তানজিমুল ইসলাম
দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ৫৮ বছর বয়সী মহসিন খান ঢাকায় থাকতেন। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে একসময় বেশ সুনাম ছিল তার। ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু হারিয়ে গেলে দৈবক্রমেই জীবনে কালোবেলা নেমে আসে এই অভিমানী মানুষটির।
জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য একমাত্র ছেলেটি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছে; রোগে-শোকে কাতর এ অসহায় মানুষটি একটি ফ্ল্যাটে বড্ড নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। ক্রমান্বয়ে অবচেতন মনে নানাভাবে আতঙ্কিত হতে হতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। নানাবিধ অশুভ আশঙ্কায় ম্রিয়মান হয়ে পড়েন এক সময়কার ধনাঢ্য এই ক্ষণজন্মা! পরিবার ও সন্তানের জন্য ধ্যানমগ্ন এ অভিমানী লোকটি ধন-সম্পদ, অর্থ-প্রাচুর্য গড়েছেন বটে! কিন্তু ভোগ করা তো আর হলো না! যাদের জন্য জীবনযুদ্ধে পাড়ি দেয়া সেই কাছের মানুষেরা এমনকি অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুটিও কি চুপটি মেরে থাকবেন? তবে কি মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষের সম্পর্কটি শুধুই স্বার্থের? অবেলায় কেন এই মানবিতকতা হারিয়ে যায়? কিসের কারণে মিথ্যা মোহে মানুষ আসলে এত লোভী হয়? “সবার তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”-এ কথাটি কি তবে শুধুই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ দুটি লাইন মাত্র? তবে কি অবশেষে এটিই প্রমাণিত হলো যে, “মুখে যতই উদারনৈতিকতার কথা বলুক না কেন, প্রতিটি ব্যক্তিই কোন না কোনভাবে বড্ড স্বার্থপর”! কী জানি, এটি হয়তো খুবই আপেক্ষিক এবং বিতর্কিত বিষয়!
এ সমাজের লক্ষ লক্ষ মহসিনেরা রাতদিন খেটে কেবল ধন-সম্পদের পেছনে ছুটতেই থাকেন; আর তাই বুঝি সন্তান নামক শ্রেষ্ঠ সম্পদটিকে সঠিকভাবে লালন পালন করার সময় এতটুকু সময়ও থাকে না? আজকের সব অভিভাবকের কাছে অতি সাধারণ একটি বিষয়ে জানবার বড্ড কৌতূহল- “পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে এমন কোন পদক্ষেপ কি গ্রহণ করেছেন যে শিক্ষার বদৌলতে আপনার সন্তান অন্তত: মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে!” পরিবার তথা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে!
পরিবার হলো একটি শেষ্ঠ অলিখিত বিদ্যাপীঠ! একজন নাগরিক যত বড় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করুক না কেন, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য পারিবারিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই! পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আজ সারা দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ মহসিনেরা ডুকরে কাঁদে একাকী! তিল তিল করে পুষে রাখা কষ্টগুলো একদিন তাদের দুমড়ে-মুচড়ে নিষ্পেষিত করে তোলে! জীবন সায়ান্নে বড্ড অসহায় ধন কুবেরগণ ব্যর্থতার চাদর গায়ে জড়িয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে প্রতিটি মুহূর্তে অভিনয় করে বেঁচে থাকে। একরাশ অভিমান, চাপা কষ্ট আর প্রতারিত হবার ঘৃণায় কেউ কেউ এভাবেই হয়তো বেঁচে থাকার কোন উৎসাহ খুঁজে পান না নতুন করে! কোন এক সময় নেশা নিয়ন্ত্রিত জীবনে বিকিয়ে দেয় নিজেকে! জীবন-সংসারের নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলো নির্মম আঘাতে জর্জরিত হয়ে এক সময় নিজেদের কাছেই পরাজয় বরণ করে নেয়। পাড়ি জমায় না ফেরার দেশের অজানা কোন গন্তব্যে! কে রাখে তাদের খবর?
আত্মহত্যা একটি মহাপাপ জেনেও যারা সে পথে পাড়ি জমায়, তারা আসলে কতটা পরাজিত, আমরা কি কেউ তা উপলব্ধি করতে পারি? জীবনটা অনেক বর্ণিল, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর জেনেও যারা অতি অভিমন্যু সাজে তারা আসলে কত বেশি লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার, আমরা কি কেউ তা বোঝার চেষ্টা করি?
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহসিনদের জানা অজানা গল্পকথাগুলো লিপিবব্ধ থাকে ফেসবুকে, ইতিহাসে, খবরের কাগজে! অল্প কিছুদিন সমস্বরে উচ্চারিত হয় মানুষের মুখে মুখে, টেলিভিশনে অথবা প্রতিবাদের মিছিলে! আমরা সাধারণ জনতা কিছুদিন বাদে আবার একই চিত্র দেখতে পাই, ভিন্ন নামে, ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে! আমরা কি তবে হতাশাগ্রস্ত এসব মহসিনদের পাশে দাঁড়াব না? আসুন তবে খুঁজে দেখি অভিমানের নেপথ্যের কারণসমূহ! প্রকৃত মানুষ হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই! সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রকৃত মানুষ হয়ে বাঁচি একসঙ্গে, মরে গিয়েও বেঁচে থাকি মানুষেরই সঙ্গে, আবহমান কালের সাক্ষী হয়ে!
[লেখক : সামাজিক ও উন্নয়নকর্মী]
তানজিমুল ইসলাম
মঙ্গলবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২
দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ৫৮ বছর বয়সী মহসিন খান ঢাকায় থাকতেন। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে একসময় বেশ সুনাম ছিল তার। ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু হারিয়ে গেলে দৈবক্রমেই জীবনে কালোবেলা নেমে আসে এই অভিমানী মানুষটির।
জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য একমাত্র ছেলেটি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছে; রোগে-শোকে কাতর এ অসহায় মানুষটি একটি ফ্ল্যাটে বড্ড নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। ক্রমান্বয়ে অবচেতন মনে নানাভাবে আতঙ্কিত হতে হতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। নানাবিধ অশুভ আশঙ্কায় ম্রিয়মান হয়ে পড়েন এক সময়কার ধনাঢ্য এই ক্ষণজন্মা! পরিবার ও সন্তানের জন্য ধ্যানমগ্ন এ অভিমানী লোকটি ধন-সম্পদ, অর্থ-প্রাচুর্য গড়েছেন বটে! কিন্তু ভোগ করা তো আর হলো না! যাদের জন্য জীবনযুদ্ধে পাড়ি দেয়া সেই কাছের মানুষেরা এমনকি অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুটিও কি চুপটি মেরে থাকবেন? তবে কি মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষের সম্পর্কটি শুধুই স্বার্থের? অবেলায় কেন এই মানবিতকতা হারিয়ে যায়? কিসের কারণে মিথ্যা মোহে মানুষ আসলে এত লোভী হয়? “সবার তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”-এ কথাটি কি তবে শুধুই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ দুটি লাইন মাত্র? তবে কি অবশেষে এটিই প্রমাণিত হলো যে, “মুখে যতই উদারনৈতিকতার কথা বলুক না কেন, প্রতিটি ব্যক্তিই কোন না কোনভাবে বড্ড স্বার্থপর”! কী জানি, এটি হয়তো খুবই আপেক্ষিক এবং বিতর্কিত বিষয়!
এ সমাজের লক্ষ লক্ষ মহসিনেরা রাতদিন খেটে কেবল ধন-সম্পদের পেছনে ছুটতেই থাকেন; আর তাই বুঝি সন্তান নামক শ্রেষ্ঠ সম্পদটিকে সঠিকভাবে লালন পালন করার সময় এতটুকু সময়ও থাকে না? আজকের সব অভিভাবকের কাছে অতি সাধারণ একটি বিষয়ে জানবার বড্ড কৌতূহল- “পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে এমন কোন পদক্ষেপ কি গ্রহণ করেছেন যে শিক্ষার বদৌলতে আপনার সন্তান অন্তত: মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে!” পরিবার তথা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে!
পরিবার হলো একটি শেষ্ঠ অলিখিত বিদ্যাপীঠ! একজন নাগরিক যত বড় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করুক না কেন, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য পারিবারিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই! পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আজ সারা দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ মহসিনেরা ডুকরে কাঁদে একাকী! তিল তিল করে পুষে রাখা কষ্টগুলো একদিন তাদের দুমড়ে-মুচড়ে নিষ্পেষিত করে তোলে! জীবন সায়ান্নে বড্ড অসহায় ধন কুবেরগণ ব্যর্থতার চাদর গায়ে জড়িয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে প্রতিটি মুহূর্তে অভিনয় করে বেঁচে থাকে। একরাশ অভিমান, চাপা কষ্ট আর প্রতারিত হবার ঘৃণায় কেউ কেউ এভাবেই হয়তো বেঁচে থাকার কোন উৎসাহ খুঁজে পান না নতুন করে! কোন এক সময় নেশা নিয়ন্ত্রিত জীবনে বিকিয়ে দেয় নিজেকে! জীবন-সংসারের নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলো নির্মম আঘাতে জর্জরিত হয়ে এক সময় নিজেদের কাছেই পরাজয় বরণ করে নেয়। পাড়ি জমায় না ফেরার দেশের অজানা কোন গন্তব্যে! কে রাখে তাদের খবর?
আত্মহত্যা একটি মহাপাপ জেনেও যারা সে পথে পাড়ি জমায়, তারা আসলে কতটা পরাজিত, আমরা কি কেউ তা উপলব্ধি করতে পারি? জীবনটা অনেক বর্ণিল, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর জেনেও যারা অতি অভিমন্যু সাজে তারা আসলে কত বেশি লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার, আমরা কি কেউ তা বোঝার চেষ্টা করি?
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহসিনদের জানা অজানা গল্পকথাগুলো লিপিবব্ধ থাকে ফেসবুকে, ইতিহাসে, খবরের কাগজে! অল্প কিছুদিন সমস্বরে উচ্চারিত হয় মানুষের মুখে মুখে, টেলিভিশনে অথবা প্রতিবাদের মিছিলে! আমরা সাধারণ জনতা কিছুদিন বাদে আবার একই চিত্র দেখতে পাই, ভিন্ন নামে, ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে! আমরা কি তবে হতাশাগ্রস্ত এসব মহসিনদের পাশে দাঁড়াব না? আসুন তবে খুঁজে দেখি অভিমানের নেপথ্যের কারণসমূহ! প্রকৃত মানুষ হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই! সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রকৃত মানুষ হয়ে বাঁচি একসঙ্গে, মরে গিয়েও বেঁচে থাকি মানুষেরই সঙ্গে, আবহমান কালের সাক্ষী হয়ে!
[লেখক : সামাজিক ও উন্নয়নকর্মী]