মিথুশিলাক মুরমু
দেশে বসবাসরত ‘আদিবাসী’দের আদিবাসী না বলে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। আদিবাসী শব্দটি নির্বাসনের লক্ষ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, সংবাদপত্রের সম্পাদক, সুশীল সমাজে ব্যক্তিবর্গকে। যারা দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে, তারা সবাই উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী; অর্থাৎ নতুন পরিচয়ে পরিচিত করার প্রয়াস অত্যন্ত বেদনাদায়ক, রহস্যজনক এবং দূরভিসন্ধিমূলক। ইতিপূর্বেও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দচয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। মূলত, ৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও উন্নয়ন সংগঠন, অরাজনৈতিক সংগঠন বা ক্লাবগুলো আড়ম্বরের সঙ্গে দিবসটি উদ্যাপন করে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে-তাহলে কী দেশের আদিবাসী সাঁওতাল, কোল, ভীল, মুন্ডা, উরাঁও, মাহালে, রাজোয়াড় কিংবা গারো, হাজং, খাসি, চাকমা, ত্রিপুরা, মারমাদের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা রাতারাতি বদলে গেল?
আদিবাসী শব্দটির প্রচলন হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। আমরা দেখেছি, ব্রিটিশ সরকারের শাসনামলে বেঙ্গল টেনেন্সি অ্যাক্টের ৯৭ ধারায় Indigenous-এর বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে- আদিবাসী। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার আইনটি রিভিউ করে আদিবাসী শব্দটিকে বহাল রেখেই। অতঃপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের নাম-নিশানাকে নিশ্চিহ্ন করে সোনার বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। সদ্য স্বাধীন দেশে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে যে আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে গেছেন, সেখানেও আদিবাসী বা Indigenous শব্দটি শুধু ব্যবহারই নয়, তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। সাহায্য ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান দৈনিক আজাদ, ২ অক্টোবর ১৯৭২, সোমবার, ৫ম পৃষ্ঠা, ২য় কলাম প্রকাশিত সংবাদে প্রতীয়মান হয়েছে, কামরুজ্জামান সাহেব আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করে সাঁওতালদের সঙ্গে মতবিনিয় করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অদ্য প্রাতে এখানে সার্কিট হাউসে আদিম অধিবাসী (সাঁওতাল) নেতাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান প্রসঙ্গে মন্ত্রী এ কথা বলেন। কামরুজ্জামান তাদের আদিবাসী বলে মনে না করে অন্যদের মতো নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে মনে করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব নাগরিক সমান অধিকার ও সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন যে, সরকার দেশের জনগণের কোন এক সম্প্রদায়ের প্রতি উদাসীনতা বরদাশত করবেন না।’ তারপরও কেটেছে দীর্ঘ বছর, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত আদিবাসীরা আদিবাসী হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন কিন্তু সংশোধনীর পরই হয়ে গেলেন ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’; যা আদিবাসীরা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভাবনার বিষয় হচ্ছে-কেন শিক্ষক, সংবাদপত্র কিংবা বুদ্ধিজীবীর মুখ থেকে বলানোর ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার! শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরাই গবেষণা করেছেন, ইতিহাস ঘেঁটেছেন, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো বিশ্লেষণ করেছেন; সে ক্ষেত্রে সঠিক ও নিরেট সত্যকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। একদল শিক্ষক সত্যের সন্ধানী, সত্যকে ধারণ করে এগিয়েছেন; অন্যদিকে সরকারের সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিচিতিকে শিক্ষকদের দ্বারাই হালাল করার পরিকল্পনা খুবই ন্যক্কারজনক। মজার বিষয় হচ্ছে-আজ পর্যন্ত সরকারের কর্মকর্তাগণ ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’র কোনো সংজ্ঞা নির্মাণ করতে পারেনি; পারেননি কোন কোন জাতিগোষ্ঠী ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে!
প্রজ্ঞাপনটি জারির পর আদিবাসী শব্দটি পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাদের সাফ কথা আমরা তো এই স্বপ্ন-দর্শনের জন্য লড়াই করিনি। আমরা আদিবাসী, আদিবাসী হিসেবে বাংলার মাটিতে সমাহিত হতে চাই। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার চার দশক পর্যন্ত দেশের সর্বত্রই আদিবাসী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেছি, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্ববোধ করেছি; কিন্তু কোথায় থেকে কিভাবে পরিস্থিতি পাল্টেছে, সেটির গোঁড়া খুঁজে বের করা দরকার। আমাদের দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলো আদিবাসীদের দুদর্শা, অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সহমত পোষণ করেছেন; পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহিত করেছেন; এমনকি ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বাণী দিয়েছেন। এতো কিছুর পরেও কেন সবচেয়ে নিরীহ জাতিগোষ্ঠী নিয়ে ষড়যন্ত্র, কেন পরিচিতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! তাহলে কী আদিবাসীরা তরুপের তাসে পরিণত হতে চলেছে!’ উল্লেখ্য যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তাঁর দেওয়া বাণীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সব অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর বলিষ্ঠ গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার সাংসদগণ অহরহ রাজনৈতিক ময়দানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আওড়াচ্ছেন। জাতীয় সংসদে বক্তব্যকালেও সতর্কতার সঙ্গেই শব্দটি ব্যবহার করে যাচ্ছেন। তাহলে কেন নয় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা; তারাই তো আইন প্রণেতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে উপলব্ধীয় যে, ভোটের বা ক্ষমতার রাজনীতিতে আদিবাসীদের ভোট বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসীদের হাতে রাখতে রাজনৈতিক কৌশল পূর্বেও ছিল, আজও তা বহমান রয়েছে। আদিবাসীরা পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রাক্কালে দেখেছে, দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কেউ-ই আদিবাসী শব্দটি সংযোজনের পক্ষে সংসদে কথা বলেননি। স্বচ্ছ জলের মতোই আদিবাসীদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দগুচ্ছগুলো রাজনৈতিক ভাষা, রাজনৈতিক পোশাক-পরিচ্ছেদ।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ (ক) ও ২ (খ) ধারায় যে বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া রয়েছে, তাতেও সরকারের সার্কুলারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। একজন কী কী শব্দ চয়ন করলেন, তাতে রাষ্ট্রের কারও কিছু বলার নাই, যদি এই শব্দ ব্যবহারে অন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা না ছড়ানো হয়। দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানের কোনো ধারা বা বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টই দিতে পারবেন। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়। আর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে কোন আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই। তাহলে কী রাষ্ট্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চেয়েছে!
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল- অসাম্প্রদায়িক, শান্তি ও সম্প্রীতিজনক। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন, ‘সব নাগরিকের আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে পুনর্বার আদিবাসী শব্দটি নিষিদ্ধকরণের পদক্ষেপগুলো রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে। মানবাধিকার, সাম্যতা বিনির্মাণে আমরা কতটা সহনশীল, কতটা আগ্রহী! নাকি অন্যকে অসম্মান করে নিজেদের সম্মানিত করব। আদিবাসী কবি শরৎ জ্যোতি চাকমা’র ভাষায়- ‘শোষণ করিবে শোষিত হবো/ অথচ অধিকার দেবে না, কথা বলতে দেবে না লড়তে দেবে না/ তা কেমন করে হয়?/ আমি আদিবাসী তাতে কি, বঙ্গেই রহিবে জীবন/ দেশহীন হবো কেন?/ সংবিধানে আমার নাম থাকবে না কেন?/ সবই ষড়যন্ত্র!/ অষ্টপ্রহর দৃষ্টিতে বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি/ দানবের দানবীয়তায় বিকট বিকট আর্তচিৎকার/ ফলাফল, অগণিত লাশ, ধর্ষিত রমনীর আহাজারি/ কিংবা ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ/ হুমকি বারংবার, ত্যাগী হও বাস্তুভিটা, হবে ইকোপার্ক/ কিংবা নববসতি খাটিবে না আইনের ডায়েরি, চলিবে না যৌক্তিকতা/ অসহায় হয় বসুমতি/ তবে ভীত নয় আদিবাসী, লড়বে বারবার মানিবে না এই দুর্গতি। / আমি আদিবাসী/ আমাকে কথা বলতে দাও, শুনতে দাও, লড়তে দাও/ বন্দিত্ব আর হবে না, উত্তপ্ত আজ প্রতিটি রক্তবিন্দু
ভাঙবো শোষকের লোহার বাঁধ/ মানব না ঘৃণার দাবানল, পুলিশি গ্রেপ্তার/ ফিরিয়ে দাও আমার মায়ের হাঁসি/ মেনে তোমাকে নিতেই হবে/ আমি আদিবাসী।’
মিথুশিলাক মুরমু
সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২
দেশে বসবাসরত ‘আদিবাসী’দের আদিবাসী না বলে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। আদিবাসী শব্দটি নির্বাসনের লক্ষ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, সংবাদপত্রের সম্পাদক, সুশীল সমাজে ব্যক্তিবর্গকে। যারা দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে, তারা সবাই উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী; অর্থাৎ নতুন পরিচয়ে পরিচিত করার প্রয়াস অত্যন্ত বেদনাদায়ক, রহস্যজনক এবং দূরভিসন্ধিমূলক। ইতিপূর্বেও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দচয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। মূলত, ৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও উন্নয়ন সংগঠন, অরাজনৈতিক সংগঠন বা ক্লাবগুলো আড়ম্বরের সঙ্গে দিবসটি উদ্যাপন করে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে-তাহলে কী দেশের আদিবাসী সাঁওতাল, কোল, ভীল, মুন্ডা, উরাঁও, মাহালে, রাজোয়াড় কিংবা গারো, হাজং, খাসি, চাকমা, ত্রিপুরা, মারমাদের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা রাতারাতি বদলে গেল?
আদিবাসী শব্দটির প্রচলন হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। আমরা দেখেছি, ব্রিটিশ সরকারের শাসনামলে বেঙ্গল টেনেন্সি অ্যাক্টের ৯৭ ধারায় Indigenous-এর বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে- আদিবাসী। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার আইনটি রিভিউ করে আদিবাসী শব্দটিকে বহাল রেখেই। অতঃপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের নাম-নিশানাকে নিশ্চিহ্ন করে সোনার বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। সদ্য স্বাধীন দেশে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে যে আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে গেছেন, সেখানেও আদিবাসী বা Indigenous শব্দটি শুধু ব্যবহারই নয়, তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। সাহায্য ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান দৈনিক আজাদ, ২ অক্টোবর ১৯৭২, সোমবার, ৫ম পৃষ্ঠা, ২য় কলাম প্রকাশিত সংবাদে প্রতীয়মান হয়েছে, কামরুজ্জামান সাহেব আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করে সাঁওতালদের সঙ্গে মতবিনিয় করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অদ্য প্রাতে এখানে সার্কিট হাউসে আদিম অধিবাসী (সাঁওতাল) নেতাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান প্রসঙ্গে মন্ত্রী এ কথা বলেন। কামরুজ্জামান তাদের আদিবাসী বলে মনে না করে অন্যদের মতো নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে মনে করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব নাগরিক সমান অধিকার ও সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন যে, সরকার দেশের জনগণের কোন এক সম্প্রদায়ের প্রতি উদাসীনতা বরদাশত করবেন না।’ তারপরও কেটেছে দীর্ঘ বছর, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত আদিবাসীরা আদিবাসী হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন কিন্তু সংশোধনীর পরই হয়ে গেলেন ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’; যা আদিবাসীরা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভাবনার বিষয় হচ্ছে-কেন শিক্ষক, সংবাদপত্র কিংবা বুদ্ধিজীবীর মুখ থেকে বলানোর ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার! শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরাই গবেষণা করেছেন, ইতিহাস ঘেঁটেছেন, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো বিশ্লেষণ করেছেন; সে ক্ষেত্রে সঠিক ও নিরেট সত্যকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। একদল শিক্ষক সত্যের সন্ধানী, সত্যকে ধারণ করে এগিয়েছেন; অন্যদিকে সরকারের সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিচিতিকে শিক্ষকদের দ্বারাই হালাল করার পরিকল্পনা খুবই ন্যক্কারজনক। মজার বিষয় হচ্ছে-আজ পর্যন্ত সরকারের কর্মকর্তাগণ ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’র কোনো সংজ্ঞা নির্মাণ করতে পারেনি; পারেননি কোন কোন জাতিগোষ্ঠী ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে!
প্রজ্ঞাপনটি জারির পর আদিবাসী শব্দটি পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাদের সাফ কথা আমরা তো এই স্বপ্ন-দর্শনের জন্য লড়াই করিনি। আমরা আদিবাসী, আদিবাসী হিসেবে বাংলার মাটিতে সমাহিত হতে চাই। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার চার দশক পর্যন্ত দেশের সর্বত্রই আদিবাসী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেছি, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্ববোধ করেছি; কিন্তু কোথায় থেকে কিভাবে পরিস্থিতি পাল্টেছে, সেটির গোঁড়া খুঁজে বের করা দরকার। আমাদের দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলো আদিবাসীদের দুদর্শা, অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সহমত পোষণ করেছেন; পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহিত করেছেন; এমনকি ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বাণী দিয়েছেন। এতো কিছুর পরেও কেন সবচেয়ে নিরীহ জাতিগোষ্ঠী নিয়ে ষড়যন্ত্র, কেন পরিচিতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! তাহলে কী আদিবাসীরা তরুপের তাসে পরিণত হতে চলেছে!’ উল্লেখ্য যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তাঁর দেওয়া বাণীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সব অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর বলিষ্ঠ গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার সাংসদগণ অহরহ রাজনৈতিক ময়দানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আওড়াচ্ছেন। জাতীয় সংসদে বক্তব্যকালেও সতর্কতার সঙ্গেই শব্দটি ব্যবহার করে যাচ্ছেন। তাহলে কেন নয় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা; তারাই তো আইন প্রণেতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে উপলব্ধীয় যে, ভোটের বা ক্ষমতার রাজনীতিতে আদিবাসীদের ভোট বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসীদের হাতে রাখতে রাজনৈতিক কৌশল পূর্বেও ছিল, আজও তা বহমান রয়েছে। আদিবাসীরা পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রাক্কালে দেখেছে, দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কেউ-ই আদিবাসী শব্দটি সংযোজনের পক্ষে সংসদে কথা বলেননি। স্বচ্ছ জলের মতোই আদিবাসীদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দগুচ্ছগুলো রাজনৈতিক ভাষা, রাজনৈতিক পোশাক-পরিচ্ছেদ।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ (ক) ও ২ (খ) ধারায় যে বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া রয়েছে, তাতেও সরকারের সার্কুলারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। একজন কী কী শব্দ চয়ন করলেন, তাতে রাষ্ট্রের কারও কিছু বলার নাই, যদি এই শব্দ ব্যবহারে অন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা না ছড়ানো হয়। দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানের কোনো ধারা বা বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টই দিতে পারবেন। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়। আর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে কোন আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই। তাহলে কী রাষ্ট্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চেয়েছে!
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল- অসাম্প্রদায়িক, শান্তি ও সম্প্রীতিজনক। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন, ‘সব নাগরিকের আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে পুনর্বার আদিবাসী শব্দটি নিষিদ্ধকরণের পদক্ষেপগুলো রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে। মানবাধিকার, সাম্যতা বিনির্মাণে আমরা কতটা সহনশীল, কতটা আগ্রহী! নাকি অন্যকে অসম্মান করে নিজেদের সম্মানিত করব। আদিবাসী কবি শরৎ জ্যোতি চাকমা’র ভাষায়- ‘শোষণ করিবে শোষিত হবো/ অথচ অধিকার দেবে না, কথা বলতে দেবে না লড়তে দেবে না/ তা কেমন করে হয়?/ আমি আদিবাসী তাতে কি, বঙ্গেই রহিবে জীবন/ দেশহীন হবো কেন?/ সংবিধানে আমার নাম থাকবে না কেন?/ সবই ষড়যন্ত্র!/ অষ্টপ্রহর দৃষ্টিতে বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি/ দানবের দানবীয়তায় বিকট বিকট আর্তচিৎকার/ ফলাফল, অগণিত লাশ, ধর্ষিত রমনীর আহাজারি/ কিংবা ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ/ হুমকি বারংবার, ত্যাগী হও বাস্তুভিটা, হবে ইকোপার্ক/ কিংবা নববসতি খাটিবে না আইনের ডায়েরি, চলিবে না যৌক্তিকতা/ অসহায় হয় বসুমতি/ তবে ভীত নয় আদিবাসী, লড়বে বারবার মানিবে না এই দুর্গতি। / আমি আদিবাসী/ আমাকে কথা বলতে দাও, শুনতে দাও, লড়তে দাও/ বন্দিত্ব আর হবে না, উত্তপ্ত আজ প্রতিটি রক্তবিন্দু
ভাঙবো শোষকের লোহার বাঁধ/ মানব না ঘৃণার দাবানল, পুলিশি গ্রেপ্তার/ ফিরিয়ে দাও আমার মায়ের হাঁসি/ মেনে তোমাকে নিতেই হবে/ আমি আদিবাসী।’