে সরকার ইতিপূর্বে বিনাবিচারে আটক রেখেছেন। অবিলম্বে সব বন্দীকে মুক্তি না দিলে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন সৃষ্টি হবে। তিনি দেশবাসীর স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দাবি করেন। পরিশেষে বলেন, ‘মওলানা ভাসানী ও সহকর্মীরা জেলে পচে মরলে আমরা বাইরে থাকতে চাই না।’
ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯,
সর্বশেষ সম্পাদনা ৫ মে ২১ ॥
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]
mustafajabbar@gmail.com
মোস্তাফা জব্বার
সোমবার, ০৩ মে ২০২১
নয় ॥
রক্তে ভেজা বাংলা ভাষা
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা আমরা করেছি। সেই আলোচনার সূত্র ধরেই আমাদের নিবন্ধের শিরোনামের প্রতি সুবিচার করতে রক্তে ভেজা বাংলা ভাষার সময়টাকে আমাদের স্মরণ করতে হবে।
অমর একুশে : বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার অপপ্রয়াস বন্ধের দাবিতে ২১ ফেব্রুযারি ডাকা হরতালের প্রাক্কালে ২০ ফেব্রুযারি ঢাকায এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয। সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এই হরতাল আহ্বান করে। ২১ ফেব্রুযারি হরতাল ডাকা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাডা ঢাকা শহরের অন্যত্র অবস্থা শান্ত ছিল। ছাত্র ধর্মঘট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয়। কলা ভবনে ছাত্রদের সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও রাজশাহীসহ অনেক এলাকায হরতাল পালিত হয়। ঢাকায ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পডলে অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েটে, বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে। কল-কারখানা, রেল ও রিকশার চাকা বন্ধ হয়ে যায়। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিতে মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত ও রফিকউদ্দিন আহমদ মারা যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয় ।
সূত্র : আজাদ, ২২ ফেব্রুযারি, ১৯৫২
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের আহ্বানে ২২ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) ঢাকায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। দোকান, বাজার, অফিস বন্ধ ছিল। সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরাও মিছিলে নামে। সৈন্য তলব করা হয়। শহরে গুলিতে ১২ জন নিহত হয়। আহত শতাধিক। শহিদদের গায়েবি জানাজায় লক্ষাধিক লোক উপস্থিত হয়। ৭ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। ভাষা-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রদেশের সর্বত্র। ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পূর্ববঙ্গ সরকারের দেয়া প্রেসনোটে বলা হয়, নওযাবপুর রোড, কার্জন হল, হাইকোর্টসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি চালানোর পর আহত ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুজন নিহত হন। সূত্র : আজাদ, ২৩ ফেব্রুযারি ৫২
২৩ ফেব্রুযারি ঢাকায পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। রেল ধর্মঘট হয়। পরপর তিন দিন হরতাল হয়। দেশের অন্যান্য স্থানে হরতাল হয়। ঢাকার মহল্লার অভ্যন্তরেও দোকান খোলেনি। রেল, সাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকে। সেক্রেটারিয়েটে ও সকল ব্যাংকে ধর্মঘট হয়। সূত্র : ইনসাফ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ৫২
২৪ ফেব্রুযারি, রোববার ঢাকায রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি ছাডা অন্য যানবাহন চলেনি। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ থাকে। পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পরপর চারদিন ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ ছাড়া কোনও অনুষ্ঠান প্রচার হয়নি। সূত্র : আজাদ, ২৫ ফেব্রুযারি ৫২
২৫ ফেব্রুযারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয, ক্রমাগত ধর্মঘট চলতে থাকলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা থাকে। তাই স্থির হয়েছে, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য ধর্মঘট স্থগিত থাকবে। প্রদেশব্যাপী ৫ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট হবে। সূত্র : আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫২
এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ গ্রেপ্তার ছাত্রনেতারা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালেন, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেড়িওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না।,’ ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই,’ ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক স্লোগান। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধুর জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোন স্লোগান দিচ্ছে না কেন তাই বঙ্গবন্ধুর মন খারাপ হলো? বঙ্গবন্ধু বলেন শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, বললেই তো হতো। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলেন তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। দুজন কয়েদি ছিল বঙ্গবন্ধুদের পাহারা দেবার এবং কাজকর্ম করে দেবার জন্য। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বললো, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরের দিন ৯-১০টার সময় বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল। শোভাযাত্রীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতেন তিনি, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্তু আমরা নিচের তলায়, হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। বঙ্গবন্ধদের জানবার জন্যই। কি হয়েছে ঢাকায় কিছু কিছু বুঝতে পারলেন বঙ্গবন্ধু। জেল কর্তৃপক্ষ কোন খবর দিতে চায় না। খবরের কাগজ একদিন পরে আসবে, ঢাকা থেকে। ২২ তারিখে সারাদিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চললো। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী একজায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এলো, কিছু কিছু খবর পেলেন তিনি। উত্তেজনা চলতে থাকে। ২৩ ও ২৪ তারিখও সরকারি দমননীতি অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কা ব্যক্ত করে গভর্নর ২৪ তারিখ আইন পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। ২৫ ফেব্রয়ারি কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন এবং ছাত্রদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করেন। অন্যদিকে ২৭ ফেব্রুয়ারি গণদাবির মুখে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল বেলা তারা অনশন ভঙ্গ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পান। মহিউদ্দিন আহমদ মুক্তি পান ১ মার্চ, ১৯৫২।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও পাকিস্তান সরকার তার ওপরে সার্বক্ষণিক নজর রাখতেই থাকে। অন্যদিকে এক নাগাড়ে প্রায় আড়াই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন জেলে বন্দী থাকার ফলে তার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বেশ কিছুদিন রক্ত আমাশায় ভুগেছেন। পূর্ববাংলার ফরিদপুর জেলা কারাগার থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ইংরেজিতে চিঠি লিখেন বঙ্গবন্ধু। অবশ্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা দপ্তর সে চিঠি জব্দ করে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে এক মাস ২০ দিন অবস্থান করতে হয়েছে। তিনি অসুস্থ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিকট লিখিত পত্রে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের জনবিরোধী কর্মকা-, সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা ও সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা এবং অবিলম্বে ঢাকায় আসার জন্য উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি ব্যক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক লিখিত অথবা মুজিবকে লিখিত পত্রসমূহ গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে কঠোরভাবে সেন্সর করা হতো। তফাজ্জল হসেন মানিক মিয়ার নিকট ২৮.৩.৫২ তারিখে লিখিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এরূপ একটি চিঠি (চিঠিটি গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ আটক করেছিল।) থেকে গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে যে, শেখ মুজিব শীঘ্রই ঢাকায় আসছেন। এই চিঠি ঢাকার জিপিও থেকে বাজেয়াপ্ত করার পরপরই গোয়েন্দা দপ্তর তৎপর হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু ১৯ এপ্রিল, ১৯৫২ রওনা হয়ে তিন দিনের মাথায় ২১ এপ্রিল, ১৯৫২ ঢাকায় পৌঁছেন।
২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৬টি জেলার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লিখা ভাষণ পাঠ করেন কমরুদ্দীন আহমদ। ওই প্রতিনিধিত্ব সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক বাংলাকে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের সুপারিশের বিরোধিতা করে সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু বলেন দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মাওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশিম ও অন্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাইনা। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই। ভাষা চাই মুসলিম লীগ সরকার আর ‘মর্নিং নিউজ’ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’
লক্ষণীয়, শেখ মুজিব তার নেতাকেও বাংলা ভাষা সম্পর্কে আঞ্চলিক ভাষা করার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধিতা করতে ছাড়েননি। এ থেকে শেখ মুজিবের দৃঢ়চিত্ততা ও নেতৃত্বের স্বাক্ষর মেলে।
গোপন সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে...
সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি দিয়ে বাংলাকে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের সুপারিশ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অন্যান্য শ্রমিকরাও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাদের মূল দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেন, আমি এ রাষ্ট্রভাষার বিতর্ককে অর্থহীন মনে করি। এটি পাকিস্তানকে বিভক্ত করবে। এটি বাদ দেয়া উচিত। না হয় আমরা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বাংলার জন্য বাংলা উর্দুর জন্য উর্দু ব্যবহার করি এবং আন্তঃঅঞ্চল ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে মাঝে মাঝে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করি। আমি বাংলার মুসলমানদের বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু শেখার পরামর্শ দেব। তারা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করে, আমি মনে করি তাদের কোন আপত্তি থাকবে না বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৃঢ়চিত্ততা লক্ষ্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে যে পত্র দেন সেটিও প্রণিধানযোগ্য। লক্ষণীয়, শেখ মুজিব ভাষার বিষয়ে যেমন, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কর্মকা-, দলীয় কাজকর্ম, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়েও সমানভাবে চিন্তা করতেন। তিনি এজন্য জেল-জুলুমের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতেন।
বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।” বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ঢাকায় চিকিৎসার জন্য এলেও শেখ মুজিব ২১ ফেব্রুয়ারি উত্তর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং জাতীয় রাজনীতির ঘটনাবলীর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ৫ ডিসেম্বর ১৯৫২ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সভা-সমিতির মাধ্যমে বন্দীমুক্তি দিবস হিসেবে প্রতিটি শাখাকে পালনের জন্য সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দেন। ওইদিন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে বিরাট জনসভা পরিষদের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে মওলানা ভাসানীসহ বহুকর্মী বিনাবিচারে জেলে আটক আছেন। ভাষার দাবিতে গোলাগুলি চলে কিংবা এরূপ বন্দী করা হয় এই দুনিয়ার ইতিহাসে এটাই তার প্রথম নজির। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ছাড়াও জনতার দাবি নিয়ে যারা সংগ্রাম করছিলেন তাদের অনেককে সরকার ইতিপূর্বে বিনাবিচারে আটক রেখেছেন। অবিলম্বে সব বন্দীকে মুক্তি না দিলে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন সৃষ্টি হবে। তিনি দেশবাসীর স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দাবি করেন। পরিশেষে বলেন, ‘মওলানা ভাসানী ও সহকর্মীরা জেলে পচে মরলে আমরা বাইরে থাকতে চাই না।’
ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯,
সর্বশেষ সম্পাদনা ৫ মে ২১ ॥
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]
mustafajabbar@gmail.com