মোস্তাফা জব্বারু
চার
আমার জীবনটাও নানা খাতে প্রবাহিত হতে হতে ৮৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে এসে পৌঁছায়। সেই সময়েই শেখ হাসিনা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্থির করেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে কম্পিউটারের যুগে প্রবেশ করাবেন। সেই মোতাবেক তিনি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একটি মেকিন্টোস কম্পিউটার ও একটি লেজার প্রিন্টার কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমার দায়িত্ব পড়ে শেখ হাসিনাকে বাংলা টাইপিং শেখানোর। তিনি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদে জয়ের কাছ থেকে কম্পিউটারের নানা বিষয় শিখতেন এবং আমি তাকে ইংরেজি কোন বোতামে কোন বাংলা অক্ষর বা কোন যুক্তাক্ষর কেমন করে বানাতে হবে সেটি শেখাতাম। তখন কোন কোন সময় তিনি নিজে টাইপ করে দলের প্রেস রিলিজ মিডিয়ায় পাঠাতেন। তখন তো দূরের কথা এরপরও বহু বছর বাংলাদেশের কোন রাজনীতিবিদ এমন করে কম্পিউটার ব্যবহার করা শুরু করেননি বা কম্পিউটারের সঙ্গে মিতালিও করেননি। তার একটি বাড়তি সুবিধা ছিল যে তার ঘরেই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আছে। তারা তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে ওঠতে সহায়তা করেন। আমি অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে এটি বলতে পারি যে তিনি একজন প্রযুক্তিমুখী মানুষ বলেই আজ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে রূপান্তরের পথের দেশ বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
দিনে দিনে আমি নিজেও তথ্যপ্রযুক্তিতেই অনেক বেশি জড়িয়ে ফেলি। সেই যে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করে মুক্তিযুদ্ধে গেলাম-তারপর সাংবাদিকতা, মুদ্রণ ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সি এসব নিয়ে কাটিয়ে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রটাতেই আটকে গেলাম। বলা যেতে পারে যে, জীবনের পুরো ছকটাই পাল্টে গেল।
মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনীতির চাইতে সাংবাদিকতা অনেক বেশি প্রিয় হওয়ার পরও রাজনীতি আমার পিছু ছাড়েনি। পারিবারিকভাবেও আমি আমার রাজনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ থেকে যাই। ৭০ সালে বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই খালিয়াজুরী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। ৭৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার ও হাসান চৌধুরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ৯৮ সালে ছোট ভাই কিবরিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়। তার আগেই আবদুুল মমিন সাহেব আমাদের এলাকার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। ৯১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। এরপরই কিবরিয়ার মাধ্যমে উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতে থাকে। এক সময়ে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি আমাকে জেলা কমিটিতে যুক্ত করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হওয়াটা তখনই প্রথম। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে পেশার সূত্র ধরে। ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগের পর আমি ৮৯ সালে আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ-আবাস নামে দেশের প্রথম ডিজিটাল সংবাদ সংস্থা গড়ে তুলি। প্রথমে ফ্যাক্সের মাধ্যমে তথ্য পাঠাতাম। পরে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহৃত হতে থাকে। যোগাযোগ করা হতো ইন্টারনেট ছাড়া। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল এই সংবাদমাধ্যমটি দিয়ে আমরা তখন দেশ-বিদেশে তথ্য প্রচার করি। একটি মেকিন্টোস কম্পিউটারের সঙ্গে একটি মডেম ও একটি টিঅ্যান্ডটি ফোন লাইন ব্যবহার করে আমরা তথ্য আদান প্রদান করতাম। সেই সময়েই জননেত্রী শেখ হাসিনা এক পরম দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৯৬ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আমি যুক্ত হই আওয়ামী লীগের মিডিয়া টিমের সঙ্গে। সেই টিমেই আমি প্রস্তাব করি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণাকে ডিজিটাল করা যেতে পারে। আমার প্রস্তাব জননেত্রী শেখ হাসিনা সানন্দে গ্রহণ করেন। আমার প্রতিষ্ঠান আবাসের মাধ্যমে আমরা প্রথম নির্বাচনে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করি। কাজটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। তখন আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা যদি ঢাকার বাইরে কোথাও হতো তবে তার খবর পরের দিনের পত্রিকায় ছাপা হলেও ছবি ছাপা হতো আরও একদিন পরে। তখন হয়তো সেই ছবির গুরুত্বও থাকত না। মোনায়েম সরকার তখন নির্বাচনী প্রচারণার সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। আমি তার সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমরা তখন আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সিদ্দিকুর রহমানকে একটি স্ক্যানার, একটি মেকিন্টোস ও একটি মডেম দিয়ে নেত্রীর নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সঙ্গে যুক্ত করে দিই। তখনও আমাদের কোন ল্যাপটপ ছিল না। ৯ ইঞ্চির ডেস্কটপ ব্যবহার করতে হতো। বিশাল আকারের মডেম বহন করতে হতো। শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সঙ্গে আমাদের কম্পিউটার টিমটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমাদের টিম সেখানে শেখ হাসিনার জনসভার ছবি স্ক্যান করে মডেমের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দিত। আমরা আবাসের মাধ্যমে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব পত্রিকায় ডিজিটাল ও এনালগ পদ্ধতিতে ছবি পৌঁছে দিতাম। আমদের ডিজিটাল প্রচারণায় শেখ হাসিনা শুধু সন্তোষ প্রকাশ করেননি, ৯৭ সালে এক দিন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলেন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের জন্য তার সরকার কি পদক্ষেপ নিতে পারে। আমি তখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি। ৯৬ সালে বিসিএস কম্পিউটার শোতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী জিল্লুর রহমান এসেছিলেন। আমরা তার কাছে কম্পিউটারকে শুল্কমুক্ত করাসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অন্যান্য করণীয় নিয়ে দাবি পেশ করি। জিল্লুর রহমান সাহেব আমাদের সব দাবি মেনে নেবার কথা বলেছিলেন। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কিবরিয়া সাহেবও ছিলেন। নেত্রী তাকে আগেই বসিয়ে রেখেছিলেন। আমি নেত্রীকে অনুরোধ করলাম কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়ার জন্য। তিনি আমার কথা শুনেই কিবরিয়া সাহেবের দিকে তাকালেন। কিবরিয়া সাহেব বললেন, আমাদের রাজস্ব আদায় অনেক কমে যাবে। কমবে ২২০ কোটি টাকা। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, দেখুন অর্থমন্ত্রী তার দিকটাই দেখছেন। আমি নেত্রীকে বললাম, নেত্রী আপনি রাজস্ব দেখবেন না দেশের ভবিষ্যৎ দেখবেন? আজ যদি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেন তবে দেশ সামনে যাবে-আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো করব। তিনি কিবরিয়া সাহেবকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়ার নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার পরিবার থেকে ইতোমধ্যেই কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তোলার প্রস্তাব আসে। সেই থেকেই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রবেশ করে এক নতুন যুগে। আজ যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠা সেটি সেদিনের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফসল।
২০০১ সাল পর্যন্ত আমার নিজের জন্য একটি অসাধারণ সময় ছিল এ জন্য যে শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের সব প্রস্তাবনাকে শুধু গুরুত্বই দিতেন না-বাস্তবায়নে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতেন। প্রথম দুই বছর আমি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি ছিলাম বলে তার অসাধারণ সমর্থনও আমি সেই সময়ে পেয়েছি। এই ছোট নিবন্ধে তার পাঁচ বছরের সময়কালের বিস্তারিত বিষয়াদি তুলে ধরা সহজ নয়। আমি শুধু তার তিনটি বড় কাজের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১) প্রথমত তিনি সেই সময়ে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেন। এই একটি কাজের জন্য বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে কম্পিউটার আসার সুযোগ তৈরি হয়। দেশের রাজস্ব আয়ের চাইতেও সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানো যে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সেটি তিনি এককভাবে অনুভব করেন। সেই সময়েই তিনি বিদেশে সফটওয়্যার রপ্তানি করার উপায় উদ্ভাবন করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন যারা ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে এবং তিনি ২০০১ সালের আগেই সেই সুপারিশসমূহের ২৮টি বাস্তবায়ন করেন। সেই সময়েই তিনি কম্পিউটার শিক্ষার দিগন্তটি উন্মোচন করেন ও সরকারি বেসরকারি সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সিট বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
২) দ্বিতীয়ত তিনি মোবাইলের মনোপলি ভাঙেন এবং দেশের মোবাইল বিপ্লবের ভিত রচনা করেন। সেই সময়ে মুর্শেদ খানের সিটি সেল ফোনের দাম ছিল সোয়া লাখ টাকা আর আউটগোযিং কল ১৪ টাকা ও ইনকামিং কল ১২ টাকা ছিলো। ৯৭ সালে তিনি মোবাইল ফোনের ২জি প্রযুক্তি চালু করেন। ৩) তিনি সেই সময়েই অনলাইন ইন্টারনেটের বিষয়টিকেও স্থায়ী করেন।
যারা মনে করেন যে, তিনি ২০০৮ সালে আকস্মিকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন, তারা তার সেই সময়কালের কাজের কোন খবরই রাখেন না। বস্তুত আমি দেখি যে নিজের হাতে কম্পিউটার দিয়ে কাজ করা থেকেই তিনি একটি ডিজিটাল দেশের স্বপ্ন দেখেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার জন্য তার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথা বলেন। জয় শুধু ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশে প্রযুক্তি বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ। বস্তুত তার চাইতে ডিজিটাল ধারণা সম্ভবত বাংলাদেশের ডিজিটাল শিক্ষকদেরও নাই। এখনও তিনি যে অসাধারণভাবে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরকে সামনে নিয়ে যেতে সচেষ্ট আছেন তাতে তার তুলনা তিনি একাই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]
মোস্তাফা জব্বারু
সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২
চার
আমার জীবনটাও নানা খাতে প্রবাহিত হতে হতে ৮৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে এসে পৌঁছায়। সেই সময়েই শেখ হাসিনা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্থির করেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে কম্পিউটারের যুগে প্রবেশ করাবেন। সেই মোতাবেক তিনি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একটি মেকিন্টোস কম্পিউটার ও একটি লেজার প্রিন্টার কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমার দায়িত্ব পড়ে শেখ হাসিনাকে বাংলা টাইপিং শেখানোর। তিনি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদে জয়ের কাছ থেকে কম্পিউটারের নানা বিষয় শিখতেন এবং আমি তাকে ইংরেজি কোন বোতামে কোন বাংলা অক্ষর বা কোন যুক্তাক্ষর কেমন করে বানাতে হবে সেটি শেখাতাম। তখন কোন কোন সময় তিনি নিজে টাইপ করে দলের প্রেস রিলিজ মিডিয়ায় পাঠাতেন। তখন তো দূরের কথা এরপরও বহু বছর বাংলাদেশের কোন রাজনীতিবিদ এমন করে কম্পিউটার ব্যবহার করা শুরু করেননি বা কম্পিউটারের সঙ্গে মিতালিও করেননি। তার একটি বাড়তি সুবিধা ছিল যে তার ঘরেই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আছে। তারা তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে ওঠতে সহায়তা করেন। আমি অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে এটি বলতে পারি যে তিনি একজন প্রযুক্তিমুখী মানুষ বলেই আজ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে রূপান্তরের পথের দেশ বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
দিনে দিনে আমি নিজেও তথ্যপ্রযুক্তিতেই অনেক বেশি জড়িয়ে ফেলি। সেই যে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করে মুক্তিযুদ্ধে গেলাম-তারপর সাংবাদিকতা, মুদ্রণ ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সি এসব নিয়ে কাটিয়ে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রটাতেই আটকে গেলাম। বলা যেতে পারে যে, জীবনের পুরো ছকটাই পাল্টে গেল।
মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনীতির চাইতে সাংবাদিকতা অনেক বেশি প্রিয় হওয়ার পরও রাজনীতি আমার পিছু ছাড়েনি। পারিবারিকভাবেও আমি আমার রাজনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ থেকে যাই। ৭০ সালে বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই খালিয়াজুরী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। ৭৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার ও হাসান চৌধুরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ৯৮ সালে ছোট ভাই কিবরিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়। তার আগেই আবদুুল মমিন সাহেব আমাদের এলাকার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। ৯১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। এরপরই কিবরিয়ার মাধ্যমে উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতে থাকে। এক সময়ে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি আমাকে জেলা কমিটিতে যুক্ত করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হওয়াটা তখনই প্রথম। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে পেশার সূত্র ধরে। ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগের পর আমি ৮৯ সালে আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ-আবাস নামে দেশের প্রথম ডিজিটাল সংবাদ সংস্থা গড়ে তুলি। প্রথমে ফ্যাক্সের মাধ্যমে তথ্য পাঠাতাম। পরে ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহৃত হতে থাকে। যোগাযোগ করা হতো ইন্টারনেট ছাড়া। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল এই সংবাদমাধ্যমটি দিয়ে আমরা তখন দেশ-বিদেশে তথ্য প্রচার করি। একটি মেকিন্টোস কম্পিউটারের সঙ্গে একটি মডেম ও একটি টিঅ্যান্ডটি ফোন লাইন ব্যবহার করে আমরা তথ্য আদান প্রদান করতাম। সেই সময়েই জননেত্রী শেখ হাসিনা এক পরম দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৯৬ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আমি যুক্ত হই আওয়ামী লীগের মিডিয়া টিমের সঙ্গে। সেই টিমেই আমি প্রস্তাব করি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণাকে ডিজিটাল করা যেতে পারে। আমার প্রস্তাব জননেত্রী শেখ হাসিনা সানন্দে গ্রহণ করেন। আমার প্রতিষ্ঠান আবাসের মাধ্যমে আমরা প্রথম নির্বাচনে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করি। কাজটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। তখন আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা যদি ঢাকার বাইরে কোথাও হতো তবে তার খবর পরের দিনের পত্রিকায় ছাপা হলেও ছবি ছাপা হতো আরও একদিন পরে। তখন হয়তো সেই ছবির গুরুত্বও থাকত না। মোনায়েম সরকার তখন নির্বাচনী প্রচারণার সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। আমি তার সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমরা তখন আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সিদ্দিকুর রহমানকে একটি স্ক্যানার, একটি মেকিন্টোস ও একটি মডেম দিয়ে নেত্রীর নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সঙ্গে যুক্ত করে দিই। তখনও আমাদের কোন ল্যাপটপ ছিল না। ৯ ইঞ্চির ডেস্কটপ ব্যবহার করতে হতো। বিশাল আকারের মডেম বহন করতে হতো। শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী প্রচারণা টিমের সঙ্গে আমাদের কম্পিউটার টিমটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমাদের টিম সেখানে শেখ হাসিনার জনসভার ছবি স্ক্যান করে মডেমের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দিত। আমরা আবাসের মাধ্যমে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব পত্রিকায় ডিজিটাল ও এনালগ পদ্ধতিতে ছবি পৌঁছে দিতাম। আমদের ডিজিটাল প্রচারণায় শেখ হাসিনা শুধু সন্তোষ প্রকাশ করেননি, ৯৭ সালে এক দিন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলেন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের জন্য তার সরকার কি পদক্ষেপ নিতে পারে। আমি তখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি। ৯৬ সালে বিসিএস কম্পিউটার শোতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী জিল্লুর রহমান এসেছিলেন। আমরা তার কাছে কম্পিউটারকে শুল্কমুক্ত করাসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অন্যান্য করণীয় নিয়ে দাবি পেশ করি। জিল্লুর রহমান সাহেব আমাদের সব দাবি মেনে নেবার কথা বলেছিলেন। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কিবরিয়া সাহেবও ছিলেন। নেত্রী তাকে আগেই বসিয়ে রেখেছিলেন। আমি নেত্রীকে অনুরোধ করলাম কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়ার জন্য। তিনি আমার কথা শুনেই কিবরিয়া সাহেবের দিকে তাকালেন। কিবরিয়া সাহেব বললেন, আমাদের রাজস্ব আদায় অনেক কমে যাবে। কমবে ২২০ কোটি টাকা। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, দেখুন অর্থমন্ত্রী তার দিকটাই দেখছেন। আমি নেত্রীকে বললাম, নেত্রী আপনি রাজস্ব দেখবেন না দেশের ভবিষ্যৎ দেখবেন? আজ যদি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেন তবে দেশ সামনে যাবে-আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো করব। তিনি কিবরিয়া সাহেবকে শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়ার নির্দেশনা দেন। শেখ হাসিনার পরিবার থেকে ইতোমধ্যেই কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট তোলার প্রস্তাব আসে। সেই থেকেই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রবেশ করে এক নতুন যুগে। আজ যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠা সেটি সেদিনের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফসল।
২০০১ সাল পর্যন্ত আমার নিজের জন্য একটি অসাধারণ সময় ছিল এ জন্য যে শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের সব প্রস্তাবনাকে শুধু গুরুত্বই দিতেন না-বাস্তবায়নে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতেন। প্রথম দুই বছর আমি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি ছিলাম বলে তার অসাধারণ সমর্থনও আমি সেই সময়ে পেয়েছি। এই ছোট নিবন্ধে তার পাঁচ বছরের সময়কালের বিস্তারিত বিষয়াদি তুলে ধরা সহজ নয়। আমি শুধু তার তিনটি বড় কাজের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১) প্রথমত তিনি সেই সময়ে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেন। এই একটি কাজের জন্য বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে কম্পিউটার আসার সুযোগ তৈরি হয়। দেশের রাজস্ব আয়ের চাইতেও সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানো যে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সেটি তিনি এককভাবে অনুভব করেন। সেই সময়েই তিনি বিদেশে সফটওয়্যার রপ্তানি করার উপায় উদ্ভাবন করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন যারা ৪৫টি সুপারিশ পেশ করে এবং তিনি ২০০১ সালের আগেই সেই সুপারিশসমূহের ২৮টি বাস্তবায়ন করেন। সেই সময়েই তিনি কম্পিউটার শিক্ষার দিগন্তটি উন্মোচন করেন ও সরকারি বেসরকারি সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সিট বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
২) দ্বিতীয়ত তিনি মোবাইলের মনোপলি ভাঙেন এবং দেশের মোবাইল বিপ্লবের ভিত রচনা করেন। সেই সময়ে মুর্শেদ খানের সিটি সেল ফোনের দাম ছিল সোয়া লাখ টাকা আর আউটগোযিং কল ১৪ টাকা ও ইনকামিং কল ১২ টাকা ছিলো। ৯৭ সালে তিনি মোবাইল ফোনের ২জি প্রযুক্তি চালু করেন। ৩) তিনি সেই সময়েই অনলাইন ইন্টারনেটের বিষয়টিকেও স্থায়ী করেন।
যারা মনে করেন যে, তিনি ২০০৮ সালে আকস্মিকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন, তারা তার সেই সময়কালের কাজের কোন খবরই রাখেন না। বস্তুত আমি দেখি যে নিজের হাতে কম্পিউটার দিয়ে কাজ করা থেকেই তিনি একটি ডিজিটাল দেশের স্বপ্ন দেখেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার জন্য তার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথা বলেন। জয় শুধু ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশে প্রযুক্তি বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ। বস্তুত তার চাইতে ডিজিটাল ধারণা সম্ভবত বাংলাদেশের ডিজিটাল শিক্ষকদেরও নাই। এখনও তিনি যে অসাধারণভাবে দেশের ডিজিটাল রূপান্তরকে সামনে নিয়ে যেতে সচেষ্ট আছেন তাতে তার তুলনা তিনি একাই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]