alt

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলা সিনেমার সুদিন কি ফিরছে

রেজাউল করিম খোকন

: শুক্রবার, ১২ আগস্ট ২০২২
image

‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’- প্রায় সমান গতিতে দুটি ছবি ঝড় তুলেছে দেশের প্রেক্ষাগৃহে

‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’- প্রায় সমান গতিতে দুটি ছবি ঝড় তুলেছে দেশের প্রেক্ষাগৃহে। করোনা, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই সিনেমা ছিল স্থবির। এতে আটকে যায় বড় বাজেটের প্রায় দেড় ডজন সিনেমা। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দর্শক আসবেন কি না, এমন শঙ্কায় সিনেমা মুক্তি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন পরিচালকরা। গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ ও ‘গলুই’ দিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় দেশীয় সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর। এরপর ঈদুল আজহায় বাংলা সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ঈদের তিন ছবি দেখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে ভিড় করতে থাকেন দর্শক। মুক্তির পর হাওয়া তৈরি করে বাংলা সিনেমার নতুন রেকর্ড। মুক্তির আগেই সিনেমাটির অগ্রিম টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বহুল আলোচিত একটি হলিউডি ছবির প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়, যা প্রযোজক ও পরিচালকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

যারা এত দিন সিনেমা মুক্তি দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তারা নড়েচড়ে বসেছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাদের ছবির মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, দ্রুত শুটিং শেষ করে সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিচ্ছেন কোন কোন পরিচালক। নতুন পরিচালকেরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড় পর্দার চ্যালেঞ্জ নিতে। ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র সাফল্যে ছোট পর্দার বেশ কয়েকজন সিনেমা তৈরির ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। একের পর এক ছবি মুক্তির ঘোষণাকে ভীষণ ইতিবাচকভাবে দেখছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। অনেকে বলছেন, বাংলা সিনেমার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে সতর্ক থাকতে হবে। পরপর ভালো ছবি না দিলে দর্শক আবার হলবিমুখ হতে পারেন।

বাংলাদেশে এবারের ঈদের মাসে মুক্তি পাওয়া তিনটি সিনেমা- ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ আর ‘দিন দ্য ডে’ নিয়ে দর্শক আগ্রহ বেড়েই চলেছে। সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হলগুলোতে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ভিড়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত হল না থাকার কারণে সিনেমাগুলো নিয়ে আগ্রহ মূলত ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ। চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, নির্মাতা ও দর্শকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ দেখা গেছে। কিন্তু পরে তা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে দেখা যায়নি। তারা মনে করছেন, এবার এক সঙ্গে তিনটি ছবি মুক্তি পাওয়াতেই দর্শকের আগ্রহটা আবার ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ তিনটি ছবিই বাংলাদেশি সিনেমার কথিত সুদিন- অর্থাৎ হলভর্তি দর্শক কিংবা টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি-এমন দৃশ্য দেখার মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে কি না, তা বলা কঠিন বলেই মনে করছেন তারা। কারণ হিসেবে এই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানসম্মত সিনেমা হলের সংখ্যাই আছে হাতেগোনা কয়েকটি।

আবার বিনিয়োগ সংকটের পাশাপাশি সিনেমার গল্প তৈরিতেও আছে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি। আলোচিত তিনটি ছবিতে বিনোদনের সব উপাদান যেমন আছে তেমনি গল্পও ভালো। আবার ছবি বানানোর মানও এখন অনেক ভালো হয়েছে, যা দর্শকদের ভালো লেগেছে। ছবিগুলোর টিকিট পেতে দর্শকদের কষ্টই হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমা নিয়ে ভয় কেটে গেছে বলা যায়। হলগুলো ভালো হলে আর সিনেমা মোটামুটি হলেও নিয়মিতই সিনেমা দেখবেন দর্শক। পরিবেশটা ভালো পেলে তো নিয়মিত হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন। প্রসঙ্গত, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ আর ‘দিন দ্য ডে’- তিনটি সিনেমাই চলচ্চিত্র রিলিজের যে প্রথাগত ধাপগুলো অর্থাৎ পোস্টার, ট্রেলার এবং পরে রিলিজ- সব ধাপেই ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সিনেমাগুলো দেখতে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়াও সিনেমা হলগুলোতে ভিড় করছে মানুষ। এমনকি অনেক বছর পর এবার এই তিনটি বাংলাদেশি সিনেমারই অগ্রিম টিকিট কিনতে দেখা গেছে দর্শকদের। ঢাকার প্রচলিত ধারার সিনেমা হলগুলোর অনলাইনে টিকিট বিক্রির সুযোগ না থাকায় ঢাকার কয়েকটি হলের কাউন্টার থেকেই অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করেছেন দর্শকরা। হল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটির মাধ্যমে তারা আবার নাইট শো চালু করেছেন, যা দর্শকের অভাবে প্রায়শই বন্ধ রাখতে হতো। ঈদে মুক্তির পর থেকেই দর্শকদের কাউন্টার বা অনলাইন থেকে কয়েক দিন পরে দেখার জন্য টিকিট কিনতে হচ্ছে।

একসঙ্গে একাধিক বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। এ তিনটি সিনেমাকে ঘিরে যা হলো- তাতে সিনেমার ভালো সময়ের লক্ষণ পরিষ্কার, কিন্তু সেটি টেকসই করার জন্য দরকার নিয়মিত ভালো সিনেমা আর দেশজুড়ে মানসম্মত সিনেমা হল। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই হঠাৎ এমন কিছু সিনেমা আসছে, যা দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু এ রকম ছবির মুক্তি পাওয়াটা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে না বলে কিছুদিন পরেই সিনেপ্লেক্সগুলোতে দেখানো ইংরেজি বা হিন্দি সিনেমাগুলোতে আবার আলোচনায় চলে আসে। এবার যে ছবিগুলো এসেছে এগুলো এফডিসি ঘরানার বাইরের সিনেমা। কিন্তু এগুলো প্রমাণ করেছে যে মোটামুটি দেখার মতো সিনেমা হলেই মানুষ হলে আসবে।

গত কয়েক বছর ধরেই হঠাৎ হঠাৎ কিছু কিছু সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছিল। কিন্তু নিয়মিতই ভালো সিনেমা সিনেমা আসছেনা। এবার একসঙ্গে তিনটি রিলিজ হয়েছে। এখন সব সিনেমাই চলবে তা নয়, তবে লক্ষণটা ভালো। কারণ, উচ্চশিক্ষিত নতুন প্রজন্মের তরুণ নির্মাতারা আসছেন। কিন্তু সিনেমার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। মাঝেমধ্যে এমন ২-৩টি সিনেমা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে না। প্রসঙ্গত, এফডিসি-কেন্দ্রিক যেসব বাংলাদেশি সিনেমা মাঝেমধ্যে মুক্তি পায় সেগুলো সাধারণ সিনেমা হলগুলোতে চললেও তাতে খুব একটা দর্শক দেখা যায় না। দেশে এখন সিনেমা হলের সংখ্যাই হাতেগোনা এবং সেগুলোর আবার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে এ তিনটি সিনেমা একটি আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি করেছে বাংলা সিনেমার জন্য। মানুষ যে মুখিয়ে আছে ভালো বাংলা সিনেমার জন্য সেটিই আবার প্রমাণ হলো।

কিন্তু সব স্তরের মানুষকে আবার হলমুখো করতে আরও অনেক কিছু করতে হবে। বাংলাদেশের এর আগে আয়নাবাজি, দেবী, ঢাকা অ্যাটাক, মনপুরা কিংবা স্বপ্নজালের মতো কিছু সিনেমা গত কয়েক বছরে বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে এগুলো আলাদা আলাদা সময়ে মুক্তি পেয়েছিল এবং এরপরের অন্য সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে দর্শকদের ততটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এসব সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকরাও নিয়মিত নতুন সিনেমা নিয়ে আসেননি। ভালো সিনেমা পেলে মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে-এটি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করবে নতুন বিনিয়োগের জন্য। তবে সিনেমার গল্প, নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি প্রমোশন বা মার্কেটিং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ- সেটিও এ তিনটি ছবি প্রমাণ করেছে। এবার ‘হাওয়া’ সিনেমার প্রমোশন হয়েছে অসাধারণ। ভালো সিনেমাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ‘হাওয়া’ ছবিটির প্রমোশন নির্মাতাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং দর্শকরাও সেটি গ্রহণ করেছে। অনেক বছর পর এবার মানুষ হলে গিয়ে সেলিব্রেট করে সিনেমা দেখছেন। কিন্তু এখন যদি সবাই মনে করে যে প্রতি মাসেই এমন সিনেমা আসবে, সেটা ঠিক হবে না।

বাংলাদেশি সিনেমার বিপরীতে মানুষ হলিউড-বলিউডের মুভি দেখে। কিন্তু নাচ-গানে তো বাধা আছেই এমনকি অনেক গল্পও এখানে সেন্সর বোর্ড অনুমোদন দেয় না। ভারতে আর্মি ও পুলিশ নিয়ে কত ধরনের সিনেমা। পুলিশের কত ধরনের চরিত্র। কিন্তু এখানে সিনেমায় পুলিশ চরিত্রের ইউনিফর্মে ব্যাজ কোন কর্মকর্তার- তা নিয়ে নির্মাতাদের হেনস্তা করা হয়। অনেক ভালো গল্প নিয়ে নির্মাতারা এগুনোর সাহস পান না এসব কারণে। আবার ভারতে তাজ হোটেলে হামলা নিয়ে সিনেমা হলেও বাংলাদেশে হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে নির্মাণ করা সিনেমা আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড। অন্যদিকে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়া দেশের সিনেমা দেখার মতো ভালো পরিবেশ আছে এমন সিনেমা হল নেই বললেই চলে। দেশজুড়ে এখন মাত্র ৫০-৬০টি প্রচলিত ধারার সিনেমা হল এখন চলমান আছে। আর সব হল ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকশূন্যতা ও অশ্লীলতার কারণে। মাঝে এমন পরিবেশ হয়েছিল যে হলের সামনে দিয়ে যেতেও অস্বস্তি হতো। আর এখন তো বন্ধই হয়ে গেছে হলগুলো। সরকার প্রতি উপজেলায় সিনেপ্লেক্স তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি হলে আর বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এলে বাংলাদেশি সিনেমা আবার যে দর্শক পাবে এবারের আলোচিত তিনটি সিনেমাই তার প্রমাণ।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বাংলা সিনেমার সুদিন কি ফিরছে

রেজাউল করিম খোকন

image

‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’- প্রায় সমান গতিতে দুটি ছবি ঝড় তুলেছে দেশের প্রেক্ষাগৃহে

শুক্রবার, ১২ আগস্ট ২০২২

‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’- প্রায় সমান গতিতে দুটি ছবি ঝড় তুলেছে দেশের প্রেক্ষাগৃহে। করোনা, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই সিনেমা ছিল স্থবির। এতে আটকে যায় বড় বাজেটের প্রায় দেড় ডজন সিনেমা। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দর্শক আসবেন কি না, এমন শঙ্কায় সিনেমা মুক্তি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন পরিচালকরা। গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ ও ‘গলুই’ দিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় দেশীয় সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর। এরপর ঈদুল আজহায় বাংলা সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ঈদের তিন ছবি দেখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে ভিড় করতে থাকেন দর্শক। মুক্তির পর হাওয়া তৈরি করে বাংলা সিনেমার নতুন রেকর্ড। মুক্তির আগেই সিনেমাটির অগ্রিম টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বহুল আলোচিত একটি হলিউডি ছবির প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়, যা প্রযোজক ও পরিচালকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

যারা এত দিন সিনেমা মুক্তি দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তারা নড়েচড়ে বসেছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাদের ছবির মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, দ্রুত শুটিং শেষ করে সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিচ্ছেন কোন কোন পরিচালক। নতুন পরিচালকেরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড় পর্দার চ্যালেঞ্জ নিতে। ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র সাফল্যে ছোট পর্দার বেশ কয়েকজন সিনেমা তৈরির ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। একের পর এক ছবি মুক্তির ঘোষণাকে ভীষণ ইতিবাচকভাবে দেখছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। অনেকে বলছেন, বাংলা সিনেমার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে সতর্ক থাকতে হবে। পরপর ভালো ছবি না দিলে দর্শক আবার হলবিমুখ হতে পারেন।

বাংলাদেশে এবারের ঈদের মাসে মুক্তি পাওয়া তিনটি সিনেমা- ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ আর ‘দিন দ্য ডে’ নিয়ে দর্শক আগ্রহ বেড়েই চলেছে। সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হলগুলোতে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ভিড়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত হল না থাকার কারণে সিনেমাগুলো নিয়ে আগ্রহ মূলত ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ। চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, নির্মাতা ও দর্শকরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ দেখা গেছে। কিন্তু পরে তা ধারাবাহিকভাবে ঘটতে দেখা যায়নি। তারা মনে করছেন, এবার এক সঙ্গে তিনটি ছবি মুক্তি পাওয়াতেই দর্শকের আগ্রহটা আবার ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ তিনটি ছবিই বাংলাদেশি সিনেমার কথিত সুদিন- অর্থাৎ হলভর্তি দর্শক কিংবা টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি-এমন দৃশ্য দেখার মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে কি না, তা বলা কঠিন বলেই মনে করছেন তারা। কারণ হিসেবে এই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানসম্মত সিনেমা হলের সংখ্যাই আছে হাতেগোনা কয়েকটি।

আবার বিনিয়োগ সংকটের পাশাপাশি সিনেমার গল্প তৈরিতেও আছে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি। আলোচিত তিনটি ছবিতে বিনোদনের সব উপাদান যেমন আছে তেমনি গল্পও ভালো। আবার ছবি বানানোর মানও এখন অনেক ভালো হয়েছে, যা দর্শকদের ভালো লেগেছে। ছবিগুলোর টিকিট পেতে দর্শকদের কষ্টই হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমা নিয়ে ভয় কেটে গেছে বলা যায়। হলগুলো ভালো হলে আর সিনেমা মোটামুটি হলেও নিয়মিতই সিনেমা দেখবেন দর্শক। পরিবেশটা ভালো পেলে তো নিয়মিত হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন। প্রসঙ্গত, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ আর ‘দিন দ্য ডে’- তিনটি সিনেমাই চলচ্চিত্র রিলিজের যে প্রথাগত ধাপগুলো অর্থাৎ পোস্টার, ট্রেলার এবং পরে রিলিজ- সব ধাপেই ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সিনেমাগুলো দেখতে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়াও সিনেমা হলগুলোতে ভিড় করছে মানুষ। এমনকি অনেক বছর পর এবার এই তিনটি বাংলাদেশি সিনেমারই অগ্রিম টিকিট কিনতে দেখা গেছে দর্শকদের। ঢাকার প্রচলিত ধারার সিনেমা হলগুলোর অনলাইনে টিকিট বিক্রির সুযোগ না থাকায় ঢাকার কয়েকটি হলের কাউন্টার থেকেই অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করেছেন দর্শকরা। হল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটির মাধ্যমে তারা আবার নাইট শো চালু করেছেন, যা দর্শকের অভাবে প্রায়শই বন্ধ রাখতে হতো। ঈদে মুক্তির পর থেকেই দর্শকদের কাউন্টার বা অনলাইন থেকে কয়েক দিন পরে দেখার জন্য টিকিট কিনতে হচ্ছে।

একসঙ্গে একাধিক বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্রহ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। এ তিনটি সিনেমাকে ঘিরে যা হলো- তাতে সিনেমার ভালো সময়ের লক্ষণ পরিষ্কার, কিন্তু সেটি টেকসই করার জন্য দরকার নিয়মিত ভালো সিনেমা আর দেশজুড়ে মানসম্মত সিনেমা হল। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই হঠাৎ এমন কিছু সিনেমা আসছে, যা দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু এ রকম ছবির মুক্তি পাওয়াটা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে না বলে কিছুদিন পরেই সিনেপ্লেক্সগুলোতে দেখানো ইংরেজি বা হিন্দি সিনেমাগুলোতে আবার আলোচনায় চলে আসে। এবার যে ছবিগুলো এসেছে এগুলো এফডিসি ঘরানার বাইরের সিনেমা। কিন্তু এগুলো প্রমাণ করেছে যে মোটামুটি দেখার মতো সিনেমা হলেই মানুষ হলে আসবে।

গত কয়েক বছর ধরেই হঠাৎ হঠাৎ কিছু কিছু সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছিল। কিন্তু নিয়মিতই ভালো সিনেমা সিনেমা আসছেনা। এবার একসঙ্গে তিনটি রিলিজ হয়েছে। এখন সব সিনেমাই চলবে তা নয়, তবে লক্ষণটা ভালো। কারণ, উচ্চশিক্ষিত নতুন প্রজন্মের তরুণ নির্মাতারা আসছেন। কিন্তু সিনেমার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। মাঝেমধ্যে এমন ২-৩টি সিনেমা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে না। প্রসঙ্গত, এফডিসি-কেন্দ্রিক যেসব বাংলাদেশি সিনেমা মাঝেমধ্যে মুক্তি পায় সেগুলো সাধারণ সিনেমা হলগুলোতে চললেও তাতে খুব একটা দর্শক দেখা যায় না। দেশে এখন সিনেমা হলের সংখ্যাই হাতেগোনা এবং সেগুলোর আবার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে এ তিনটি সিনেমা একটি আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি করেছে বাংলা সিনেমার জন্য। মানুষ যে মুখিয়ে আছে ভালো বাংলা সিনেমার জন্য সেটিই আবার প্রমাণ হলো।

কিন্তু সব স্তরের মানুষকে আবার হলমুখো করতে আরও অনেক কিছু করতে হবে। বাংলাদেশের এর আগে আয়নাবাজি, দেবী, ঢাকা অ্যাটাক, মনপুরা কিংবা স্বপ্নজালের মতো কিছু সিনেমা গত কয়েক বছরে বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে এগুলো আলাদা আলাদা সময়ে মুক্তি পেয়েছিল এবং এরপরের অন্য সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রে দর্শকদের ততটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এসব সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকরাও নিয়মিত নতুন সিনেমা নিয়ে আসেননি। ভালো সিনেমা পেলে মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে-এটি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করবে নতুন বিনিয়োগের জন্য। তবে সিনেমার গল্প, নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি প্রমোশন বা মার্কেটিং যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ- সেটিও এ তিনটি ছবি প্রমাণ করেছে। এবার ‘হাওয়া’ সিনেমার প্রমোশন হয়েছে অসাধারণ। ভালো সিনেমাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ‘হাওয়া’ ছবিটির প্রমোশন নির্মাতাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং দর্শকরাও সেটি গ্রহণ করেছে। অনেক বছর পর এবার মানুষ হলে গিয়ে সেলিব্রেট করে সিনেমা দেখছেন। কিন্তু এখন যদি সবাই মনে করে যে প্রতি মাসেই এমন সিনেমা আসবে, সেটা ঠিক হবে না।

বাংলাদেশি সিনেমার বিপরীতে মানুষ হলিউড-বলিউডের মুভি দেখে। কিন্তু নাচ-গানে তো বাধা আছেই এমনকি অনেক গল্পও এখানে সেন্সর বোর্ড অনুমোদন দেয় না। ভারতে আর্মি ও পুলিশ নিয়ে কত ধরনের সিনেমা। পুলিশের কত ধরনের চরিত্র। কিন্তু এখানে সিনেমায় পুলিশ চরিত্রের ইউনিফর্মে ব্যাজ কোন কর্মকর্তার- তা নিয়ে নির্মাতাদের হেনস্তা করা হয়। অনেক ভালো গল্প নিয়ে নির্মাতারা এগুনোর সাহস পান না এসব কারণে। আবার ভারতে তাজ হোটেলে হামলা নিয়ে সিনেমা হলেও বাংলাদেশে হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে নির্মাণ করা সিনেমা আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড। অন্যদিকে সিনেপ্লেক্স ও মাল্টিপ্লেক্স ছাড়া দেশের সিনেমা দেখার মতো ভালো পরিবেশ আছে এমন সিনেমা হল নেই বললেই চলে। দেশজুড়ে এখন মাত্র ৫০-৬০টি প্রচলিত ধারার সিনেমা হল এখন চলমান আছে। আর সব হল ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকশূন্যতা ও অশ্লীলতার কারণে। মাঝে এমন পরিবেশ হয়েছিল যে হলের সামনে দিয়ে যেতেও অস্বস্তি হতো। আর এখন তো বন্ধই হয়ে গেছে হলগুলো। সরকার প্রতি উপজেলায় সিনেপ্লেক্স তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি হলে আর বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এলে বাংলাদেশি সিনেমা আবার যে দর্শক পাবে এবারের আলোচিত তিনটি সিনেমাই তার প্রমাণ।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top