alt

উপ-সম্পাদকীয়

অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রসঙ্গে

সিরাজ প্রামাণিক

: সোমবার, ২৪ মে ২০২১

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় যে সব ব্যক্তি পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৪ সাল থেকে শত্রু সম্পত্তির নতুন নাম দেয়া হয় অর্পিত সম্পত্তি। যদিও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৩-০৩-৭৪-এর পরে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা বেআইনি মর্মে রায় প্রদান করেছেন, যা ৫৮ ডিএলআর (আপিল্যাট বিভাগ) এ ১৭৭ পৃষ্ঠাসহ অপরাপর প্রকাশনায় নজির হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সব অর্পিত সম্পত্তির মূল মালিক বা তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন তৈরি হয়। এর মধ্যে ‘ক’ তফসিলে বর্ণিত অর্পিত সম্পত্তি হচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্পিত সম্পত্তি। ‘খ’ তফসিলে বর্ণিত অর্পিত সম্পত্তি হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অর্পিত সম্পত্তি।

সরকারি গেজেটে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে তা ফেরত লাভের জন্য আবেদন করতে হবে। না করলে অর্পিত সম্পত্তি সরকারি দখলে নিয়ে তা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হবে। অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে হলে দাবিদারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। তবে বিনিময় মামলার আওতায় যারা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য তাদের ভারতে প্রদত্ত সম্পত্তির বিবরণী জমা দিতে হবে। যদিও ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কোন সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ১৯৭৪ সালের শত্রু সম্পত্তি আইন (বিলুপ্ত) ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল। ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে অর্পিত সম্পত্তি বা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার কাজ সম্পূর্ণ বেআইনি। অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক এক রায়ে হাইকোর্ট এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব অর্পিত সম্পত্তির আইনগত দাবিদার নেই, সে সম্পদ শুধু মানবিক উন্নয়নকাজে ব্যবহার করতে হবে। যেসব সম্পদ সরকারের অনুকূলে অর্পিত হয়েছে, সেসব সম্পদ ব্যবহারের জন্য আইন করতে হবে। যেসব সম্পদ আইনগত অধিকারীকে ফেরত দেয়া সম্ভব নয় সে ক্ষেত্রে আইনগত দাবিদারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে আইন করতে হবে। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য এক বা একাধিক বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ট্রাইব্যুনালকে আইনে (২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন) বেঁধে দেয়া সময়সীমা কঠোরভাবে মেনে চলতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ১৯৮০ সালের ১৮ জুনের পর থেকে তালিকা করার কাজে নিয়োজিত থাকা আদালত অবমাননার শামিল। রায়ে আরও বলা হয়, ২০০১ সালের আইনকে (২০১৩ সালে সংশোধিত) কার্যকর করতে হলে ১৯৭৪ সালের আইন ও ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশের আংশিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে নতুন আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিজ্ঞ ট্রাব্যুনালকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যার সমাধান আইনে নেই।

যেমন- প্রথমত, অ্যাবেটেড মামলার বাদীর নাম যদি ২০১২ সালের তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে নালিশি সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয়, তৎক্ষেত্রে বাদীর কী প্রতিকার তা আইনে বলা নেই। দ্বিতীয়ত, প্রকাশিত তালিকায় যদি কোন ভুল থাকে সেই ভুল সংশোধনের বিষয়ে নতুন আইনে কোন ব্যবস্থা নেই। তৃতীয়ত, নতুন আইনে দরখাস্ত মঞ্জুর হওয়ার পর প্রার্থীদের নামে লেটেস্ট রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনী বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও প্রার্থী উভয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে সংশোধন বা নামজারি প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণায়ের প্রজ্ঞাপন মূলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। চতুর্থত, একই দাগের তালিকাভুক্ত সম্পত্তি দুজন আলাদা আলাদাভাবে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করলে একটি আবেদন ইতোমধ্যে মঞ্জুর হলে অপর বিচারাধীন আবেদনটি অবমুক্ত নাকি খারিজ হবে নতুন আইনে কিছু বলা নেই। পঞ্চমত, সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস যদি একাধিক দাগ বিশিষ্ট খতিয়ানের একটি দাগ তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে খাজনা গ্রহণ না করে নতুন আইনে সমাধানমূলক নির্দেশনা নেই। ষষ্ঠত, অর্পিত আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে না পারলে ফলাফল কী হবে তা বলা নেই।

কিন্তু আইন বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি অনুসারে আইনগত ফলাফলের অনুপস্থিতি প্রতিকারবিহীন অবস্থায় থাকবে না। পক্ষান্তরে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির দাবিতে নতুন মামলা দায়ের বা দাবি উত্থাপন নিষিদ্ধ’ বিধানটি নির্দিষ্ট সময়ের পর নতুন মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নয়। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের পর প্রার্থীর বাদী হিসেবে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করতে কোন আইনগত বাধা নেই। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কিছু আইন, নির্বাহী আদেশ ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে উক্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন। আবার বিজ্ঞ বিচারিক আদালত বাদীপক্ষের ডিফেন্সের কারণগুলোর আলোকে ঘোষণামূলক মামলাসমূহ নিষ্পত্তি করতে পারবেন।

যেমন- প্রথমত, বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ না করে নালিশি সম্পত্তি অর্পিত তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করা হলে; দ্বিতীয়ত, সরকার বিবাদী যদি অর্পিত সম্পত্তির সেনসাস লিস্ট প্রমাণে ব্যর্থ হন; তৃতীয়ত, ১৯৭১ সাল হতে ঘোষণামূলক মামলা দায়েরের আগ পর্যন্ত সময়ে বাদী বা তার পূর্বসূরি যদি বাংলাদেশে অবস্থান করেন; চতুর্থত, নালিশি সম্পত্তি যদি দেবোত্তর সম্পত্তি হয়ে থাকে; পঞ্চমত, অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ইস্টোপেল নীতি প্রযোজ্য হবে না।

তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ঘোষণামূলক মামলায় ডিফেন্সের কারণ বিবেচনা করা হলেও অর্পিত মামলায় এই সুযোগ নেই। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকালে চিহ্নিত সমস্যাগুলো হচ্ছে -১। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজের কিছু সিদ্ধান্ত বা রায় আইনগত কারণে পরবর্তী আপিলের সুযোগ হতে বঞ্চিত রয়েছে। ২। প্রকাশিত প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির (‘ক’ তফসিল) তালিকায় কিছু ভুল হওয়া এবং কিছু সম্পত্তি বাদ পড়ে যাওয়ায় জনস্বার্থে প্রকাশিত তালিকার সংশোধনী এবং বাদ পড়া সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের সংশোধন ও তালিকা প্রকাশের সময়সীমা ২০১৪ সালে শেষ হয়েছে। ৩। প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তিতে আইনের ধারা ১০-এর বিধান মোতাবেক দাবিদাররা দাবির আইনগত সময়সীমা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর এবং সংশোধনী তালিকার ক্ষেত্রে ২০১৪ শেষ হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক দাবিদার দাবি করতে পারছে না। ৪। বিদ্যমান আইনের ধারা ১৮-এর উপধারা (৪) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বা রায় প্রদানের ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে আপিলের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে বিলম্বে রায় দেয়ায় বা আদেশের সার্টিফায়েড কপি বিলম্বে দেয়ায় আইন অনুযায়ী ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে আপিল করা সম্ভব হয় না। ৫। বিদ্যমান আইনের ধারা ২৬-এর বিধান অনুযায়ী অদাবীকৃত এবং দাবি অপ্রমাণিত সম্পত্তিকে সরকারি সম্পত্তি বলা হয়েছে। কিন্তু ওই সরকারি সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধন ও নিষ্পত্তির বিষয়ে স্পষ্ট বিধান নেই।

আর শত্রু সম্পত্তি আইন সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য আপিল বিভাগ ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ (৫৮ ডিএলআর, পেজ ১৭৭) মামলায় বলেছেন ‘শত্রু সম্পত্তি একটি মৃত আইন, এর ভিত্তিতে নতুন করে কোন সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করাও বেআইনি।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]

কেন থমকে আছে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি

বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে অর্জনের গল্প

বাজেট কি গণমুখী হবে

টেকসই কৃষিতে মৌমাছি পালন

জনগণের বিশ্বাস ভেঙে নির্মিত নিষ্ক্রিয়তার সাম্রাজ্য

সাইবার ঝুঁকির চক্রে বাংলাদেশ

ছবি

কীভাবে পাকিস্তান ভারতের রাফায়েলকে পরাস্ত করল

ছবি

নজরুলের দ্রোহ চেতনার স্বরূপ সন্ধানে

পিতৃতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব ও নারীর গ-িবদ্ধতা

চিরতন ও কালীচরণ : শতবর্ষ আগে যারা আইনের মঞ্চে উঠেছিলেন

রম্যগদ্য : প্লিজ স্যার... প্লিজ, ইকটু রেহাই দ্যান...

জমি, সম্মান ও প্রতিহিংসার নির্মম রাজনীতি

জানি তিনি মোড়ল বটে, আমাদের কেন তা হতে হবে

ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আমূল সংস্কার জরুরি

বরেন্দ্রর মাটিতে আমের বিপ্লব : সম্ভাবনা ও সতর্কবার্তা

অবশেষে ‘হাসিনা’ গ্রেফতার

স্ক্যাবিস সংক্রমণের কারণ ও প্রতিরোধে করণীয়

বাস্তবমুখী বাজেটের প্রত্যাশা : বৈষম্যহীন অর্থনীতির পথে কতটা অগ্রগতি?

কৌশল নয়, এবার প্রযুক্তিতে সৌদি-মার্কিন জোট

সিউল : স্বর্গ নেমেছে ধরায়

নাচোল বিদ্রোহ ও ইলা মিত্র সংগ্রহশালা : সাঁওতাল স্মৃতি কেন উপেক্ষিত?

ছবি

অন্ধকার সত্য, শেষ সত্য নয়!

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রসঙ্গে

সিরাজ প্রামাণিক

সোমবার, ২৪ মে ২০২১

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় যে সব ব্যক্তি পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৪ সাল থেকে শত্রু সম্পত্তির নতুন নাম দেয়া হয় অর্পিত সম্পত্তি। যদিও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৩-০৩-৭৪-এর পরে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা বেআইনি মর্মে রায় প্রদান করেছেন, যা ৫৮ ডিএলআর (আপিল্যাট বিভাগ) এ ১৭৭ পৃষ্ঠাসহ অপরাপর প্রকাশনায় নজির হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সব অর্পিত সম্পত্তির মূল মালিক বা তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন তৈরি হয়। এর মধ্যে ‘ক’ তফসিলে বর্ণিত অর্পিত সম্পত্তি হচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্পিত সম্পত্তি। ‘খ’ তফসিলে বর্ণিত অর্পিত সম্পত্তি হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অর্পিত সম্পত্তি।

সরকারি গেজেটে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে তা ফেরত লাভের জন্য আবেদন করতে হবে। না করলে অর্পিত সম্পত্তি সরকারি দখলে নিয়ে তা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হবে। অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে হলে দাবিদারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। তবে বিনিময় মামলার আওতায় যারা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য তাদের ভারতে প্রদত্ত সম্পত্তির বিবরণী জমা দিতে হবে। যদিও ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কোন সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ১৯৭৪ সালের শত্রু সম্পত্তি আইন (বিলুপ্ত) ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল। ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে অর্পিত সম্পত্তি বা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার কাজ সম্পূর্ণ বেআইনি। অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক এক রায়ে হাইকোর্ট এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব অর্পিত সম্পত্তির আইনগত দাবিদার নেই, সে সম্পদ শুধু মানবিক উন্নয়নকাজে ব্যবহার করতে হবে। যেসব সম্পদ সরকারের অনুকূলে অর্পিত হয়েছে, সেসব সম্পদ ব্যবহারের জন্য আইন করতে হবে। যেসব সম্পদ আইনগত অধিকারীকে ফেরত দেয়া সম্ভব নয় সে ক্ষেত্রে আইনগত দাবিদারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে আইন করতে হবে। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য এক বা একাধিক বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ট্রাইব্যুনালকে আইনে (২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন) বেঁধে দেয়া সময়সীমা কঠোরভাবে মেনে চলতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ১৯৮০ সালের ১৮ জুনের পর থেকে তালিকা করার কাজে নিয়োজিত থাকা আদালত অবমাননার শামিল। রায়ে আরও বলা হয়, ২০০১ সালের আইনকে (২০১৩ সালে সংশোধিত) কার্যকর করতে হলে ১৯৭৪ সালের আইন ও ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশের আংশিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে নতুন আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিজ্ঞ ট্রাব্যুনালকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যার সমাধান আইনে নেই।

যেমন- প্রথমত, অ্যাবেটেড মামলার বাদীর নাম যদি ২০১২ সালের তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে নালিশি সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয়, তৎক্ষেত্রে বাদীর কী প্রতিকার তা আইনে বলা নেই। দ্বিতীয়ত, প্রকাশিত তালিকায় যদি কোন ভুল থাকে সেই ভুল সংশোধনের বিষয়ে নতুন আইনে কোন ব্যবস্থা নেই। তৃতীয়ত, নতুন আইনে দরখাস্ত মঞ্জুর হওয়ার পর প্রার্থীদের নামে লেটেস্ট রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনী বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও প্রার্থী উভয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে সংশোধন বা নামজারি প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণায়ের প্রজ্ঞাপন মূলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। চতুর্থত, একই দাগের তালিকাভুক্ত সম্পত্তি দুজন আলাদা আলাদাভাবে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করলে একটি আবেদন ইতোমধ্যে মঞ্জুর হলে অপর বিচারাধীন আবেদনটি অবমুক্ত নাকি খারিজ হবে নতুন আইনে কিছু বলা নেই। পঞ্চমত, সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস যদি একাধিক দাগ বিশিষ্ট খতিয়ানের একটি দাগ তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে খাজনা গ্রহণ না করে নতুন আইনে সমাধানমূলক নির্দেশনা নেই। ষষ্ঠত, অর্পিত আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে না পারলে ফলাফল কী হবে তা বলা নেই।

কিন্তু আইন বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি অনুসারে আইনগত ফলাফলের অনুপস্থিতি প্রতিকারবিহীন অবস্থায় থাকবে না। পক্ষান্তরে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির দাবিতে নতুন মামলা দায়ের বা দাবি উত্থাপন নিষিদ্ধ’ বিধানটি নির্দিষ্ট সময়ের পর নতুন মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নয়। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের পর প্রার্থীর বাদী হিসেবে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করতে কোন আইনগত বাধা নেই। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কিছু আইন, নির্বাহী আদেশ ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে উক্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন। আবার বিজ্ঞ বিচারিক আদালত বাদীপক্ষের ডিফেন্সের কারণগুলোর আলোকে ঘোষণামূলক মামলাসমূহ নিষ্পত্তি করতে পারবেন।

যেমন- প্রথমত, বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ না করে নালিশি সম্পত্তি অর্পিত তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করা হলে; দ্বিতীয়ত, সরকার বিবাদী যদি অর্পিত সম্পত্তির সেনসাস লিস্ট প্রমাণে ব্যর্থ হন; তৃতীয়ত, ১৯৭১ সাল হতে ঘোষণামূলক মামলা দায়েরের আগ পর্যন্ত সময়ে বাদী বা তার পূর্বসূরি যদি বাংলাদেশে অবস্থান করেন; চতুর্থত, নালিশি সম্পত্তি যদি দেবোত্তর সম্পত্তি হয়ে থাকে; পঞ্চমত, অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ইস্টোপেল নীতি প্রযোজ্য হবে না।

তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ঘোষণামূলক মামলায় ডিফেন্সের কারণ বিবেচনা করা হলেও অর্পিত মামলায় এই সুযোগ নেই। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকালে চিহ্নিত সমস্যাগুলো হচ্ছে -১। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজের কিছু সিদ্ধান্ত বা রায় আইনগত কারণে পরবর্তী আপিলের সুযোগ হতে বঞ্চিত রয়েছে। ২। প্রকাশিত প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির (‘ক’ তফসিল) তালিকায় কিছু ভুল হওয়া এবং কিছু সম্পত্তি বাদ পড়ে যাওয়ায় জনস্বার্থে প্রকাশিত তালিকার সংশোধনী এবং বাদ পড়া সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের সংশোধন ও তালিকা প্রকাশের সময়সীমা ২০১৪ সালে শেষ হয়েছে। ৩। প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তিতে আইনের ধারা ১০-এর বিধান মোতাবেক দাবিদাররা দাবির আইনগত সময়সীমা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর এবং সংশোধনী তালিকার ক্ষেত্রে ২০১৪ শেষ হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক দাবিদার দাবি করতে পারছে না। ৪। বিদ্যমান আইনের ধারা ১৮-এর উপধারা (৪) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বা রায় প্রদানের ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে আপিলের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে বিলম্বে রায় দেয়ায় বা আদেশের সার্টিফায়েড কপি বিলম্বে দেয়ায় আইন অনুযায়ী ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে আপিল করা সম্ভব হয় না। ৫। বিদ্যমান আইনের ধারা ২৬-এর বিধান অনুযায়ী অদাবীকৃত এবং দাবি অপ্রমাণিত সম্পত্তিকে সরকারি সম্পত্তি বলা হয়েছে। কিন্তু ওই সরকারি সম্পত্তির রেকর্ড সংশোধন ও নিষ্পত্তির বিষয়ে স্পষ্ট বিধান নেই।

আর শত্রু সম্পত্তি আইন সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য আপিল বিভাগ ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ (৫৮ ডিএলআর, পেজ ১৭৭) মামলায় বলেছেন ‘শত্রু সম্পত্তি একটি মৃত আইন, এর ভিত্তিতে নতুন করে কোন সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করাও বেআইনি।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]

back to top