alt

উপ-সম্পাদকীয়

খেলা বনাম রাজনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২১
image

মিরপুরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজে অনেক দর্শককে পাকিস্তানের পতাকা বহন ও প্রদর্শন করতে দেখা গেছে

ঢাকার শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-পাকিস্তান তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে পাকিস্তানি জার্সি গায়ে পরে এবং পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে একদল তরুণ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে। খেলায় কোন টিমকে সমর্থন দেয়া অপরাধ নয়, কিন্তু বাংলাদেশি হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলায় বিপক্ষ দলকে সমর্থন করা দৃষ্টিকটু। বাংলাদেশি ক্রিকেটারেরা আউট হলে বা পাকিস্তানের কোন ক্রিকেটার ছক্কা মারলে কিছু বাঙালি তরুণ দর্শকদের উল্লাস দেখে মনে হয়েছে, এই তরুণেরা খেলা উপভোগ করছে না, তারা তাদের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এমন ঘটনা পাকিস্তানে হলে কী হতো? ২০১৬ সনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত অস্ট্রেলিয়াকে পরাস্ত করায় উমার দ্রাজ নামের এক পাকিস্তানি যুবক তাদের বাড়ির ছাদে ভারতের পতাকা ওড়ালে পুলিশ তাকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের বিরোধী গণ্য করে আটক করেছিল। ভারতেও একই অবস্থা; সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের কাছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের হেরে যাওয়ায় ভারতে কিছু লোক আনন্দ প্রকাশ করে এবং এতে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো ক্ষেপে দেশদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ১৪ ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক দিন দিন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শুধু খেলাকে পছন্দ করার লোক প্রতিদিন কমছে। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী লোকগুলো শুধু ভালো খেলার কারণে কোন খেলার দলকে সমর্থন করছেন না। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের আদর্শে যারা বিশ্বাসী তারা সাধারণত আবাহনীকে সমর্থন করে থাকেন, আর যারা আওয়ামী রাজনীতির বিরোধী তারা মোহামেডানের সমর্থক। খেলা নিয়ে মাতামতি শুরু হয় পাকিস্তান আর ভারতকে নিয়ে। পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় সমর্থনের বিভাজন এত মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, সমর্থিত দেশ হেরে গেলে সমুদয় দায় চাপানো হয় আম্পায়ার বা ক্রিকেট আয়োজকদের ওপর। বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে বেশ কিছু সমর্থকের পাকিস্তান ও ভারত প্রীতি এবং উন্মাদনা দেখে মনে হয় না এরা খেলার প্রতি খুব বেশি অনুরক্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শুরু হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। ভারতকে কত পচানো যায়, পাকিস্তানকে কতভাবে ধিক্কার দেয়া যায় তার ফন্দিফিকির দুপক্ষের সমর্থকেরা উদ্ভাবন করতে থাকে।

যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক তাদের মনে খেলার সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠে, একাত্তরে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন তারা কোনভাবেই ভুলতে পারে না, তারা মনেপ্রাণে চায় পাকিস্তান খারাপ খেলুক, হেরে যাক। পাকিস্তানকে সহ্য করতে পারে না বলেই তারা প্রতিপক্ষ ভারতকে অন্ধভাবে সমর্থন করে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা পাকিস্তানকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজেদের কপোলে পাকিস্তানি পতাকা আঁকে, গ্যালারির মেয়েরা আফ্রিদিকে বিয়ে করার বাসনা ব্যক্ত করে, আফ্রিদির দিকে বাতাসে চুমু ভাসিয়ে দেয়। পাকিস্তানের পক্ষের এই দর্শকরা মূলত আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির সমর্থক।

এই পর্যায়ে তখন খেলা আর খেলা থাকে না, খেলা হয়ে উঠে রাজনীতির রক্তাক্ত মাঠ, ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠে রণক্ষেত্র।

খেলা শুধু খেলা নয়, খেলার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদেরও উন্মেষ ঘটে। জাতীয়তাবোধ ভুলতে পারে না বলেই বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া খেলায় অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা বাংলাদেশকে সমর্থন করে থাকে। খেলায় জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত হয় বলেই ১৯৯৪ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আসরে আত্মঘাতী গোল করার ‘অপরাধে’ কলম্বিয়ার ফুটবলার আন্দ্রে এস্কোবারকে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৯ সনে হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল ১০০ ঘণ্টা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর মতো রাজনীতিও খেলার সঙ্গে জড়িত; তাই বাংলাদেশও ইসরাইলের সঙ্গে কোন খেলায় অংশ নিতে চাইবে না। সর্বশেষ অলিম্পিকে ইসরায়েলের সঙ্গে জুডো খেলা ছিল বলে এক মুসলিম দেশের অ্যাথলেট খেলায় অংশ নেয়নি। সংখ্যালঘু শেতাঙ্গ শাসকদের অনুসৃত বর্ণ বৈষম্যমূলক আচরণে অতিষ্ঠ সংখ্যাগুরু কালো মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংগঠনগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ১৯৭০ সন থেকে ১৯৯১ সন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট খেলতে পারেনি। শুধু ক্রিকেট নয়, তারা ১৯৯২ সনের পূর্ব পর্যন্ত অলিম্পিকে নিষিদ্ধ ছিল।

আধুনিক জমানায় খেলোয়াড়দের জাতীয়তাবোধ খুব কম, অর্থই তাদের কাছে মুখ্য। টেনিস খেলায় রজার ফেদেরার বা রাফায়েল নাদাল অলিম্পিক বা ডেভিস কাপের মতো টুর্নামেন্ট ছাড়া সাধারণত নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। আবার রিয়েল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার মতো ফুটবল ক্লাবেও নানা দেশের খেলোয়াড় খেলেন এবং এই জনপ্রিয় ক্লাব দুটি স্পেনের হলেও স্পেনকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে কোন দেশের জাতীয় ক্রীড়া দল ওই দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় জাতীয় দলের সমর্থন করা ওই দেশের নাগরিকদের দেশাত্মবোধের পরিচায়ক। তাই ভালো খেলার অজুহাত দিয়ে নিজ দেশের প্রতিপক্ষ অন্যদেশকে সমর্থন করার মধ্যে কোন গৌরব নেই। বাংলাদেশ যখন ক্রিকেট খেলার প্রতিদ্বন্দ্বী তখন সব বাঙালি এক কাতারে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জয় কামনা করবে-এটাই প্রত্যাশিত। কারণ কোন খেলায় খেলোয়াড়েরা হারলে দেশ হেরে যায়, জিতলে দেশ জিতে যায়; কেউ বলে না মাশরাফিরা জিতেছে, সবাই বলে বাংলাদেশ জিতেছে।

খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অনেক গভীর। খেলাকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখার প্রচেষ্টা কম হয়নি, কিন্তু রাজনীতি খেলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। একাত্তর সনে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মর্মান্তিক দৃশ্য অবলোকন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাবেক এমপি মাইকেল বার্ন পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে ব্রিটেনে প্রবেশ বন্ধ করে দেন এবং এতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়।

ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ না থাকায় বিশ্বকাপ ফুটবলে তাদের দেশের পতাকা নিয়ে মাতামাতিতে কেউ কিছু মনে করেন না। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের ফুটবল দল এখনো বিশ্বের আসরে স্থান করে নিতে না পারায় বাঙালিদের অন্য দেশের প্রতি সমর্থন স্বাভাবিক আনন্দ, উচ্ছ্বাস বলে মনে করা হয়।

কিন্তু ক্রিকেটের আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকায় বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে এত লাফালাফি ও আনন্দ প্রকাশ কিছুটা অশোভনীয়।

ক্রিকেট খেলায় মুখে আঁকা ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা শুধু খেলার প্রতি দর্শকের সমর্থনকে প্রকাশ করে না, প্রকাশ করে দর্শকের ওই দেশের প্রতি গভীর আবেগ আর অনুভূতি। একাত্তরে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের কথা এই তরুণদের না জানানোর ব্যর্থতা আমাদের সবার। যারা একাত্তর দেখেনি তারা কেন পাকিস্তানকে সমর্থন করে নিজেদের বিজয়ী মনে করে, কেন তারা ভারতকে গালাগাল দিয়ে পাকিস্তান ভাঙার খেদ মেটায়, কেন এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে উপহাস করে- তার সূত্র ও উৎস খোঁজা দরকার। এরা সংঘবদ্ধ, উগ্র, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ। কিছু তরুণ পাকিস্তানি জার্সি আর পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে যেভাবে গলা ফাটিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছিল তাতে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে কবি আবদুল হাকিমের কথাটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। আমি তত কট্টর নই। আমি আশা করব, একাত্তরে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া বাঙালি ক্রিকেটার মুশতাক আহমেদ এবং আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলের স্মরণে মিরপুর স্টেডিয়ামে যে দুটি স্ট্যান্ড রয়েছে তাতে যেন পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে কোন উগ্র তরুণের বাংলার মাটিতে জন্ম না হয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

খেলা বনাম রাজনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

মিরপুরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজে অনেক দর্শককে পাকিস্তানের পতাকা বহন ও প্রদর্শন করতে দেখা গেছে

শনিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২১

ঢাকার শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-পাকিস্তান তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে পাকিস্তানি জার্সি গায়ে পরে এবং পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে একদল তরুণ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে। খেলায় কোন টিমকে সমর্থন দেয়া অপরাধ নয়, কিন্তু বাংলাদেশি হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলায় বিপক্ষ দলকে সমর্থন করা দৃষ্টিকটু। বাংলাদেশি ক্রিকেটারেরা আউট হলে বা পাকিস্তানের কোন ক্রিকেটার ছক্কা মারলে কিছু বাঙালি তরুণ দর্শকদের উল্লাস দেখে মনে হয়েছে, এই তরুণেরা খেলা উপভোগ করছে না, তারা তাদের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এমন ঘটনা পাকিস্তানে হলে কী হতো? ২০১৬ সনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত অস্ট্রেলিয়াকে পরাস্ত করায় উমার দ্রাজ নামের এক পাকিস্তানি যুবক তাদের বাড়ির ছাদে ভারতের পতাকা ওড়ালে পুলিশ তাকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের বিরোধী গণ্য করে আটক করেছিল। ভারতেও একই অবস্থা; সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের কাছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের হেরে যাওয়ায় ভারতে কিছু লোক আনন্দ প্রকাশ করে এবং এতে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো ক্ষেপে দেশদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ১৪ ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক দিন দিন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শুধু খেলাকে পছন্দ করার লোক প্রতিদিন কমছে। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী লোকগুলো শুধু ভালো খেলার কারণে কোন খেলার দলকে সমর্থন করছেন না। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের আদর্শে যারা বিশ্বাসী তারা সাধারণত আবাহনীকে সমর্থন করে থাকেন, আর যারা আওয়ামী রাজনীতির বিরোধী তারা মোহামেডানের সমর্থক। খেলা নিয়ে মাতামতি শুরু হয় পাকিস্তান আর ভারতকে নিয়ে। পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ক্রিকেট খেলায় সমর্থনের বিভাজন এত মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, সমর্থিত দেশ হেরে গেলে সমুদয় দায় চাপানো হয় আম্পায়ার বা ক্রিকেট আয়োজকদের ওপর। বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে বেশ কিছু সমর্থকের পাকিস্তান ও ভারত প্রীতি এবং উন্মাদনা দেখে মনে হয় না এরা খেলার প্রতি খুব বেশি অনুরক্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শুরু হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। ভারতকে কত পচানো যায়, পাকিস্তানকে কতভাবে ধিক্কার দেয়া যায় তার ফন্দিফিকির দুপক্ষের সমর্থকেরা উদ্ভাবন করতে থাকে।

যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক তাদের মনে খেলার সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠে, একাত্তরে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন তারা কোনভাবেই ভুলতে পারে না, তারা মনেপ্রাণে চায় পাকিস্তান খারাপ খেলুক, হেরে যাক। পাকিস্তানকে সহ্য করতে পারে না বলেই তারা প্রতিপক্ষ ভারতকে অন্ধভাবে সমর্থন করে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা পাকিস্তানকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজেদের কপোলে পাকিস্তানি পতাকা আঁকে, গ্যালারির মেয়েরা আফ্রিদিকে বিয়ে করার বাসনা ব্যক্ত করে, আফ্রিদির দিকে বাতাসে চুমু ভাসিয়ে দেয়। পাকিস্তানের পক্ষের এই দর্শকরা মূলত আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির সমর্থক।

এই পর্যায়ে তখন খেলা আর খেলা থাকে না, খেলা হয়ে উঠে রাজনীতির রক্তাক্ত মাঠ, ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠে রণক্ষেত্র।

খেলা শুধু খেলা নয়, খেলার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদেরও উন্মেষ ঘটে। জাতীয়তাবোধ ভুলতে পারে না বলেই বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া খেলায় অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা বাংলাদেশকে সমর্থন করে থাকে। খেলায় জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত হয় বলেই ১৯৯৪ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আসরে আত্মঘাতী গোল করার ‘অপরাধে’ কলম্বিয়ার ফুটবলার আন্দ্রে এস্কোবারকে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৯ সনে হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল ১০০ ঘণ্টা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর মতো রাজনীতিও খেলার সঙ্গে জড়িত; তাই বাংলাদেশও ইসরাইলের সঙ্গে কোন খেলায় অংশ নিতে চাইবে না। সর্বশেষ অলিম্পিকে ইসরায়েলের সঙ্গে জুডো খেলা ছিল বলে এক মুসলিম দেশের অ্যাথলেট খেলায় অংশ নেয়নি। সংখ্যালঘু শেতাঙ্গ শাসকদের অনুসৃত বর্ণ বৈষম্যমূলক আচরণে অতিষ্ঠ সংখ্যাগুরু কালো মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংগঠনগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ১৯৭০ সন থেকে ১৯৯১ সন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট খেলতে পারেনি। শুধু ক্রিকেট নয়, তারা ১৯৯২ সনের পূর্ব পর্যন্ত অলিম্পিকে নিষিদ্ধ ছিল।

আধুনিক জমানায় খেলোয়াড়দের জাতীয়তাবোধ খুব কম, অর্থই তাদের কাছে মুখ্য। টেনিস খেলায় রজার ফেদেরার বা রাফায়েল নাদাল অলিম্পিক বা ডেভিস কাপের মতো টুর্নামেন্ট ছাড়া সাধারণত নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। আবার রিয়েল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার মতো ফুটবল ক্লাবেও নানা দেশের খেলোয়াড় খেলেন এবং এই জনপ্রিয় ক্লাব দুটি স্পেনের হলেও স্পেনকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে কোন দেশের জাতীয় ক্রীড়া দল ওই দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় জাতীয় দলের সমর্থন করা ওই দেশের নাগরিকদের দেশাত্মবোধের পরিচায়ক। তাই ভালো খেলার অজুহাত দিয়ে নিজ দেশের প্রতিপক্ষ অন্যদেশকে সমর্থন করার মধ্যে কোন গৌরব নেই। বাংলাদেশ যখন ক্রিকেট খেলার প্রতিদ্বন্দ্বী তখন সব বাঙালি এক কাতারে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জয় কামনা করবে-এটাই প্রত্যাশিত। কারণ কোন খেলায় খেলোয়াড়েরা হারলে দেশ হেরে যায়, জিতলে দেশ জিতে যায়; কেউ বলে না মাশরাফিরা জিতেছে, সবাই বলে বাংলাদেশ জিতেছে।

খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অনেক গভীর। খেলাকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখার প্রচেষ্টা কম হয়নি, কিন্তু রাজনীতি খেলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। একাত্তর সনে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মর্মান্তিক দৃশ্য অবলোকন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাবেক এমপি মাইকেল বার্ন পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে ব্রিটেনে প্রবেশ বন্ধ করে দেন এবং এতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়।

ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ না থাকায় বিশ্বকাপ ফুটবলে তাদের দেশের পতাকা নিয়ে মাতামাতিতে কেউ কিছু মনে করেন না। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের ফুটবল দল এখনো বিশ্বের আসরে স্থান করে নিতে না পারায় বাঙালিদের অন্য দেশের প্রতি সমর্থন স্বাভাবিক আনন্দ, উচ্ছ্বাস বলে মনে করা হয়।

কিন্তু ক্রিকেটের আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকায় বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে এত লাফালাফি ও আনন্দ প্রকাশ কিছুটা অশোভনীয়।

ক্রিকেট খেলায় মুখে আঁকা ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা শুধু খেলার প্রতি দর্শকের সমর্থনকে প্রকাশ করে না, প্রকাশ করে দর্শকের ওই দেশের প্রতি গভীর আবেগ আর অনুভূতি। একাত্তরে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের কথা এই তরুণদের না জানানোর ব্যর্থতা আমাদের সবার। যারা একাত্তর দেখেনি তারা কেন পাকিস্তানকে সমর্থন করে নিজেদের বিজয়ী মনে করে, কেন তারা ভারতকে গালাগাল দিয়ে পাকিস্তান ভাঙার খেদ মেটায়, কেন এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে উপহাস করে- তার সূত্র ও উৎস খোঁজা দরকার। এরা সংঘবদ্ধ, উগ্র, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ। কিছু তরুণ পাকিস্তানি জার্সি আর পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে যেভাবে গলা ফাটিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছিল তাতে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে কবি আবদুল হাকিমের কথাটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। আমি তত কট্টর নই। আমি আশা করব, একাত্তরে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া বাঙালি ক্রিকেটার মুশতাক আহমেদ এবং আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলের স্মরণে মিরপুর স্টেডিয়ামে যে দুটি স্ট্যান্ড রয়েছে তাতে যেন পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে কোন উগ্র তরুণের বাংলার মাটিতে জন্ম না হয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক

ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

back to top