alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষকের মর্যাদা

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

: বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, যেখানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে খ্যাত শিক্ষক সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, কেউ কেউ ঘটনা পরম্পরায় জেল-জুলুমের মুখোমুখি হয়েছেন, কোথাওবা কাউকে এমনকি চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা-প্রতিবাদ হয়েছে। বিভিন্নজন বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসব ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করেছেন এবং করছেন।

তবে, কার্যকারণ যাই হোক, আখেরে মোদ্দাকথা এটাই দাঁড়ায় যে, সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয় বলে বিবেচিত আমাদের শিক্ষক সমাজের কিছু সদস্য শারীরিক-মানসিকভাবে নাজেহাল হয়েছেন।

আমরা হরহামেশা জপ করে আসছি, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এ পৃথিবীতে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি ব্যতিরেকে কোন জাতি উন্নতি করেছে, এমনটি কেউ কখনো শুনেনি। এ কারণে অনাদিকাল থেকে প্রত্যেক সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষ কদর পেয়ে আসছেন। প্রাচ্য সমাজে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা যে কতটা উঁচু, তার একটি উপমা পাওয়া যায় মোগল বাদশা ঔরঙ্গজেব আলমগীরের স্মৃতিধন্য কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতায়, যেখানে আমরা দেখি মহাপ্রতাপশালী দিল্লিশ্বরকে তার সন্তান তদীয় উস্তাদের চরণ নিজ হাতে ধৌত না করে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন দেখে শিক্ষক মহোদয়কে ডেকে সন্তানের ভব্যতার

প্রশ্নে হতাশা প্রকাশ করতে। আজও এতদ্দেশে সমাজের বৃহৎ পরিসরে শিক্ষকগণ শুধু শিক্ষার্থীদের নিকটই নন, তাদের অভিভাবকদের কাছেও বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু জ্ঞানের আদান-প্রদানই হয় না, এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমন একটি সমাজে আপনি যদি দেখেন, একজন শিক্ষক শারীরিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন, তাহলে চিন্তায় আপনার কপালে ভাঁজ পড়বে এটাই

স্বাভাবিক নয় কি?

তাহলে কী এমন হলো যে আমাদের মতো এমন একটি শিক্ষক অন্তপ্রাণ সমাজে এভাবে হুট-হাট শিক্ষক নিগ্রহের হিড়িক পড়ে গেল? যে বিষয়টি এখানে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে তা হল, এ ধরনের ঘটনা কি আগেও ঘটেছে, নাকি ইদানীং হঠাৎ করে ঘটতে শুরু করেছে? বিষয়টি কি এমন যে, এসব আগে থেকেই চলে আসছে, ইদানীং এ ধরনের ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র? এমন নয় তো যে, শিক্ষকগণ ঠিক এরূপ শারীরিকভাবে নিগৃহীত হননি ঠিকই, তবে বহুকাল ধরেই তাদের এক শ্রেণীর ছাত্র নামধারী স্যাঙ্গাতকূলের মন জুগিয়ে মান বাঁচিয়ে চলে আসতে হচ্ছে? বিষয়টি এমন নয় তো যে, সাধারণ শিক্ষকরা তো বটেই, এমনকি প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের আসন অলংকৃতকারী আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও রীতিমতো করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করতে বাধ্য হন? চালাক-চতুর আর বিচক্ষণ ব্যক্তিদের ব্যাপার-স্যাপার অবশ্যই আলাদা। তারা এ ধরনের স্যাঙ্গাতদের সঙ্গে তেলে-তালে, ঝোলে-ঝালে মিলে-মিশে এমনভাবে সবকিছু চালিয়ে নিতে পারেন, যাতে আপাতদৃষ্টিতে এমনটিই প্রতীয়মান হতে পারে যে, ইধার কুচ মুশকিল নেহি।

অনেকের চোখে এ ধরনের পারফরম্যান্স দক্ষ ব্যবস্থাপনার পরাকাষ্ঠা বিবেচিত হলেও এভাবে ইজ্জত-সম্মানের প্রশ্নে পদে-পদে আপোস করে কিল খেয়ে কিল চুরি করার পেছনে যে গভীর বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা দিনের পর দিন বয়ে চলা যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন।

অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, খোঁজ নিলে এমন অনেক করিৎকর্মা গুরুদেবের খোঁজও মিলতে পারে যারা তাদের নানা রকমের অনিয়ম ঢাকতে এবং অন্যায্য অভিসন্ধি পূরণ করতে এ ধরনের স্যাঙ্গাতদের অতি আদরে লালন করেন। এরা তখন একে অপরের দোসর রূপে মনিকাঞ্চন জোড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

কখনোবা নানামুখী স্থানীয়-অস্থানীয় চাপের মুখে নিজেদের প্রটেকশনের জন্যও স্কুল-কলেজের শিক্ষাগুরুরা স্ট্রাটেজিক কারণে এসব স্যাঙ্গাতদের পালনে বাধ্য হন বলে অনেকের ধারণা। আবার কখনো এমনও দেখতে পারেন, ওই দুষ্টু ছোকরাগুলো স্রেফ ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে, আসল ঝামেলাটা গুরুদেবদের নিজেদের মধ্যেই, যারা একে অপরকে দেখে নেয়ার জন্য ওই ছোকরাগুলোর মাথায় তেল দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া এমন পর্যবেক্ষণও আছে যে, প্রায়শ এলাকার বিগ ব্রাদাররাও তাদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব ছোকরাদের একটি গ্রুপকে লালন করে থাকেন।

তবে যে বিষয়টি জরুরি তা হলো, এ ধরনের যে কোন ঘটনাকে সিরিয়াসলি নিয়ে এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। ওপরের আলোচনার আলোকে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক হবেনা যে, অনেক জায়গায়ই দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের জন্য একটি অস্বস্তিকর গুমোট পরিবেশ চলে আসছে। তথাপি, বলা চলে, শিক্ষকরা কোনমতে মান বাঁচিয়ে চালিয়ে নেয়ার মতো একটি ব্যবস্থা চলে আসছিল। এখন তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো যে, দুর্বৃত্তরা তাদের ওপর গায়ে গতরে হামলে পড়তে শুরু করেছে? এটা কি আগে থেকে চলে আসা অবক্ষয়ের নতুন পর্যায়, নাকি এর সঙ্গে নতুন কোন উপাদানের সংযুক্তির ফসল? এটি বুঝতে না পারলে এ রকম ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকবে। সরল রৈখিকভাবে সবকিছুকে এক কাতারে না ফেলে প্রতিটি ঘটনার পক্ষপাতহীন চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বোঝা দরকার, সমস্যা কি একমুখী, দ্বিমুখী না বহুমুখী। নিগৃহীত শিক্ষকগণ কি নিতান্তই নিগ্রহের শিকার, নাকি তাদের কারও কারও মধ্যে এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন এসেছে, যা কোন কোন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে? কোন কোন ক্ষেত্রে, সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক যোগসূত্রের অভিযোগ পাওয়া যায়।

যেমন, সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় আক্রান্ত শিক্ষকগণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা সাম্প্রদায়িক কারণে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে। অন্যদিকে তারা তাদের কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন বলেও পাল্টা অভিযোগ এসেছে। সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলের একটি কলেজের অধ্যক্ষ স্থানীয় সংসদ সদস্যের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য হলে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।

অন্যদিকে, কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একজন শিক্ষককে হেনস্তা করার জন্য কোন একটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে আনা হলেও ওটা আসল কারণ নয়, বাহানা মাত্র। স্বার্থান্বেষী মহল ভিন্ন কোন কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর রুষ্ট ছিল এবং তাকে শায়েস্তা করার একটি উপায় খুঁজে ফিরছিল। আবার এমনও দেখা গেছে, সংঘটিত ঘটনা আসলে কোন ব্যক্তিগত রেষারেষির ফল, কিন্তু এতে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

ঘটনা যাই হোক, জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনসমূহে শান্ত, সৌম্য ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের ঐতিহ্যগত সম্মান ও মর্যাদা কেন আজ হুমকির মুখে তা নির্মোহ বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে এবং তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংঘটিত ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে কার দায় কতটুকু, তা নিশ্চিত করতে হবে। হীন রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস নিলে, অন্য কথায়- উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করলে, প্রকৃত সমস্যা ও এর আসল কার্যকারণ অচিহ্নিত থেকে যাবে। এমনটি হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, কোন সমস্যা প্রাথমিক অবস্থায় সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া না হলে তা পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষকের মর্যাদা

মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, যেখানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে খ্যাত শিক্ষক সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, কেউ কেউ ঘটনা পরম্পরায় জেল-জুলুমের মুখোমুখি হয়েছেন, কোথাওবা কাউকে এমনকি চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা-প্রতিবাদ হয়েছে। বিভিন্নজন বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসব ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করেছেন এবং করছেন।

তবে, কার্যকারণ যাই হোক, আখেরে মোদ্দাকথা এটাই দাঁড়ায় যে, সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয় বলে বিবেচিত আমাদের শিক্ষক সমাজের কিছু সদস্য শারীরিক-মানসিকভাবে নাজেহাল হয়েছেন।

আমরা হরহামেশা জপ করে আসছি, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এ পৃথিবীতে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি ব্যতিরেকে কোন জাতি উন্নতি করেছে, এমনটি কেউ কখনো শুনেনি। এ কারণে অনাদিকাল থেকে প্রত্যেক সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষ কদর পেয়ে আসছেন। প্রাচ্য সমাজে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা যে কতটা উঁচু, তার একটি উপমা পাওয়া যায় মোগল বাদশা ঔরঙ্গজেব আলমগীরের স্মৃতিধন্য কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতায়, যেখানে আমরা দেখি মহাপ্রতাপশালী দিল্লিশ্বরকে তার সন্তান তদীয় উস্তাদের চরণ নিজ হাতে ধৌত না করে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন দেখে শিক্ষক মহোদয়কে ডেকে সন্তানের ভব্যতার

প্রশ্নে হতাশা প্রকাশ করতে। আজও এতদ্দেশে সমাজের বৃহৎ পরিসরে শিক্ষকগণ শুধু শিক্ষার্থীদের নিকটই নন, তাদের অভিভাবকদের কাছেও বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু জ্ঞানের আদান-প্রদানই হয় না, এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমন একটি সমাজে আপনি যদি দেখেন, একজন শিক্ষক শারীরিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন, তাহলে চিন্তায় আপনার কপালে ভাঁজ পড়বে এটাই

স্বাভাবিক নয় কি?

তাহলে কী এমন হলো যে আমাদের মতো এমন একটি শিক্ষক অন্তপ্রাণ সমাজে এভাবে হুট-হাট শিক্ষক নিগ্রহের হিড়িক পড়ে গেল? যে বিষয়টি এখানে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে তা হল, এ ধরনের ঘটনা কি আগেও ঘটেছে, নাকি ইদানীং হঠাৎ করে ঘটতে শুরু করেছে? বিষয়টি কি এমন যে, এসব আগে থেকেই চলে আসছে, ইদানীং এ ধরনের ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র? এমন নয় তো যে, শিক্ষকগণ ঠিক এরূপ শারীরিকভাবে নিগৃহীত হননি ঠিকই, তবে বহুকাল ধরেই তাদের এক শ্রেণীর ছাত্র নামধারী স্যাঙ্গাতকূলের মন জুগিয়ে মান বাঁচিয়ে চলে আসতে হচ্ছে? বিষয়টি এমন নয় তো যে, সাধারণ শিক্ষকরা তো বটেই, এমনকি প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের আসন অলংকৃতকারী আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও রীতিমতো করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করতে বাধ্য হন? চালাক-চতুর আর বিচক্ষণ ব্যক্তিদের ব্যাপার-স্যাপার অবশ্যই আলাদা। তারা এ ধরনের স্যাঙ্গাতদের সঙ্গে তেলে-তালে, ঝোলে-ঝালে মিলে-মিশে এমনভাবে সবকিছু চালিয়ে নিতে পারেন, যাতে আপাতদৃষ্টিতে এমনটিই প্রতীয়মান হতে পারে যে, ইধার কুচ মুশকিল নেহি।

অনেকের চোখে এ ধরনের পারফরম্যান্স দক্ষ ব্যবস্থাপনার পরাকাষ্ঠা বিবেচিত হলেও এভাবে ইজ্জত-সম্মানের প্রশ্নে পদে-পদে আপোস করে কিল খেয়ে কিল চুরি করার পেছনে যে গভীর বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা দিনের পর দিন বয়ে চলা যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন।

অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, খোঁজ নিলে এমন অনেক করিৎকর্মা গুরুদেবের খোঁজও মিলতে পারে যারা তাদের নানা রকমের অনিয়ম ঢাকতে এবং অন্যায্য অভিসন্ধি পূরণ করতে এ ধরনের স্যাঙ্গাতদের অতি আদরে লালন করেন। এরা তখন একে অপরের দোসর রূপে মনিকাঞ্চন জোড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

কখনোবা নানামুখী স্থানীয়-অস্থানীয় চাপের মুখে নিজেদের প্রটেকশনের জন্যও স্কুল-কলেজের শিক্ষাগুরুরা স্ট্রাটেজিক কারণে এসব স্যাঙ্গাতদের পালনে বাধ্য হন বলে অনেকের ধারণা। আবার কখনো এমনও দেখতে পারেন, ওই দুষ্টু ছোকরাগুলো স্রেফ ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে, আসল ঝামেলাটা গুরুদেবদের নিজেদের মধ্যেই, যারা একে অপরকে দেখে নেয়ার জন্য ওই ছোকরাগুলোর মাথায় তেল দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া এমন পর্যবেক্ষণও আছে যে, প্রায়শ এলাকার বিগ ব্রাদাররাও তাদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব ছোকরাদের একটি গ্রুপকে লালন করে থাকেন।

তবে যে বিষয়টি জরুরি তা হলো, এ ধরনের যে কোন ঘটনাকে সিরিয়াসলি নিয়ে এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। ওপরের আলোচনার আলোকে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক হবেনা যে, অনেক জায়গায়ই দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের জন্য একটি অস্বস্তিকর গুমোট পরিবেশ চলে আসছে। তথাপি, বলা চলে, শিক্ষকরা কোনমতে মান বাঁচিয়ে চালিয়ে নেয়ার মতো একটি ব্যবস্থা চলে আসছিল। এখন তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো যে, দুর্বৃত্তরা তাদের ওপর গায়ে গতরে হামলে পড়তে শুরু করেছে? এটা কি আগে থেকে চলে আসা অবক্ষয়ের নতুন পর্যায়, নাকি এর সঙ্গে নতুন কোন উপাদানের সংযুক্তির ফসল? এটি বুঝতে না পারলে এ রকম ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকবে। সরল রৈখিকভাবে সবকিছুকে এক কাতারে না ফেলে প্রতিটি ঘটনার পক্ষপাতহীন চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বোঝা দরকার, সমস্যা কি একমুখী, দ্বিমুখী না বহুমুখী। নিগৃহীত শিক্ষকগণ কি নিতান্তই নিগ্রহের শিকার, নাকি তাদের কারও কারও মধ্যে এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন এসেছে, যা কোন কোন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে? কোন কোন ক্ষেত্রে, সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক যোগসূত্রের অভিযোগ পাওয়া যায়।

যেমন, সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় আক্রান্ত শিক্ষকগণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা সাম্প্রদায়িক কারণে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে। অন্যদিকে তারা তাদের কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন বলেও পাল্টা অভিযোগ এসেছে। সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলের একটি কলেজের অধ্যক্ষ স্থানীয় সংসদ সদস্যের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য হলে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।

অন্যদিকে, কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একজন শিক্ষককে হেনস্তা করার জন্য কোন একটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে আনা হলেও ওটা আসল কারণ নয়, বাহানা মাত্র। স্বার্থান্বেষী মহল ভিন্ন কোন কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর রুষ্ট ছিল এবং তাকে শায়েস্তা করার একটি উপায় খুঁজে ফিরছিল। আবার এমনও দেখা গেছে, সংঘটিত ঘটনা আসলে কোন ব্যক্তিগত রেষারেষির ফল, কিন্তু এতে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

ঘটনা যাই হোক, জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনসমূহে শান্ত, সৌম্য ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের ঐতিহ্যগত সম্মান ও মর্যাদা কেন আজ হুমকির মুখে তা নির্মোহ বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে এবং তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংঘটিত ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে কার দায় কতটুকু, তা নিশ্চিত করতে হবে। হীন রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস নিলে, অন্য কথায়- উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করলে, প্রকৃত সমস্যা ও এর আসল কার্যকারণ অচিহ্নিত থেকে যাবে। এমনটি হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, কোন সমস্যা প্রাথমিক অবস্থায় সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া না হলে তা পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top