alt

উপ-সম্পাদকীয়

জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার উত্তাপ

রেজাউল করিম খোকন

: শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ২০২১

আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। নতুন হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে আরও ৩২৭ ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা। মনে রাখতে হবে, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিটেন্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে, তা নিশ্চিত করছে না। কোভিডসহ নানা কারণে অর্থনীতিতে বৈষম্য বেড়েছে। তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক দিক হলো, অর্থনীতি গতিশীল আছে। সাধারণ মানুষ কিছুটা হলে লাভবান হচ্ছেন। তবে সেই লাভ হতদরিদ্রদের দরিদ্র দশা থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখছে কিনা, তা দেখতে হবে। মাথাপিছু আয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক ছিল। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। করোনায় বেড়েছে দারিদ্র্য। আবার বাড়ছে মাথাপিছু আয়। এ পরস্পর বিপরীত অবস্থার ব্যাখ্যা কী।

ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় বাসের ভাড়া ইচ্ছেমতো বাড়ানোয় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। যদিও বিআরটিএ বাড়তি ভাড়ায় নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে। তবে তা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে আছে সংশয়। কারণ অতীতে বাস মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে তার কোনো নজির নেই। আর তেলে চলা বাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হলেও গ্যাসে চলা বাসের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা। অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটি চেইন রিঅ্যাকশন আছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের যাতায়াত ভাড়া বেড়ে গেল। বেড়ে গেল পণ্য পরিবহন খরচ। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম খুব দ্রুতই বাড়ছে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে এর দামও বাড়বে। এখানে দুই ধরনের প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন এবং পরিবহন- দুই ধরনের খরচই বাড়ছে। অন্য শিল্প উৎপাদনের খরচও বাড়ছে। আর যেসব পণ্যের ওপর সরাসরি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব নাই তার দামও বাড়বে। কারণ যিনি ভোক্তা তাদেরই একটি অংশ বিক্রেতা ও উৎপাদনকারী। ফলে দাম বাড়ছে সবকিছুর।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হিসাবে ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে বেড়েছে ৬.৫০ শতাংশ আর ২০১৮ সালে বেড়েছে ৬ শতাংশ। ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এ সময়ে। তারা মনে করছে চলতি বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার অতীতের সব হিসাব ছাড়িয়ে যাবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিপিআরসি সর্বশেষ গবেষণা বলেছে, তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। গত মার্চে এ সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ। গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। এটা ঠিক যে মোট উৎপাদন বেড়েছে। মোট জাতীয় সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে। কিন্তু সেটা কিছু মানুষের, সবার নয়। ফলে সবার জীবনে এর প্রভাব নেই।

বাংলাদেশে করোনার মধ্যেও কোটিপতিদের আয় বেড়েছে। ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর আয় বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে কাজ ও ব্যবসা হারিয়েছেন। আর সাধারণ মানুষের আয় বাড়লেও তা খেয়ে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। এখন মূল্যস্ফীতির হার ছয় ভাগ। বাংলাদেশে এই যে সব কিছুর দাম বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক। বাংলাদেশে প্রতি বছর দাম বাড়ার এ প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রধানত পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল অথবা গ্যাস-বিদ্যুৎকে ঘিরে। প্রয়োজনীয় পেঁয়াজের প্রায় ৮০ ভাগই বাংলাদেশ নিজে উৎপাদন করে। বাকি পেঁয়াজ প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আর এই আমদানি সংকট শুরু হলেই দাম বাড়তে থাকে; যার প্রভাব শুরু হয় সব ভোগ্যপণ্যে। ভোজ্যতেলেও বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। তবে এ তেল আমদানি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জন্য বলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয়ের কথা।

আসলে এখানে কাজ করছে সিন্ডিকেট ও সরকারের কিছু ভুল নীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে এখানে বিপিসি কমায় না। কিন্তু বাড়লে বাড়ায়। গত এক বছরে এই করে বিপিসি পাঁচ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় তাদের সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। সরকারের সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের পক্ষে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বাজার মনিটরিং টিম, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন কিছুই কাজে আসছে না। বাস্তবে এখানে প্রতিযোগিতামূলক কোনো বাজার নেই। আছে সিন্ডিকেট।

সাধারণ মানুষকে এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। এখন যে বেষ্টনী আছে আছে তা সব মানুষের জন্য নয়। প্রকৃত অর্থেই সবার আয় বাড়তে হবে। কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দরকার।

জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার উত্তাপ সবখানেই। কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে

অভিঘাতের কথা চিন্তা না করে কোন আলোচনা ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৪২ ডলার। তখন বাংলাদেশে লিটারে ডিজেলের দাম ৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ করা হয়। দাম কমানোর পরও কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি মূল্যে তেল বিক্রি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি। এ কারণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯০৪০ কোটি টাকা মুনাফা করে তারা। ২০১৬-১৭ সালে এসে মুনাফা দাঁড়ায় ৮৬৫৩ কোটিতে। এর পরের বছরগুলোতে বিপিসি গড়ে পাঁচ হাজার কোটির টাকার বেশি লাভ করেছে। সব মিলিয়ে আট বছরে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকায়। যেখানে ২০০৮-২০১৪ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৩৮ হাজার ৬৪৬ কোটি।

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার আর কত ভর্তুকি দেবে। কিছুটা তো ভোক্তাদের শেয়ার করতেই হবে। সরকারকে আয় করে তারপর ব্যয় করতে হয়। যখন দাম কমে আমরা কমাই, যখন বাড়ে আমরা বাড়াই।’

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে পরিবহন, বিদ্যুৎ, কৃষিশিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়া, যার যন্ত্রণাদায়ক আঁচ এরই মধ্যে মানুষ অনুভব করতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য তো আর মুনাফা অর্জন নয়। এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সেচের খরচের জোগান কৃষকদের জন্য বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। এ বাড়তি টাকা তারা কোথায় পাবেন? খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কীভাবে সামলাবেন। বাংলাদেশে গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক না কেন, কৃষক-শ্রমিক বা চাকরিজীবী যেই হোন না কেন, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া সবার জন্যই বাজারদর এখন বড় মাথা ব্যথার কারণ।

জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার উত্তাপ সবখানেই। কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণেই বলা যায়, বাজারে মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়াচ্ছে ক্রমাগতভাবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার উত্তাপ

রেজাউল করিম খোকন

শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ২০২১

আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। নতুন হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে আরও ৩২৭ ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা। মনে রাখতে হবে, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিটেন্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে, তা নিশ্চিত করছে না। কোভিডসহ নানা কারণে অর্থনীতিতে বৈষম্য বেড়েছে। তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক দিক হলো, অর্থনীতি গতিশীল আছে। সাধারণ মানুষ কিছুটা হলে লাভবান হচ্ছেন। তবে সেই লাভ হতদরিদ্রদের দরিদ্র দশা থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখছে কিনা, তা দেখতে হবে। মাথাপিছু আয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক ছিল। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। করোনায় বেড়েছে দারিদ্র্য। আবার বাড়ছে মাথাপিছু আয়। এ পরস্পর বিপরীত অবস্থার ব্যাখ্যা কী।

ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় বাসের ভাড়া ইচ্ছেমতো বাড়ানোয় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। যদিও বিআরটিএ বাড়তি ভাড়ায় নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে। তবে তা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে আছে সংশয়। কারণ অতীতে বাস মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে তার কোনো নজির নেই। আর তেলে চলা বাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হলেও গ্যাসে চলা বাসের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা। অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এর একটি চেইন রিঅ্যাকশন আছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের যাতায়াত ভাড়া বেড়ে গেল। বেড়ে গেল পণ্য পরিবহন খরচ। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম খুব দ্রুতই বাড়ছে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে এর দামও বাড়বে। এখানে দুই ধরনের প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন এবং পরিবহন- দুই ধরনের খরচই বাড়ছে। অন্য শিল্প উৎপাদনের খরচও বাড়ছে। আর যেসব পণ্যের ওপর সরাসরি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব নাই তার দামও বাড়বে। কারণ যিনি ভোক্তা তাদেরই একটি অংশ বিক্রেতা ও উৎপাদনকারী। ফলে দাম বাড়ছে সবকিছুর।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হিসাবে ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে বেড়েছে ৬.৫০ শতাংশ আর ২০১৮ সালে বেড়েছে ৬ শতাংশ। ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এ সময়ে। তারা মনে করছে চলতি বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার অতীতের সব হিসাব ছাড়িয়ে যাবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিপিআরসি সর্বশেষ গবেষণা বলেছে, তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। গত মার্চে এ সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ। গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। এটা ঠিক যে মোট উৎপাদন বেড়েছে। মোট জাতীয় সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে। কিন্তু সেটা কিছু মানুষের, সবার নয়। ফলে সবার জীবনে এর প্রভাব নেই।

বাংলাদেশে করোনার মধ্যেও কোটিপতিদের আয় বেড়েছে। ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর আয় বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে কাজ ও ব্যবসা হারিয়েছেন। আর সাধারণ মানুষের আয় বাড়লেও তা খেয়ে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। এখন মূল্যস্ফীতির হার ছয় ভাগ। বাংলাদেশে এই যে সব কিছুর দাম বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক। বাংলাদেশে প্রতি বছর দাম বাড়ার এ প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রধানত পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল অথবা গ্যাস-বিদ্যুৎকে ঘিরে। প্রয়োজনীয় পেঁয়াজের প্রায় ৮০ ভাগই বাংলাদেশ নিজে উৎপাদন করে। বাকি পেঁয়াজ প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আর এই আমদানি সংকট শুরু হলেই দাম বাড়তে থাকে; যার প্রভাব শুরু হয় সব ভোগ্যপণ্যে। ভোজ্যতেলেও বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। তবে এ তেল আমদানি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জন্য বলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয়ের কথা।

আসলে এখানে কাজ করছে সিন্ডিকেট ও সরকারের কিছু ভুল নীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে এখানে বিপিসি কমায় না। কিন্তু বাড়লে বাড়ায়। গত এক বছরে এই করে বিপিসি পাঁচ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় তাদের সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। সরকারের সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের পক্ষে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বাজার মনিটরিং টিম, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন কিছুই কাজে আসছে না। বাস্তবে এখানে প্রতিযোগিতামূলক কোনো বাজার নেই। আছে সিন্ডিকেট।

সাধারণ মানুষকে এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। এখন যে বেষ্টনী আছে আছে তা সব মানুষের জন্য নয়। প্রকৃত অর্থেই সবার আয় বাড়তে হবে। কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দরকার।

জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার উত্তাপ সবখানেই। কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে

অভিঘাতের কথা চিন্তা না করে কোন আলোচনা ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৪২ ডলার। তখন বাংলাদেশে লিটারে ডিজেলের দাম ৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ করা হয়। দাম কমানোর পরও কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি মূল্যে তেল বিক্রি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি। এ কারণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯০৪০ কোটি টাকা মুনাফা করে তারা। ২০১৬-১৭ সালে এসে মুনাফা দাঁড়ায় ৮৬৫৩ কোটিতে। এর পরের বছরগুলোতে বিপিসি গড়ে পাঁচ হাজার কোটির টাকার বেশি লাভ করেছে। সব মিলিয়ে আট বছরে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকায়। যেখানে ২০০৮-২০১৪ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৩৮ হাজার ৬৪৬ কোটি।

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার আর কত ভর্তুকি দেবে। কিছুটা তো ভোক্তাদের শেয়ার করতেই হবে। সরকারকে আয় করে তারপর ব্যয় করতে হয়। যখন দাম কমে আমরা কমাই, যখন বাড়ে আমরা বাড়াই।’

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে পরিবহন, বিদ্যুৎ, কৃষিশিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়া, যার যন্ত্রণাদায়ক আঁচ এরই মধ্যে মানুষ অনুভব করতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য তো আর মুনাফা অর্জন নয়। এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সেচের খরচের জোগান কৃষকদের জন্য বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। এ বাড়তি টাকা তারা কোথায় পাবেন? খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কীভাবে সামলাবেন। বাংলাদেশে গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক না কেন, কৃষক-শ্রমিক বা চাকরিজীবী যেই হোন না কেন, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া সবার জন্যই বাজারদর এখন বড় মাথা ব্যথার কারণ।

জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার উত্তাপ সবখানেই। কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণেই বলা যায়, বাজারে মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়াচ্ছে ক্রমাগতভাবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top