বাবুল রবিদাস
পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৮৬০ সালে একটি স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলকে ৩টি জেলায় রূপান্তর করা হয়। ৩টি পার্বত্য জেলায় মোট ৭টি পৌরসভা এবং ২৬টি উপজেলা আছে। প্রধান ৩টি সম্প্রদায় হচ্ছে- চাকমা, মারাম, ত্রিপুরাসহ সাড়ে ১৫ লাখ জনসাধারণ বসবাস করে। এ ছাড়া আছে–তঞ্চঙ্গা, লুসাই, পাংখো, মুরং, খিয়াং, বম, খুমি, চাক এবং বিপুলসংখ্যক বাঙালি (৪৫%)। দেশের মোট জনসংখ্যার ১%।
সার্ভে আইন ১৮৭৫ এবং ১৮৮৫ সালের বি.টি অ্যাক্টের বিধানমতে ব্রিটিশ সরকার প্রথমবারের মতো প্রত্যেক জমিদারের জমিদারি এলাকায় কোন চাষি রায়ত কোথায়, কি পরিমাণ, কোন শ্রেণীর সম্পত্তি ভোগদখল করতেন তা রেকর্ড করে বাস্তবভিত্তিক নকশা অংকন এবং সংশ্লিষ্ট দখলকারের নাম উল্লেখপূর্বক খতিয়ান বা রেকর্ড অব রাইটস বা ‘স্বত্বলিপি’ প্রণয়ন করা হয়। ‘স্বত্বলিপি’ প্রণয়নের এ পদ্ধতিকেই বলা হয় ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে অপারেশন বা সি.এস জরিপ। সি.এস জরিপ ১৮৮৮ ইং সালে কক্সবাজার জেলা থেকে শুরু হয় এবং ১৯৪০ সালে দিনাজপুর জেলা জরিপের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শেষ হয়।
পার্বত্যচট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, জমি, বন ও পাহাড় হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। তাই সরকারিভাবে প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্র্রেশন পদ্ধতি আর উপ-জাতিদের বংশানুক্রমভাবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার তফাৎ রয়েছে। CHT-Regulation-এর ৪২ ধারা অনুযায়ী জুম চাষের জন্য মালিকানার দরকার হয় না। ফলে, উপজাতিরা নিবন্ধন ছাড়াই জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করতে পারে এবং সার্কেল প্রধানকে খাজনা দিয়ে নতুন জমির মালিকানা লাভ করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ভূমি জরিপ হয়নি। তাই এ অঞ্চলের মোট ভূমির পরিমাণ নিরুপণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, পার্বত্য এলাকার মোট জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ৭৭৫.৬৩ বর্গমাইল। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ১ হাজার ৪২৩ বর্গমাইল এবং অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বন ২ হাজার ৮৯৪.৩৭ বর্গমাইল। উল্লেখ্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহণ কেন্দ্র, কর্ণফুলি পেপার মিল এবং সরকারি অধিভুক্ত সম্পত্তি (জমি) শান্তি চুক্তির আওতায় নয়।
শান্তি চুক্তির ৬৪ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে ভূমি লিজ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা মহামান্য হাইকোর্টের আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সার্কেল প্রধান নিয়ন্ত্রিত প্রচলিত পদ্ধতি দ্বারা ভূমি ব্যবস্থাপনা চলছে। জেলা প্রশাসক সার্কেল প্রধানের পরামর্শক্রমে হেডম্যান নিয়োগ দেন। সার্কেল প্রধানের অধীনে থেকে হেডম্যান তার মৌজায় ভূমি ও জুম চাষ থেকে রাজস্ব আদায় করে। ভূমি প্রশাসন বিশেষত ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যার ফলে, দেখা যায় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই অনেকে মৃত্যুবরণ করে বা ক্ষেত্রবিশেষে আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে অনেকেই অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয়সহ অননুমোদিতভাবে ভূমির মালিকানা প্রাপ্ত হয়।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রতারক নিজ নামে ভূমি নিবন্ধন করে নিরীহ জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত দাঙ্গার জন্ম দিচ্ছে। অবৈধভাবে জমি দখল না করলে জমির মালিক হওয়া কঠিন। এমন বাস্তবতা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিতর্ক ও সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে পার্বত্যচট্টগ্রামের ভূমি জটিলতা দীর্ঘসূত্রতা লাভ করছে।
ভূমি কমিশনকে অবৈধভাবে দখলকৃত জমি এবং পাহাড়ের মালিকানা বাতিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ২৪ বছরেও ভূমি জরিপ ও আদমশুমারি হয়নি। ভূমি জরিপ ও আদমশুমারিতে শুরু থেকেই বাধা দিয়ে আসছে পাহাড়ি জাতি। একবার ভূমি জরিপের কাজ করতে গেলে সেখানকার উপ-জাতিরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ কারণে সেখানে ভূমি জরিপ ও আদমশুমারি বন্ধ ছিল এবং এখনো বন্ধ রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিগণ বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ প্রথাগত ভূমি অধিকার ভোগদখল করে। সেখানে সি.এস রেকর্ড, এম.আর.আর (এস.এ) রেকর্ড বা আর.এস রেকর্ড সমতলে বসবাসরত আদিবাসীদের মতো বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মতো প্রস্তুত হয়নি।
এ কারণে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল টেনান্সী অ্যাক্টের ৪৯ ধারাতে পার্বত্যচট্টগ্রামের উপ-জাতিদের নাম অনুপস্থিত। উক্ত ধারামতে চাকমা, মারমা, খুকি, হাজং, তঞ্চঙ্গা, লুসাই, পাংখো, মুরং, খিয়াং, বম, খুমি, চাক জাতির নাম নেই।
এরপর ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের নাম পাওয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগণ তাদের নিজস্ব আইন-কানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সব কিছু দেখাশুনা করে। উপজাতিদের জন্য এটি একটি আলাদা মন্ত্রণালয়। সমগ্র বাংলাদেশে জন্য যে ভূমি আইন আছে তা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়। সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্পত্তি ডকুমেন্টস্বরূপ বিভিন্ন খতিয়ান আছে। তারা তাদের সম্পত্তি নিজ জাতির কাছে হস্তান্তর (আদিবাসী-টু-আদিবাসী) করতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্য জাতির (হিন্দু, মুসলিম জনগোষ্ঠী) কাছে বিক্রয় করতে চাইলে বিক্রয়ের অনুমতি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে নেওয়া বাধ্যতামূলক। অন্যথায়, উক্ত বিক্রয়কৃত দলিল বাতিল বলে গণ্য হয়।
তবে, ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গেজেট আকারে বের হয়। এ আইনে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খূমি, লুসাই জাতির নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, উপরে উল্লেখিত জাতিগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। এ আইনের উদ্দেশ্য হলো– বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণিত আইন।
ইতিপূর্বে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানআইনে প্রথমে ২৭টি জাতিকে গেজেটে আনিত হয়েছিল। জানতে পারা যায় যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির বা শ্রেণীর সংখ্যা ২২৮ টি। একুনে সর্বমোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির সংখ্যা ২৫৫টি দাঁড়ায়। অতঃপর সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ২৫৫টি জাতির মধ্যে যেসকল জাতির ভাষা ও সাংস্কৃতি সংকটাপন্ন, ঝুঁকির মধ্যে, বিলুপ্তির পথে রয়েছে তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ক্রমান্বয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গত ২৩/০৩/২০১৯ তারিখের ৫০টি জাতির তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
এখন প্রশ্ন হলো–৫০টি জাতির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কি ভূমি আইন, চাকুরী, ভর্তি, শিক্ষা বৃত্তি, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সনদ প্রাপ্ত হবেন? আর যারা গেজেটের বাইরে আছেন তারা পাবেন।
২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির মধ্যে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির ভাষা, সাংস্কৃতিক বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রয়োজন। ২৫৫টি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ৫০টি জাতিরই সংস্কৃতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হওয়ার পক্ষে মতামত দেন বিশিষ্টজনেরা। এমন বিবেচনায় জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৫০টি জাতির সংস্কৃতি সংরক্ষণ দ্রুত প্রয়োজন মর্মে অত্র ৫০টি জাতির নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, গেজেটবহির্ভূত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসাধারণ রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
জেলা প্রশাসনগুলোর হিসাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) জাতি ২২৮টি।
কোন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে উন্নয়ন নয়। গেজেটভুক্ত বা গেজেটবহির্ভূত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি সব কিছুর সুযোগ সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ চাকরির কোটা, শিক্ষা বৃত্তি, সনদপ্রাপ্তি, সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতা পাইতে আইনগত কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা হবে না। স্পষ্টভাবে বলা যায়, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের গেজেটে প্রকাশিত ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন আর গেজেটবহির্ভূত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগণ সুযোগ সুবিধা পাবেন না। এই ধারণা সত্য নয়।
[লেখক : আইনবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন]
বাবুল রবিদাস
সোমবার, ২০ জুন ২০২২
পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৮৬০ সালে একটি স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলকে ৩টি জেলায় রূপান্তর করা হয়। ৩টি পার্বত্য জেলায় মোট ৭টি পৌরসভা এবং ২৬টি উপজেলা আছে। প্রধান ৩টি সম্প্রদায় হচ্ছে- চাকমা, মারাম, ত্রিপুরাসহ সাড়ে ১৫ লাখ জনসাধারণ বসবাস করে। এ ছাড়া আছে–তঞ্চঙ্গা, লুসাই, পাংখো, মুরং, খিয়াং, বম, খুমি, চাক এবং বিপুলসংখ্যক বাঙালি (৪৫%)। দেশের মোট জনসংখ্যার ১%।
সার্ভে আইন ১৮৭৫ এবং ১৮৮৫ সালের বি.টি অ্যাক্টের বিধানমতে ব্রিটিশ সরকার প্রথমবারের মতো প্রত্যেক জমিদারের জমিদারি এলাকায় কোন চাষি রায়ত কোথায়, কি পরিমাণ, কোন শ্রেণীর সম্পত্তি ভোগদখল করতেন তা রেকর্ড করে বাস্তবভিত্তিক নকশা অংকন এবং সংশ্লিষ্ট দখলকারের নাম উল্লেখপূর্বক খতিয়ান বা রেকর্ড অব রাইটস বা ‘স্বত্বলিপি’ প্রণয়ন করা হয়। ‘স্বত্বলিপি’ প্রণয়নের এ পদ্ধতিকেই বলা হয় ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে অপারেশন বা সি.এস জরিপ। সি.এস জরিপ ১৮৮৮ ইং সালে কক্সবাজার জেলা থেকে শুরু হয় এবং ১৯৪০ সালে দিনাজপুর জেলা জরিপের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শেষ হয়।
পার্বত্যচট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, জমি, বন ও পাহাড় হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। তাই সরকারিভাবে প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্র্রেশন পদ্ধতি আর উপ-জাতিদের বংশানুক্রমভাবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার তফাৎ রয়েছে। CHT-Regulation-এর ৪২ ধারা অনুযায়ী জুম চাষের জন্য মালিকানার দরকার হয় না। ফলে, উপজাতিরা নিবন্ধন ছাড়াই জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করতে পারে এবং সার্কেল প্রধানকে খাজনা দিয়ে নতুন জমির মালিকানা লাভ করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ভূমি জরিপ হয়নি। তাই এ অঞ্চলের মোট ভূমির পরিমাণ নিরুপণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, পার্বত্য এলাকার মোট জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ৭৭৫.৬৩ বর্গমাইল। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ১ হাজার ৪২৩ বর্গমাইল এবং অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বন ২ হাজার ৮৯৪.৩৭ বর্গমাইল। উল্লেখ্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহণ কেন্দ্র, কর্ণফুলি পেপার মিল এবং সরকারি অধিভুক্ত সম্পত্তি (জমি) শান্তি চুক্তির আওতায় নয়।
শান্তি চুক্তির ৬৪ ধারা অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে ভূমি লিজ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা মহামান্য হাইকোর্টের আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সার্কেল প্রধান নিয়ন্ত্রিত প্রচলিত পদ্ধতি দ্বারা ভূমি ব্যবস্থাপনা চলছে। জেলা প্রশাসক সার্কেল প্রধানের পরামর্শক্রমে হেডম্যান নিয়োগ দেন। সার্কেল প্রধানের অধীনে থেকে হেডম্যান তার মৌজায় ভূমি ও জুম চাষ থেকে রাজস্ব আদায় করে। ভূমি প্রশাসন বিশেষত ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যার ফলে, দেখা যায় সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই অনেকে মৃত্যুবরণ করে বা ক্ষেত্রবিশেষে আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে অনেকেই অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয়সহ অননুমোদিতভাবে ভূমির মালিকানা প্রাপ্ত হয়।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রতারক নিজ নামে ভূমি নিবন্ধন করে নিরীহ জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত দাঙ্গার জন্ম দিচ্ছে। অবৈধভাবে জমি দখল না করলে জমির মালিক হওয়া কঠিন। এমন বাস্তবতা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিতর্ক ও সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। এ ধরনের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে পার্বত্যচট্টগ্রামের ভূমি জটিলতা দীর্ঘসূত্রতা লাভ করছে।
ভূমি কমিশনকে অবৈধভাবে দখলকৃত জমি এবং পাহাড়ের মালিকানা বাতিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ২৪ বছরেও ভূমি জরিপ ও আদমশুমারি হয়নি। ভূমি জরিপ ও আদমশুমারিতে শুরু থেকেই বাধা দিয়ে আসছে পাহাড়ি জাতি। একবার ভূমি জরিপের কাজ করতে গেলে সেখানকার উপ-জাতিরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ কারণে সেখানে ভূমি জরিপ ও আদমশুমারি বন্ধ ছিল এবং এখনো বন্ধ রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিগণ বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ প্রথাগত ভূমি অধিকার ভোগদখল করে। সেখানে সি.এস রেকর্ড, এম.আর.আর (এস.এ) রেকর্ড বা আর.এস রেকর্ড সমতলে বসবাসরত আদিবাসীদের মতো বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মতো প্রস্তুত হয়নি।
এ কারণে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল টেনান্সী অ্যাক্টের ৪৯ ধারাতে পার্বত্যচট্টগ্রামের উপ-জাতিদের নাম অনুপস্থিত। উক্ত ধারামতে চাকমা, মারমা, খুকি, হাজং, তঞ্চঙ্গা, লুসাই, পাংখো, মুরং, খিয়াং, বম, খুমি, চাক জাতির নাম নেই।
এরপর ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের নাম পাওয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগণ তাদের নিজস্ব আইন-কানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সব কিছু দেখাশুনা করে। উপজাতিদের জন্য এটি একটি আলাদা মন্ত্রণালয়। সমগ্র বাংলাদেশে জন্য যে ভূমি আইন আছে তা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়। সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্পত্তি ডকুমেন্টস্বরূপ বিভিন্ন খতিয়ান আছে। তারা তাদের সম্পত্তি নিজ জাতির কাছে হস্তান্তর (আদিবাসী-টু-আদিবাসী) করতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্য জাতির (হিন্দু, মুসলিম জনগোষ্ঠী) কাছে বিক্রয় করতে চাইলে বিক্রয়ের অনুমতি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে নেওয়া বাধ্যতামূলক। অন্যথায়, উক্ত বিক্রয়কৃত দলিল বাতিল বলে গণ্য হয়।
তবে, ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গেজেট আকারে বের হয়। এ আইনে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খূমি, লুসাই জাতির নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, উপরে উল্লেখিত জাতিগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। এ আইনের উদ্দেশ্য হলো– বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণিত আইন।
ইতিপূর্বে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানআইনে প্রথমে ২৭টি জাতিকে গেজেটে আনিত হয়েছিল। জানতে পারা যায় যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির বা শ্রেণীর সংখ্যা ২২৮ টি। একুনে সর্বমোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির সংখ্যা ২৫৫টি দাঁড়ায়। অতঃপর সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ২৫৫টি জাতির মধ্যে যেসকল জাতির ভাষা ও সাংস্কৃতি সংকটাপন্ন, ঝুঁকির মধ্যে, বিলুপ্তির পথে রয়েছে তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ক্রমান্বয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গত ২৩/০৩/২০১৯ তারিখের ৫০টি জাতির তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
এখন প্রশ্ন হলো–৫০টি জাতির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কি ভূমি আইন, চাকুরী, ভর্তি, শিক্ষা বৃত্তি, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সনদ প্রাপ্ত হবেন? আর যারা গেজেটের বাইরে আছেন তারা পাবেন।
২৫৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির মধ্যে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতির ভাষা, সাংস্কৃতিক বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রয়োজন। ২৫৫টি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ৫০টি জাতিরই সংস্কৃতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হওয়ার পক্ষে মতামত দেন বিশিষ্টজনেরা। এমন বিবেচনায় জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৫০টি জাতির সংস্কৃতি সংরক্ষণ দ্রুত প্রয়োজন মর্মে অত্র ৫০টি জাতির নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, গেজেটবহির্ভূত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসাধারণ রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
জেলা প্রশাসনগুলোর হিসাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) জাতি ২২৮টি।
কোন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে উন্নয়ন নয়। গেজেটভুক্ত বা গেজেটবহির্ভূত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি সব কিছুর সুযোগ সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ চাকরির কোটা, শিক্ষা বৃত্তি, সনদপ্রাপ্তি, সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতা পাইতে আইনগত কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা হবে না। স্পষ্টভাবে বলা যায়, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের গেজেটে প্রকাশিত ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতি সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন আর গেজেটবহির্ভূত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগণ সুযোগ সুবিধা পাবেন না। এই ধারণা সত্য নয়।
[লেখক : আইনবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন]