alt

উপ-সম্পাদকীয়

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হতে হবে মূল লক্ষ্য

নাসির উদ্দিন

: সোমবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২২

বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন, নতুন আবিষ্কারের ফলে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে শল্য চিকিৎসা, জেনিটিক চিকিৎসা, সংক্রামক এবং মহামারি রোগের বিরুদ্ধে টিকা উদ্ভাবন এ দুই শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে উন্নত থেকে উন্নতর করেছে। অ্যালোপ্যাথিসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হলেও অনেক ধরনের অসংক্রামক রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় বা আরোগ্য সাধন করা সম্ভব হচ্ছেনা। বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীকে নয় রোগকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ওষুধ নির্ভর হয়ে পড়েছে। রোগীও যে রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধের কারণ হতে পারে এ বিষয়টি কখন ও আমলে নেয়া হচ্ছে না। বহুকাল আগে থেকেই একটি প্রবাদ প্রচলিত যা চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত “প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে উত্তম”। কিন্তু বর্তমানে প্রতিরোধকে বাদ দিয়ে নিরাময়ের দিকেই সব শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।

রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে মধ্যযুগের অন্যতম বিশিষ্ট চিকিৎসক ইবনে সিনা বলেছেন যে, এ বিষয়ে দরকারি হচ্ছে ব্যায়াম, তারপর খাদ্য। তাছাড়া, পানি, বিশ্রাম, ঘুম ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে তার মতে নিয়মিত ব্যায়াম করলে ওষুধের দরকার হয় না। ইবনে সিনা বলেন, ‘নিয়মিত ব্যায়াম কর ও সর সময় খুশি থাকো তা হলে তোমার আয়ু হবে একশ’ বছর কিংবা তারও বেশি। মিকশ্চার অথবা অন্য কোন ওষুধ স্বাস্থ্য দিতে পারে না, বাগান, নির্মল হাওয়া... প্রকৃতিই সেরা নিরাময়কারী।’ প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে তা দিয়েই আমরা নিজেরাই নিজেদের রোগকে প্রতিহত করতে পারি। গ্রিক চিকিৎসাবিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস ৪৪০ বিসি তে বলেছিলেন ‘খাদ্য হলো ওষুধ এবং ওষুধ হলো খাদ্য’। হাজার বছরের পূর্বের এ বাক্যসমূহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ব্যায়াম, পানি, বিশ্রাম, ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যের গুরুত্ব।

শারীরিক সুস্থতা, রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য শারীরিক, মানসিক ব্যায়াম এবং খাবারের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের উপকারী ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ শরীরকে ফ্রিরেডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে অনেক ধরনের দুরারোগ্য রোগ প্রতিহত করে। তাই শরীরকে সুস্থ রাখা এবং রোগ প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত ফলমূল, শাকসবজি, পানীয় এবং খাবার নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাবার নির্বাচন এবং পরিমিত খাবার মাংসপেশীর গঠন, মস্তিষ্ক সমৃদ্ধকরণ, চামড়া কুঁচকানো রোধ, হৃদযন্ত্র শক্তিশালীকরণ, হাড় গঠন, ইমিউনিটি বৃদ্ধি এবং প্রদাহ রোধে কার্যকর। দেহকে দুরারোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, বার্ধক্য, হৃদরোগ, স্নায়ু রোগ, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আলঝেইমার, পারকিনসন, স্মৃতিলোপ, স্ট্রোক, ক্যাটারাক্ট, রেটিনাল রোগ, ইসকিমিয়া, হার্টফেল থেকে রক্ষা করতে ফলমূল এবং শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শরীর ও মনকে উজ্জীবিত করে ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে শারীরিক ব্যায়াম একান্ত অপরিহার্য। যে কোন বয়সে বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে নিয়মিত শরীর চর্চা করা একান্ত আবশ্যক। গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত শরীর চর্চা করে তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩৫%, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৫০%, কোলন ক্যানসার ৫০%, ব্রেস্ট ক্যানসার ২০%, অকাল মৃত্যু ৩০%, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ৮৩%, হীপ ভঙ্কুরতা ৬৮%, পরে যাওয়া ৩০%, মানসিক চাপ ৩০% এবং অনিদ্রার ঝুঁকি ৩০% হ্রাস পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট শরীর চর্চা করা উচিত।

করোনা মহামারী আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন করেছে যে শুধু ওষুধনির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৮ সনের নন-কমিউনিক্যাবল রোগের কান্ট্রি প্রোফাইল অনুযায়ী ২০১৬ সনে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগ ও কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮,৫৬০০০ জনের মধ্যে হৃদরোগজনিত রোগে মৃত্যুর হার ৩০%, ক্যানসারে ১২%, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ১০%, ডায়াবেটিসে ৩%, অন্যান্য নন-কমিউনিক্যাবল রোগে ১২%, সংক্রামক রোগ, মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু এবং অপুষ্টিজনিত রোগে ২৬%, এবং আঘাতজনিত কারণে ৭%। হিসেবমতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ৬৭% লোক মারা যাচ্ছে নন-কমিউনিক্যাবল রোগে।

অধিকাংশ নন-কমিউনিক্যাবল (অসংক্রামক) রোগ যথা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, ধমনী বদ্ধতা, স্ট্রোক, ক্যানসার, আলসার, পারকিনসন, আলঝেইমার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধূমপান, মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা, শারীরিক পরিশ্রম না করা, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত দৈহিক ওজনের বিষয়গুলো জড়িত। এ সব কারণগুলো প্রতিরোধের কিন্তু কোন ওষুধ নেই। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অধিকাংশ অসংক্রামক রোগের জন্য জীবনব্যাপী ওষুধ সেবনের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিষয়টি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। সুশৃঙ্খল জীবনাচার, উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচন, মানসিক ও শারীরক ব্যায়ামের মাধ্যমে ওষুধ ব্যতীত অধিকাংশ নন-কমিউনিক্যাবল রোগ এবং কিছু সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময় করা সম্ভব।

করোনা মহামারী আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন করেছে যে শুধু ওষুধনির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ সময় শরীরের ইমিউনিটি বৃদ্ধি করার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে এবং ইমিউনিটি অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য কি করতে হবে কি খেতে হবে তার কথা বলা হচ্ছে। করোনাকে প্রতিরোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে সব বিষযের কথা বলছে তাতে ওষুধের কোন স্থান নেই সবই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা : শারীরিক ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলমূল গ্রহণ, ধূমপান না করা, মদ্যপান না করা, মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ইত্যাদি। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিল শুধু ওষুধ নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা। আজকাল অনেক ক্ষতিকর মাইক্রো-অর্গানিজম ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ওষুধের বিশেষ করে এন্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে অনেক সংক্রামক রোগের জীবাণু অর্থাৎ ব্যাক্টেরিয়া এবং ফাংগাস ওষুধের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করে ফেলেছে এ ক্ষেত্রে অনেক উচ্চ ক্ষমতার ওষুধ প্রয়োগ করতে হচ্ছে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কোন ক্ষমতার ওষুধই কার্যকর হচ্ছে না।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সনের মধ্যে নন-কমিউনিক্যাবল রোগে অকাল মৃত্যুর হার এক তৃতীয়াংশে হ্রাস করতে হবে। ওষুধ নির্ভর স্বাস্থ্যনীতির মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব হবে না। এর জন্য নজর দিতে দেহের নিজস্ব শক্তিকে উজ্জীবিত করে রোগকে প্রতিরোধ করার প্রতি। ওষুধ কিন্তু এ কাজটি করতে পারবে না। এটা সম্ভব সুশৃঙ্খল জীবনাচার, স্বাস্থ্যরক্ষায় উপযুক্ত খাবার, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম (হাঁটা, দৌড়ানো) এবং মানসিক ব্যায়াম (প্রাণায়াম, মেডিটেশন, হাসি, নেচার থেরাপি, আকুপ্রেশার) এর মাধ্যমে। ওষুধের যত্রতত্র ব্যবহার থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। প্রাকৃতিক বিকল্প পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের প্রয়োজন হবে না অধিকন্তু ইহা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হ্রাস করবে। তবে এর জন্য দরকার ব্যাপক জনসচেতনা এবং শিক্ষা কার্যক্রমে এ বিষয়গুলো সম্পৃক্তকরণসহ স্বাস্থ্যনীতিতে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিবেচনায় আনতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হতে হবে মূল লক্ষ্য

নাসির উদ্দিন

সোমবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২২

বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন, নতুন আবিষ্কারের ফলে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে শল্য চিকিৎসা, জেনিটিক চিকিৎসা, সংক্রামক এবং মহামারি রোগের বিরুদ্ধে টিকা উদ্ভাবন এ দুই শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে উন্নত থেকে উন্নতর করেছে। অ্যালোপ্যাথিসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হলেও অনেক ধরনের অসংক্রামক রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় বা আরোগ্য সাধন করা সম্ভব হচ্ছেনা। বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীকে নয় রোগকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ওষুধ নির্ভর হয়ে পড়েছে। রোগীও যে রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধের কারণ হতে পারে এ বিষয়টি কখন ও আমলে নেয়া হচ্ছে না। বহুকাল আগে থেকেই একটি প্রবাদ প্রচলিত যা চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত “প্রতিরোধ নিরাময়ের চেয়ে উত্তম”। কিন্তু বর্তমানে প্রতিরোধকে বাদ দিয়ে নিরাময়ের দিকেই সব শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।

রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে মধ্যযুগের অন্যতম বিশিষ্ট চিকিৎসক ইবনে সিনা বলেছেন যে, এ বিষয়ে দরকারি হচ্ছে ব্যায়াম, তারপর খাদ্য। তাছাড়া, পানি, বিশ্রাম, ঘুম ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে তার মতে নিয়মিত ব্যায়াম করলে ওষুধের দরকার হয় না। ইবনে সিনা বলেন, ‘নিয়মিত ব্যায়াম কর ও সর সময় খুশি থাকো তা হলে তোমার আয়ু হবে একশ’ বছর কিংবা তারও বেশি। মিকশ্চার অথবা অন্য কোন ওষুধ স্বাস্থ্য দিতে পারে না, বাগান, নির্মল হাওয়া... প্রকৃতিই সেরা নিরাময়কারী।’ প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে তা দিয়েই আমরা নিজেরাই নিজেদের রোগকে প্রতিহত করতে পারি। গ্রিক চিকিৎসাবিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস ৪৪০ বিসি তে বলেছিলেন ‘খাদ্য হলো ওষুধ এবং ওষুধ হলো খাদ্য’। হাজার বছরের পূর্বের এ বাক্যসমূহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ব্যায়াম, পানি, বিশ্রাম, ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যের গুরুত্ব।

শারীরিক সুস্থতা, রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য শারীরিক, মানসিক ব্যায়াম এবং খাবারের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের উপকারী ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহ শরীরকে ফ্রিরেডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে অনেক ধরনের দুরারোগ্য রোগ প্রতিহত করে। তাই শরীরকে সুস্থ রাখা এবং রোগ প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত ফলমূল, শাকসবজি, পানীয় এবং খাবার নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাবার নির্বাচন এবং পরিমিত খাবার মাংসপেশীর গঠন, মস্তিষ্ক সমৃদ্ধকরণ, চামড়া কুঁচকানো রোধ, হৃদযন্ত্র শক্তিশালীকরণ, হাড় গঠন, ইমিউনিটি বৃদ্ধি এবং প্রদাহ রোধে কার্যকর। দেহকে দুরারোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, বার্ধক্য, হৃদরোগ, স্নায়ু রোগ, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আলঝেইমার, পারকিনসন, স্মৃতিলোপ, স্ট্রোক, ক্যাটারাক্ট, রেটিনাল রোগ, ইসকিমিয়া, হার্টফেল থেকে রক্ষা করতে ফলমূল এবং শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শরীর ও মনকে উজ্জীবিত করে ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে শারীরিক ব্যায়াম একান্ত অপরিহার্য। যে কোন বয়সে বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে নিয়মিত শরীর চর্চা করা একান্ত আবশ্যক। গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত শরীর চর্চা করে তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩৫%, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৫০%, কোলন ক্যানসার ৫০%, ব্রেস্ট ক্যানসার ২০%, অকাল মৃত্যু ৩০%, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ৮৩%, হীপ ভঙ্কুরতা ৬৮%, পরে যাওয়া ৩০%, মানসিক চাপ ৩০% এবং অনিদ্রার ঝুঁকি ৩০% হ্রাস পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট শরীর চর্চা করা উচিত।

করোনা মহামারী আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন করেছে যে শুধু ওষুধনির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৮ সনের নন-কমিউনিক্যাবল রোগের কান্ট্রি প্রোফাইল অনুযায়ী ২০১৬ সনে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগ ও কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮,৫৬০০০ জনের মধ্যে হৃদরোগজনিত রোগে মৃত্যুর হার ৩০%, ক্যানসারে ১২%, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ১০%, ডায়াবেটিসে ৩%, অন্যান্য নন-কমিউনিক্যাবল রোগে ১২%, সংক্রামক রোগ, মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যু এবং অপুষ্টিজনিত রোগে ২৬%, এবং আঘাতজনিত কারণে ৭%। হিসেবমতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ৬৭% লোক মারা যাচ্ছে নন-কমিউনিক্যাবল রোগে।

অধিকাংশ নন-কমিউনিক্যাবল (অসংক্রামক) রোগ যথা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, ধমনী বদ্ধতা, স্ট্রোক, ক্যানসার, আলসার, পারকিনসন, আলঝেইমার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধূমপান, মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা, শারীরিক পরিশ্রম না করা, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত দৈহিক ওজনের বিষয়গুলো জড়িত। এ সব কারণগুলো প্রতিরোধের কিন্তু কোন ওষুধ নেই। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অধিকাংশ অসংক্রামক রোগের জন্য জীবনব্যাপী ওষুধ সেবনের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিষয়টি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। সুশৃঙ্খল জীবনাচার, উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচন, মানসিক ও শারীরক ব্যায়ামের মাধ্যমে ওষুধ ব্যতীত অধিকাংশ নন-কমিউনিক্যাবল রোগ এবং কিছু সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময় করা সম্ভব।

করোনা মহামারী আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন করেছে যে শুধু ওষুধনির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ সময় শরীরের ইমিউনিটি বৃদ্ধি করার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে এবং ইমিউনিটি অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য কি করতে হবে কি খেতে হবে তার কথা বলা হচ্ছে। করোনাকে প্রতিরোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে সব বিষযের কথা বলছে তাতে ওষুধের কোন স্থান নেই সবই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা : শারীরিক ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলমূল গ্রহণ, ধূমপান না করা, মদ্যপান না করা, মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ইত্যাদি। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিল শুধু ওষুধ নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা। আজকাল অনেক ক্ষতিকর মাইক্রো-অর্গানিজম ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ওষুধের বিশেষ করে এন্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে অনেক সংক্রামক রোগের জীবাণু অর্থাৎ ব্যাক্টেরিয়া এবং ফাংগাস ওষুধের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরক্ষা বৃদ্ধি করে ফেলেছে এ ক্ষেত্রে অনেক উচ্চ ক্ষমতার ওষুধ প্রয়োগ করতে হচ্ছে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কোন ক্ষমতার ওষুধই কার্যকর হচ্ছে না।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সনের মধ্যে নন-কমিউনিক্যাবল রোগে অকাল মৃত্যুর হার এক তৃতীয়াংশে হ্রাস করতে হবে। ওষুধ নির্ভর স্বাস্থ্যনীতির মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব হবে না। এর জন্য নজর দিতে দেহের নিজস্ব শক্তিকে উজ্জীবিত করে রোগকে প্রতিরোধ করার প্রতি। ওষুধ কিন্তু এ কাজটি করতে পারবে না। এটা সম্ভব সুশৃঙ্খল জীবনাচার, স্বাস্থ্যরক্ষায় উপযুক্ত খাবার, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম (হাঁটা, দৌড়ানো) এবং মানসিক ব্যায়াম (প্রাণায়াম, মেডিটেশন, হাসি, নেচার থেরাপি, আকুপ্রেশার) এর মাধ্যমে। ওষুধের যত্রতত্র ব্যবহার থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। প্রাকৃতিক বিকল্প পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের প্রয়োজন হবে না অধিকন্তু ইহা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হ্রাস করবে। তবে এর জন্য দরকার ব্যাপক জনসচেতনা এবং শিক্ষা কার্যক্রমে এ বিষয়গুলো সম্পৃক্তকরণসহ স্বাস্থ্যনীতিতে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিবেচনায় আনতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব]

back to top