মোস্তাফা জব্বার
এক
বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী বা সুবর্ণজয়ন্তী এবার আমরা পার করছি। বরাবরের মতোই বাঙালি তার এই বিজয়ের দিনটিকে অনন্য সাধারণ করে তোলার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। বিজয় অর্জন করার মাত্র দুদিন আগে আলবদর রাজাকাররা আমাদের দেশের মেধাবীদের যেভাবে হত্যা করেছিলো তা আমরা এমনভাবে পালন করছি যাতে মনেই হবে যে এরই মাঝে আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছি। তবে বিজয় অর্জনের এত বছর পরেও আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমরা সব শহীদকে সেই সম্মান দিতে পেরেছি, যা আমাদের দেয়া উচিত ছিল। শহীদদের তালিকায় বুদ্ধিজীবীরাই থাকুক বা মুক্তিযোদ্ধাই থাকুক কিংবা অতি সাধারণ মানুষ যারা গণহত্যার শিকার হয়েছিল তাদের প্রতি কি আমরা সেই সম্মান দিতে পারছি, যা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। দুঃখজনকভাবে এটিও সত্য যে আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের সেই শহীদদের চিনে কিনা-জানে কিনা বা আমরা তাদের শহীদদের কথা বলাও হয় কিনা। আজকের বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি সেই মানুষগুলোই সংখ্যায় বেশি। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরার কাজটা আমরা খুব সক্ষমতার সঙ্গে করতে পারিনি। ৭৫ থেকে ৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৮ সময়টাতে বাংলাদেশের সামনে চলার পাটিকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে পাকিস্তানতন্ত্র বানানোর প্রচেষ্টার জন্য সেটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
৯ নভেম্বর ২০১৭ আমার প্রিয় মানুষদের একজন বাসদ নেতা আ ফ ম মাহবুবুল হক কানাডা থেকে পরপারে চলে গেলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটিকে দেশে আনা হলো না। আমার জানামতে তাকে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রও দেয়া হয়নি। মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কানাডার মাটিতে শুয়ে থাকতে হলো। এর ফলে তার সহযোদ্ধারা বা দেশের মানুষ, এমনকি তার কবরও জিয়ারত করতে পারবে না। আমি তাকে সেই ৬৮ সাল থেকে দেখে এটা নিশ্চিত জানি যে, এই দেশের কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি কোনোদিন কোনো আকারে গ্রহণ করেননি। দেশ তাকে কোনো প্রতিদান না দিক অন্তত সম্মানটাতো তার প্রাপ্য। কিন্তু সেটি আমরা দিতে পারিনি। ৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহম্মদ আলী জিন্নাহ হলে প্রবেশ করার পর থেকে যতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন ততদিনই একেবারে বড় ভাই বা অভিভাবক এর মতো মাথার ওপরে ছিলেন। সেই মানুষটি অপঘাতে প্রাণ হারালেন, তার বিচারও হলো না। সেই কষ্টটা এখনও সামলাতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মাহবুব ভাইয়ের কাছে এত ঋণী যে এই অপারগতার দায় থেকে নিজেকে কোনোভাবেই মুক্ত করতে পারছি না। আমার নিজের কষ্ট লাগে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ভরে যায় আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খবর কেউ রাখে না। এটি নিশ্চিত যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও ভাতার জন্য যুদ্ধ করেনি। কিন্তু রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে তাকে স্বীকৃতি প্রদান করা। অথচ রাষ্ট্র আমার মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতিই দেয়নি।
আরও অনেক দায় থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। তারও এক বছর আগে ১৬ সালের ১৬ নভেম্বর চলে গেলো খুলনার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু শেখ আব্দুল কাইয়ুম। ওর জন্যও কিছুই করতে পারিনি। যতবার ওর মেয়ে ফারজানার সঙ্গে ওর ছবি দেখি ততবারই মনে হয় আমরা বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যা আমাদের করা উচিত। ২১ সালে ওর নামটা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত করতে পারায় ওর পরিবারটা কিছুটা সহায়তা পাচ্ছে। এটি একটি সান্ত¡না। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আফতাব আহমদকে গুলি করে হত্যা করা হলো-তারও কোনো বিচার হয়নি। এদের কারও কারও সঙ্গে আমি রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। আফতাব তো এক সময়ে আমাদের ভাবনার বিপরীত রাজনীতি করেছে। মাহবুব ভাই বিপরীত রাজনীতি করেননি, তবে তার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে কোনোভাবেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার অপঘাতে মৃত্যু আমি বিচারহীনভাবে পার করাটা সমর্থন করি না। আমার নিজের কাছে এটিকে একটি দায় বলে মনে হয়।
আরও একটি দায় নিজের কাঁধে আছে। একাত্তর সালের ১৬ নভেম্বর শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস। হাওর অঞ্চলের এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় স্তরের মানুষজনেরা জানেন বলে মনে হয়না। ১৬ নভেম্বরতো দূরের কথা অন্য কোনোদিনও তার নাম কাউকে উচ্চারণ করতে শুনি না। জগৎজ্যোতি যে লড়াইতে শহীদ হন হাওরে তার মতো বড় যুদ্ধও আর হয়নি। তিনি যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন তাতে আমরা তাকে কেন যে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিইনি তাও আমি জানি না। ইতিহাস আমাদের সেজন্য ক্ষমা করবে না।
উল্লিখিত সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েই আমি কিছু কথা লিখতে পারি। সময় পেলেই ওদের নিয়ে আমি লিখবোও। আপাতত জগৎজ্যোতির ইতিহাসটা পড়ুন। মাহবুব ভাই, আফতাব আর কাইয়ুমের সঙ্গে আমার যতটা গাঢ় সম্পর্ক ছিল, জগৎজ্যোতির সঙ্গে তেমনটা ছিল না। তিনি আমার চাইতে এক শ্রেণী ওপরে একই স্কুলে পড়তেন। আমরা হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ থানার বিরাট গ্রামে অবস্থিত এএবিসি হাই স্কুলে পড়তাম। জগৎজ্যোতির বাড়ি বিরাট এর পাশের গ্রাম জলসুখায়। আমার জ্যেঠাতো ভাই আব্দুল হান্নান ও দুই ভাগিনা- প্রয়াত আবিদ ও হেলিম তার সহপাঠী ছিল। আবিদ আজ আর নেই। তবে সে জগৎজ্যোতির গ্রামের বাড়ি জলসুখাতেই লজিং থাকতো। ওরা একসঙ্গে স্কুলে আসতো। শুকনো মওসুমে একসঙ্গে পায়ে হেঁটে আসতেন তারা। বর্ষায় আসতেন এক নৌকায়। দারুণ বন্ধুত্ব ছিল ওদের। ওরা ৬০ সাল থেকে ৬৫ সাল অবধি পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়েছেন। আমরা তাদের ৬১ থেকে ৬৫ এই চার বছর দেখেছি। আমরা স্কুল ছাড়ার আগের বছর তারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ছাড়েন। তবে এরপর আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। অন্যদিকে আমার সঙ্গে জগৎজ্যোতির সম্পর্কটা স্কুলেই সীমিত থাকেনি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধের জন্য। তিনি একাত্তর সালে যে যুদ্ধে শহীদ হন আমি সেই এলাকারই বাসিন্দা। শাল্লা আমার বাড়ির পাশের থানা। শাল্লার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো আমাদের জন্য দারুণ উদ্বেগের ছিলো। আরও একটি বড় বিষয় হচ্ছে; আমি বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে জগৎজ্যোতির খুনি ও পলাতক রাজাকারদের আমার গ্রামের বাড়িতে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলাম যাদের শাল্লার মুক্তিযোদ্ধারা পরে হত্যা করে। আমি সেই ইতিহাসটি এখানে উল্লেখ করব। জগৎজ্যোতি আমার গ্রামে বা তার পাশের গ্রাম কল্যাণপুরে সাধারণ মানুষের ভরসার কেন্দ্র হিসেবে আসা-যাওয়া করতেন। আমাদের গ্রামের বাজার কৃষ্ণপুর ছিল তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পের মতো। যদিও আমি তখন ভারতে তথাপি আমি পরে জেনেছি যে শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামটিকে তাদের নানা কাজে ব্যবহার করত। আমাদের বাজারটি তাদের রসদ জোগাতো। আমার চাচাতো ভাই ডা. নিয়াজ মুহম্মদ তালুকদার তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আর বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। হাসান মুর্শেদ নামক একজন জগৎজ্যোতির ওপর একটি বই লিখেছেন যার অংশ বিশেষ একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হাসান মুর্শেদের কাছ থেকে জগৎজ্যোতির যুদ্ধের ইতিহাসটি ছোট করে নিচ্ছি। আসুন একটু যুদ্ধের শুরুর বিবরণটি পাঠ করি। এটি বিজয় দিবসের মাত্র এক মাস আগের ঘটনা।
“সেদিন জগৎজ্যোতির দলটা ছিল ৪২ জনের। খালিয়াজুড়ির কল্যাণপুর (আমার গ্রামের পাশের গ্রাম) থেকে কয়েকটা নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটার মূল অপারেশন ছিল আজমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উড়িয়ে দেয়া। যাবার পথে মুক্তিযোদ্ধা সুবল দাসের দলকে সাহায্য করার জন্য ঘুঙ্গিয়ার গাঁও, শাল্লায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে জ্যোতির দল। সেখান থেকে ভোরে রওয়ানা হয়ে সকাল ৯টায় ইউনিয়ন অফিসের সামনে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের নৌকা, তেলাপোকাগুলো নিরীহ জেলেদের নৌকা আটকে লুটপাট করছে। এক জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে আকুল স্বরে অনুনয় করল, ও দাস বাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান।’
তৎক্ষণাৎ আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার মারা যায় সেখানেই। বাকিরা দুই নৌকায় ইঁদুরের বাচ্চার মতো পালিয়ে আসতে থাকে। জ্যোতি বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে বারোজন সঙ্গে নিয়ে তাড়া করেন সেই পলায়নপর তেলাপোকাগুলোকে। অন্যরা তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, জগৎজ্যোতি ধমক দিয়ে বলেছে, কয়টা রাজাকার ধরতে সবার আসার কি দরকার?
বোঝা যায় প্রচ- আত্মবিশ্বাসে ভরপুর জগৎজোতি নিজের সক্ষমতার প্রতি অসাধারণ বিশ্বাস রাখতো। হাওরের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। খুব সঙ্গতকারণেই তাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা একটু বেশিই থাকে। (চলবে)
সর্বশেষ সম্পাদনা: ১২ নভেম্বর, ২০২১
[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর প্রণেতা]
মোস্তাফা জব্বার
সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১
এক
বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী বা সুবর্ণজয়ন্তী এবার আমরা পার করছি। বরাবরের মতোই বাঙালি তার এই বিজয়ের দিনটিকে অনন্য সাধারণ করে তোলার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। বিজয় অর্জন করার মাত্র দুদিন আগে আলবদর রাজাকাররা আমাদের দেশের মেধাবীদের যেভাবে হত্যা করেছিলো তা আমরা এমনভাবে পালন করছি যাতে মনেই হবে যে এরই মাঝে আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছি। তবে বিজয় অর্জনের এত বছর পরেও আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমরা সব শহীদকে সেই সম্মান দিতে পেরেছি, যা আমাদের দেয়া উচিত ছিল। শহীদদের তালিকায় বুদ্ধিজীবীরাই থাকুক বা মুক্তিযোদ্ধাই থাকুক কিংবা অতি সাধারণ মানুষ যারা গণহত্যার শিকার হয়েছিল তাদের প্রতি কি আমরা সেই সম্মান দিতে পারছি, যা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। দুঃখজনকভাবে এটিও সত্য যে আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের সেই শহীদদের চিনে কিনা-জানে কিনা বা আমরা তাদের শহীদদের কথা বলাও হয় কিনা। আজকের বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি সেই মানুষগুলোই সংখ্যায় বেশি। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরার কাজটা আমরা খুব সক্ষমতার সঙ্গে করতে পারিনি। ৭৫ থেকে ৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৮ সময়টাতে বাংলাদেশের সামনে চলার পাটিকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে পাকিস্তানতন্ত্র বানানোর প্রচেষ্টার জন্য সেটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
৯ নভেম্বর ২০১৭ আমার প্রিয় মানুষদের একজন বাসদ নেতা আ ফ ম মাহবুবুল হক কানাডা থেকে পরপারে চলে গেলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটিকে দেশে আনা হলো না। আমার জানামতে তাকে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রও দেয়া হয়নি। মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কানাডার মাটিতে শুয়ে থাকতে হলো। এর ফলে তার সহযোদ্ধারা বা দেশের মানুষ, এমনকি তার কবরও জিয়ারত করতে পারবে না। আমি তাকে সেই ৬৮ সাল থেকে দেখে এটা নিশ্চিত জানি যে, এই দেশের কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি কোনোদিন কোনো আকারে গ্রহণ করেননি। দেশ তাকে কোনো প্রতিদান না দিক অন্তত সম্মানটাতো তার প্রাপ্য। কিন্তু সেটি আমরা দিতে পারিনি। ৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহম্মদ আলী জিন্নাহ হলে প্রবেশ করার পর থেকে যতদিন তিনি ঢাকায় ছিলেন ততদিনই একেবারে বড় ভাই বা অভিভাবক এর মতো মাথার ওপরে ছিলেন। সেই মানুষটি অপঘাতে প্রাণ হারালেন, তার বিচারও হলো না। সেই কষ্টটা এখনও সামলাতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মাহবুব ভাইয়ের কাছে এত ঋণী যে এই অপারগতার দায় থেকে নিজেকে কোনোভাবেই মুক্ত করতে পারছি না। আমার নিজের কষ্ট লাগে যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ভরে যায় আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খবর কেউ রাখে না। এটি নিশ্চিত যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও ভাতার জন্য যুদ্ধ করেনি। কিন্তু রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে তাকে স্বীকৃতি প্রদান করা। অথচ রাষ্ট্র আমার মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে স্বীকৃতিই দেয়নি।
আরও অনেক দায় থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। তারও এক বছর আগে ১৬ সালের ১৬ নভেম্বর চলে গেলো খুলনার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু শেখ আব্দুল কাইয়ুম। ওর জন্যও কিছুই করতে পারিনি। যতবার ওর মেয়ে ফারজানার সঙ্গে ওর ছবি দেখি ততবারই মনে হয় আমরা বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যা আমাদের করা উচিত। ২১ সালে ওর নামটা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত করতে পারায় ওর পরিবারটা কিছুটা সহায়তা পাচ্ছে। এটি একটি সান্ত¡না। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু আফতাব আহমদকে গুলি করে হত্যা করা হলো-তারও কোনো বিচার হয়নি। এদের কারও কারও সঙ্গে আমি রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। আফতাব তো এক সময়ে আমাদের ভাবনার বিপরীত রাজনীতি করেছে। মাহবুব ভাই বিপরীত রাজনীতি করেননি, তবে তার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে কোনোভাবেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার অপঘাতে মৃত্যু আমি বিচারহীনভাবে পার করাটা সমর্থন করি না। আমার নিজের কাছে এটিকে একটি দায় বলে মনে হয়।
আরও একটি দায় নিজের কাঁধে আছে। একাত্তর সালের ১৬ নভেম্বর শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস। হাওর অঞ্চলের এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় স্তরের মানুষজনেরা জানেন বলে মনে হয়না। ১৬ নভেম্বরতো দূরের কথা অন্য কোনোদিনও তার নাম কাউকে উচ্চারণ করতে শুনি না। জগৎজ্যোতি যে লড়াইতে শহীদ হন হাওরে তার মতো বড় যুদ্ধও আর হয়নি। তিনি যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন তাতে আমরা তাকে কেন যে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিইনি তাও আমি জানি না। ইতিহাস আমাদের সেজন্য ক্ষমা করবে না।
উল্লিখিত সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েই আমি কিছু কথা লিখতে পারি। সময় পেলেই ওদের নিয়ে আমি লিখবোও। আপাতত জগৎজ্যোতির ইতিহাসটা পড়ুন। মাহবুব ভাই, আফতাব আর কাইয়ুমের সঙ্গে আমার যতটা গাঢ় সম্পর্ক ছিল, জগৎজ্যোতির সঙ্গে তেমনটা ছিল না। তিনি আমার চাইতে এক শ্রেণী ওপরে একই স্কুলে পড়তেন। আমরা হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ থানার বিরাট গ্রামে অবস্থিত এএবিসি হাই স্কুলে পড়তাম। জগৎজ্যোতির বাড়ি বিরাট এর পাশের গ্রাম জলসুখায়। আমার জ্যেঠাতো ভাই আব্দুল হান্নান ও দুই ভাগিনা- প্রয়াত আবিদ ও হেলিম তার সহপাঠী ছিল। আবিদ আজ আর নেই। তবে সে জগৎজ্যোতির গ্রামের বাড়ি জলসুখাতেই লজিং থাকতো। ওরা একসঙ্গে স্কুলে আসতো। শুকনো মওসুমে একসঙ্গে পায়ে হেঁটে আসতেন তারা। বর্ষায় আসতেন এক নৌকায়। দারুণ বন্ধুত্ব ছিল ওদের। ওরা ৬০ সাল থেকে ৬৫ সাল অবধি পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়েছেন। আমরা তাদের ৬১ থেকে ৬৫ এই চার বছর দেখেছি। আমরা স্কুল ছাড়ার আগের বছর তারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ছাড়েন। তবে এরপর আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। অন্যদিকে আমার সঙ্গে জগৎজ্যোতির সম্পর্কটা স্কুলেই সীমিত থাকেনি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধের জন্য। তিনি একাত্তর সালে যে যুদ্ধে শহীদ হন আমি সেই এলাকারই বাসিন্দা। শাল্লা আমার বাড়ির পাশের থানা। শাল্লার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো আমাদের জন্য দারুণ উদ্বেগের ছিলো। আরও একটি বড় বিষয় হচ্ছে; আমি বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে জগৎজ্যোতির খুনি ও পলাতক রাজাকারদের আমার গ্রামের বাড়িতে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলাম যাদের শাল্লার মুক্তিযোদ্ধারা পরে হত্যা করে। আমি সেই ইতিহাসটি এখানে উল্লেখ করব। জগৎজ্যোতি আমার গ্রামে বা তার পাশের গ্রাম কল্যাণপুরে সাধারণ মানুষের ভরসার কেন্দ্র হিসেবে আসা-যাওয়া করতেন। আমাদের গ্রামের বাজার কৃষ্ণপুর ছিল তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পের মতো। যদিও আমি তখন ভারতে তথাপি আমি পরে জেনেছি যে শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামটিকে তাদের নানা কাজে ব্যবহার করত। আমাদের বাজারটি তাদের রসদ জোগাতো। আমার চাচাতো ভাই ডা. নিয়াজ মুহম্মদ তালুকদার তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আর বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। হাসান মুর্শেদ নামক একজন জগৎজ্যোতির ওপর একটি বই লিখেছেন যার অংশ বিশেষ একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হাসান মুর্শেদের কাছ থেকে জগৎজ্যোতির যুদ্ধের ইতিহাসটি ছোট করে নিচ্ছি। আসুন একটু যুদ্ধের শুরুর বিবরণটি পাঠ করি। এটি বিজয় দিবসের মাত্র এক মাস আগের ঘটনা।
“সেদিন জগৎজ্যোতির দলটা ছিল ৪২ জনের। খালিয়াজুড়ির কল্যাণপুর (আমার গ্রামের পাশের গ্রাম) থেকে কয়েকটা নৌকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটার মূল অপারেশন ছিল আজমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উড়িয়ে দেয়া। যাবার পথে মুক্তিযোদ্ধা সুবল দাসের দলকে সাহায্য করার জন্য ঘুঙ্গিয়ার গাঁও, শাল্লায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে জ্যোতির দল। সেখান থেকে ভোরে রওয়ানা হয়ে সকাল ৯টায় ইউনিয়ন অফিসের সামনে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের নৌকা, তেলাপোকাগুলো নিরীহ জেলেদের নৌকা আটকে লুটপাট করছে। এক জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে আকুল স্বরে অনুনয় করল, ও দাস বাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান।’
তৎক্ষণাৎ আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার মারা যায় সেখানেই। বাকিরা দুই নৌকায় ইঁদুরের বাচ্চার মতো পালিয়ে আসতে থাকে। জ্যোতি বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে বারোজন সঙ্গে নিয়ে তাড়া করেন সেই পলায়নপর তেলাপোকাগুলোকে। অন্যরা তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, জগৎজ্যোতি ধমক দিয়ে বলেছে, কয়টা রাজাকার ধরতে সবার আসার কি দরকার?
বোঝা যায় প্রচ- আত্মবিশ্বাসে ভরপুর জগৎজোতি নিজের সক্ষমতার প্রতি অসাধারণ বিশ্বাস রাখতো। হাওরের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। খুব সঙ্গতকারণেই তাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা একটু বেশিই থাকে। (চলবে)
সর্বশেষ সম্পাদনা: ১২ নভেম্বর, ২০২১
[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর প্রণেতা]