ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের পঞ্চম এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ছিল না। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনগুলো পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকায় ছিল ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো। ইসির ভূমিকা ছিল গৌণ। এসব নির্বাচনে, বিশেষ করে দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ-হীনতা ও অনিয়মের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে। জনগণ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। বিগত সময়ে ইসি নির্বাচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার মূল কারণগুলো হলো ক. নির্বাচনে দলীয় সরকারগুলোর হস্তক্ষেপ রোধে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনায় দৃঢ়তা প্রদর্শনে দলীয় ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী ইসির ব্যর্থতা; খ. ক্ষমতায় থাকা দলের প্রতি বাস্তবে নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠ প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব।
গত পাঁচ দশকে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হয়েছে, তা পেছন ফিরে দেখার সময় এসেছে। গণতন্ত্র কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। জাতীয় নির্বাচন বলতে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনকে বোঝানো হয়েছে। সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। দায়িত্ব প্রদান করেই সংবিধান নিশ্চুপ থাকেনি। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারী (এখানে কর্মচারী বলতে কর্মকর্তাকেও বোঝাবে) প্রয়োজন হবে, কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি সেরূপ কর্মচারীর ব্যবস্থা করবেন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩য় অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিস্তারিত বিধানাবলি সংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ জারি করা হয়েছে, যা সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় সংশোধিত হয়েছে। তা ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে প্রণীত হয়েছে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, স্বতন্ত্র প্রার্থী বিধিমালা। আরও প্রণীত হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন। এ সবের উদ্দেশ্য হলো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার নির্বাচন তাদের স্ব স্ব আইন যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ আইন, উপজেলা পরিষদ আইন, জেলা পরিষদ আইন, সিটি করপোরেশন আইন এবং পৌরসভা আইনের অধীনের অনুষ্ঠিত হয়। এসব আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনা করে। এসব আইনের অধীনে প্রণীত হয়েছে নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, যার উদ্দেশ্য হলো সব ধরনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা করবে। তবে গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচনকালীন প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কমিশনের অধীনে থাকবে। কিন্তু কার্যত নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই ইসিকে শক্তিশালীকরণ ও ক্ষমতায়ন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্বাচন পরিচালনার বিষয়টিকে এখানে স্পষ্টীকরণ করা হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব ও অহংকার। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের বিরুদ্ধে তাদের গৌরব ঐতিহ্য কোনো দিন ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশে যে ১১টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় নির্বাচনেই দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করে থাকে। তা ছাড়া ১৯৭৪, ২০০২ ও ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থাকালেও কম্বাইন্ড অপারেশন সময়ও সেনাবাহিনী দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে থাকে।
সম্প্রতি চলমান নির্বাচন কমিশনের সংলাপে দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, আইন ও সংবিধানে দেয়া ক্ষমতা ইসি ব্যবহার করতে পারবে কি না, তা অনেকখানি নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আইন ও সংবিধানে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে ইসি সরকারকে সেটা করার প্রস্তাব করতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, এমনটি মনে হলে পদত্যাগ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ভবনে দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সম্প্রতি এই সংলাপের আয়োজন করে ইসি। এতে ৩৯ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১৯ জন অংশ নেন। অবশ্য এর মধ্যে দুজন দেশের বাইরে আছেন। সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, জাতীয় নির্বাচনের চার মাস আগে থেকে ফলাফলের পরের দুই মাস পর্যন্ত প্রশাসনকে ইসির নিয়ন্ত্রণে আনা, ভোটের আগে সংসদ অকার্যকর রাখা, ভোটারদের বাধাহীনভাবে ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করা, ভোটের আগে-পরে ভোটারদের বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ এসেছে। অধিকন্তু সংলাপের প্রাসঙ্গিকতায় টিআইবির উল্লেখযোগ্য কিছু সুপারিশমালাকে বিবেচনায় আনতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় সরকার যদি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এমন ইচ্ছা থাকলে সরকারকে কয়েকটি কাজ করতে হবে। সর্বপ্রথমে সবগুলো দলের সঙ্গে বসে খোলামন নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করে জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য একটি বিল উত্থাপন ও পাস করে ওই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে ডিসি, এডিসি ও প্রশাসকদের পরিবর্তে লোকবলসমৃদ্ধ নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অথবা অন্যান্য অধিদপ্তরসমূহ থেকেজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও অন্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে পরামর্শ দিতে হবে। এ ছাড়া বিতর্কিত ও ব্যয়বহুল হওয়ায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ ঠিক হবে না। এর পরিবর্তে কাগজের ব্যালটে ভোট গ্রহণ সমীচীন হবে। নতুন পাস করা আইনে নির্বাচনকালীন সরকার যেন নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সার্বিক সহায়তা প্রদান করে, সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যথার্থই ইসির দক্ষ জনবল ও লজিস্টিকের ঘাটতি রয়েছে। দক্ষ জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট ছাড়া কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
সঙ্গত কারণেই জনমনে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসায় সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় ইসি কতটা সামর্থ্যরে অধিকারী। এই সামর্থ্যরে অভাব এবং সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ঘাটতির কারণেই এ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই বিভিন্ন আলোচনা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দল নিরপেক্ষ মাঠ প্রশাসন নিশ্চিত না করে ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সফলকাম হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যমান ব্যবস্থার ওপর ভর করেই নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন ব্যবস্থাকে যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে ইসিকে শক্তিশালী করণ যেমন-দক্ষ জনবল নিয়োগ, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তাসহ মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকর করে নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে।
[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক,
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বুধবার, ১০ আগস্ট ২০২২
বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের পঞ্চম এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ছিল না। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনগুলো পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকায় ছিল ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো। ইসির ভূমিকা ছিল গৌণ। এসব নির্বাচনে, বিশেষ করে দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ-হীনতা ও অনিয়মের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে। জনগণ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। বিগত সময়ে ইসি নির্বাচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার মূল কারণগুলো হলো ক. নির্বাচনে দলীয় সরকারগুলোর হস্তক্ষেপ রোধে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনায় দৃঢ়তা প্রদর্শনে দলীয় ভাবধারা ও আদর্শে বিশ্বাসী ইসির ব্যর্থতা; খ. ক্ষমতায় থাকা দলের প্রতি বাস্তবে নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠ প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব।
গত পাঁচ দশকে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হয়েছে, তা পেছন ফিরে দেখার সময় এসেছে। গণতন্ত্র কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। জাতীয় নির্বাচন বলতে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনকে বোঝানো হয়েছে। সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। দায়িত্ব প্রদান করেই সংবিধান নিশ্চুপ থাকেনি। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারী (এখানে কর্মচারী বলতে কর্মকর্তাকেও বোঝাবে) প্রয়োজন হবে, কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি সেরূপ কর্মচারীর ব্যবস্থা করবেন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩য় অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিস্তারিত বিধানাবলি সংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ জারি করা হয়েছে, যা সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় সংশোধিত হয়েছে। তা ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে প্রণীত হয়েছে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, স্বতন্ত্র প্রার্থী বিধিমালা। আরও প্রণীত হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন। এ সবের উদ্দেশ্য হলো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার নির্বাচন তাদের স্ব স্ব আইন যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ আইন, উপজেলা পরিষদ আইন, জেলা পরিষদ আইন, সিটি করপোরেশন আইন এবং পৌরসভা আইনের অধীনের অনুষ্ঠিত হয়। এসব আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনা করে। এসব আইনের অধীনে প্রণীত হয়েছে নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, যার উদ্দেশ্য হলো সব ধরনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা করবে। তবে গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। নির্বাচনকালীন প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কমিশনের অধীনে থাকবে। কিন্তু কার্যত নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই ইসিকে শক্তিশালীকরণ ও ক্ষমতায়ন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্বাচন পরিচালনার বিষয়টিকে এখানে স্পষ্টীকরণ করা হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব ও অহংকার। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের বিরুদ্ধে তাদের গৌরব ঐতিহ্য কোনো দিন ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশে যে ১১টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় নির্বাচনেই দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করে থাকে। তা ছাড়া ১৯৭৪, ২০০২ ও ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থাকালেও কম্বাইন্ড অপারেশন সময়ও সেনাবাহিনী দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে থাকে।
সম্প্রতি চলমান নির্বাচন কমিশনের সংলাপে দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, আইন ও সংবিধানে দেয়া ক্ষমতা ইসি ব্যবহার করতে পারবে কি না, তা অনেকখানি নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আইন ও সংবিধানে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে ইসি সরকারকে সেটা করার প্রস্তাব করতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, এমনটি মনে হলে পদত্যাগ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ভবনে দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সম্প্রতি এই সংলাপের আয়োজন করে ইসি। এতে ৩৯ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১৯ জন অংশ নেন। অবশ্য এর মধ্যে দুজন দেশের বাইরে আছেন। সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, জাতীয় নির্বাচনের চার মাস আগে থেকে ফলাফলের পরের দুই মাস পর্যন্ত প্রশাসনকে ইসির নিয়ন্ত্রণে আনা, ভোটের আগে সংসদ অকার্যকর রাখা, ভোটারদের বাধাহীনভাবে ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করা, ভোটের আগে-পরে ভোটারদের বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ এসেছে। অধিকন্তু সংলাপের প্রাসঙ্গিকতায় টিআইবির উল্লেখযোগ্য কিছু সুপারিশমালাকে বিবেচনায় আনতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় সরকার যদি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এমন ইচ্ছা থাকলে সরকারকে কয়েকটি কাজ করতে হবে। সর্বপ্রথমে সবগুলো দলের সঙ্গে বসে খোলামন নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করে জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য একটি বিল উত্থাপন ও পাস করে ওই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে ডিসি, এডিসি ও প্রশাসকদের পরিবর্তে লোকবলসমৃদ্ধ নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অথবা অন্যান্য অধিদপ্তরসমূহ থেকেজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও অন্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে পরামর্শ দিতে হবে। এ ছাড়া বিতর্কিত ও ব্যয়বহুল হওয়ায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ ঠিক হবে না। এর পরিবর্তে কাগজের ব্যালটে ভোট গ্রহণ সমীচীন হবে। নতুন পাস করা আইনে নির্বাচনকালীন সরকার যেন নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সার্বিক সহায়তা প্রদান করে, সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যথার্থই ইসির দক্ষ জনবল ও লজিস্টিকের ঘাটতি রয়েছে। দক্ষ জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট ছাড়া কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
সঙ্গত কারণেই জনমনে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসায় সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় ইসি কতটা সামর্থ্যরে অধিকারী। এই সামর্থ্যরে অভাব এবং সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ঘাটতির কারণেই এ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই বিভিন্ন আলোচনা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দল নিরপেক্ষ মাঠ প্রশাসন নিশ্চিত না করে ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সফলকাম হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যমান ব্যবস্থার ওপর ভর করেই নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন ব্যবস্থাকে যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে ইসিকে শক্তিশালী করণ যেমন-দক্ষ জনবল নিয়োগ, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তাসহ মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকর করে নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে।
[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক,
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]