alt

উপ-সম্পাদকীয়

টিকটক : সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৬ জুন ২০২১

ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি তরুণী নির্যাতনের টিকটক ভিডিও প্রচার হওয়ার পর মানবপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যাদের পাচার করা হয়েছিল তাদের টিকটক মডেল করে দেয়ার লোভ দেখানো হয়েছিল। এই টোপের ফাঁদে যারা পা বাড়িয়েছে তাদের চোরাপথে ভারতে পাঠিয়ে দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুব সমাজ ও তরুণদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য বিগো লাইভ, টিকটক, লাইকি মোবাইল অ্যাপস নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। অনেকের ধারণা, এসব অ্যাপ তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করছে, এগুলোর ব্যবহারে তাদের নীতি-নৈতিকতা বিনষ্ট হচ্ছে, পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপকভাবে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার পেছনেও এই অ্যাপগুলোর প্রভাব থাকার কথা অনেকে স্পষ্ট করে উল্লেখ করছেন। সম্প্রতি নারী পাচারের ঘটনা এবং বিদেশে অর্থপাচারের ঘটনায়ও এই অ্যাপগুলোর ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

প্রথমদিকে টিকটকের বেশিরভাগ ভিডিওতে শালীনতা ছিল; এখন বেশি ‘লাইক’ পাওয়ার জন্য অনেকেই অশালীন অঙ্গভঙ্গি ও স্ল্যাং ভাষা ব্যবহার করছে। এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে কিছু সংখ্যক কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী স্বাভাবিক নাচ, গান ও অভিনয়ের স্থলে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির দৃশ্য ভিডিও করে আপলোড করে থাকে। হতাশাগ্রস্ত ও উচ্ছৃঙ্খল ছেলেমেয়েরা এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে নিজেদের জাহির করার প্রয়াস পায়, নিজেদের সিনেমার নায়ক-নায়িকার আসনে কল্পনা করে বিধায় অপরাধীদের প্ররোচনায় সহজেই প্রলুব্ধ হয়। শর্টকাট পথে তারকা হওয়ার ইচ্ছা উঠতি বয়সের অনেক ছেলেমেয়ের রয়েছে। অন্যদিকে টিকটকে পারফর্ম করে আয় করার সুযোগ থাকায় গরিব ঘরের মেয়েরা টিকটক ব্যবহার করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। টিকটিকে পারফর্ম করে কোটি কোটি টাকা আয়ের খবর ইন্টারনেটে রয়েছে। বিশ বছর বয়সী জম্মু-কাশ্মীরের টিকটক তারকা বসুন্ধরা পান্ডিতা ইতোমধ্যে বলিউড নায়িকাদের সমানে টক্কর দিয়ে যাচ্ছেন। ভারতে বন্ধ হওয়ার আগে টিকটকে তার ফলোয়ার সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ কোটি। টিকটক তারকা বসুন্ধরা ইতোমধ্যে ১৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

আমরা হয়তো অনেকে জানি না যে, এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে নির্মল বিনোদনের ভিডিও এবং শিক্ষামূলক বার্তা তৈরি করা সম্ভব। সৃজনশীল মেধা ও প্রতিভা বিকাশের ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম হলো টিকটক। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অসংখ্য এনজিও এক মিনিটের আকর্ষণীয় ভিডিওর মাধ্যমে শিশুদের পাঠে ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহী করে তুলছে। আমাদের দেশে যারা টিকটক করে তাদের মেধা বা প্রতিভা একেবারেই নেই তা বলা যাবে না, এক মিনিটের মধ্যে সম্পাদিত অনেকগুলো পারফর্ম অতুলনীয়। লেখাপড়া না থাকায় পাড়ার অশিক্ষিত টিকটক কিশোরেরা টিকটকেও বেপরোয়া, সৃজনশীল হওয়ার কোন তাগাদা নেই। অনেক সমাজ বিজ্ঞানী এদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য মা-বাবাকে দায়ী করেন- কিন্তু এই সব সমাজ বিজ্ঞানীদের জানা উচিত যে, এরা মা-বাবার শাসনের ধার ধারে না।

নতুন প্রজন্মের অশ্লীল কনটেন্টে আসক্তি সৃষ্টির পেছনে বিদেশি সংস্কৃতির অনুসরণকে দায়ী করা হয়, সংস্কৃতির সঙ্গে ‘অপ’ উপসর্গটি যোগ করে সংস্কৃতির বদনাম করা হয়। দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় যারা সোচ্চার তাদের আচার-আচরণেও কিন্তু বিদেশি সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কোন সংস্কৃতিই ‘অপসংস্কৃতি’ নয়। কোন দেশ বা জনতার সংস্কৃতি আমাদের অবস্থান বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য না হলেই তাকে ‘অপসংস্কৃতি’ বলা যায় না। টিকটক তো শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্য কোন দেশের কম বয়সের ছেলেমেয়েরা টিকটিক ব্যবহার করে উচ্ছন্নে যাচ্ছে বলে তো শোনা যায় না, ওই সব দেশে টিকটক ব্যবহার করে নারী বা অর্থ পাচার করা হচ্ছে বলেও জানা যায় না, ওই সব দেশে কোন মাদকসেবীকে ক্রসফায়ারিং-এ মরতে হয় না। পৃথিবীর বহু দেশে গাঁজার মতো কিছু মাদক সেবনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে, তাই বলে দেশগুলোর যুবক সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। ১৯৮৯ সনে মালয়েশিয়ায় গিয়ে খোলা বাজারে মদ বিক্রি হতে দেখেছি, মালয়েশিয়া তো মাতালে ভরে যায়নি। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর সব আবিষ্কার কিন্তু আমাদের কথিত অপসংস্কৃতির দেশগুলোতেই হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে অপসংস্কৃতি রোখার এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৪০ হাজার টাকায় স্বামী তার স্ত্রীকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে যাচ্ছে। আমরা যারা নীতিকথা বলি তাদের মানতে হবে যে, পেটে ভাত না থাকলে বুভুক্ষুর কাছে সতীত্বের গুরুত্ব থাকে না। পরকালের দোজখের ভয় আর ইহকালের জীবন ও সতীত্বের ঝুঁকি ক্ষুধার্তের কাছে মূল্যহীন, নীতি আর মূল্যবোধের গালভরা উপদেশ তাৎপর্যহীন। টিকটক একটি উছিলা, টিকটক আসার আগেও নারী পাচার হয়েছে, ভারত এবং পাকিস্তানের পতিতালয়ে বাঙালি নারীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য সেটেলাইট লাগে না। বর্তমান সরকারের আমলে চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমলেও এখনও ১২ শতাংশ লোকের থাকার কোন আশ্রয় নেই, খাবারের সামান্যতম নিশ্চয়তাও নেই। তাই এরা জীবন ও জীবিকার মিথ্যা আশ্বাসে দালাল চক্রের হাতের ক্রীড়নক হয়ে টিকটক করছে, নায়িকা আর মডেল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, অধিক সম্পদের লালসায় বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সব সমস্যার মূল কারণ জনসংখ্যার আধিক্য। সীমিত সম্পদের ছোট্ট একটি ভূখন্ডে এত লোকের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব বলে মনে হয় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা না গেলে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধের কোন পরামর্শই কাজে আসবে না। কাজ যে পরিমাণে সৃষ্টি হচ্ছে তারচেয়ে অধিক সংখ্যায় লোক বাড়ছে, রাষ্ট্র জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা নিয়ে যুবসমাজের সম্মুখে আশ্বাস সৃষ্টি করতে পারছে না। যুবকদের সম্মুখে সেই লোকই মডেল যার সম্পদ আছে, ক্ষমতা আছে, অবৈধ সম্পদে বিলাসি জীবন আছে। ধর্ম দেখায় পরকালের ভয়, রাষ্ট্র দেখায় আইন আর পুলিশের ভয়; অথচ টিকে থাকার তীব্র লড়াইয়ে হেরে গেলে জীবন-জীবিকার কী হবে তার কোন নির্দেশনা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নেই। এত অভাবের মধ্যেও কিছু লোক অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে কিছু লোক শুধু আইন ভাঙ্গছে না, তারা অবৈধ সম্পদের মহিমায় সমাজের সমীহ আদায় করতে সমর্থ হচ্ছে; কারণ এরা মসজিদ করে, মন্দির বানায়, উপসনালয়ের সভাপতি হয়ে পরকালের সুখও নিশ্চিত করতে চায়।

পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অফিস হয়, মসজিদ হয়, মন্দির হয়, হয় না শুধু লাইব্রেরি। ভোট প্রার্থীদের টাকায় মাদ্রাসা হয়, মক্তব হয়, হয় না কোন বিজ্ঞানাগার। ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় কিশোর, যুবকদের খেলার মাঠ নেই, ব্যায়ামাগার নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই, সৃজনশীল বিকাশের কোন পরিকল্পনাও নেই। পাড়ায় অ্যাম্বুলেন্স ঢুকার রাস্তা নেই, আছে বস্তির মতো ইটের দালান; চিপা গলিতে শুধু মানুষ আর মানুষ। জীবনমানের উন্নয়ন না হলে, দারিদ্র্য বিমোচন না হলে, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার না হলে টিকটক বন্ধ করে দিলেও নারী পাচারকারী থাকবে, কিশোর গ্যাং মাস্তানি করবে, দুর্নীতিবাজের টাকা বিদেশে যাবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

টিকটক : সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২৬ জুন ২০২১

ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি তরুণী নির্যাতনের টিকটক ভিডিও প্রচার হওয়ার পর মানবপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যাদের পাচার করা হয়েছিল তাদের টিকটক মডেল করে দেয়ার লোভ দেখানো হয়েছিল। এই টোপের ফাঁদে যারা পা বাড়িয়েছে তাদের চোরাপথে ভারতে পাঠিয়ে দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুব সমাজ ও তরুণদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য বিগো লাইভ, টিকটক, লাইকি মোবাইল অ্যাপস নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। অনেকের ধারণা, এসব অ্যাপ তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করছে, এগুলোর ব্যবহারে তাদের নীতি-নৈতিকতা বিনষ্ট হচ্ছে, পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপকভাবে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার পেছনেও এই অ্যাপগুলোর প্রভাব থাকার কথা অনেকে স্পষ্ট করে উল্লেখ করছেন। সম্প্রতি নারী পাচারের ঘটনা এবং বিদেশে অর্থপাচারের ঘটনায়ও এই অ্যাপগুলোর ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

প্রথমদিকে টিকটকের বেশিরভাগ ভিডিওতে শালীনতা ছিল; এখন বেশি ‘লাইক’ পাওয়ার জন্য অনেকেই অশালীন অঙ্গভঙ্গি ও স্ল্যাং ভাষা ব্যবহার করছে। এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে কিছু সংখ্যক কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী স্বাভাবিক নাচ, গান ও অভিনয়ের স্থলে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির দৃশ্য ভিডিও করে আপলোড করে থাকে। হতাশাগ্রস্ত ও উচ্ছৃঙ্খল ছেলেমেয়েরা এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে নিজেদের জাহির করার প্রয়াস পায়, নিজেদের সিনেমার নায়ক-নায়িকার আসনে কল্পনা করে বিধায় অপরাধীদের প্ররোচনায় সহজেই প্রলুব্ধ হয়। শর্টকাট পথে তারকা হওয়ার ইচ্ছা উঠতি বয়সের অনেক ছেলেমেয়ের রয়েছে। অন্যদিকে টিকটকে পারফর্ম করে আয় করার সুযোগ থাকায় গরিব ঘরের মেয়েরা টিকটক ব্যবহার করতে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। টিকটিকে পারফর্ম করে কোটি কোটি টাকা আয়ের খবর ইন্টারনেটে রয়েছে। বিশ বছর বয়সী জম্মু-কাশ্মীরের টিকটক তারকা বসুন্ধরা পান্ডিতা ইতোমধ্যে বলিউড নায়িকাদের সমানে টক্কর দিয়ে যাচ্ছেন। ভারতে বন্ধ হওয়ার আগে টিকটকে তার ফলোয়ার সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ কোটি। টিকটক তারকা বসুন্ধরা ইতোমধ্যে ১৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

আমরা হয়তো অনেকে জানি না যে, এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে নির্মল বিনোদনের ভিডিও এবং শিক্ষামূলক বার্তা তৈরি করা সম্ভব। সৃজনশীল মেধা ও প্রতিভা বিকাশের ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম হলো টিকটক। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অসংখ্য এনজিও এক মিনিটের আকর্ষণীয় ভিডিওর মাধ্যমে শিশুদের পাঠে ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহী করে তুলছে। আমাদের দেশে যারা টিকটক করে তাদের মেধা বা প্রতিভা একেবারেই নেই তা বলা যাবে না, এক মিনিটের মধ্যে সম্পাদিত অনেকগুলো পারফর্ম অতুলনীয়। লেখাপড়া না থাকায় পাড়ার অশিক্ষিত টিকটক কিশোরেরা টিকটকেও বেপরোয়া, সৃজনশীল হওয়ার কোন তাগাদা নেই। অনেক সমাজ বিজ্ঞানী এদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য মা-বাবাকে দায়ী করেন- কিন্তু এই সব সমাজ বিজ্ঞানীদের জানা উচিত যে, এরা মা-বাবার শাসনের ধার ধারে না।

নতুন প্রজন্মের অশ্লীল কনটেন্টে আসক্তি সৃষ্টির পেছনে বিদেশি সংস্কৃতির অনুসরণকে দায়ী করা হয়, সংস্কৃতির সঙ্গে ‘অপ’ উপসর্গটি যোগ করে সংস্কৃতির বদনাম করা হয়। দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় যারা সোচ্চার তাদের আচার-আচরণেও কিন্তু বিদেশি সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কোন সংস্কৃতিই ‘অপসংস্কৃতি’ নয়। কোন দেশ বা জনতার সংস্কৃতি আমাদের অবস্থান বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য না হলেই তাকে ‘অপসংস্কৃতি’ বলা যায় না। টিকটক তো শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্য কোন দেশের কম বয়সের ছেলেমেয়েরা টিকটিক ব্যবহার করে উচ্ছন্নে যাচ্ছে বলে তো শোনা যায় না, ওই সব দেশে টিকটক ব্যবহার করে নারী বা অর্থ পাচার করা হচ্ছে বলেও জানা যায় না, ওই সব দেশে কোন মাদকসেবীকে ক্রসফায়ারিং-এ মরতে হয় না। পৃথিবীর বহু দেশে গাঁজার মতো কিছু মাদক সেবনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে, তাই বলে দেশগুলোর যুবক সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। ১৯৮৯ সনে মালয়েশিয়ায় গিয়ে খোলা বাজারে মদ বিক্রি হতে দেখেছি, মালয়েশিয়া তো মাতালে ভরে যায়নি। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর সব আবিষ্কার কিন্তু আমাদের কথিত অপসংস্কৃতির দেশগুলোতেই হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে অপসংস্কৃতি রোখার এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৪০ হাজার টাকায় স্বামী তার স্ত্রীকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে যাচ্ছে। আমরা যারা নীতিকথা বলি তাদের মানতে হবে যে, পেটে ভাত না থাকলে বুভুক্ষুর কাছে সতীত্বের গুরুত্ব থাকে না। পরকালের দোজখের ভয় আর ইহকালের জীবন ও সতীত্বের ঝুঁকি ক্ষুধার্তের কাছে মূল্যহীন, নীতি আর মূল্যবোধের গালভরা উপদেশ তাৎপর্যহীন। টিকটক একটি উছিলা, টিকটক আসার আগেও নারী পাচার হয়েছে, ভারত এবং পাকিস্তানের পতিতালয়ে বাঙালি নারীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য সেটেলাইট লাগে না। বর্তমান সরকারের আমলে চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমলেও এখনও ১২ শতাংশ লোকের থাকার কোন আশ্রয় নেই, খাবারের সামান্যতম নিশ্চয়তাও নেই। তাই এরা জীবন ও জীবিকার মিথ্যা আশ্বাসে দালাল চক্রের হাতের ক্রীড়নক হয়ে টিকটক করছে, নায়িকা আর মডেল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, অধিক সম্পদের লালসায় বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সব সমস্যার মূল কারণ জনসংখ্যার আধিক্য। সীমিত সম্পদের ছোট্ট একটি ভূখন্ডে এত লোকের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব বলে মনে হয় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা না গেলে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধের কোন পরামর্শই কাজে আসবে না। কাজ যে পরিমাণে সৃষ্টি হচ্ছে তারচেয়ে অধিক সংখ্যায় লোক বাড়ছে, রাষ্ট্র জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা নিয়ে যুবসমাজের সম্মুখে আশ্বাস সৃষ্টি করতে পারছে না। যুবকদের সম্মুখে সেই লোকই মডেল যার সম্পদ আছে, ক্ষমতা আছে, অবৈধ সম্পদে বিলাসি জীবন আছে। ধর্ম দেখায় পরকালের ভয়, রাষ্ট্র দেখায় আইন আর পুলিশের ভয়; অথচ টিকে থাকার তীব্র লড়াইয়ে হেরে গেলে জীবন-জীবিকার কী হবে তার কোন নির্দেশনা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নেই। এত অভাবের মধ্যেও কিছু লোক অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে কিছু লোক শুধু আইন ভাঙ্গছে না, তারা অবৈধ সম্পদের মহিমায় সমাজের সমীহ আদায় করতে সমর্থ হচ্ছে; কারণ এরা মসজিদ করে, মন্দির বানায়, উপসনালয়ের সভাপতি হয়ে পরকালের সুখও নিশ্চিত করতে চায়।

পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অফিস হয়, মসজিদ হয়, মন্দির হয়, হয় না শুধু লাইব্রেরি। ভোট প্রার্থীদের টাকায় মাদ্রাসা হয়, মক্তব হয়, হয় না কোন বিজ্ঞানাগার। ঢাকা শহরের পাড়ায় পাড়ায় কিশোর, যুবকদের খেলার মাঠ নেই, ব্যায়ামাগার নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই, সৃজনশীল বিকাশের কোন পরিকল্পনাও নেই। পাড়ায় অ্যাম্বুলেন্স ঢুকার রাস্তা নেই, আছে বস্তির মতো ইটের দালান; চিপা গলিতে শুধু মানুষ আর মানুষ। জীবনমানের উন্নয়ন না হলে, দারিদ্র্য বিমোচন না হলে, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার না হলে টিকটক বন্ধ করে দিলেও নারী পাচারকারী থাকবে, কিশোর গ্যাং মাস্তানি করবে, দুর্নীতিবাজের টাকা বিদেশে যাবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top