alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রভাব

দেলোয়ার হোসেন প্রধান

: রোববার, ১৩ মার্চ ২০২২

উৎপাদনকারীরা ফল-মূল ও শাকসবজি উৎপাদন করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হন সেটি হলো রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। কাজেই কৃষকেরা রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এ সমস্ত বালাইনাশকের ব্যবহার শুধু ফসলের উৎপাদন খরচই বৃদ্ধি করে না বরং ফলমূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি পরিবেশ ও জনস্বাস্থের জন্য বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রভাবে আজ জীববৈচিত্র্য হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছে। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের মাছসহ অন্যান্য অনেক প্রজাতির জীব।

দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, হংকং, তাইওয়ান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশ সমূহ বাংলাদেশের তুলনায় যথাক্রমে ৯.৪, ৭.৫, ৭.৪, ৭.০ এবং ৬.৭ গুণ বেশি রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে রাসায়নিক বালাইনাশক কম ব্যবহার করা হলেও আমাদের দেশের কৃষকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তম কৃষি চর্চা (Good Agricultural Practice) অনুসরণ করেন না। যেমন: অনেক সময় তারা ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া একই ফসলে বার বার বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে তারা বালাইনাশক প্রয়োগের পর অপেক্ষমান সময় (Pre-Harvest Interval) পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ফসল সংগ্রহ (Harvest) ও বাজারজাত করেন।

প্রতিটি বালাইনাশকের একটি নির্দিষ্ট অপেক্ষমাণ সময় রয়েছে অর্থাৎ একটি বালাইনাশক প্রয়োগের কতদিন পর ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করবে। এই অপেক্ষমাণ সময় ফসলভেদে ও বালাইনাশকের প্রকারভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন : সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৪-৭ দিন, অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮-২০ দিন, নিওনিকোটিনয়িড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮-২০ দিন এবং কার্বামেট কীটনাশকের ক্ষেত্রে ২০-৪০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষমাণ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে যদি ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করা হয়, তবে ফলমূল ও শাকসবজিতে ব্যবহৃত বালাইনাশকসমূহের অবশিষ্টাংশের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায় বা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (Maximum Residue Limit-MRL) নিচে চলে যাবে।

কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারের প্রাপ্ত ফলাফল হতে প্রতীয়মান হয় যে, বাজার হতে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রকার সবজির নমুনা সমূহের মধ্যে শতকরা ৮-১২ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে এবং বিশ্লেষণকৃত বিভিন্ন প্রকার ফলের নমুনাসমূহের মধ্যে শতকরা ৩-৪ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে। ফলমূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায় বিধায় ফলমূল ও শাকসবজি ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকলে আমাদের যেমন বিভিন্ন প্রকার শারীরিক সমস্যা দেখা দিবে তেমনি হ্রাস পাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। কাজেই আসুন জেনে নেয়া যাক ফলমূল ও শাকসবজি হতে আমরা কীভাবে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করতে পারি। আমরা অত্যন্ত সহজ উপায়ে নিমোক্ত চার স্তর বিশিষ্ট decontamination পদ্ধতি অবলম্বন করে ফলমূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করতে পারি।

১ম স্তর : ফলমূল ও শাকসবজি পরিষ্কার পানিতে ধৌতকরণ

ফলমূল, শাকসবজি পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। ধৌতকরণ পদ্ধতির কার্যকারিতা নির্ভর করে ব্যবহৃত বালাইনাশকের ফিজিওকেমিক্যাল বৈশিষ্ট্যের ওপর। যেমন : পানিতে বালাইনাশকের দ্রবণীয়তা, ফল ও সবজি ইত্যাদিতে বালাইনাশকের প্রকৃত অবস্থান। ধৌত করার সময় যদি ১ মিনিট হাত দ্বারা ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়, তবে এ পদ্ধতিতে কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় স্তর : ফলমূল ও শাকসবজি লবণ-পানির দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা

সাধারণত, ফলমূল, শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করার জন্য লবণ-পানির দ্রবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন হতে প্রতীয়মান হয় যে, ১ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম খাবার লবণ (২% লবণ-পানির দ্রবণ) মিশিয়ে ১৫ মিনিট পর্যন্ত এ মিশ্রণে ফলমূল, শাকসবজি ডুবিয়ে রাখলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দূর করা যায়।

তৃতীয় স্তর : ফলমূল ও সবজির খোসা ছাড়ানো

যে সব সবজি ও ফলের বাহিরের আবরণ ছাড়ানো যায়, সে সব সবজি ও ফলের বাহিরের আবরণ ছাড়িয়ে নিন। কারণ কৃষক যখন বালাইনাশক প্রয়োগ করে তখন ফলমূল ও শাকসবজির বাহিরের আবরণেই বালাইনাশক বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যদি বাহিরের আবরণ ফেলে দেয়া হয় তবে শতকরা ৫০ ভাগ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। অনেকেই আমরা মনে করি, ফলমূল ও সবজির বাহিরের আবরণটি ফেলে দিলে ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান কমে যাবে। এ কথাটি শতভাগ সত্য, তবে একটু ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান কম খেয়ে রাসায়নিক বালাইনাশকমুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? কাজেই আসুন যে সব সবজি ও ফলের খোসা ফেলে দেয়া যায় (যেমন: পেয়ারা, শসা ও গাজর ইত্যাদি) সে সব সবজি ও ফলের বাহিরের আবরণ বা খোসা পরিহারের মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হ্রাস করে তুলনামূলকভাবে কম বালাইনাশকযুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি ভক্ষণ করি।

চতুর্থ স্তর : শাকসবজি পরিমিত তাপমাত্রায় রান্না করা

সাধারণত, রান্না করার মাধ্যমে শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। এ পদ্ধতির কার্যকারিতা নির্ভর করে রান্নার সময়কাল, তাপমাত্রার পরিমাণ, খাদ্যদ্রব্যে পানি সংযোজনের পরিমাণ এবং রান্নার ধরন (খোলা বা বন্ধ) ইত্যাদি। সাধারণত, খোলা পদ্ধতিতে ভোলাটিলাইজেশন এবং বন্ধ পদ্ধতিতে হাইড্রোলাইসিসের মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হ্রাস পায়।

এই চার স্তরবিশিষ্ট decontamination পদ্ধতি অবলম্বন করে ফলমূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের প্রকার ভেদে শতকরা ৩০-৮০ ভাগ পর্যন্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। পরিশেষে সব ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকল্পে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১। ফলমূল ও শাকসবজির পোকামাকড়, রোগবালাই দমনে বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা।

২। রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষকেরা যাতে অপেক্ষমাণ সময় মেনে চলেন, সেজন্য সরকার কর্তৃক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনটি করা হয়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম সংগ্রহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার কর্তৃক রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম সংগ্রের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে বর্তমানে নিরাপদ আম ভোক্তাদের জন্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে উত্তম কৃষি চর্চা-২০২০ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করা যায় এ নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশের কৃষকরা অপেক্ষমাণ সময় মেনে ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করতে অভ্যস্ত হবেন। ফলশ্রুতিতে দেশের সব ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ ফলমূল ও শাকসবজি সহজলভ্য হবে।

৩। ভোক্তাদের জন্য ওপরে বর্ণিত চার স্তরবিশিষ্ট decontamination পদ্ধতি অনুসরণ করা।

প্রকৃতপক্ষে রাসায়নিক বালাইনাশক মুক্ত/নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত কল্পে উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী, জনপ্রতিনিধি, ভোক্তা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং আইন প্রণয়নকারী সংস্থা সবাইকেই সচেতন হতে হবে। আমাদের সবাইকে সম্মিলিত প্রয়াশের মাধ্যমেই রাসায়নিক বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ মুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদন ও সরবরাহ সম্ভব হবে।

[লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বালাইনাশক গবেষণা ও পরিবেশ বিষতত্ত্ব শাখা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]

কেন এত তরুণ দেশ ছাড়তে চাচ্ছে

রেলওয়ে পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাব

রম্যগদ্য : ‘গোপালগঞ্জ, বাংলার গোপালগঞ্জ...’

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রভাব

দেলোয়ার হোসেন প্রধান

রোববার, ১৩ মার্চ ২০২২

উৎপাদনকারীরা ফল-মূল ও শাকসবজি উৎপাদন করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হন সেটি হলো রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। কাজেই কৃষকেরা রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এ সমস্ত বালাইনাশকের ব্যবহার শুধু ফসলের উৎপাদন খরচই বৃদ্ধি করে না বরং ফলমূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি পরিবেশ ও জনস্বাস্থের জন্য বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রভাবে আজ জীববৈচিত্র্য হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছে। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের মাছসহ অন্যান্য অনেক প্রজাতির জীব।

দেশে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, হংকং, তাইওয়ান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশ সমূহ বাংলাদেশের তুলনায় যথাক্রমে ৯.৪, ৭.৫, ৭.৪, ৭.০ এবং ৬.৭ গুণ বেশি রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে রাসায়নিক বালাইনাশক কম ব্যবহার করা হলেও আমাদের দেশের কৃষকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তম কৃষি চর্চা (Good Agricultural Practice) অনুসরণ করেন না। যেমন: অনেক সময় তারা ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া একই ফসলে বার বার বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে তারা বালাইনাশক প্রয়োগের পর অপেক্ষমান সময় (Pre-Harvest Interval) পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ফসল সংগ্রহ (Harvest) ও বাজারজাত করেন।

প্রতিটি বালাইনাশকের একটি নির্দিষ্ট অপেক্ষমাণ সময় রয়েছে অর্থাৎ একটি বালাইনাশক প্রয়োগের কতদিন পর ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করবে। এই অপেক্ষমাণ সময় ফসলভেদে ও বালাইনাশকের প্রকারভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন : সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৪-৭ দিন, অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮-২০ দিন, নিওনিকোটিনয়িড কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৮-২০ দিন এবং কার্বামেট কীটনাশকের ক্ষেত্রে ২০-৪০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষমাণ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে যদি ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করা হয়, তবে ফলমূল ও শাকসবজিতে ব্যবহৃত বালাইনাশকসমূহের অবশিষ্টাংশের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায় বা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার (Maximum Residue Limit-MRL) নিচে চলে যাবে।

কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারের প্রাপ্ত ফলাফল হতে প্রতীয়মান হয় যে, বাজার হতে সংগৃহীত বিভিন্ন প্রকার সবজির নমুনা সমূহের মধ্যে শতকরা ৮-১২ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে এবং বিশ্লেষণকৃত বিভিন্ন প্রকার ফলের নমুনাসমূহের মধ্যে শতকরা ৩-৪ ভাগ নমুনাতে প্রাপ্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার ওপরে। ফলমূল ও শাকসবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায় বিধায় ফলমূল ও শাকসবজি ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকলে আমাদের যেমন বিভিন্ন প্রকার শারীরিক সমস্যা দেখা দিবে তেমনি হ্রাস পাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। কাজেই আসুন জেনে নেয়া যাক ফলমূল ও শাকসবজি হতে আমরা কীভাবে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করতে পারি। আমরা অত্যন্ত সহজ উপায়ে নিমোক্ত চার স্তর বিশিষ্ট decontamination পদ্ধতি অবলম্বন করে ফলমূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করতে পারি।

১ম স্তর : ফলমূল ও শাকসবজি পরিষ্কার পানিতে ধৌতকরণ

ফলমূল, শাকসবজি পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। ধৌতকরণ পদ্ধতির কার্যকারিতা নির্ভর করে ব্যবহৃত বালাইনাশকের ফিজিওকেমিক্যাল বৈশিষ্ট্যের ওপর। যেমন : পানিতে বালাইনাশকের দ্রবণীয়তা, ফল ও সবজি ইত্যাদিতে বালাইনাশকের প্রকৃত অবস্থান। ধৌত করার সময় যদি ১ মিনিট হাত দ্বারা ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়, তবে এ পদ্ধতিতে কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় স্তর : ফলমূল ও শাকসবজি লবণ-পানির দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা

সাধারণত, ফলমূল, শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করার জন্য লবণ-পানির দ্রবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বালাইনাশক বিশ্লেষণ গবেষণাগারে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন হতে প্রতীয়মান হয় যে, ১ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম খাবার লবণ (২% লবণ-পানির দ্রবণ) মিশিয়ে ১৫ মিনিট পর্যন্ত এ মিশ্রণে ফলমূল, শাকসবজি ডুবিয়ে রাখলে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দূর করা যায়।

তৃতীয় স্তর : ফলমূল ও সবজির খোসা ছাড়ানো

যে সব সবজি ও ফলের বাহিরের আবরণ ছাড়ানো যায়, সে সব সবজি ও ফলের বাহিরের আবরণ ছাড়িয়ে নিন। কারণ কৃষক যখন বালাইনাশক প্রয়োগ করে তখন ফলমূল ও শাকসবজির বাহিরের আবরণেই বালাইনাশক বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যদি বাহিরের আবরণ ফেলে দেয়া হয় তবে শতকরা ৫০ ভাগ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। অনেকেই আমরা মনে করি, ফলমূল ও সবজির বাহিরের আবরণটি ফেলে দিলে ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান কমে যাবে। এ কথাটি শতভাগ সত্য, তবে একটু ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান কম খেয়ে রাসায়নিক বালাইনাশকমুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? কাজেই আসুন যে সব সবজি ও ফলের খোসা ফেলে দেয়া যায় (যেমন: পেয়ারা, শসা ও গাজর ইত্যাদি) সে সব সবজি ও ফলের বাহিরের আবরণ বা খোসা পরিহারের মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হ্রাস করে তুলনামূলকভাবে কম বালাইনাশকযুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি ভক্ষণ করি।

চতুর্থ স্তর : শাকসবজি পরিমিত তাপমাত্রায় রান্না করা

সাধারণত, রান্না করার মাধ্যমে শাকসবজি হতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। এ পদ্ধতির কার্যকারিতা নির্ভর করে রান্নার সময়কাল, তাপমাত্রার পরিমাণ, খাদ্যদ্রব্যে পানি সংযোজনের পরিমাণ এবং রান্নার ধরন (খোলা বা বন্ধ) ইত্যাদি। সাধারণত, খোলা পদ্ধতিতে ভোলাটিলাইজেশন এবং বন্ধ পদ্ধতিতে হাইড্রোলাইসিসের মাধ্যমে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ হ্রাস পায়।

এই চার স্তরবিশিষ্ট decontamination পদ্ধতি অবলম্বন করে ফলমূল ও শাকসবজি হতে বালাইনাশকের প্রকার ভেদে শতকরা ৩০-৮০ ভাগ পর্যন্ত বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ দূর করা যায়। পরিশেষে সব ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকল্পে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১। ফলমূল ও শাকসবজির পোকামাকড়, রোগবালাই দমনে বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করা।

২। রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষকেরা যাতে অপেক্ষমাণ সময় মেনে চলেন, সেজন্য সরকার কর্তৃক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনটি করা হয়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম সংগ্রহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার কর্তৃক রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম সংগ্রের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে বর্তমানে নিরাপদ আম ভোক্তাদের জন্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে উত্তম কৃষি চর্চা-২০২০ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করা যায় এ নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশের কৃষকরা অপেক্ষমাণ সময় মেনে ফলমূল ও শাকসবজি সংগ্রহ করতে অভ্যস্ত হবেন। ফলশ্রুতিতে দেশের সব ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ ফলমূল ও শাকসবজি সহজলভ্য হবে।

৩। ভোক্তাদের জন্য ওপরে বর্ণিত চার স্তরবিশিষ্ট decontamination পদ্ধতি অনুসরণ করা।

প্রকৃতপক্ষে রাসায়নিক বালাইনাশক মুক্ত/নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত কল্পে উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী, জনপ্রতিনিধি, ভোক্তা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং আইন প্রণয়নকারী সংস্থা সবাইকেই সচেতন হতে হবে। আমাদের সবাইকে সম্মিলিত প্রয়াশের মাধ্যমেই রাসায়নিক বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ মুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদন ও সরবরাহ সম্ভব হবে।

[লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বালাইনাশক গবেষণা ও পরিবেশ বিষতত্ত্ব শাখা, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট]

back to top