মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য গর্ব করার মতো। পাশাপাশি আগের চেয়ে দ্রুত বেড়ে চলছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এদের অনেকেই নিয়োজিত হচ্ছে দেশ বিদেশের নানা কর্মকান্ডে। কেউ কেউ বহাল হচ্ছেন রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে। কিন্তু শিক্ষার এ বিস্তৃত পরিধি দিয়ে আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজের সার্বিক অগ্রগতির, প্রগতির ক্ষেত্রে কতটা ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাতে পারছি? আমাদের চিন্তা, মননে এমনকি প্রতিটি কর্মে আমরা কতটা মানবিক? আমাদের আচার-আচরণে, মানবতার বিচারে আমরা কতখানি উদারতার পরিচয় দিচ্ছি? এ দেশে তো বিরামহীন, অবর্ণনীয় নারী নির্যাতন, নিপীড়নের চিত্র অহরহ দেখছি। পারিবারিক নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, যৌন নিপীড়ন শেষে হত্যা, পেটের দায়ে কাজ করতে আসা শিশু গৃহকর্মীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন, যৌতুকের বলি হয়ে নারীর অব্যাহত আত্মহত্যার মতো নারীর প্রতি বহুমাত্রিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
তারপরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, যা কোনোমতে একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত হতে পারে না। কেন এদেশে প্রতিদিন ভেজাল ওষুধের কারখানা ধরা পড়ে? কেন দেশে কোন একটি খাদ্যপণ্য ভেজালমুক্ত পাওয়া যায় না? কেন মজুতদাররা খাদ্য মজুত করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, দাম বাড়ায়? কেন কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে পথে মিছিল করে? কেন মানুষ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজায়? কেন মানুষের গায়ে পেট্রোল বোমা ছুড়ে হত্যা করা হয়? এত কেনোর জবাব কী? শুধু কম্পিউটার লিটারেসি, আইসিটির প্রসার, মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি কি শিক্ষা বিকাশের মাপকাঠি হতে পারে? স্বভাব-চরিত্র গঠন, অভ্যাস পাল্টানো না গেলে শিক্ষা গ্রহণ করে কী লাভ? কী অর্জন দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর, সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের!
আজকাল আমাদের দেশে শিশু শিক্ষার পাঠ্যক্রমে মূল্যবোধ বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তেমন স্থান পেতে দেখি না। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা পাঠ্যক্রমের বাইরে তার শিক্ষার্থীকে তেমন কিছু শেখাবার তাগিদ অনুভব করেন না। আজকাল ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার নামে পাঠ্যপুস্তকে যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তার অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার তেমন প্রচেষ্টা সবক্ষেত্রে রয়েছে বলে মনে হয় না। মা-বাবা, শিক্ষককেই তো এ দায়িত্বটি নিতে হবে। দায়সারা গোছের শিক্ষকতা দিয়ে তো আর সে অর্জন সম্ভব নয়। আজকাল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান থেকে বিরত থেকে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের দিকে। শিক্ষকদের মধ্যেও তো রয়েছে বিভাজন, দলাদলি। আর শিক্ষার্থীরা এসবের সুযোগ নেবে তা স্বাভাবিক।
যে কোন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে মতাদর্শের অমিল থাকবে। শিক্ষকরাও এর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এসবের নেতিবাচক প্রভাব কেন শিক্ষার্থীদের জীবনকে কলুষিত করবে? শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলির কারণে তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধের স্থানটি অনেকটা বিচ্যুত হয়েছে। আমাদের দেশে আজকাল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যরিস্টার, ব্যবসায়ী বা বড় আমলা হওয়ার নেশায় নষ্ট করে দেয়া হয় শৈশব-কৈশোরের সব আনন্দ-আয়োজন। সেখানে সুকুমার বৃত্তি চর্চার তেমন কোন সুযোগ থাকে না। সমাজের প্রতি পদে সে প্রত্যক্ষ করে চরম ভন্ডামী আর নীতিহীনতা। ঘরে ও শিক্ষায়তনে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর খুব একটা সুযোগ তার কম। জীবনে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়ার পেছনে ছুটে চলার দুনির্বার নেশা তাকে চেপে ধরে জীবনের শুরুতে। বিত্ত-বৈভব আর প্রাচুর্যে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার প্রবল বাসনা মানুষের ভেতরকার জীবনবোধকে ক্রমশ কুরে কুরে খেতে থাকে। এক সময় সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলে সততা ও নিষ্ঠার মতো গুণাবলি অর্জনের সব শক্তি। একজন উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী বা যে কোন পেশায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে গাড়ি-ঘোড়ায় তার ঠিকই চড়া হয়, কিন্তু জীবনের সত্যিকারের সুখ-সমৃদ্ধির সন্ধান লাভ কঠিন হয়ে পড়ে।
দেশের প্রচলিত আইনকানুন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা তার নৈতিক দায়িত্ব। উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সঠিক দায়িত্ব পালন এবং কর্তব্যবোধের সৃষ্টি হয়। সুশিক্ষা বিকাশ ঘটায় মানবিক মূল্যবোধের। ঘরে বাবা-মা, অভিভাবকের কাছ থেকে শিশুকালে যে শিক্ষার শুরু হয় তার ধারাবাহিকতা চলে আমৃত্যু। পরবর্তীতে শিক্ষক এবং পারিপার্শ্বিকতা থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণই মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারে। সততা, নিষ্ঠাবোধ ছাড়া মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় না। আর মানবিক মূল্যবোধ ব্যতীত মানুষ কখনও মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে প্রচলিত সর্বস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং সমাজ কাঠামোর প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে হয় রাষ্ট্র ও সমাজকে। মানুষ হচ্ছে এ সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মানবিক কর্মযজ্ঞ দ্বারা গড়ে তোলা সম্ভব সবার বসবাসযোগ্য বিকশিত সমাজ।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য গর্ব করার মতো। পাশাপাশি আগের চেয়ে দ্রুত বেড়ে চলছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এদের অনেকেই নিয়োজিত হচ্ছে দেশ বিদেশের নানা কর্মকান্ডে। কেউ কেউ বহাল হচ্ছেন রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে। কিন্তু শিক্ষার এ বিস্তৃত পরিধি দিয়ে আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজের সার্বিক অগ্রগতির, প্রগতির ক্ষেত্রে কতটা ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাতে পারছি? আমাদের চিন্তা, মননে এমনকি প্রতিটি কর্মে আমরা কতটা মানবিক? আমাদের আচার-আচরণে, মানবতার বিচারে আমরা কতখানি উদারতার পরিচয় দিচ্ছি? এ দেশে তো বিরামহীন, অবর্ণনীয় নারী নির্যাতন, নিপীড়নের চিত্র অহরহ দেখছি। পারিবারিক নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, যৌন নিপীড়ন শেষে হত্যা, পেটের দায়ে কাজ করতে আসা শিশু গৃহকর্মীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন, যৌতুকের বলি হয়ে নারীর অব্যাহত আত্মহত্যার মতো নারীর প্রতি বহুমাত্রিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
তারপরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, যা কোনোমতে একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত হতে পারে না। কেন এদেশে প্রতিদিন ভেজাল ওষুধের কারখানা ধরা পড়ে? কেন দেশে কোন একটি খাদ্যপণ্য ভেজালমুক্ত পাওয়া যায় না? কেন মজুতদাররা খাদ্য মজুত করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, দাম বাড়ায়? কেন কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে পথে মিছিল করে? কেন মানুষ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজায়? কেন মানুষের গায়ে পেট্রোল বোমা ছুড়ে হত্যা করা হয়? এত কেনোর জবাব কী? শুধু কম্পিউটার লিটারেসি, আইসিটির প্রসার, মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি কি শিক্ষা বিকাশের মাপকাঠি হতে পারে? স্বভাব-চরিত্র গঠন, অভ্যাস পাল্টানো না গেলে শিক্ষা গ্রহণ করে কী লাভ? কী অর্জন দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর, সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের!
আজকাল আমাদের দেশে শিশু শিক্ষার পাঠ্যক্রমে মূল্যবোধ বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তেমন স্থান পেতে দেখি না। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা পাঠ্যক্রমের বাইরে তার শিক্ষার্থীকে তেমন কিছু শেখাবার তাগিদ অনুভব করেন না। আজকাল ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার নামে পাঠ্যপুস্তকে যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তার অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার তেমন প্রচেষ্টা সবক্ষেত্রে রয়েছে বলে মনে হয় না। মা-বাবা, শিক্ষককেই তো এ দায়িত্বটি নিতে হবে। দায়সারা গোছের শিক্ষকতা দিয়ে তো আর সে অর্জন সম্ভব নয়। আজকাল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান থেকে বিরত থেকে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের দিকে। শিক্ষকদের মধ্যেও তো রয়েছে বিভাজন, দলাদলি। আর শিক্ষার্থীরা এসবের সুযোগ নেবে তা স্বাভাবিক।
যে কোন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে মতাদর্শের অমিল থাকবে। শিক্ষকরাও এর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এসবের নেতিবাচক প্রভাব কেন শিক্ষার্থীদের জীবনকে কলুষিত করবে? শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলির কারণে তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধের স্থানটি অনেকটা বিচ্যুত হয়েছে। আমাদের দেশে আজকাল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যরিস্টার, ব্যবসায়ী বা বড় আমলা হওয়ার নেশায় নষ্ট করে দেয়া হয় শৈশব-কৈশোরের সব আনন্দ-আয়োজন। সেখানে সুকুমার বৃত্তি চর্চার তেমন কোন সুযোগ থাকে না। সমাজের প্রতি পদে সে প্রত্যক্ষ করে চরম ভন্ডামী আর নীতিহীনতা। ঘরে ও শিক্ষায়তনে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর খুব একটা সুযোগ তার কম। জীবনে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়ার পেছনে ছুটে চলার দুনির্বার নেশা তাকে চেপে ধরে জীবনের শুরুতে। বিত্ত-বৈভব আর প্রাচুর্যে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার প্রবল বাসনা মানুষের ভেতরকার জীবনবোধকে ক্রমশ কুরে কুরে খেতে থাকে। এক সময় সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলে সততা ও নিষ্ঠার মতো গুণাবলি অর্জনের সব শক্তি। একজন উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী বা যে কোন পেশায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে গাড়ি-ঘোড়ায় তার ঠিকই চড়া হয়, কিন্তু জীবনের সত্যিকারের সুখ-সমৃদ্ধির সন্ধান লাভ কঠিন হয়ে পড়ে।
দেশের প্রচলিত আইনকানুন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা তার নৈতিক দায়িত্ব। উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সঠিক দায়িত্ব পালন এবং কর্তব্যবোধের সৃষ্টি হয়। সুশিক্ষা বিকাশ ঘটায় মানবিক মূল্যবোধের। ঘরে বাবা-মা, অভিভাবকের কাছ থেকে শিশুকালে যে শিক্ষার শুরু হয় তার ধারাবাহিকতা চলে আমৃত্যু। পরবর্তীতে শিক্ষক এবং পারিপার্শ্বিকতা থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণই মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারে। সততা, নিষ্ঠাবোধ ছাড়া মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় না। আর মানবিক মূল্যবোধ ব্যতীত মানুষ কখনও মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে প্রচলিত সর্বস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং সমাজ কাঠামোর প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে হয় রাষ্ট্র ও সমাজকে। মানুষ হচ্ছে এ সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মানবিক কর্মযজ্ঞ দ্বারা গড়ে তোলা সম্ভব সবার বসবাসযোগ্য বিকশিত সমাজ।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]