জ্যোতির্ময় ধর
বিদ্যাসাগর বাঙালির বিস্ময়। তিনি এক অখ্যাত গ্রামের খুব সাধারণ ঘর থেকে এসেছেন, কিন্তু অত্যন্ত অসাধারণ হয়ে উঠেছেন তার পান্ডিত্য, সাহিত্যকীর্তি, ব্যক্তিত্ব, প্রতিভার জন্যই শুধু নয়, সমাজ সংস্কারকরূপে যারা এসেছেন তাদের মধ্য অন্যতম বলেই শুধু নয়, সেই প্রায় অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের যুক্তিহীন অনড় অচল নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা কালের সঙ্গে তাল রাখতে না পারা পিছিয়ে পড়া জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করে তিনি যুক্তিবাদের কথা বলেছেন, মনুষ্যত্বকে খর্ব করে দেয়, এমন দেশাচার ও কালাচারের ঊর্ধ্বে উঠতে চেয়েছেন, কঠিন অধ্যবসায় সহকারে যুক্তি পারস্পর্যের মধ্যে দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে এসেছেন, সাড়ম্বরে তা ঘোষণা করেছেন, তার মত প্রতিষ্ঠায় চমৎকার মরণপণ সংগ্রাম করেছেন, বক্তব্যে ছিল তার ঋজু ও সুস্পষ্টতা, ছিল তার তীব্র বিশেষণ ক্ষমতা, সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ পেলে কোন কিছু তিনি গ্রহণ করেছেন, না পেলে করেছেন বর্জন, পরিচয় দিয়েছেন প্রখর বাস্তববোধের এবং এ সমস্তের মূলে ছিল তার বিজ্ঞানমনষ্কতা।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞানমস্কতা, বিজ্ঞান ভাবনা ও চেতনা নিয়ে বড় একটা আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। তাকে একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজবিজ্ঞানী বলতে কি পারা যায় না? জনসাস্থ্য বিষয়ক চেতনাও ছিল তার মধ্যে, তার কাজে, তার লেখায়। তিনি মূলত সাহিত্যের লোক। সাহিত্যে তার কীর্তি ও অবদান কালজয়ী। কিন্তু বিজ্ঞানের অমল আলোয় উদ্ভাসিত ছিল তার হৃদয়। যে কালে তিনি জন্মেছিলেন, সেই কাল ছাড়িয়ে, ছাপিয়ে উঠেছিল তার মাথা। মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারণার আঘাত হেনেছিলেন। ছিলেন অতি আধুনিক।
বিদ্যাসাগর তাই তার কালে এবং এখন আমাদের এই কালেও এক পুরোধা পুরুষ, যিনি লোকাচারের অন্ধবদ্ধ ক্ষয়িষ্ণু মায়া-মমতাহীন, নিষ্প্রাণ নিষ্ঠুর প্রচলিত ছকের বাইরে সমাজ ও জাতিকে পথ দেখান, ধরে থাকেন অগ্রগতির অনির্বাণ মশাল।
আশ্চর্য এই যে আচারে, ব্যবহারে, আহারে, পরিধানে, জীবনযাত্রায় তিনি শতকরা ১০০ ভাগ বাঙালি। বাঙালি তো ভীরু, দুর্বল, লঘুমতি, অব্যবস্থিত চিত্ত, স্বপ্নবিলাসী! এ সবের এক কণাও বিদ্যাসাগরের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি। বাঙালি মনীষার অন্তরের অন্তঃস্তলে হিমালয় ছাড়িয়ে যাবার যে কল্পনা, বিদ্যাসাগর তার বাস্তব রূপ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন, হৃদয় ও বুদ্ধিবৃত্তির মিলিত বিকাশ দেখি তাঁর খর্বকায় দৃঢ় ঋজু চরিত্রে, বাঙালির মধ্যে যুগোপযোগী এক স্বতন্ত্র উজ্জ্বল আবির্ভাব। জাতীয় উজ্জীবনের প্রেতনাদাতৃ। পৌরুষের উদ্গাতা। কোমলে কঠোরতায় মিলিয়ে এক আদর্শ বাঙালির চিরকালীন অমল নির্দশন।
তার বিজ্ঞানমনস্কতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তার রচিত ‘জীবন চরিত” গ্রন্থ। বইটি লিখেছিলেন ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে। তার বয়স তখন ঊনত্রিশ। চেম্বার্স সংগৃহীত বহু সুপ্রসিদ্ধ পুরুষের জীবনীর যে সংকলন, তার থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়েছিলেন। মূলত অনুবাদ করেছিলেন, যদিও স্বকীয় বিশিষ্টতা, টিকা-টিপনীও রয়েছে। এই বইয়ে বেছে নিয়েছেন তিনি কাদের জীবনী? বেশিরভাগ বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী এবং এদের অনেকে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন, কারণ সত্য তাদের কাছে ছিল সব থেকে বড় ধর্ম।
বইটিতে যাদের জীবনী আছে: নিকলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, আইজাক নিউটন, উইলিয়ম হর্শেল, গ্রোশ্যস, লিনিয়স, বলন্টিন জামিরে ডুবাল, তামস জেস্কিন্স ও উইলিয়ম জোন্স। প্রচলিত তথাকথিত অভ্রান্ত ধর্মশাস্ত্রের বিধান না মেনে কোপার্নিকাস বলেছিলেন পৃথিবী সূর্য্যরে চারিদিকে ঘোরে, গালিলিয়ও তাই প্রমাণ করেছিলেন, এর ফলে তাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। শেষ জীবনে যদিও তিনি অন্ধ বধির হয়ে গিয়ে ছিলেন তাহলেও তার বিজ্ঞানসঞ্জাত বিশ্বাস ত্যাগ করেনি গালিলিয়। মাধ্যাকর্ষণ সঙ্গে নিউটনের নাম অভিন্নভাবে জড়িত। তিনি আলোক ও বর্ণ দুই পদার্থের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন, ভৌতবিদ্যার আরও অনেক প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন। উইলিয়াম হার্শল আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের জনক। গতিশাস্ত্রে পারদর্শী গ্রোশ্যস ‘সর্বতন্ত্র পক্ষীয়’ (যেখানে রাজা নাই, সর্বসাধারণ লোকের মতানুসারে যাবতীয় রাজকার্য নির্বাহ হয়) সমর্থন করতে বলে জেলে গিয়েছিলেন, চিকিৎসক লিনিয়ন জীবজগত ও উদ্ভিদজগতের বিজ্ঞানানুযায়ী নতুন নামকরণ করেন। ডুবাল ছিলেন জ্যোতিষ, ভূগোল, পুরাবৃত্ত ও পৌরাণিক বিশারদ। জেষ্কিস-আফ্রিকা দেশীয় কোন রাজার পুত্র ছিলেন ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ। স্যার উইলিয়াম জোন্স অনুবাদ করেছিলেন শকুন্তলা, মনুসংহিতা প্রভৃতির।
বিজ্ঞানীদের চরিত্র চিত্রণে ধর্মের উপর সত্যের স্থান বিদ্যাসাগরও তার রচনায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এক জায়গায় তিনি লিখছেন: “গ্রোশ্যস অত্যন্ত কুৎসিত সময়ে ভূমন্ডলে আসিয়াছিলেন। ওই কালে জনসমাজ ধর্ম ও দন্ডনীতিবিষয়ক বিষম বিসংবাদ দ্বারা সাতিশয় বিসস্কুল ছিল। মনুষ্যমাত্রই ধর্মসংক্রান্ত বিবাদে উন্মত্ত এবং ভিন্ন ভিন্ন পক্ষের ঔদ্ধতা ও কলহপ্রিয়তা দ্বারা সৌজন্য ও দয়া দক্ষিণ্য একান্ত বিলুপ্ত হইয়াছিল”
বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। সাধারণ মানুষ যে বিজ্জান সচেতন এটি তার প্রমাণ। বিদ্যাসাগর সেই সচেতনতা যাতে ছড়িয়ে যায় তার জন্যই এ রকম পুস্তক রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ছয় মাসের মধ্যে বইটির প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। অন্য একদিক দিয়ে জীবনচরিত গ্রন্থটির গুরুত্ব আছে। বিদ্যাসাগর দুরূহ বিজ্ঞানবিষয়ক ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা বেশকিছু সন্নিবেশিত করেছেন পুস্তকটি শেষাংশে। যেমন অস্থিত পাটিগণিত-Arethmetic of Infinites, উদ্ভিদবিদ্যা- Botaû, কক্ষ- Orbit, কেন্দ্র- Centre, গণিত- Mathematics, গবেষণা- Research, গ্রহণীহারিকা- Planatary Nebulae, ছায়াপথ- MilKy Way, দূরবীক্ষণ- Telescope, দৃষ্টিবিজ্ঞান - Optics, স্থিতিস্থাপক- Elusticity প্রভৃতি। এ সবের মধ্যে কতকগুলো তো কাব্যের মতো মনোরম, যেমন গ্রহনীহারিকা, ছায়াপথ প্রভৃতি। বঙ্গভাষায় গদ্যের সেই সবের আধুনিক যাত্রা। সেকালে তিনি পরিভাষার চিন্তাও করে গেছেন এবং নিজে এ বিষয়ে হাত লাগিয়েছেন। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার যে ধ্বনি তুলেছিলেন কুদরাৎ-এ-খুদা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু তার নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে একটি যে পরিভাষা সমস্যা ছিল তার উল্লেখ অনেকেই করেছেন। অথচ তাদের বহু আগে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তার সাধ্যমতো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এই ছোট্ট কথাটুকু ভুলে গেলে চলবে না।
হাজার হোক, জীবনচরিত অনুবাদ গ্রন্থ। বিজ্ঞানের প্রতি তার অকৃত্রিম অনুরাগের আর একটি প্রমাণ-“বোধোদয়” গ্রন্থটি (প্রথম প্রকাশ ১৮৮১)। এটি পরিণত বয়সের লেখা। তার জীবৎকালেই ৯৬টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে রয়েছে চেতন পদার্থ, ঈশ্বর, পদার্থ, মানবজাতি, পঞ্চ ইন্দ্রীয় (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) প্রভৃতির কথা, গণনা-অঙ্ক, নানা বস্তুর বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ণনা (যেমন ধাতু, সোনা, রূপা, পারদ, সীসা, তামা, লোহা, রাঙ, দস্তা প্রভৃতি), হীরা, কাচ, ক্রয়-বিক্রয়, জল-নদী-সমুদ্র-উদ্ভিদ প্রভৃতি প্রভৃতি।
বর্ণনাগুলো পড়লে বিদ্যাসাগরের অন্য একটি গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। তার ছিল প্রখর বাস্তববোধ। বইটিতে রয়েছে কৃষিকর্ম, শিল্প-বাণিজ্য-সমাজের কথাও।
আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। যখন তার বর্ণনার কোন ভুল কেউ দেখিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা সংশোধন করেছেন এবং যারা ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে যেমন আছেন মুসলমান শ্রীযুক্ত মহম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহম্মদ মহাশয়, তেমনই আছেন ডাক্তার চন্দ্রমোহন ঘোষ মহাশয় প্রমুখ। একটি সংস্করণের বিজ্ঞাপনে উলেখ করেছেন ওদের নাম। এতে মনে হয়, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি হতেও তিনি মুক্ত ছিলেন।
আপাদমস্তক বিজ্ঞানের বই ‘বোধোদয়’: বোধোদয় বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান-নির্ভর আর একটি পুস্তক। আগেই বলেছি এটিতে ভৌতবিজ্ঞান, গণি, জীবনবিজ্ঞান, ভূগোলবিদ্যা ইত্যাদিরই প্রাধান্য। বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন এমন পাঠ্যই প্রয়োজনীয়। সে পাঠ্যে আছে পদার্থ, চেতন পদার্থ, মানবজাতি, স্বপ্ন, মৃত্যু, শিক্ষা, ইন্দ্রীয়, বাক্যকথন-ভাষা, কাল, গণনা-অঙ্ক, বর্ণ, বস্তুর আকার পরিমাণ, ধাতু, হীরক, কাচ, ক্রয়বিক্রয় মুদ্রা, জল-নদী-সমুদ্র, উদ্ভিদ, ইতর জন্তু, কয়লা, কৃষিকাজ প্রভৃতির কথা। পাঠ্য হিসেবে সে সময়ে এ একেবারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এ-কথা মনে রাখা ভালো বোধোদয় Rudiments of Knowledge থেকে নেয়া হলেও তার অনুবাদ নয়। আর তা যে অন্য কল্পনাশ্রয়ী গল্প পাঠের চেয়ে উপকারের হবে সে বিষয়ে বিদ্যাসাগরের কোনো সংশয় ছিল না। তাই, বোধোদয়-এর বিজ্ঞাপনে ঈশ্বরচন্দ্রকে লিখতে দেখি-
‘বোধোদয় নানা ইংরেজি পুস্তক হইতে সংকলিত হইল, পুস্তক বিশেষের অনুবাদ নহে। যে কয়টি বিষয় লিখিত হইল, বোধ করি, তৎপাঠের অমূলক কল্পিত গল্পের পাঠ অপেক্ষা অধিকতর উপকার দর্শিবার সম্ভাবনা। অল্পবয়স্ক সুকুমারমতি বালক বালিকারা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেক, এই আশয়ে অতি সরল ভাষায় লিখিবার নিমিত্তে সবিশেষ যত্ন করিয়াছি; কিন্তু কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না। মধ্যে মধ্যে অগত্যা, যে যে প্রচলিত দুরূহ শব্দের প্রয়োগ করিতে হইয়াছে, পাঠকবর্গে বোধসৌকার্যার্থে, পুস্তকের শেষে সেই সব শব্দের অর্থ লিখিত হইল। অক্ষণে, বোধোদয় সর্বত্র পরিগৃহীত হইলে, শ্রম সফল বোধ করিব।
শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা’, কলিকাতা, ২০ শেষ চৈত্র, সং বৎ ১৯০৭। গোপাল হালদার সম্পাদিত বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভারের অন্তর্গত বোধোদয় প্রথমবারের বিজ্ঞাপন এমনটাই। প্রথমনাথ বিশী সম্পাদিত বিদ্যাসাগর রচনাসম্ভারের প্রথমবারের বিজ্ঞাপনটিও অনুরূপ।
দ্বিতীয় মুদ্রণের ‘প্রথম বারের বিজ্ঞাপনের দ্বিতীয় বাক্যে ‘যে কয়টির পরিবর্তে ‘যে কয়েকটি’, ‘অধিকতর উপকার দর্শিবার সম্ভাবনা’র বদলে ‘অনেক উপকার দর্শিতে পারিবেক’ রয়েছে। তৃতীয় বাক্যে ‘বুঝিতে পারিবেক’ এর বদলে ‘বুঝিতে পারিবে’, ‘সবিশেষ যত্নের বদলে ‘বিশেষ যত্ন’ রয়েছে। চতুর্থ বাক্যে ‘দুরূহ শব্দের প্রয়োগ’ বদলে হয়েছে ‘দুরূহ শব্দ প্রয়োগ’। ভাষাকে সরল করার যে বাসনা প্রতিনিয়ত তার মধ্যে ছিল সেই জায়গা থেকেই প্রথমবারের বিজ্ঞাপনের এই সংশোধন তিনি নিজেই দ্বিতীয় মুদ্রণে করেছিলেন বলে ধারণা। দ্বিতীয়বারের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছেন- ‘বোধোদয় প্রথমবার যে রূপ মুদ্রিত হইয়াছিল প্রায় তাহাই রহিল, কেবল কোন কোন স্থানে ভাষার কিছু পরিবর্ত্ত করা গিয়াছে, যে যে স্থানে ভুল ছিল সংশোধিত হইয়াছে আর সুসংলগ্ন করিবার নিমিত্ত কয়েকটি প্রকরণের ক্রম বিপর্যয় করা গিয়াছে।
শ্রী ঈশ্বর চন্দ্রে শর্ম্মা’ কলিকাতা ১৯ এ ফাল্গুন, সং বৎ ১৯০৮। বোধোদএর প্রথম রচনা ‘পদার্থ’। বিশ্ব পদার্থময়। সুতরাং পদার্থ চেনানো গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আসে চেতন অচেতন আর উদ্ভিদ এই তিন ধরনের পদার্থের কথা। এখন আমরা পদার্থকে জড় আর জীব এই দু’ভাগে ভাগ করি। উদ্ভিদ বিষয় তখনও নানা সংশয় মিটে যায়নি। তাই এই সাবধানী প্রয়াস তার। পরে ‘চেতন পদার্থ’ বিষয়ে লেখাটি দীর্ঘ। সেখানে প্রাণীদের (জন্তু!) স্থলচর, জলচর, উভয়চর বিভাগ হয়। মানুষ যে বুদ্ধি ও ক্ষমতার গুণে সর্বপ্রধান প্রাণী তার উল্লেখ থাকে সযত্নে। তাদের খাদ্যসহ জীবনের অন্যান্য উপকরণ আলোচনায় আসে। আসে পাখির কথা, তাদের জীবনযাত্রা, মাছেদের কথা, সরীসৃপের কথা, ব্যাঙ-পতঙ্গ-মনকি আনুবীক্ষণিক ক্ষুদ্র কীটের কথাও। পরম যত্নে ছাত্র-ছাত্রীদের জানানো হয় স্তন্যপায়ী জন্তুদের কথা। পাঠক জেনে যান বাদুড় উড়লেও পাখি নয়, চিংড়ি আর তিমি মোটেও মাছ নয়।
সবার কথা জানা হলো কিন্তু বিশেষ করে জানা দরকার তো নিজেদের কথা। তাই ‘মানবজাতি’ রচনা উঠে আসে। সে রচনা মানুষের আর সমাজের নানা কথায় পূর্ণ। মানুষ যে সমাজ তৈরি করা ছাড়া থাকতে পারে না , আসে সে কথাও । পাঁচ ইন্দ্রীয় মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উৎস তাই তাদের বিস্তৃত আলোচনা বোধোদয়ে। আর সপ্ন। তার ব্যাখ্যা তখনও আসেনি বিদগ্ধ মহল থেকে। তাই এ আলোচনায় বিদ্যাসাগর স্পষ্ট আর নির্মম। ‘স্বপপ অমূলক চিন্তামাত্র, কার্যকারক নহে’। তেমনি মৃত্যু রচনায় তার বাস্তববাদী মন বলে ওঠে।
মরণের অবধারিত কাল নাই.. কেহই অমর নহে। সবাই মরিতে হইবে। বস্তুর আকার আর পরিমাণ চর্চাও আছে বোধোদয়-এ, যা ভৌত বিজ্ঞানের অন্যতম পাঠ্য, সেখানে দৈর্ঘ্য, বিস্তা (প্রস্থ) ও বেধ (উচ্চতা) এর ধারণা সঙ্গে ভারী আর হাল্কা, উচ্চতা-গভীরতার জ্ঞানও সহজ ভাষায় রাখা আছে। মৌল বস্তু মাত্রই ধাতু বা অধাতু। আট রকম ধাতু বিষয়ে আলোচনা আছে বোধেদয়-এ-যেগুলোকে বলা হয়েছে প্রধান ধাতু। সেগুলো হলো স্বর্ণ, রৌপ্য, পারদ, সীসা, র, লৌহ, বঙ্গ (বা টিন) এবং দস্তা। পারদ যে ধাতু হলেও তরল তা জানিয়ে দিতে ভুল হয়নি। দস্তা সম্পর্কে বলার সময় অ্যালয় বা সঙ্কর ধাতু সম্পর্কে ধারণাও দেয়া হয়েছে। অ্যালয় হলো নির্দিষ্ট অনুপাতে দুটি ধাতুর বিগলিত অবস্থায় সমস্বত্ব মিশ্রণ। পিতল হলো দস্তা বা জিঙ্ক এবং তামা বা কপারের একটি অ্যালয়। ‘তিন ভাগ দস্তা ও চারি ভাগ মাতা মিশ্রিত করিলে পিতল হয়। তামায় যত শীঘ্রই মরিচা ধরে, পিতলে তত শিগগির ধরে না একথা বোধোদয়েরই।
বোধোদয়ের রচনায় বিজ্ঞান শিক্ষার-ই প্রাধান্য। কিন্তু অবকাশ পেলে বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ-দর্শনের শিক্ষা দিতেও তার কলম পিছিয়ে থাকেনি। হীরক বিষয়ে আলোচনার কয়েকটি কথা উল্লেখ করলে এ বক্তব্যের যথার্থতা বোঝা যাবে। এ পর্যন্ত যত বস্তু রহিয়াছে, হীরা সকল অপেক্ষা কঠিন... বিবেচনা করিয়া দেখিলে হীরা অতি অকিঞ্চিতকর পদার্থ। ঔজ্জ্বল্য ব্যতিরিক্ত উহার আর কোন গুণ নাই। কাচ কাটা বই আর কোন বিশেষ প্রয়োজনে আইসে না, এরূপ একখ- গৃহে রাখিবার নিমিত্ত অত অর্থ ব্যয় করা কেবল মনের অহঙ্কার প্রদর্শন ও মূঢ়তা মাত্র। ...ইহা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, এই মহামূল্য প্রস্তর ও কয়লা, দুই-ই এক পদার্থ।
বোধোদয়ে ভুগোলবিদ্যার শিক্ষা রয়েছে অনেকটা জুড়েই। কাল, দিনরাত্রি, মাস, ঋতু, বৎসর প্রভৃতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জল-নদী সমুদ্রের কথা। জোয়ার ভাটার কথা। রয়েছে জলচক্রের কথাও। পাথরিয়া কয়লা ও কেরাসিন তেলের মত সম্পদের কথা শিক্ষার্থীদের জানানোর সঙ্গে জানানো হয়েছে কৃষিকাজ তার গুরুত্ব আর কৃষিসম্পদের কথাও।
প্রাণিবিদ্যার বহু বিষয়র আলোচনা রয়েছে ‘চেতন বস্তু’ অংশে যা আগেই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু উদ্ভিদবিদ্যার ও আলোচনা আছে বোধোদয়ে। সেখানে স্বভোজী ও পরভোজী উদ্ভিদসহ ছত্রাকের কথাও সংযুক্ত রয়েছে। উদ্ভিদের উপকারী গুণগুলোর কথাও তুলে ধরা আছে। গবফরহরপধষ চষধহঃ এবং অ্যারোমেটিক প্যান্টের গুরুত্ব আজ শুধু আমরাই অনুভব করছি তা নয়, বিদেশেও এর চর্চা হচ্ছে। বহু আগে আমাদের চরক-শুশ্রতের সময়ে এই চর্চা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছিল। বোধেদয় সে ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি। বিভিন্ন প্রাণী থেকে আমরা অর্থকরী উৎপাদন কি কি পেতে পারি তা নিয়ে আজকাল অর্থনৈতিক প্রাণিবিদ্যা বা ‘ইকোনমিক জুলজি’ বলে প্রাণিবিদ্যার একটি নতুন শাখা জন্ম নিয়েছে। আশ্চর্যের কথা বোধোদয়ে তারও ছোঁয়া আছে। ইতর জন্তু আলোচনায় চামর, মুক্তো, লাক্ষা, রেশম, মধু, মোম প্রভৃতি পাওয়ার কথা সহজভাবেই এসেছে। দেড়শ’ বছর আগেও বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে গুরুত্ব সমানভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। বোধোদয়ে তাই বিজ্ঞান শিক্ষার নানা প্রসঙ্গে সচেতন পদচারণা। আর তারই সঙ্গে একজন সমাজসচেতন ঋজু পুরুষের ঐকান্তিক প্রয়াস, আগামী প্রজন্মকে বিজ্ঞানসচেতন করে তোলার।
বোধোদয়ের একটা সংক্ষিপ্ত চবি আগের পাতাগুলোতে হয়তো তুলে ধরা হলো। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভাগ ধরে ধরে আরো আলোচনার অবকাশ আছে। গুণী পাঠক তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন বিজ্ঞানের বিবিধ বিভাগে কি সাবলীল পদাচারণা ছিল তার।
পদার্থ বিজ্ঞান- প্রথমে পদার্থ বিজ্ঞানের কথা ধরি। চেতন, অচেতন আর উদ্ভিদ এই তিনরকমের পদার্থের কথা বিদ্যাসাগর শুনিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু চেতন বা প্রাণিজগৎ আর উদ্ভিদজগৎ বিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন আলোচনার বিভাগের বিভক্ত হবে। ভাবতই পদার্থবিজ্ঞানের পরিধিতে আসবে অচেতন বস্তু। আর আকার জানা দরকার, দরকার তার পরিমাণ কিংবা ওজন জানা। বিদ্যাসাগর তা জানাতে লিখছেন- ‘সকল বস্তুরই দৈর্ঘ্য, বিস্তার, বেধএই তিন গুণ আছে।’ আর ওজন? তার কথা বলতে বোধোদয়ের পাতায় বিদ্যাসাগরের কলম লিখছে ‘বস্তুর ভারের পরিমাপক ওজন কহে।’ এই ওজন যে ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের ক্ষেত্রে সমআকারের হলেও ভিন্ন হবে- পদার্থের এই বিশেষ গুণটি বুঝিয়ে দিতে তার ভুল হয়নি। বলেছেন, ‘সমান সমান আকারের একখ- কাষ্ঠ অপেক্ষা একখ- লৌহ অধিক ভারি।’ বোধোদয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে একটি অধ্যায় ‘বর্ণ রঙ’। সেখানে তিনি বলেন, ‘কি স্বাভাবিক, কি কৃত্রিম, উভয়বিদ পদার্থেরই নানা প্রকার বর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে যত বর্ণ আছে সবই তিনটি মাত্র মূল বর্ণ হইতে উৎপন্ন। সেই তিন মূল বর্ণ এই; নীল, পীত, লৌহিত। এই তিন মূলীভূত বর্ণকে যত ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে মিশ্রিত করা যায় ততপ্রকার বর্ণ উৎপন্ন হয়। ওই সকল বর্ণকে মিশ্র বর্ণ কহে। মিশ্র বর্ণের মধ্যে হরিত, পাঠল, ধূমল এই তিনটি প্রধান। নীল ও পীত এই দুই মূল বর্ণ মিশ্রিত করিলে হরিত বর্ণ উৎপন্ন হয়। পীত ও লোহিত এই দুই মিশ্রিত করিলে পাটল বর্ণ হয়। নীল ও লোহিত এই দুই বর্ণের মিলনে মূল বর্ণ হয়। এভাবেই মৌলিক রঙ ও যৌগিক রঙের এর পাঠ শেষ করে বিদ্যাসাগর যান মিশ্র রঙ বা টারসিয়ারী কালার বোঝাতে। বলেন, ‘তদ্ভিন্ন কপিশ, ধুসর, পিঙ্গল ইত্যাদি নানা মিশ্র বর্ণ আছে। সেসব ও ঐ তিন মূলীভূত বর্ণের মিশ্রণে উৎপন্ন হয়।’ আলোক বিজ্ঞানের পরের পাঠটি যেভাবে দ্বিতীয় সংস্করণে রয়েছে তা যথোচিত নয়। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘সৃষ্ট বর্ণের অভাব, অর্থাৎ যেখানে কোন বর্ণই নাই, সেই শুল্ক বর্ণ। আর নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারই কৃষ্ণবর্ণ।
বোধোদয়ের পরবর্তী সংস্করণে এই ভ্রম সংশোধন করে নিতে তার ভুল হয়নি। সেখানে নতুন করে ‘আলোর প্রকৃতি’ আলোর বিচ্ছুরণ’ নামে নতুন নতুন অধ্যায়ে তাকে লিখতে দেখি। সত্যি সহজ সরল ভঙ্গিতে বিজ্ঞান পরিবেশন- আজ থেকে প্রায় ১৭৭ বছর আগে দাঁড়িয়ে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞানমনস্কতার অপর প্রমাণ ধর্মসম্পর্কে তার একান্ত নিস্পৃহ মনোভাব। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাতের বিবরণ সবিস্তৃত লিপিবদ্ধ আছে শ্রী ম লিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের দ্বিতীয় খন্ডে। শ্রীরামকৃষ্ণ কোনরকমেই বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন স্থির বিশ্বাসভক্তির একটি কথাও আদায় করতে পারেনি। তিনি কোন ধর্মযাজকের কাছে ঘেঁষেননি-মন্দিরে যাননি। পূজাআর্চা জপতপ করতেন না। কিন্তু ছিলেন মানবতায় উদ্বুদ্ধ দয়ার সাগর। এত সব সত্ত্বেও বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছেন, রামকৃষ্ণের পরেই তার গুরু বিদ্যাসাগর। এ প্রসঙ্গে কাশীর পান্ডাদের প্রতি তার উত্তরও স্মরণীয়-‘সাক্ষাৎ বিশ্বেশ্বর অন্নপূর্ণা আমার জনক-জননী, তাদের প্রসাদ পাই, আমার বিশ্বনাথ দর্শণে বা গঙ্গাস্নানে কী প্রয়োজন? তবে কেউ কিছু মানলে তিনি আপত্তি করতেন না, শিবনাথ তো ছিলেন ব্রাহ্ম, তাকে ওই ধর্মমত থেকে দূরে সরিয়ে আনার কথা ভাবেননি। তার চরিত্রে পরমত সহিষ্ণুতার এ এক উজ্জ্বল নির্দশন।
বিজ্ঞানমনস্ক মন কখনও কুসংস্কার বিশ্বাস করে না। বিদ্যাসাগরও কুসংস্কার তাড়াতে চেয়েছেন দেশের মানুষের মন থেকে।
২২ জানুয়ারি ১৯৫১ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হন। এর অল্প কয়েক মাস পরে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থরা কলেজে প্রবেশাধিকার পায়। আগে কলেজে পড়ার অনুমতি ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের। এক বছরের ভিতর যে কোনও হিন্দুসন্তান কলেজে ভর্তি হতে পারবে, এই মর্মে নিয়ম জারি করা হয়।
খলিফা ওমর নাকি গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রন্থশালা পুড়িয়েছিলেন। ওই কাহিনী উলেখ করে পরিহাসছলে বিদ্যাসাগর বলছেন- ‘ভারতীয় পন্ডিতদের গোঁড়ামি ঐ আরব খলিফাদের গোঁড়ামির চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। ... ভারতবর্ষীয় পন্ডিতদের নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য গ্রহণ করিবার কোন সম্ভাবনা আছে, এমন আমার বোধ হয় না।’
বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে একটি নৃশংস কুসংস্কার কীভাবে দূর হলো বলছেন : ‘বহুকাল অবধি ব্যবহার ছিল পিতামাতা গঙ্গাসাগরে গিয়া শিশুসন্তান সাগর জলে নিক্ষিপ্ত করিতেন। তাহারা এই কর্ম ধর্মবোধে করিতে বটে, কিন্তু ধর্মশান্ত্রে ইহাব কোন বিধি নাই। গভর্নর জেনারেল বাহাদুর এই নৃশংস ব্যবহার একেবারে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত ১৮০২ সালের ২০ আগস্ট এক আইন জারি করিলেন ও তাহার পোশকতার নিমিত্ত গঙ্গাসাগরে একদল সিপাই পাঠাইয়া দিলেন। তদবধি এই নৃশংস ব্যবহার একবারে রহিত হইয়া গিয়াছে।
আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি বিদ্যাসাগরের আস্থা এখানে সুপ্রকট। মৌলবাদীরা দেশকে যে পিছনের দিকে টানছে, সেই ধারণা তখনই হয়েছে তার। কীভাবে এর মোকাবেলা করা যেতে পারে, সে বিষয়েও তিনি তার মত নিয়েছেন এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তিনি বলছেন : ‘বাংলাদেশে যেখানে শিক্ষা বিস্তার হচ্ছে সেখানেই পন্ডিতদের প্রভাব কমে আসছে। দেখা যাচ্ছে বাঙালার আধিবাসীরা শিক্ষা লাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র। ...জনসাধারণের জন্য শিক্ষা বিস্তার- এই এখন আমাদের প্রধান প্রয়োজন। ...মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ দখল প্রয়োজনীয় বহুবিদ তথ্যে যথেষ্ট জ্ঞান, দেশের কুসংস্কারের কবল থেকে মুক্তি শিক্ষকদের এই গুণগুলি থাকা চই। ...সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরা কলেজের পাঠ শেষ করে এই ধরনের লোক হয়ে উঠবে এমন আশা করবার যথেষ্ঠ কারণ আছে।’
বস্তুত শিক্ষাবিস্তারে তিনি তার মনপ্রাণ সমর্পণ করেছিলেন এবং বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তার যাতে জনসাধারণের মধ্যে প্রসার লাভ করবে শিক্ষা। তিনি জানতেন, শিক্ষা বিস্তারের অর্থই হলো কুসংস্কারের কালো হাত থেকে যুক্ত বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণ জনগণ ছিল বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবনকে বরণ করে নেবার জন্য ব্যগ্র। শিক্ষার প্রসার ও প্রচারে নানা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও তিনি একা যা করেছেন, তা আজকের দিনে বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। বীরসিংহ গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন (১৮৫৩), নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি মেদিনীপুরে ৫টি করে মডেল স্কুল স্থাপন করেছিলেন (১৮৫৫-৫৬)। স্ত্রীশিক্ষা প্রচারেও তার ভূমিকা অনুধাবনযোগ্য। হুগলি জেলায় ২০টি, বর্ধমানে ১১টি, মেদিনীপুরে ৩টি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন (১৮৫৭-৫৮)। এছাড়া প্রতিষ্ঠা করেন মুর্শিদাবাদের কাঁদিতে ইংরেজি, বাংলা স্কুল (১৮৫৯)। মৃত্যুর এক বছর আগেও (১৮৯০) বীরসিংহ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভগবতী বিদ্যালয়। সাঁওতাল পরগনার কর্মাটারে শেষ জীবনেও তিনি পাঠশালা চালাতেন সাঁওতাল পড়–য়াদের নিয়ে। শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তার প্রায় একক প্রচেষ্টার এ এক আশ্চর্য নিদর্শন।
বাঙালি মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন চন্দ্রমুখী বসু। বিদ্যাসাগর একপ্রন্থ শেক্সপিয়ার গ্রন্থাবলী উপহার দিয় তাকে একটি সুন্দর চিঠি লেখেন। এই রকম গুণ ও গুণীর সমাদর করতে তিনি জানতেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত হতে পেরেছেন কবি মধুসূদন। তিনি নিজে বাংলা গদ্যের আদিপুরুষ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বাংলাভাষায় প্রথম যথার্থ শিল্পী। সেই সঙ্গে তার উদ্যোগে পালিত হয়েছে আধুনিক বাংলা বাক্যের আবির্ভাব-মধুসুধনের কাব্যে। তার বিজ্ঞান মনস্কতাই সাহিত্যের আধুনিকতার এ ধারাকে উস্কে দিয়েছে।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান প্রীতির আর একটি প্রমাণ এখানে প্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে। নিজের জীবনযাত্রায়, আচার-আচরণে বিদ্যাসাগর ছিলেন কিঞ্চিৎ কৃপণ। একটি ব্যাপারে কৃপণতা ছিল না বই সংগ্রহ। অত্যন্ত ভালভাবে বইগুলো বাঁধাতেন। এতই ছিল প্রতি মমতা। তার থেকেও বড় কথা ১৮৭০ সালের জানুয়ারিতে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় তিনি এক হাজার টাকা দান করেছিলেন। বিজ্ঞানকে মনেপ্রাণে ভালো না বাসলেও এমনটি সম্ভব নয়।
সাহিত্যের লোক হয়ে তার বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসা নজরে পড়ার মতো এবং সে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বহুধাবিস্তৃত। বাংলা ভাষায় বলা যেতে পারে তিনি আদি বিজ্ঞান লেখক। আধুনিক বাংলা গদ্যের জন্মলগ্নেই তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, বিজ্ঞানকে সাহিত্যে অম্বিত করেছেন।
বিদ্যাসাগর চিকিৎসক ছিলেন না। কিন্তু জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে তার বিজ্ঞানভিত্তিক কতগুলো ধারণা ছিল। আর ছিল মমতামাখা বিশাল হৃদয়। এর জন্য প্রয়োজনের সময় তিনি বসে থাকতে পারেননি। কলেরা মহামারীর সময় কর্মাটারে সাঁওতালপল্লীতে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। এ সম্পর্কে পরে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, খুব সম্ভবত তার মনোভাবও ছিল তাই। রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, তার মতো সাহিত্য-ডাক্তারকে দায়ে পড়ে ভিষক-ডাক্তার হতে হয়। লিখেছেন- ‘যাদের সাধ্যগোচরে কোথাও কোন চিকিৎসার উপায় নেই। তারা যখন কেঁদে এসে পায়ে ধরে পড়ে, তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি, এত বড় নিষ্ঠুর শক্তি আমার নেই। এদের সম্বন্ধে পণ করে বসতে পারি যে পুরো চিকিৎসক নই বলে কোন চেষ্টা করব না। আমাদের এ হতভাগ্য দেশে আধা চিকিৎসকদেরও যমের সঙ্গে যুদ্ধে আড়কাঠি দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়।’ যে মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যাসাগর ওই সেবাব্রত করেছিলেন, জনস্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে তাকে স্বাগত জানাতে হয়।
বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য তার যে প্রচেষ্টা, তার অন্যতম একটি কারণ ছিল এই যে গোপন ব্যভিচারের স্ত্রোত বন্ধ হবে। জনস্বাস্থ্যের এটা একটা দিক তো বটেই। স্বাস্থ্যে মানে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাই নয়, মানসিকভাবেও সুস্থ থাকা। সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা। তাছাড়া তিনি অবশ্যই চেয়েছিলেন স্ত্রীজাতির দুঃখ লাঘব করতে। সমানাধিকার যদি স্ত্রী ও পুরুষের না থাকে, তাহলে কখনই সে জাতির স্বাস্থ্য ভালো হতে পারে না। এজন্য বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বহু বিবাহ রদ করবার জন্যও আন্দোলন করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো উচ্চশিক্ষিত সাহিত্যিকও বরাবর বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইনের ও বহু বিবাহ নিরোধক প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। সমাজের কুপ্রথার শিকড় কতদূর পর্যন্ত গেড়ে বসতে পারে এবং তা উপড়ে ফেলা কত শক্ত, এ তার একটা প্রমাণ।
‘সর্ব শুভঙ্কী’তে বিদ্যাসাগরের প্রথম সামাজিক লেখা ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্যের দিক দিয়ে নাতিদীর্ঘ এ প্রবন্ধটি অত্যন্ত মূল্যবান এবং তার প্রখর বিজ্ঞানমনস্কতা ও বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দেয়।
‘সর্ব শুভঙ্করী’ নামে একটি সভা ছিল। তার মুখপত্রেরও নাম ছিল সর্ব শুভঙ্করী। ১৮৫০ সালে ওই পত্রিকায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগরের নাম না থাকলেও তার জীবনীকার ও গবেষকগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন লেখাটি বিদ্যাসাগরের। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রেরণার উৎস।
বিদ্যাসাগরের প্রথম সামাজিক প্রবন্ধটি সম্বন্ধে অন্য একটি বক্তব্য আছে। বিধবা বিবাহ বিষয় নিয়ে লেখার আগে তিনি এই প্রবন্ধটি লিখেছেন। এটি একাধারে সমাজ সংস্কারমূলক ও জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখা। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে এখনও এ লেখা একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে।
বাল্যবিবাহের দোষ সম্পর্কে তার প্রথম বক্তব্যে, নারী-পুরুষ উভয়েই, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে মন যায়, নিজের নিজর জীবন গঠন করতে পারে না। আপনার ভাগ্য জয় করবার সাধনায় ব্রতী হতে পারে না। তাদের মেধা, শক্তি, ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ হয় না। তিনি লিখেছেন- ‘নব বিবাহিত বালক বালিকারা পরস্পরের চিত্তরঞ্জনার্থে রসালাপ, বিদগ্ধতা, বাক্চাতুরী, কামকলাকৌশল প্রভৃতির অভ্যাসকরণে ও প্রকাশকরণে সর্বদা সযতœ থাকে এবং তদ্বিষয়ে প্রয়োজনীয় উপায় পরিপাটী পরিচিন্তনেও তৎপর থাকে, সুতরাং তাহাদিগের বিদ্যালোচনার বিষম ব্যাঘাত জন্মিবাতে সংসারের সারভূত বিদ্যাধনে বঞ্চিত হইয়া কেবল মানুষের আকারমাত্রধারী, বস্তুত প্রকৃতরূপে মনুষ্য গণনায় পরিগণিত হয় না।’
দ্বিতীয় আপত্তি তার স্বাস্থ্যের হানি : ‘সকল সুখের মূল যে শারীরিক স্বাস্থ্য, তাহাও বাল্যপরিণয় প্রযুক্ত ক্ষয় পায়। ফলত অন্যান্য জাতি অপেক্ষা আমদ্দেশীয় লোকেরা যে শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যে নিতান্ত দরিদ্র হইয়াছে, কারণ পরিশেষে বাল্যবিবাহই ইহার মূল কারণ নির্ধারিত হইবে- সন্দেহ নাই।’
বিদ্যাসাগর বলেছেন : ‘আমদ্দেশীয়রা ভূম-লস্থিত প্রায় সর্বজাতি অপেক্ষা ভীরু, ক্ষীণ, দুর্বল স্বভাব এবং অল্প বয়সেই স্থবিরদশাপন্ন হইয়া অবসন্ন হয়, তথাপি এতদ্বিষয়ে অন্যান্য সামান্য কারণ খুঁজিলে করিলে প্রাপ্ত হওয়া যায় বটে, কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধান করিলে ইহাই প্রতীতি হইবে যে, বাল্যবিবাহই এ সমুদায়ের মুখ্য কারণ হইয়াছে। পিতামাতা সকল ও দৃঢ়শরীর না হইলে সন্তানরা কখন সবল হইতে পারে না যেহেতু ইহা সকলেই স্বীকার করিবেন যে, দুর্বল কারণ হইতে সবল কার্যের উৎপত্তি কদাপি সম্ভব না।
তৃতীয়ত মনের ঐক্য ওই বয়সে সম্ভব নয়। অথচ ‘মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল। সেই ঐক্য বয়স, অবস্থা, রূপ, গুণ, চরিত্র, বাহ্যভাব ও আন্তরিকভাব ইত্যাদি নানা কারণের ওপর নির্ভর করে। ভালো দম্পতিরা পরস্পরের আশায় জানিতে পারিল না, অভিপ্রায় অবগান করিতে অবকাশ পাইল না, অবস্থার পাইল না, আলাপ পরিচয়ের দ্বারা ইতরেতর চরিত্র পরিচয়ের কথা দূরে থাকুক... এজন্যই অম্মদ্দেশে দাম্পত্য নিবন্ধন অকপট প্রণয় প্রায় দৃষ্ট হয় না, কেবল প্রণয়ী ভরভা স্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচালিকাস্ব^রূপ হইয়া সংসার যাত্রা নির্বাহ করে।’
চতুর্থত ভালো দম্পতিদের উপার্জন ক্ষমতার জন্ম হতে না হতে সন্তানের জন্মদাতা হতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় অর্থের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হতে হয়। তখন তার জন্য নানা দুষ্কৃতির শরণাপন্ন হতে হয়। নানা অপকর্মের জাল জড়িয়ে পড়তে হয়। সন্তানদের ভার বোধ হয়।
পঞ্চমত তার মতে বাল্যবিবাহ রদ হলে অল্প বয়সে মৃত্যুর হার অনেক কমবে, কমবে বাল্যবিধবার সংখ্যাও : ‘কত বয়সে মনুষ্যদিগের মত্যু ঘটনার অধিক সম্ভাবনা, যদি আমরা এ বিষয়ের আলোচনা করি, তবে অবশ্যই প্রতীতি হইবে। মানুষের জন্মকাল অবদি বিংশতিবর্ষ বয়স পর্যন্ত মৃত্যুর অধিক সম্ভাবনা। অতএব, বিংশতি বর্ষ অতীত হইলে যদ্যপি উদ্বাহকর্ম নির্বাহ হয়, তবে বিধবার সংখ্যাও অধিক হইতে পারে না।’
বিধবা-বিবাহ প্রবির্তনই হোক, বহুবিবাহ রোধ বা বাল্যবিবাহ রোধের ব্যাপারই হোক, সবটাই এসেছে তার স্ত্রীজাতির প্রতি শ্রদ্ধাসম্ভ্রম থেকে, তাদের বিড়ম্বিত জীবন তাঁকে কাঁদিয়েছে, তাই তিনি বলেছেন ‘হা অবলাগণ তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।’ বিদ্যাসাগরের রচনায় কতগুলো স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু বিষয় আছে।
‘মানবজাতি’ প্রবন্ধে (বোধোদয়) আছে : ‘প্রাণীগণ যখন সচ্ছন্দ শরীরে আহারবিহার করিয়া বেড়ায়, তখন তাহাদিগকে সুস্থ বলা যায়; আর যখন তাহাদের পীড়া হয়, সচ্ছন্দে আহারবিহার করিতে পারে না, সর্বদা শুইয়া থাকে, ওই সময় তাহাদিগকে অসুস্থ বলে।’
ওই প্রবন্ধে আছে, অসাবধানতার জন্য মানুষের পীড়া হতে পারে, অসুখ হলে চিকিৎসক দেখানো উচিত। তাহাদের কথামতো চললে ত্বরায় রোগমুক্তি সম্ভব। তা না হলে বিস্তর ক্লেশ, তাহাদের মধ্যে অনেকে মরে যায়।
আবার ওই প্রবন্ধের অন্যত্র ‘মরণের অবধারিত কাল নাই, অনেকে প্রায় ষাট বৎসরের মধ্য মরিয়া যায়। যাহারা সত্তর, আশি, নব্বই অথবা একশত বৎসর বাঁচে, তাহাদিগকে লোকে দীর্ঘজীবী বলে। কিন্তু অনেকেই শৈশবকালে মরিয়া যায়।’ শৈশবে তখন অনেকের মৃত্যু মত। বোধোদয়ে কয়েকটি ইন্দ্রিয়ের সহজ সরল সর্বচজনবোধ্য বর্ণনা আছে যেমন- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। বোধোদয়ের উদ্ভিদ প্রবন্ধ ‘কতগুলো বৃক্ষের ছালে আমাদের অনেক উপকার হয়। ...আমেরিকার পেরু প্রদেশস্থ সিষ্কোনা নামক বৃক্ষের ত্বক সিদ্ধ করিলে যে ক্লাথ হয়, তাহা হইতে কুইনাইন উৎপন্ন হয়। ইদানীং দার্জিলিং অঞ্চলে সিষ্কোনার চাষ হইতেছে।’ বলাবাহুল্য, সেই যুগে ম্যালেরিয়ার একমাত্র চিকিৎসা ছিল কুইনাইন। ওই প্রবন্ধেই আছে- ‘অসুখের সময় রোগীকে যে এরোরুট পথ্য দেওয়া হয়, তাহা হরিদ্রাজাতীয় এক প্রকার বৃক্ষের মূল হইতে উৎপন্ন।’ বার্লি, এরোরুট প্রভৃতি ওই সময় রোগীর পথ্য হিসেবে বহুল প্রচলিত ছিল। পরিশ্রমের গুণগান করেছেন বোধোদয়ের আরেকটি প্রবন্ধ। লিখেছেন : ‘বালকগণের উচিত, বাল্যকাল অবধি পরিশ্রম করিতে অভ্যাস করে, তাহা হইলে বড় হইয়া অনায়াসে সকল কর্ম করিতে পারিবে।’
জন্তুকে ক্লেশ দেওয়া অন্যায়। এরকম একটি পাঠ আছে বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয় ভাগে : ‘সুরেন্দ্র শুনিয়া অতিশয় লজ্জিত হইল এবং কহিল, মহাশয়! আমি আর কখনও কোন জন্তুকে ডেলা মারিব না।’
বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগে তিনি শেখাচ্ছেন : ‘আমি মুখ ধুইয়াছি।’ দিন শুরু করা পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে। সকালে ওঠা অভ্যাসটি করতে পারলে ভালো : ‘আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নবজাগরণ না হলেও মধ্যবিত্তের বিজ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চার জগতে তাদের সমস্ত দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে উজ্জ্বলতম সাফল্য বিদ্যাসাগর- এতে কোন সন্দেহ নেই।
[লেখক : প্রকৌশলী; জার্মান ইনস্টিটিউট অব অল্টারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি]
জ্যোতির্ময় ধর
বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট ২০২১
বিদ্যাসাগর বাঙালির বিস্ময়। তিনি এক অখ্যাত গ্রামের খুব সাধারণ ঘর থেকে এসেছেন, কিন্তু অত্যন্ত অসাধারণ হয়ে উঠেছেন তার পান্ডিত্য, সাহিত্যকীর্তি, ব্যক্তিত্ব, প্রতিভার জন্যই শুধু নয়, সমাজ সংস্কারকরূপে যারা এসেছেন তাদের মধ্য অন্যতম বলেই শুধু নয়, সেই প্রায় অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের যুক্তিহীন অনড় অচল নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা কালের সঙ্গে তাল রাখতে না পারা পিছিয়ে পড়া জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করে তিনি যুক্তিবাদের কথা বলেছেন, মনুষ্যত্বকে খর্ব করে দেয়, এমন দেশাচার ও কালাচারের ঊর্ধ্বে উঠতে চেয়েছেন, কঠিন অধ্যবসায় সহকারে যুক্তি পারস্পর্যের মধ্যে দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে এসেছেন, সাড়ম্বরে তা ঘোষণা করেছেন, তার মত প্রতিষ্ঠায় চমৎকার মরণপণ সংগ্রাম করেছেন, বক্তব্যে ছিল তার ঋজু ও সুস্পষ্টতা, ছিল তার তীব্র বিশেষণ ক্ষমতা, সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ পেলে কোন কিছু তিনি গ্রহণ করেছেন, না পেলে করেছেন বর্জন, পরিচয় দিয়েছেন প্রখর বাস্তববোধের এবং এ সমস্তের মূলে ছিল তার বিজ্ঞানমনষ্কতা।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞানমস্কতা, বিজ্ঞান ভাবনা ও চেতনা নিয়ে বড় একটা আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। তাকে একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজবিজ্ঞানী বলতে কি পারা যায় না? জনসাস্থ্য বিষয়ক চেতনাও ছিল তার মধ্যে, তার কাজে, তার লেখায়। তিনি মূলত সাহিত্যের লোক। সাহিত্যে তার কীর্তি ও অবদান কালজয়ী। কিন্তু বিজ্ঞানের অমল আলোয় উদ্ভাসিত ছিল তার হৃদয়। যে কালে তিনি জন্মেছিলেন, সেই কাল ছাড়িয়ে, ছাপিয়ে উঠেছিল তার মাথা। মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারণার আঘাত হেনেছিলেন। ছিলেন অতি আধুনিক।
বিদ্যাসাগর তাই তার কালে এবং এখন আমাদের এই কালেও এক পুরোধা পুরুষ, যিনি লোকাচারের অন্ধবদ্ধ ক্ষয়িষ্ণু মায়া-মমতাহীন, নিষ্প্রাণ নিষ্ঠুর প্রচলিত ছকের বাইরে সমাজ ও জাতিকে পথ দেখান, ধরে থাকেন অগ্রগতির অনির্বাণ মশাল।
আশ্চর্য এই যে আচারে, ব্যবহারে, আহারে, পরিধানে, জীবনযাত্রায় তিনি শতকরা ১০০ ভাগ বাঙালি। বাঙালি তো ভীরু, দুর্বল, লঘুমতি, অব্যবস্থিত চিত্ত, স্বপ্নবিলাসী! এ সবের এক কণাও বিদ্যাসাগরের ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি। বাঙালি মনীষার অন্তরের অন্তঃস্তলে হিমালয় ছাড়িয়ে যাবার যে কল্পনা, বিদ্যাসাগর তার বাস্তব রূপ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন, হৃদয় ও বুদ্ধিবৃত্তির মিলিত বিকাশ দেখি তাঁর খর্বকায় দৃঢ় ঋজু চরিত্রে, বাঙালির মধ্যে যুগোপযোগী এক স্বতন্ত্র উজ্জ্বল আবির্ভাব। জাতীয় উজ্জীবনের প্রেতনাদাতৃ। পৌরুষের উদ্গাতা। কোমলে কঠোরতায় মিলিয়ে এক আদর্শ বাঙালির চিরকালীন অমল নির্দশন।
তার বিজ্ঞানমনস্কতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তার রচিত ‘জীবন চরিত” গ্রন্থ। বইটি লিখেছিলেন ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে। তার বয়স তখন ঊনত্রিশ। চেম্বার্স সংগৃহীত বহু সুপ্রসিদ্ধ পুরুষের জীবনীর যে সংকলন, তার থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়েছিলেন। মূলত অনুবাদ করেছিলেন, যদিও স্বকীয় বিশিষ্টতা, টিকা-টিপনীও রয়েছে। এই বইয়ে বেছে নিয়েছেন তিনি কাদের জীবনী? বেশিরভাগ বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী এবং এদের অনেকে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন, কারণ সত্য তাদের কাছে ছিল সব থেকে বড় ধর্ম।
বইটিতে যাদের জীবনী আছে: নিকলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, আইজাক নিউটন, উইলিয়ম হর্শেল, গ্রোশ্যস, লিনিয়স, বলন্টিন জামিরে ডুবাল, তামস জেস্কিন্স ও উইলিয়ম জোন্স। প্রচলিত তথাকথিত অভ্রান্ত ধর্মশাস্ত্রের বিধান না মেনে কোপার্নিকাস বলেছিলেন পৃথিবী সূর্য্যরে চারিদিকে ঘোরে, গালিলিয়ও তাই প্রমাণ করেছিলেন, এর ফলে তাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। শেষ জীবনে যদিও তিনি অন্ধ বধির হয়ে গিয়ে ছিলেন তাহলেও তার বিজ্ঞানসঞ্জাত বিশ্বাস ত্যাগ করেনি গালিলিয়। মাধ্যাকর্ষণ সঙ্গে নিউটনের নাম অভিন্নভাবে জড়িত। তিনি আলোক ও বর্ণ দুই পদার্থের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন, ভৌতবিদ্যার আরও অনেক প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন। উইলিয়াম হার্শল আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের জনক। গতিশাস্ত্রে পারদর্শী গ্রোশ্যস ‘সর্বতন্ত্র পক্ষীয়’ (যেখানে রাজা নাই, সর্বসাধারণ লোকের মতানুসারে যাবতীয় রাজকার্য নির্বাহ হয়) সমর্থন করতে বলে জেলে গিয়েছিলেন, চিকিৎসক লিনিয়ন জীবজগত ও উদ্ভিদজগতের বিজ্ঞানানুযায়ী নতুন নামকরণ করেন। ডুবাল ছিলেন জ্যোতিষ, ভূগোল, পুরাবৃত্ত ও পৌরাণিক বিশারদ। জেষ্কিস-আফ্রিকা দেশীয় কোন রাজার পুত্র ছিলেন ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ। স্যার উইলিয়াম জোন্স অনুবাদ করেছিলেন শকুন্তলা, মনুসংহিতা প্রভৃতির।
বিজ্ঞানীদের চরিত্র চিত্রণে ধর্মের উপর সত্যের স্থান বিদ্যাসাগরও তার রচনায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এক জায়গায় তিনি লিখছেন: “গ্রোশ্যস অত্যন্ত কুৎসিত সময়ে ভূমন্ডলে আসিয়াছিলেন। ওই কালে জনসমাজ ধর্ম ও দন্ডনীতিবিষয়ক বিষম বিসংবাদ দ্বারা সাতিশয় বিসস্কুল ছিল। মনুষ্যমাত্রই ধর্মসংক্রান্ত বিবাদে উন্মত্ত এবং ভিন্ন ভিন্ন পক্ষের ঔদ্ধতা ও কলহপ্রিয়তা দ্বারা সৌজন্য ও দয়া দক্ষিণ্য একান্ত বিলুপ্ত হইয়াছিল”
বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। সাধারণ মানুষ যে বিজ্জান সচেতন এটি তার প্রমাণ। বিদ্যাসাগর সেই সচেতনতা যাতে ছড়িয়ে যায় তার জন্যই এ রকম পুস্তক রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ছয় মাসের মধ্যে বইটির প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। অন্য একদিক দিয়ে জীবনচরিত গ্রন্থটির গুরুত্ব আছে। বিদ্যাসাগর দুরূহ বিজ্ঞানবিষয়ক ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা বেশকিছু সন্নিবেশিত করেছেন পুস্তকটি শেষাংশে। যেমন অস্থিত পাটিগণিত-Arethmetic of Infinites, উদ্ভিদবিদ্যা- Botaû, কক্ষ- Orbit, কেন্দ্র- Centre, গণিত- Mathematics, গবেষণা- Research, গ্রহণীহারিকা- Planatary Nebulae, ছায়াপথ- MilKy Way, দূরবীক্ষণ- Telescope, দৃষ্টিবিজ্ঞান - Optics, স্থিতিস্থাপক- Elusticity প্রভৃতি। এ সবের মধ্যে কতকগুলো তো কাব্যের মতো মনোরম, যেমন গ্রহনীহারিকা, ছায়াপথ প্রভৃতি। বঙ্গভাষায় গদ্যের সেই সবের আধুনিক যাত্রা। সেকালে তিনি পরিভাষার চিন্তাও করে গেছেন এবং নিজে এ বিষয়ে হাত লাগিয়েছেন। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার যে ধ্বনি তুলেছিলেন কুদরাৎ-এ-খুদা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু তার নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে একটি যে পরিভাষা সমস্যা ছিল তার উল্লেখ অনেকেই করেছেন। অথচ তাদের বহু আগে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তার সাধ্যমতো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এই ছোট্ট কথাটুকু ভুলে গেলে চলবে না।
হাজার হোক, জীবনচরিত অনুবাদ গ্রন্থ। বিজ্ঞানের প্রতি তার অকৃত্রিম অনুরাগের আর একটি প্রমাণ-“বোধোদয়” গ্রন্থটি (প্রথম প্রকাশ ১৮৮১)। এটি পরিণত বয়সের লেখা। তার জীবৎকালেই ৯৬টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে রয়েছে চেতন পদার্থ, ঈশ্বর, পদার্থ, মানবজাতি, পঞ্চ ইন্দ্রীয় (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) প্রভৃতির কথা, গণনা-অঙ্ক, নানা বস্তুর বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ণনা (যেমন ধাতু, সোনা, রূপা, পারদ, সীসা, তামা, লোহা, রাঙ, দস্তা প্রভৃতি), হীরা, কাচ, ক্রয়-বিক্রয়, জল-নদী-সমুদ্র-উদ্ভিদ প্রভৃতি প্রভৃতি।
বর্ণনাগুলো পড়লে বিদ্যাসাগরের অন্য একটি গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। তার ছিল প্রখর বাস্তববোধ। বইটিতে রয়েছে কৃষিকর্ম, শিল্প-বাণিজ্য-সমাজের কথাও।
আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। যখন তার বর্ণনার কোন ভুল কেউ দেখিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা সংশোধন করেছেন এবং যারা ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে যেমন আছেন মুসলমান শ্রীযুক্ত মহম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহম্মদ মহাশয়, তেমনই আছেন ডাক্তার চন্দ্রমোহন ঘোষ মহাশয় প্রমুখ। একটি সংস্করণের বিজ্ঞাপনে উলেখ করেছেন ওদের নাম। এতে মনে হয়, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি হতেও তিনি মুক্ত ছিলেন।
আপাদমস্তক বিজ্ঞানের বই ‘বোধোদয়’: বোধোদয় বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান-নির্ভর আর একটি পুস্তক। আগেই বলেছি এটিতে ভৌতবিজ্ঞান, গণি, জীবনবিজ্ঞান, ভূগোলবিদ্যা ইত্যাদিরই প্রাধান্য। বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন এমন পাঠ্যই প্রয়োজনীয়। সে পাঠ্যে আছে পদার্থ, চেতন পদার্থ, মানবজাতি, স্বপ্ন, মৃত্যু, শিক্ষা, ইন্দ্রীয়, বাক্যকথন-ভাষা, কাল, গণনা-অঙ্ক, বর্ণ, বস্তুর আকার পরিমাণ, ধাতু, হীরক, কাচ, ক্রয়বিক্রয় মুদ্রা, জল-নদী-সমুদ্র, উদ্ভিদ, ইতর জন্তু, কয়লা, কৃষিকাজ প্রভৃতির কথা। পাঠ্য হিসেবে সে সময়ে এ একেবারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এ-কথা মনে রাখা ভালো বোধোদয় Rudiments of Knowledge থেকে নেয়া হলেও তার অনুবাদ নয়। আর তা যে অন্য কল্পনাশ্রয়ী গল্প পাঠের চেয়ে উপকারের হবে সে বিষয়ে বিদ্যাসাগরের কোনো সংশয় ছিল না। তাই, বোধোদয়-এর বিজ্ঞাপনে ঈশ্বরচন্দ্রকে লিখতে দেখি-
‘বোধোদয় নানা ইংরেজি পুস্তক হইতে সংকলিত হইল, পুস্তক বিশেষের অনুবাদ নহে। যে কয়টি বিষয় লিখিত হইল, বোধ করি, তৎপাঠের অমূলক কল্পিত গল্পের পাঠ অপেক্ষা অধিকতর উপকার দর্শিবার সম্ভাবনা। অল্পবয়স্ক সুকুমারমতি বালক বালিকারা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেক, এই আশয়ে অতি সরল ভাষায় লিখিবার নিমিত্তে সবিশেষ যত্ন করিয়াছি; কিন্তু কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না। মধ্যে মধ্যে অগত্যা, যে যে প্রচলিত দুরূহ শব্দের প্রয়োগ করিতে হইয়াছে, পাঠকবর্গে বোধসৌকার্যার্থে, পুস্তকের শেষে সেই সব শব্দের অর্থ লিখিত হইল। অক্ষণে, বোধোদয় সর্বত্র পরিগৃহীত হইলে, শ্রম সফল বোধ করিব।
শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা’, কলিকাতা, ২০ শেষ চৈত্র, সং বৎ ১৯০৭। গোপাল হালদার সম্পাদিত বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভারের অন্তর্গত বোধোদয় প্রথমবারের বিজ্ঞাপন এমনটাই। প্রথমনাথ বিশী সম্পাদিত বিদ্যাসাগর রচনাসম্ভারের প্রথমবারের বিজ্ঞাপনটিও অনুরূপ।
দ্বিতীয় মুদ্রণের ‘প্রথম বারের বিজ্ঞাপনের দ্বিতীয় বাক্যে ‘যে কয়টির পরিবর্তে ‘যে কয়েকটি’, ‘অধিকতর উপকার দর্শিবার সম্ভাবনা’র বদলে ‘অনেক উপকার দর্শিতে পারিবেক’ রয়েছে। তৃতীয় বাক্যে ‘বুঝিতে পারিবেক’ এর বদলে ‘বুঝিতে পারিবে’, ‘সবিশেষ যত্নের বদলে ‘বিশেষ যত্ন’ রয়েছে। চতুর্থ বাক্যে ‘দুরূহ শব্দের প্রয়োগ’ বদলে হয়েছে ‘দুরূহ শব্দ প্রয়োগ’। ভাষাকে সরল করার যে বাসনা প্রতিনিয়ত তার মধ্যে ছিল সেই জায়গা থেকেই প্রথমবারের বিজ্ঞাপনের এই সংশোধন তিনি নিজেই দ্বিতীয় মুদ্রণে করেছিলেন বলে ধারণা। দ্বিতীয়বারের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছেন- ‘বোধোদয় প্রথমবার যে রূপ মুদ্রিত হইয়াছিল প্রায় তাহাই রহিল, কেবল কোন কোন স্থানে ভাষার কিছু পরিবর্ত্ত করা গিয়াছে, যে যে স্থানে ভুল ছিল সংশোধিত হইয়াছে আর সুসংলগ্ন করিবার নিমিত্ত কয়েকটি প্রকরণের ক্রম বিপর্যয় করা গিয়াছে।
শ্রী ঈশ্বর চন্দ্রে শর্ম্মা’ কলিকাতা ১৯ এ ফাল্গুন, সং বৎ ১৯০৮। বোধোদএর প্রথম রচনা ‘পদার্থ’। বিশ্ব পদার্থময়। সুতরাং পদার্থ চেনানো গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আসে চেতন অচেতন আর উদ্ভিদ এই তিন ধরনের পদার্থের কথা। এখন আমরা পদার্থকে জড় আর জীব এই দু’ভাগে ভাগ করি। উদ্ভিদ বিষয় তখনও নানা সংশয় মিটে যায়নি। তাই এই সাবধানী প্রয়াস তার। পরে ‘চেতন পদার্থ’ বিষয়ে লেখাটি দীর্ঘ। সেখানে প্রাণীদের (জন্তু!) স্থলচর, জলচর, উভয়চর বিভাগ হয়। মানুষ যে বুদ্ধি ও ক্ষমতার গুণে সর্বপ্রধান প্রাণী তার উল্লেখ থাকে সযত্নে। তাদের খাদ্যসহ জীবনের অন্যান্য উপকরণ আলোচনায় আসে। আসে পাখির কথা, তাদের জীবনযাত্রা, মাছেদের কথা, সরীসৃপের কথা, ব্যাঙ-পতঙ্গ-মনকি আনুবীক্ষণিক ক্ষুদ্র কীটের কথাও। পরম যত্নে ছাত্র-ছাত্রীদের জানানো হয় স্তন্যপায়ী জন্তুদের কথা। পাঠক জেনে যান বাদুড় উড়লেও পাখি নয়, চিংড়ি আর তিমি মোটেও মাছ নয়।
সবার কথা জানা হলো কিন্তু বিশেষ করে জানা দরকার তো নিজেদের কথা। তাই ‘মানবজাতি’ রচনা উঠে আসে। সে রচনা মানুষের আর সমাজের নানা কথায় পূর্ণ। মানুষ যে সমাজ তৈরি করা ছাড়া থাকতে পারে না , আসে সে কথাও । পাঁচ ইন্দ্রীয় মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উৎস তাই তাদের বিস্তৃত আলোচনা বোধোদয়ে। আর সপ্ন। তার ব্যাখ্যা তখনও আসেনি বিদগ্ধ মহল থেকে। তাই এ আলোচনায় বিদ্যাসাগর স্পষ্ট আর নির্মম। ‘স্বপপ অমূলক চিন্তামাত্র, কার্যকারক নহে’। তেমনি মৃত্যু রচনায় তার বাস্তববাদী মন বলে ওঠে।
মরণের অবধারিত কাল নাই.. কেহই অমর নহে। সবাই মরিতে হইবে। বস্তুর আকার আর পরিমাণ চর্চাও আছে বোধোদয়-এ, যা ভৌত বিজ্ঞানের অন্যতম পাঠ্য, সেখানে দৈর্ঘ্য, বিস্তা (প্রস্থ) ও বেধ (উচ্চতা) এর ধারণা সঙ্গে ভারী আর হাল্কা, উচ্চতা-গভীরতার জ্ঞানও সহজ ভাষায় রাখা আছে। মৌল বস্তু মাত্রই ধাতু বা অধাতু। আট রকম ধাতু বিষয়ে আলোচনা আছে বোধেদয়-এ-যেগুলোকে বলা হয়েছে প্রধান ধাতু। সেগুলো হলো স্বর্ণ, রৌপ্য, পারদ, সীসা, র, লৌহ, বঙ্গ (বা টিন) এবং দস্তা। পারদ যে ধাতু হলেও তরল তা জানিয়ে দিতে ভুল হয়নি। দস্তা সম্পর্কে বলার সময় অ্যালয় বা সঙ্কর ধাতু সম্পর্কে ধারণাও দেয়া হয়েছে। অ্যালয় হলো নির্দিষ্ট অনুপাতে দুটি ধাতুর বিগলিত অবস্থায় সমস্বত্ব মিশ্রণ। পিতল হলো দস্তা বা জিঙ্ক এবং তামা বা কপারের একটি অ্যালয়। ‘তিন ভাগ দস্তা ও চারি ভাগ মাতা মিশ্রিত করিলে পিতল হয়। তামায় যত শীঘ্রই মরিচা ধরে, পিতলে তত শিগগির ধরে না একথা বোধোদয়েরই।
বোধোদয়ের রচনায় বিজ্ঞান শিক্ষার-ই প্রাধান্য। কিন্তু অবকাশ পেলে বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ-দর্শনের শিক্ষা দিতেও তার কলম পিছিয়ে থাকেনি। হীরক বিষয়ে আলোচনার কয়েকটি কথা উল্লেখ করলে এ বক্তব্যের যথার্থতা বোঝা যাবে। এ পর্যন্ত যত বস্তু রহিয়াছে, হীরা সকল অপেক্ষা কঠিন... বিবেচনা করিয়া দেখিলে হীরা অতি অকিঞ্চিতকর পদার্থ। ঔজ্জ্বল্য ব্যতিরিক্ত উহার আর কোন গুণ নাই। কাচ কাটা বই আর কোন বিশেষ প্রয়োজনে আইসে না, এরূপ একখ- গৃহে রাখিবার নিমিত্ত অত অর্থ ব্যয় করা কেবল মনের অহঙ্কার প্রদর্শন ও মূঢ়তা মাত্র। ...ইহা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, এই মহামূল্য প্রস্তর ও কয়লা, দুই-ই এক পদার্থ।
বোধোদয়ে ভুগোলবিদ্যার শিক্ষা রয়েছে অনেকটা জুড়েই। কাল, দিনরাত্রি, মাস, ঋতু, বৎসর প্রভৃতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জল-নদী সমুদ্রের কথা। জোয়ার ভাটার কথা। রয়েছে জলচক্রের কথাও। পাথরিয়া কয়লা ও কেরাসিন তেলের মত সম্পদের কথা শিক্ষার্থীদের জানানোর সঙ্গে জানানো হয়েছে কৃষিকাজ তার গুরুত্ব আর কৃষিসম্পদের কথাও।
প্রাণিবিদ্যার বহু বিষয়র আলোচনা রয়েছে ‘চেতন বস্তু’ অংশে যা আগেই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু উদ্ভিদবিদ্যার ও আলোচনা আছে বোধোদয়ে। সেখানে স্বভোজী ও পরভোজী উদ্ভিদসহ ছত্রাকের কথাও সংযুক্ত রয়েছে। উদ্ভিদের উপকারী গুণগুলোর কথাও তুলে ধরা আছে। গবফরহরপধষ চষধহঃ এবং অ্যারোমেটিক প্যান্টের গুরুত্ব আজ শুধু আমরাই অনুভব করছি তা নয়, বিদেশেও এর চর্চা হচ্ছে। বহু আগে আমাদের চরক-শুশ্রতের সময়ে এই চর্চা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছিল। বোধেদয় সে ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি। বিভিন্ন প্রাণী থেকে আমরা অর্থকরী উৎপাদন কি কি পেতে পারি তা নিয়ে আজকাল অর্থনৈতিক প্রাণিবিদ্যা বা ‘ইকোনমিক জুলজি’ বলে প্রাণিবিদ্যার একটি নতুন শাখা জন্ম নিয়েছে। আশ্চর্যের কথা বোধোদয়ে তারও ছোঁয়া আছে। ইতর জন্তু আলোচনায় চামর, মুক্তো, লাক্ষা, রেশম, মধু, মোম প্রভৃতি পাওয়ার কথা সহজভাবেই এসেছে। দেড়শ’ বছর আগেও বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে গুরুত্ব সমানভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। বোধোদয়ে তাই বিজ্ঞান শিক্ষার নানা প্রসঙ্গে সচেতন পদচারণা। আর তারই সঙ্গে একজন সমাজসচেতন ঋজু পুরুষের ঐকান্তিক প্রয়াস, আগামী প্রজন্মকে বিজ্ঞানসচেতন করে তোলার।
বোধোদয়ের একটা সংক্ষিপ্ত চবি আগের পাতাগুলোতে হয়তো তুলে ধরা হলো। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভাগ ধরে ধরে আরো আলোচনার অবকাশ আছে। গুণী পাঠক তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন বিজ্ঞানের বিবিধ বিভাগে কি সাবলীল পদাচারণা ছিল তার।
পদার্থ বিজ্ঞান- প্রথমে পদার্থ বিজ্ঞানের কথা ধরি। চেতন, অচেতন আর উদ্ভিদ এই তিনরকমের পদার্থের কথা বিদ্যাসাগর শুনিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু চেতন বা প্রাণিজগৎ আর উদ্ভিদজগৎ বিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন আলোচনার বিভাগের বিভক্ত হবে। ভাবতই পদার্থবিজ্ঞানের পরিধিতে আসবে অচেতন বস্তু। আর আকার জানা দরকার, দরকার তার পরিমাণ কিংবা ওজন জানা। বিদ্যাসাগর তা জানাতে লিখছেন- ‘সকল বস্তুরই দৈর্ঘ্য, বিস্তার, বেধএই তিন গুণ আছে।’ আর ওজন? তার কথা বলতে বোধোদয়ের পাতায় বিদ্যাসাগরের কলম লিখছে ‘বস্তুর ভারের পরিমাপক ওজন কহে।’ এই ওজন যে ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের ক্ষেত্রে সমআকারের হলেও ভিন্ন হবে- পদার্থের এই বিশেষ গুণটি বুঝিয়ে দিতে তার ভুল হয়নি। বলেছেন, ‘সমান সমান আকারের একখ- কাষ্ঠ অপেক্ষা একখ- লৌহ অধিক ভারি।’ বোধোদয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে একটি অধ্যায় ‘বর্ণ রঙ’। সেখানে তিনি বলেন, ‘কি স্বাভাবিক, কি কৃত্রিম, উভয়বিদ পদার্থেরই নানা প্রকার বর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে যত বর্ণ আছে সবই তিনটি মাত্র মূল বর্ণ হইতে উৎপন্ন। সেই তিন মূল বর্ণ এই; নীল, পীত, লৌহিত। এই তিন মূলীভূত বর্ণকে যত ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে মিশ্রিত করা যায় ততপ্রকার বর্ণ উৎপন্ন হয়। ওই সকল বর্ণকে মিশ্র বর্ণ কহে। মিশ্র বর্ণের মধ্যে হরিত, পাঠল, ধূমল এই তিনটি প্রধান। নীল ও পীত এই দুই মূল বর্ণ মিশ্রিত করিলে হরিত বর্ণ উৎপন্ন হয়। পীত ও লোহিত এই দুই মিশ্রিত করিলে পাটল বর্ণ হয়। নীল ও লোহিত এই দুই বর্ণের মিলনে মূল বর্ণ হয়। এভাবেই মৌলিক রঙ ও যৌগিক রঙের এর পাঠ শেষ করে বিদ্যাসাগর যান মিশ্র রঙ বা টারসিয়ারী কালার বোঝাতে। বলেন, ‘তদ্ভিন্ন কপিশ, ধুসর, পিঙ্গল ইত্যাদি নানা মিশ্র বর্ণ আছে। সেসব ও ঐ তিন মূলীভূত বর্ণের মিশ্রণে উৎপন্ন হয়।’ আলোক বিজ্ঞানের পরের পাঠটি যেভাবে দ্বিতীয় সংস্করণে রয়েছে তা যথোচিত নয়। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘সৃষ্ট বর্ণের অভাব, অর্থাৎ যেখানে কোন বর্ণই নাই, সেই শুল্ক বর্ণ। আর নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারই কৃষ্ণবর্ণ।
বোধোদয়ের পরবর্তী সংস্করণে এই ভ্রম সংশোধন করে নিতে তার ভুল হয়নি। সেখানে নতুন করে ‘আলোর প্রকৃতি’ আলোর বিচ্ছুরণ’ নামে নতুন নতুন অধ্যায়ে তাকে লিখতে দেখি। সত্যি সহজ সরল ভঙ্গিতে বিজ্ঞান পরিবেশন- আজ থেকে প্রায় ১৭৭ বছর আগে দাঁড়িয়ে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞানমনস্কতার অপর প্রমাণ ধর্মসম্পর্কে তার একান্ত নিস্পৃহ মনোভাব। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাতের বিবরণ সবিস্তৃত লিপিবদ্ধ আছে শ্রী ম লিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের দ্বিতীয় খন্ডে। শ্রীরামকৃষ্ণ কোনরকমেই বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন স্থির বিশ্বাসভক্তির একটি কথাও আদায় করতে পারেনি। তিনি কোন ধর্মযাজকের কাছে ঘেঁষেননি-মন্দিরে যাননি। পূজাআর্চা জপতপ করতেন না। কিন্তু ছিলেন মানবতায় উদ্বুদ্ধ দয়ার সাগর। এত সব সত্ত্বেও বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছেন, রামকৃষ্ণের পরেই তার গুরু বিদ্যাসাগর। এ প্রসঙ্গে কাশীর পান্ডাদের প্রতি তার উত্তরও স্মরণীয়-‘সাক্ষাৎ বিশ্বেশ্বর অন্নপূর্ণা আমার জনক-জননী, তাদের প্রসাদ পাই, আমার বিশ্বনাথ দর্শণে বা গঙ্গাস্নানে কী প্রয়োজন? তবে কেউ কিছু মানলে তিনি আপত্তি করতেন না, শিবনাথ তো ছিলেন ব্রাহ্ম, তাকে ওই ধর্মমত থেকে দূরে সরিয়ে আনার কথা ভাবেননি। তার চরিত্রে পরমত সহিষ্ণুতার এ এক উজ্জ্বল নির্দশন।
বিজ্ঞানমনস্ক মন কখনও কুসংস্কার বিশ্বাস করে না। বিদ্যাসাগরও কুসংস্কার তাড়াতে চেয়েছেন দেশের মানুষের মন থেকে।
২২ জানুয়ারি ১৯৫১ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হন। এর অল্প কয়েক মাস পরে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থরা কলেজে প্রবেশাধিকার পায়। আগে কলেজে পড়ার অনুমতি ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের। এক বছরের ভিতর যে কোনও হিন্দুসন্তান কলেজে ভর্তি হতে পারবে, এই মর্মে নিয়ম জারি করা হয়।
খলিফা ওমর নাকি গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রন্থশালা পুড়িয়েছিলেন। ওই কাহিনী উলেখ করে পরিহাসছলে বিদ্যাসাগর বলছেন- ‘ভারতীয় পন্ডিতদের গোঁড়ামি ঐ আরব খলিফাদের গোঁড়ামির চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। ... ভারতবর্ষীয় পন্ডিতদের নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য গ্রহণ করিবার কোন সম্ভাবনা আছে, এমন আমার বোধ হয় না।’
বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে একটি নৃশংস কুসংস্কার কীভাবে দূর হলো বলছেন : ‘বহুকাল অবধি ব্যবহার ছিল পিতামাতা গঙ্গাসাগরে গিয়া শিশুসন্তান সাগর জলে নিক্ষিপ্ত করিতেন। তাহারা এই কর্ম ধর্মবোধে করিতে বটে, কিন্তু ধর্মশান্ত্রে ইহাব কোন বিধি নাই। গভর্নর জেনারেল বাহাদুর এই নৃশংস ব্যবহার একেবারে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত ১৮০২ সালের ২০ আগস্ট এক আইন জারি করিলেন ও তাহার পোশকতার নিমিত্ত গঙ্গাসাগরে একদল সিপাই পাঠাইয়া দিলেন। তদবধি এই নৃশংস ব্যবহার একবারে রহিত হইয়া গিয়াছে।
আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি বিদ্যাসাগরের আস্থা এখানে সুপ্রকট। মৌলবাদীরা দেশকে যে পিছনের দিকে টানছে, সেই ধারণা তখনই হয়েছে তার। কীভাবে এর মোকাবেলা করা যেতে পারে, সে বিষয়েও তিনি তার মত নিয়েছেন এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তিনি বলছেন : ‘বাংলাদেশে যেখানে শিক্ষা বিস্তার হচ্ছে সেখানেই পন্ডিতদের প্রভাব কমে আসছে। দেখা যাচ্ছে বাঙালার আধিবাসীরা শিক্ষা লাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র। ...জনসাধারণের জন্য শিক্ষা বিস্তার- এই এখন আমাদের প্রধান প্রয়োজন। ...মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ দখল প্রয়োজনীয় বহুবিদ তথ্যে যথেষ্ট জ্ঞান, দেশের কুসংস্কারের কবল থেকে মুক্তি শিক্ষকদের এই গুণগুলি থাকা চই। ...সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরা কলেজের পাঠ শেষ করে এই ধরনের লোক হয়ে উঠবে এমন আশা করবার যথেষ্ঠ কারণ আছে।’
বস্তুত শিক্ষাবিস্তারে তিনি তার মনপ্রাণ সমর্পণ করেছিলেন এবং বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তার যাতে জনসাধারণের মধ্যে প্রসার লাভ করবে শিক্ষা। তিনি জানতেন, শিক্ষা বিস্তারের অর্থই হলো কুসংস্কারের কালো হাত থেকে যুক্ত বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণ জনগণ ছিল বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবনকে বরণ করে নেবার জন্য ব্যগ্র। শিক্ষার প্রসার ও প্রচারে নানা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও তিনি একা যা করেছেন, তা আজকের দিনে বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। বীরসিংহ গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন (১৮৫৩), নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি মেদিনীপুরে ৫টি করে মডেল স্কুল স্থাপন করেছিলেন (১৮৫৫-৫৬)। স্ত্রীশিক্ষা প্রচারেও তার ভূমিকা অনুধাবনযোগ্য। হুগলি জেলায় ২০টি, বর্ধমানে ১১টি, মেদিনীপুরে ৩টি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন (১৮৫৭-৫৮)। এছাড়া প্রতিষ্ঠা করেন মুর্শিদাবাদের কাঁদিতে ইংরেজি, বাংলা স্কুল (১৮৫৯)। মৃত্যুর এক বছর আগেও (১৮৯০) বীরসিংহ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভগবতী বিদ্যালয়। সাঁওতাল পরগনার কর্মাটারে শেষ জীবনেও তিনি পাঠশালা চালাতেন সাঁওতাল পড়–য়াদের নিয়ে। শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তার প্রায় একক প্রচেষ্টার এ এক আশ্চর্য নিদর্শন।
বাঙালি মেয়েদের মধ্যে সর্বপ্রথম এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন চন্দ্রমুখী বসু। বিদ্যাসাগর একপ্রন্থ শেক্সপিয়ার গ্রন্থাবলী উপহার দিয় তাকে একটি সুন্দর চিঠি লেখেন। এই রকম গুণ ও গুণীর সমাদর করতে তিনি জানতেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত হতে পেরেছেন কবি মধুসূদন। তিনি নিজে বাংলা গদ্যের আদিপুরুষ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বাংলাভাষায় প্রথম যথার্থ শিল্পী। সেই সঙ্গে তার উদ্যোগে পালিত হয়েছে আধুনিক বাংলা বাক্যের আবির্ভাব-মধুসুধনের কাব্যে। তার বিজ্ঞান মনস্কতাই সাহিত্যের আধুনিকতার এ ধারাকে উস্কে দিয়েছে।
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান প্রীতির আর একটি প্রমাণ এখানে প্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে। নিজের জীবনযাত্রায়, আচার-আচরণে বিদ্যাসাগর ছিলেন কিঞ্চিৎ কৃপণ। একটি ব্যাপারে কৃপণতা ছিল না বই সংগ্রহ। অত্যন্ত ভালভাবে বইগুলো বাঁধাতেন। এতই ছিল প্রতি মমতা। তার থেকেও বড় কথা ১৮৭০ সালের জানুয়ারিতে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় তিনি এক হাজার টাকা দান করেছিলেন। বিজ্ঞানকে মনেপ্রাণে ভালো না বাসলেও এমনটি সম্ভব নয়।
সাহিত্যের লোক হয়ে তার বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসা নজরে পড়ার মতো এবং সে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বহুধাবিস্তৃত। বাংলা ভাষায় বলা যেতে পারে তিনি আদি বিজ্ঞান লেখক। আধুনিক বাংলা গদ্যের জন্মলগ্নেই তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, বিজ্ঞানকে সাহিত্যে অম্বিত করেছেন।
বিদ্যাসাগর চিকিৎসক ছিলেন না। কিন্তু জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে তার বিজ্ঞানভিত্তিক কতগুলো ধারণা ছিল। আর ছিল মমতামাখা বিশাল হৃদয়। এর জন্য প্রয়োজনের সময় তিনি বসে থাকতে পারেননি। কলেরা মহামারীর সময় কর্মাটারে সাঁওতালপল্লীতে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। এ সম্পর্কে পরে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, খুব সম্ভবত তার মনোভাবও ছিল তাই। রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, তার মতো সাহিত্য-ডাক্তারকে দায়ে পড়ে ভিষক-ডাক্তার হতে হয়। লিখেছেন- ‘যাদের সাধ্যগোচরে কোথাও কোন চিকিৎসার উপায় নেই। তারা যখন কেঁদে এসে পায়ে ধরে পড়ে, তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি, এত বড় নিষ্ঠুর শক্তি আমার নেই। এদের সম্বন্ধে পণ করে বসতে পারি যে পুরো চিকিৎসক নই বলে কোন চেষ্টা করব না। আমাদের এ হতভাগ্য দেশে আধা চিকিৎসকদেরও যমের সঙ্গে যুদ্ধে আড়কাঠি দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়।’ যে মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যাসাগর ওই সেবাব্রত করেছিলেন, জনস্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে তাকে স্বাগত জানাতে হয়।
বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য তার যে প্রচেষ্টা, তার অন্যতম একটি কারণ ছিল এই যে গোপন ব্যভিচারের স্ত্রোত বন্ধ হবে। জনস্বাস্থ্যের এটা একটা দিক তো বটেই। স্বাস্থ্যে মানে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাই নয়, মানসিকভাবেও সুস্থ থাকা। সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা। তাছাড়া তিনি অবশ্যই চেয়েছিলেন স্ত্রীজাতির দুঃখ লাঘব করতে। সমানাধিকার যদি স্ত্রী ও পুরুষের না থাকে, তাহলে কখনই সে জাতির স্বাস্থ্য ভালো হতে পারে না। এজন্য বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বহু বিবাহ রদ করবার জন্যও আন্দোলন করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো উচ্চশিক্ষিত সাহিত্যিকও বরাবর বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইনের ও বহু বিবাহ নিরোধক প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। সমাজের কুপ্রথার শিকড় কতদূর পর্যন্ত গেড়ে বসতে পারে এবং তা উপড়ে ফেলা কত শক্ত, এ তার একটা প্রমাণ।
‘সর্ব শুভঙ্কী’তে বিদ্যাসাগরের প্রথম সামাজিক লেখা ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্যের দিক দিয়ে নাতিদীর্ঘ এ প্রবন্ধটি অত্যন্ত মূল্যবান এবং তার প্রখর বিজ্ঞানমনস্কতা ও বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দেয়।
‘সর্ব শুভঙ্করী’ নামে একটি সভা ছিল। তার মুখপত্রেরও নাম ছিল সর্ব শুভঙ্করী। ১৮৫০ সালে ওই পত্রিকায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগরের নাম না থাকলেও তার জীবনীকার ও গবেষকগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন লেখাটি বিদ্যাসাগরের। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রেরণার উৎস।
বিদ্যাসাগরের প্রথম সামাজিক প্রবন্ধটি সম্বন্ধে অন্য একটি বক্তব্য আছে। বিধবা বিবাহ বিষয় নিয়ে লেখার আগে তিনি এই প্রবন্ধটি লিখেছেন। এটি একাধারে সমাজ সংস্কারমূলক ও জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখা। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে এখনও এ লেখা একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে।
বাল্যবিবাহের দোষ সম্পর্কে তার প্রথম বক্তব্যে, নারী-পুরুষ উভয়েই, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে মন যায়, নিজের নিজর জীবন গঠন করতে পারে না। আপনার ভাগ্য জয় করবার সাধনায় ব্রতী হতে পারে না। তাদের মেধা, শক্তি, ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ হয় না। তিনি লিখেছেন- ‘নব বিবাহিত বালক বালিকারা পরস্পরের চিত্তরঞ্জনার্থে রসালাপ, বিদগ্ধতা, বাক্চাতুরী, কামকলাকৌশল প্রভৃতির অভ্যাসকরণে ও প্রকাশকরণে সর্বদা সযতœ থাকে এবং তদ্বিষয়ে প্রয়োজনীয় উপায় পরিপাটী পরিচিন্তনেও তৎপর থাকে, সুতরাং তাহাদিগের বিদ্যালোচনার বিষম ব্যাঘাত জন্মিবাতে সংসারের সারভূত বিদ্যাধনে বঞ্চিত হইয়া কেবল মানুষের আকারমাত্রধারী, বস্তুত প্রকৃতরূপে মনুষ্য গণনায় পরিগণিত হয় না।’
দ্বিতীয় আপত্তি তার স্বাস্থ্যের হানি : ‘সকল সুখের মূল যে শারীরিক স্বাস্থ্য, তাহাও বাল্যপরিণয় প্রযুক্ত ক্ষয় পায়। ফলত অন্যান্য জাতি অপেক্ষা আমদ্দেশীয় লোকেরা যে শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যে নিতান্ত দরিদ্র হইয়াছে, কারণ পরিশেষে বাল্যবিবাহই ইহার মূল কারণ নির্ধারিত হইবে- সন্দেহ নাই।’
বিদ্যাসাগর বলেছেন : ‘আমদ্দেশীয়রা ভূম-লস্থিত প্রায় সর্বজাতি অপেক্ষা ভীরু, ক্ষীণ, দুর্বল স্বভাব এবং অল্প বয়সেই স্থবিরদশাপন্ন হইয়া অবসন্ন হয়, তথাপি এতদ্বিষয়ে অন্যান্য সামান্য কারণ খুঁজিলে করিলে প্রাপ্ত হওয়া যায় বটে, কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধান করিলে ইহাই প্রতীতি হইবে যে, বাল্যবিবাহই এ সমুদায়ের মুখ্য কারণ হইয়াছে। পিতামাতা সকল ও দৃঢ়শরীর না হইলে সন্তানরা কখন সবল হইতে পারে না যেহেতু ইহা সকলেই স্বীকার করিবেন যে, দুর্বল কারণ হইতে সবল কার্যের উৎপত্তি কদাপি সম্ভব না।
তৃতীয়ত মনের ঐক্য ওই বয়সে সম্ভব নয়। অথচ ‘মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল। সেই ঐক্য বয়স, অবস্থা, রূপ, গুণ, চরিত্র, বাহ্যভাব ও আন্তরিকভাব ইত্যাদি নানা কারণের ওপর নির্ভর করে। ভালো দম্পতিরা পরস্পরের আশায় জানিতে পারিল না, অভিপ্রায় অবগান করিতে অবকাশ পাইল না, অবস্থার পাইল না, আলাপ পরিচয়ের দ্বারা ইতরেতর চরিত্র পরিচয়ের কথা দূরে থাকুক... এজন্যই অম্মদ্দেশে দাম্পত্য নিবন্ধন অকপট প্রণয় প্রায় দৃষ্ট হয় না, কেবল প্রণয়ী ভরভা স্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচালিকাস্ব^রূপ হইয়া সংসার যাত্রা নির্বাহ করে।’
চতুর্থত ভালো দম্পতিদের উপার্জন ক্ষমতার জন্ম হতে না হতে সন্তানের জন্মদাতা হতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় অর্থের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হতে হয়। তখন তার জন্য নানা দুষ্কৃতির শরণাপন্ন হতে হয়। নানা অপকর্মের জাল জড়িয়ে পড়তে হয়। সন্তানদের ভার বোধ হয়।
পঞ্চমত তার মতে বাল্যবিবাহ রদ হলে অল্প বয়সে মৃত্যুর হার অনেক কমবে, কমবে বাল্যবিধবার সংখ্যাও : ‘কত বয়সে মনুষ্যদিগের মত্যু ঘটনার অধিক সম্ভাবনা, যদি আমরা এ বিষয়ের আলোচনা করি, তবে অবশ্যই প্রতীতি হইবে। মানুষের জন্মকাল অবদি বিংশতিবর্ষ বয়স পর্যন্ত মৃত্যুর অধিক সম্ভাবনা। অতএব, বিংশতি বর্ষ অতীত হইলে যদ্যপি উদ্বাহকর্ম নির্বাহ হয়, তবে বিধবার সংখ্যাও অধিক হইতে পারে না।’
বিধবা-বিবাহ প্রবির্তনই হোক, বহুবিবাহ রোধ বা বাল্যবিবাহ রোধের ব্যাপারই হোক, সবটাই এসেছে তার স্ত্রীজাতির প্রতি শ্রদ্ধাসম্ভ্রম থেকে, তাদের বিড়ম্বিত জীবন তাঁকে কাঁদিয়েছে, তাই তিনি বলেছেন ‘হা অবলাগণ তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।’ বিদ্যাসাগরের রচনায় কতগুলো স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু বিষয় আছে।
‘মানবজাতি’ প্রবন্ধে (বোধোদয়) আছে : ‘প্রাণীগণ যখন সচ্ছন্দ শরীরে আহারবিহার করিয়া বেড়ায়, তখন তাহাদিগকে সুস্থ বলা যায়; আর যখন তাহাদের পীড়া হয়, সচ্ছন্দে আহারবিহার করিতে পারে না, সর্বদা শুইয়া থাকে, ওই সময় তাহাদিগকে অসুস্থ বলে।’
ওই প্রবন্ধে আছে, অসাবধানতার জন্য মানুষের পীড়া হতে পারে, অসুখ হলে চিকিৎসক দেখানো উচিত। তাহাদের কথামতো চললে ত্বরায় রোগমুক্তি সম্ভব। তা না হলে বিস্তর ক্লেশ, তাহাদের মধ্যে অনেকে মরে যায়।
আবার ওই প্রবন্ধের অন্যত্র ‘মরণের অবধারিত কাল নাই, অনেকে প্রায় ষাট বৎসরের মধ্য মরিয়া যায়। যাহারা সত্তর, আশি, নব্বই অথবা একশত বৎসর বাঁচে, তাহাদিগকে লোকে দীর্ঘজীবী বলে। কিন্তু অনেকেই শৈশবকালে মরিয়া যায়।’ শৈশবে তখন অনেকের মৃত্যু মত। বোধোদয়ে কয়েকটি ইন্দ্রিয়ের সহজ সরল সর্বচজনবোধ্য বর্ণনা আছে যেমন- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। বোধোদয়ের উদ্ভিদ প্রবন্ধ ‘কতগুলো বৃক্ষের ছালে আমাদের অনেক উপকার হয়। ...আমেরিকার পেরু প্রদেশস্থ সিষ্কোনা নামক বৃক্ষের ত্বক সিদ্ধ করিলে যে ক্লাথ হয়, তাহা হইতে কুইনাইন উৎপন্ন হয়। ইদানীং দার্জিলিং অঞ্চলে সিষ্কোনার চাষ হইতেছে।’ বলাবাহুল্য, সেই যুগে ম্যালেরিয়ার একমাত্র চিকিৎসা ছিল কুইনাইন। ওই প্রবন্ধেই আছে- ‘অসুখের সময় রোগীকে যে এরোরুট পথ্য দেওয়া হয়, তাহা হরিদ্রাজাতীয় এক প্রকার বৃক্ষের মূল হইতে উৎপন্ন।’ বার্লি, এরোরুট প্রভৃতি ওই সময় রোগীর পথ্য হিসেবে বহুল প্রচলিত ছিল। পরিশ্রমের গুণগান করেছেন বোধোদয়ের আরেকটি প্রবন্ধ। লিখেছেন : ‘বালকগণের উচিত, বাল্যকাল অবধি পরিশ্রম করিতে অভ্যাস করে, তাহা হইলে বড় হইয়া অনায়াসে সকল কর্ম করিতে পারিবে।’
জন্তুকে ক্লেশ দেওয়া অন্যায়। এরকম একটি পাঠ আছে বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয় ভাগে : ‘সুরেন্দ্র শুনিয়া অতিশয় লজ্জিত হইল এবং কহিল, মহাশয়! আমি আর কখনও কোন জন্তুকে ডেলা মারিব না।’
বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগে তিনি শেখাচ্ছেন : ‘আমি মুখ ধুইয়াছি।’ দিন শুরু করা পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে। সকালে ওঠা অভ্যাসটি করতে পারলে ভালো : ‘আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নবজাগরণ না হলেও মধ্যবিত্তের বিজ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চার জগতে তাদের সমস্ত দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে উজ্জ্বলতম সাফল্য বিদ্যাসাগর- এতে কোন সন্দেহ নেই।
[লেখক : প্রকৌশলী; জার্মান ইনস্টিটিউট অব অল্টারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি]