alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতের কৃষি আইন, মোদির ঘোষণা এবং রাজনীতি

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর ২০২১

সংশোধিত কৃষি আইনগুলো প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদি এই প্রত্যাহারের আইনি পদক্ষেপ করে কীভাবে শুরু হবে তা প্রধানমন্ত্রী জানাননি। মন্ত্রিসভার বৈঠক ছাড়া একক সিদ্ধান্তে আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সংসদের বাইরে খোদ প্রধানমন্ত্রী জানাচ্ছেন-এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত এর আগে দেখা যায়নি। নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক অভিসন্ধি যাই-ই থাকুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থেকে যখন তিনি আইনগুলো প্রত্যাহারের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী করবেন-এইটুকু প্রত্যাশা অন্তত দেশবাসী তার কাছে করতে পারে।

সমস্ত অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলোই প্রধানমন্ত্রী তিনটি কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্তকে শুধু নিজেদের রাজনৈতিক দলের সাফল্য হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছেন। সেভাবেই তারা বিজয় মিছিল করছেন। বিবৃতি দিচ্ছেন। ফেসবুকে তাদের ভক্তবৃন্দেরা দেওয়াল ভরাচ্ছেন। কিন্তু একটি অবিজেপি রাজনৈতিক দলই বলছেন না যে, কোনরকম দলীয় পতাকা না নিয়ে কেবলমাত্র কৃষি এবং কৃষকের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলন করলেন। গোবলয়ের সমস্ত স্তরের অবিজেপি রাজনীতিতে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ এই কোভিডকালের যাবতীয় আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে এই ধারাবাহিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে রাজনীতির দুনিয়ায় যে একটা নতুন ধারার সংযোগ করলেন। এটা আগামী ভারতকে একটা নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে হয়তো প্রতিষ্ঠিত করবে।

এমন আন্দোলন আমরা দেখেছিলাম, এনআরসির বিরুদ্ধে দিল্লির শাহিনবাগে। সেই আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কম মেহনত করেনি। খোদ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, শাহিদবাগের এনআরসিবিরোধী আন্দোলনকে ভাঙার বিষয়টি তার ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে নিয়েছিলেন। কোভিড সংক্রমণের ভয়াবহকতা সর্বোচ্চ স্তরে না পৌঁছলে শাহিনবাগ ও হয়তো কৃষি আন্দোলনের মতোই সাফল্য পেতো।

শাহিনবাগ এই কোভিডকালের প্রাদুর্ভাবের একদম প্রথম দিকে দিল্লি বিধানসভার ভোটকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল। দিল্লি বিধানসভায় জেতাটাকে মোদি-শাহ জুটি একদম নিজেদের ব্যক্তিগত মর্যাদার বিষয় হিসেবে নিয়েছিলেন। অমিত শাহ নিজে যেভাবে দিল্লি বিধানসভার ভোট ঘিরে প্রচার করেছিলেন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তেমন তৎপরতা এর আগে নিছক ভোটে জেতার তাগিদে আমরা দেখিনি।

এত কিছু সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু দিল্লিতে জেতেনি। কেজরিওয়াল বা তার দল আম আদমি পার্টি যে নিজের জোরে দিল্লি বিধানসভায় জিতেছে, তাও নয়। দিল্লি তে আম আদমি পার্টিকে জেতানোর থেকেও মানুষ বিজেপিকে হারানোর বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারি, আইনশৃঙ্খলার বিষয়গুলোর বাইরেও দিল্লিতে মানুষ বিজেপি হারাতে দৃঢ় সংকল্প ছিল এনআরসির প্রশ্নে। সিএএর প্রশ্নে। আর সে ক্ষেত্রে শাহিনবাগের ভূমিকা এবং অবদান ছিল ঐতিহাসিক। কেজরিওয়াল নানা অঙ্ক কষে একদিনের জন্যেও শাহিনবাগের অবস্থানে যাননি। ওই আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে বিজেপি আর খোদ অমিত শাহ যেসব অরাজনৈতিক, প্রতিহিংসামূলক কাজ করে গিয়েছেন, সেই প্রশ্নেও কেজরিওয়াল যে খুব দৃঢ় প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাও কিন্তু নয়।

শাহিনবাগ এবং কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক। দলীয় রাজনীতির আবর্তের বাইরে থেকে শাসকের ঘুম কেড়ে নেয়া এরকম ঘটনাক্রম এর আগে স্বাধীন ভারতে আর হয়নি

বিজেপি এবং রাষ্ট্রশক্তির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও দিল্লিতে কেজরিওয়ালের জয়ের পেছনে সামগ্রিকভাবে গোটা ভারতব্যাপী এনআরসিবিরোধী আন্দোলনের যে প্রভাব- তা না বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মানুষ কেজরিওয়াল নন। কিন্তু তিনি না বোঝার ভান করে থেকেছেন গোটা বিষয়টিতে। আর যখন কোভিড-লকডাউন ইত্যাদিকে ব্যবহার করে শাহিনবাগের আন্দোলনকে ধ্বংস করতে বিজেপি গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করেছে, মমতা থেকে কেজরিওয়াল, যাদের একাংশের প্রচার মাধ্যম মোদিবিরোধী আইকন হিসেবে তুলে ধরবার চেষ্টা করছে, তারা কিন্তু একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি। বরংচ মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আদলেই নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটেছেন কেজরিওয়াল। উত্তরপ্রদেশে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথ যেভাবে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ওপর নির্মীয়মাণ তথাকথিত রামমন্দির দেখার জন্যে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ করেছেন, কেজরিওয়াল ও তেমনটাই করেছেন। ওই বিতর্কিত ধর্মীয় সৌধ দেখার জন্য তিনি দিল্লির প্রবীণ নাগরিকদের উদ্দেশে আলাদা করে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।

শাহিনবাগ এবং কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক। দলীয় রাজনীতির আবর্তের বাইরে থেকে শাসকের ঘুম কেড়ে নেয়া এরকম ঘটনাক্রম এর আগে স্বাধীন ভারতে আর হয়নি। জরুরি অবস্থাবিরোধী আন্দোলনকে জয়প্রকাশ নারায়ণ দলীয় আবর্তের বাইরে রাখার একটা লোকদেখানো ঘোষণা করেছিলেন। তবে সেই আন্দোলনকে আরএসএস যেভাবে কব্জা করে ফেলেছিল, তাতে সেটি দলীয় রাজনীতির আবর্তের বাইরে ছিল-এটা জোর গলায় দাবি করা যায় না।

শাহিনবাগ বা কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলনকে দলীয় ঘেরাটোপের ভেতরে নিয়ে আসতে সমস্ত অবিজেপি দলগুলোই চেষ্টার কসুর করেনি। কিন্তু আন্দোলনের মেজাজটাই ছিল এমন যে, দলের ঝান্ডা ছাড়া যে কোনো দলের সাধারণ কর্মী থেকে শীর্ষ নেতা, সকলকেই এই আন্দোলনগুলো অতি কাছের মানুষ হিসেবে মেনে নিয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের গায়ে দলীয় তকমাকে কিছুতেই সাঁটতে দেয়নি।

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির গোটা ভারতের প্রবাহমান চরিত্র বদলে দিয়ে ভারতকে মুসলমান শূন্য, রাজনৈতিক হিন্দুদের দেশে পরিণত করবার যে হিশহিশে তোড়জোর, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে ভোট রাজনীতিকেই সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে সমস্ত অবিজেপি দলগুলো। বামপন্থি দলগুলোও যে এর থেকে ব্যতিক্রম- তেমন দাবি করা যায় না। হিন্দু ভোট ঘিরে অত্যন্ত সাবধানী পদচারণা কংগ্রেসের। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, বিহারে লালুর দল, উড়িষ্যাতে বিজু জনতা দল, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বা অন্ধ্র-তেলেঙ্গানায় তেলেগু দেশম, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, কর্ণাটকে জনতা পার্টি, তামিলনাডুতে এ ডিএমকে বা এআইএডিএমকে— প্রত্যেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি কপচালেও ভোট রাজনীতির তাগিদে একশো শতাংশ ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছেন না। ভাবতে অবাক লাগে বামেরাও কেরল- পশ্চিমবঙ্গ- বিহার- ত্রিপুরাতে নির্বাচনী সংগ্রামকেই একমাত্র মোক্ষ ঠাওড়েছেন। ফলে এক এক রাজ্যে , সেই সেই রাজ্যের বিন্যাসের ওপরে তারা নীতি স্থির করেছেন। যে কংগ্রেসের সঙ্গে কেরলে বামেদের সাপে নেউলে সম্পর্ক, সেই কংগ্রেসই পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে বামেদের বন্ধু। আবার যে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে মেছোহাটার রাজনীতি করছে, সেই তৃণমূলেরই এক দল বদলু নেত্রীর ওপর বিজেপি সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ ঘিরে প্রাদেশিক স্তরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সক্রিয় বামেরা ত্রিপুরায়। অথচ, তৃণমূল অমন কান্ড প্রায় প্রতিদিনই করছে পশ্চিমবঙ্গে সবস্তরের বামকর্মীদের প্রতি।

এই যে নীতি ও কৌশলগত বিভ্রান্তি, তাকে সুবিধাবাদ বলে ধরে নিচ্ছেন একটা বড় অংশের বামকর্মী- সমর্থকেরা। বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে অতিবাম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব দীপঙ্কর ভট্টাচার্য মমতার প্রতি যে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন, তা দলমতের ঊর্ধ্বে গোটা ধর্ম নিরপেক্ষ শিবির কে বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু ভোট বড়ো বালাই। দীপঙ্কর আরএসএসের অতি বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব মমতার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছেন- দুবছর পরের দিল্লি ভোটের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বামেরা বলছেন না।

ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি যখন ভোট রাজনীতির দায়ে পড়ে ব্যাকফুটে চলে যায়- তখন আগামী রাজনীতির যে অশনিসংকেত বয়ে আনে তা বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা জ্যোতি বসু, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষাণসিং সুরজিত, সৈফুদ্দিন চৌধুরী, গীতা মুখোপাধ্যায় দের ছিল। আজ আছে মহঃ সেলিমের । কারণ, যুবকর্মী হিসেবে তার ভারতদর্শনের সূচনা। আরএস ওয়াজেদ আলীর সেই ট্রাডিশনের ভারত আত্মাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করবার মতো সার্বিক প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, মননশীলতা এবং সর্বোপরি পরমতসহিষ্ণু, সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আজকের বাংলা তো বটেই , গোটা ভারতেও প্রায় দুর্লভ হয়ে পড়ছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতের কৃষি আইন, মোদির ঘোষণা এবং রাজনীতি

গৌতম রায়

শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর ২০২১

সংশোধিত কৃষি আইনগুলো প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদি এই প্রত্যাহারের আইনি পদক্ষেপ করে কীভাবে শুরু হবে তা প্রধানমন্ত্রী জানাননি। মন্ত্রিসভার বৈঠক ছাড়া একক সিদ্ধান্তে আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সংসদের বাইরে খোদ প্রধানমন্ত্রী জানাচ্ছেন-এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত এর আগে দেখা যায়নি। নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক অভিসন্ধি যাই-ই থাকুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থেকে যখন তিনি আইনগুলো প্রত্যাহারের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী করবেন-এইটুকু প্রত্যাশা অন্তত দেশবাসী তার কাছে করতে পারে।

সমস্ত অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলোই প্রধানমন্ত্রী তিনটি কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্তকে শুধু নিজেদের রাজনৈতিক দলের সাফল্য হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছেন। সেভাবেই তারা বিজয় মিছিল করছেন। বিবৃতি দিচ্ছেন। ফেসবুকে তাদের ভক্তবৃন্দেরা দেওয়াল ভরাচ্ছেন। কিন্তু একটি অবিজেপি রাজনৈতিক দলই বলছেন না যে, কোনরকম দলীয় পতাকা না নিয়ে কেবলমাত্র কৃষি এবং কৃষকের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলন করলেন। গোবলয়ের সমস্ত স্তরের অবিজেপি রাজনীতিতে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ এই কোভিডকালের যাবতীয় আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে এই ধারাবাহিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে রাজনীতির দুনিয়ায় যে একটা নতুন ধারার সংযোগ করলেন। এটা আগামী ভারতকে একটা নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে হয়তো প্রতিষ্ঠিত করবে।

এমন আন্দোলন আমরা দেখেছিলাম, এনআরসির বিরুদ্ধে দিল্লির শাহিনবাগে। সেই আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কম মেহনত করেনি। খোদ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, শাহিদবাগের এনআরসিবিরোধী আন্দোলনকে ভাঙার বিষয়টি তার ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে নিয়েছিলেন। কোভিড সংক্রমণের ভয়াবহকতা সর্বোচ্চ স্তরে না পৌঁছলে শাহিনবাগ ও হয়তো কৃষি আন্দোলনের মতোই সাফল্য পেতো।

শাহিনবাগ এই কোভিডকালের প্রাদুর্ভাবের একদম প্রথম দিকে দিল্লি বিধানসভার ভোটকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল। দিল্লি বিধানসভায় জেতাটাকে মোদি-শাহ জুটি একদম নিজেদের ব্যক্তিগত মর্যাদার বিষয় হিসেবে নিয়েছিলেন। অমিত শাহ নিজে যেভাবে দিল্লি বিধানসভার ভোট ঘিরে প্রচার করেছিলেন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তেমন তৎপরতা এর আগে নিছক ভোটে জেতার তাগিদে আমরা দেখিনি।

এত কিছু সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু দিল্লিতে জেতেনি। কেজরিওয়াল বা তার দল আম আদমি পার্টি যে নিজের জোরে দিল্লি বিধানসভায় জিতেছে, তাও নয়। দিল্লি তে আম আদমি পার্টিকে জেতানোর থেকেও মানুষ বিজেপিকে হারানোর বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারি, আইনশৃঙ্খলার বিষয়গুলোর বাইরেও দিল্লিতে মানুষ বিজেপি হারাতে দৃঢ় সংকল্প ছিল এনআরসির প্রশ্নে। সিএএর প্রশ্নে। আর সে ক্ষেত্রে শাহিনবাগের ভূমিকা এবং অবদান ছিল ঐতিহাসিক। কেজরিওয়াল নানা অঙ্ক কষে একদিনের জন্যেও শাহিনবাগের অবস্থানে যাননি। ওই আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে বিজেপি আর খোদ অমিত শাহ যেসব অরাজনৈতিক, প্রতিহিংসামূলক কাজ করে গিয়েছেন, সেই প্রশ্নেও কেজরিওয়াল যে খুব দৃঢ় প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাও কিন্তু নয়।

শাহিনবাগ এবং কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক। দলীয় রাজনীতির আবর্তের বাইরে থেকে শাসকের ঘুম কেড়ে নেয়া এরকম ঘটনাক্রম এর আগে স্বাধীন ভারতে আর হয়নি

বিজেপি এবং রাষ্ট্রশক্তির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও দিল্লিতে কেজরিওয়ালের জয়ের পেছনে সামগ্রিকভাবে গোটা ভারতব্যাপী এনআরসিবিরোধী আন্দোলনের যে প্রভাব- তা না বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মানুষ কেজরিওয়াল নন। কিন্তু তিনি না বোঝার ভান করে থেকেছেন গোটা বিষয়টিতে। আর যখন কোভিড-লকডাউন ইত্যাদিকে ব্যবহার করে শাহিনবাগের আন্দোলনকে ধ্বংস করতে বিজেপি গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করেছে, মমতা থেকে কেজরিওয়াল, যাদের একাংশের প্রচার মাধ্যম মোদিবিরোধী আইকন হিসেবে তুলে ধরবার চেষ্টা করছে, তারা কিন্তু একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি। বরংচ মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আদলেই নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটেছেন কেজরিওয়াল। উত্তরপ্রদেশে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথ যেভাবে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ওপর নির্মীয়মাণ তথাকথিত রামমন্দির দেখার জন্যে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ করেছেন, কেজরিওয়াল ও তেমনটাই করেছেন। ওই বিতর্কিত ধর্মীয় সৌধ দেখার জন্য তিনি দিল্লির প্রবীণ নাগরিকদের উদ্দেশে আলাদা করে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।

শাহিনবাগ এবং কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক। দলীয় রাজনীতির আবর্তের বাইরে থেকে শাসকের ঘুম কেড়ে নেয়া এরকম ঘটনাক্রম এর আগে স্বাধীন ভারতে আর হয়নি। জরুরি অবস্থাবিরোধী আন্দোলনকে জয়প্রকাশ নারায়ণ দলীয় আবর্তের বাইরে রাখার একটা লোকদেখানো ঘোষণা করেছিলেন। তবে সেই আন্দোলনকে আরএসএস যেভাবে কব্জা করে ফেলেছিল, তাতে সেটি দলীয় রাজনীতির আবর্তের বাইরে ছিল-এটা জোর গলায় দাবি করা যায় না।

শাহিনবাগ বা কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলনকে দলীয় ঘেরাটোপের ভেতরে নিয়ে আসতে সমস্ত অবিজেপি দলগুলোই চেষ্টার কসুর করেনি। কিন্তু আন্দোলনের মেজাজটাই ছিল এমন যে, দলের ঝান্ডা ছাড়া যে কোনো দলের সাধারণ কর্মী থেকে শীর্ষ নেতা, সকলকেই এই আন্দোলনগুলো অতি কাছের মানুষ হিসেবে মেনে নিয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের গায়ে দলীয় তকমাকে কিছুতেই সাঁটতে দেয়নি।

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির গোটা ভারতের প্রবাহমান চরিত্র বদলে দিয়ে ভারতকে মুসলমান শূন্য, রাজনৈতিক হিন্দুদের দেশে পরিণত করবার যে হিশহিশে তোড়জোর, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে ভোট রাজনীতিকেই সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে সমস্ত অবিজেপি দলগুলো। বামপন্থি দলগুলোও যে এর থেকে ব্যতিক্রম- তেমন দাবি করা যায় না। হিন্দু ভোট ঘিরে অত্যন্ত সাবধানী পদচারণা কংগ্রেসের। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, বিহারে লালুর দল, উড়িষ্যাতে বিজু জনতা দল, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বা অন্ধ্র-তেলেঙ্গানায় তেলেগু দেশম, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, কর্ণাটকে জনতা পার্টি, তামিলনাডুতে এ ডিএমকে বা এআইএডিএমকে— প্রত্যেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি কপচালেও ভোট রাজনীতির তাগিদে একশো শতাংশ ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছেন না। ভাবতে অবাক লাগে বামেরাও কেরল- পশ্চিমবঙ্গ- বিহার- ত্রিপুরাতে নির্বাচনী সংগ্রামকেই একমাত্র মোক্ষ ঠাওড়েছেন। ফলে এক এক রাজ্যে , সেই সেই রাজ্যের বিন্যাসের ওপরে তারা নীতি স্থির করেছেন। যে কংগ্রেসের সঙ্গে কেরলে বামেদের সাপে নেউলে সম্পর্ক, সেই কংগ্রেসই পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে বামেদের বন্ধু। আবার যে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে মেছোহাটার রাজনীতি করছে, সেই তৃণমূলেরই এক দল বদলু নেত্রীর ওপর বিজেপি সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ ঘিরে প্রাদেশিক স্তরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সক্রিয় বামেরা ত্রিপুরায়। অথচ, তৃণমূল অমন কান্ড প্রায় প্রতিদিনই করছে পশ্চিমবঙ্গে সবস্তরের বামকর্মীদের প্রতি।

এই যে নীতি ও কৌশলগত বিভ্রান্তি, তাকে সুবিধাবাদ বলে ধরে নিচ্ছেন একটা বড় অংশের বামকর্মী- সমর্থকেরা। বিজেপিকে রোখার প্রশ্নে অতিবাম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব দীপঙ্কর ভট্টাচার্য মমতার প্রতি যে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন, তা দলমতের ঊর্ধ্বে গোটা ধর্ম নিরপেক্ষ শিবির কে বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু ভোট বড়ো বালাই। দীপঙ্কর আরএসএসের অতি বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব মমতার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছেন- দুবছর পরের দিল্লি ভোটের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বামেরা বলছেন না।

ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি যখন ভোট রাজনীতির দায়ে পড়ে ব্যাকফুটে চলে যায়- তখন আগামী রাজনীতির যে অশনিসংকেত বয়ে আনে তা বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা জ্যোতি বসু, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষাণসিং সুরজিত, সৈফুদ্দিন চৌধুরী, গীতা মুখোপাধ্যায় দের ছিল। আজ আছে মহঃ সেলিমের । কারণ, যুবকর্মী হিসেবে তার ভারতদর্শনের সূচনা। আরএস ওয়াজেদ আলীর সেই ট্রাডিশনের ভারত আত্মাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করবার মতো সার্বিক প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, মননশীলতা এবং সর্বোপরি পরমতসহিষ্ণু, সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আজকের বাংলা তো বটেই , গোটা ভারতেও প্রায় দুর্লভ হয়ে পড়ছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top