এস এম জাহাঙ্গীর আলম
অতীতে উদ্যোগ নেয়ার পরও কোন সরকারই কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার কাজটা এগিয়ে নেয় নাই। খসড়া নীতির ওপর পর্যালোচনা পর্ষদ করা হয়েছে কয়েকবার। এবং পরিষদের দেয়া সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সরকার কয়লা নীতি আবার পর্যালোচনা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। খসড়া নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলেটেশন সেন্টারকে (আইআইএফসি)। ২০০৬ সালে সংস্থাটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে খসড়া কয়লা নীতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। খসড়া নীতিতে ঢালাও রপ্তানি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রপ্তানি সীমিত করা হয়। একই সঙ্গে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের আগের ৬ শতাংশের (রয়্যালিটির) হার পরিবর্তন করে কয়লার আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়। এর ফলে জায়গা বিশেষে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের হার প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।
২০০৬ সালে ফুলবাড়ী কয়লা খনি এবং এশিয়া এনার্জিকে ঘিরে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের দুই শিক্ষকের কাছে খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। তারা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে খসড়াটি আবার পর্যালোচনার জন্য একটা পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব দেন। এরই মধ্যে জোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সামরিক বাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৭ সালে বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটা পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করে। ওই পর্ষদ পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দেয় ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি। প্রতিবেদনে বিতর্কিত খনন পদ্ধতি ও সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ সম্পর্কে সরাসরি কোন মতামত দেয়া হয়নি।
এ প্রতিবেদনের আলোকে খসড়া নীতি উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হলেও কয়লা নীতির অনুমোদন দেয়নি পর্ষদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টা নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়। মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগে কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু গত দেড় বছরে এ ব্যাপারে কোন কাজই দেখা যায় নাই। জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনকে প্রধান করে একটা পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করা হয়। বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা ‘কয়লা নীতি-২০০৮’ পর্যালোচনা করে নীতিটা চূড়ান্ত করবে এ পর্ষদ। এখনো পর্যন্ত কয়লা নীতি আগের অবস্থাতেই আছে। ফলে কবে নাগাদ এ কয়লা নীতি চূড়ান্ত হবে, সেটা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ তৈরি করা খসড়া কয়লা নীতিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে ‘কোল বাংলা’ নামে একটা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা কয়লা ওঠানোর সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কয়লা উন্নয়ন তহবিল নামে একটা স্থায় তহবিল গঠনের কথাও বলা হয়েছে এতে। এ খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন হলে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যৌথ মূলধনি উদ্যোগ নেয়া যাবে। এতে পরীক্ষামূলকভাবে খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিধান রাখা হয়েছে এবং বলা হয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তর দিকে পরীক্ষামূলকভাবে একটা খোলামুখের কয়লার খনি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সন্তোষজনকভাবে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে খোলামুখ খনন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা ওঠানো যাবে।
খসড়া নীতিতে কয়লা রপ্তানির কোন সুযোগ রাখা হয়নি। তবে উন্নতমানের ‘কোকিং কয়লা’ থেকে কোক তৈরি করে তা রপ্তানি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ, দেশে এ কয়লা ব্যবহারের সুযোগ নেই। এতে বলা হয়েছে, কয়লা খনির সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার তার প্রাপ্য লভ্যাংশের হার নির্ধারণ করবে। সরকার কয়লা খনি ভেদেই এ প্রাপ্য লভ্যাংশ নির্ধারণ করবে। তবে ‘কোল বাংলা’ কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করলে এবং সরকারি মালিকানা বা যৌথ মালিকানায় কয়লা তোলা হলে সেটা সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের পরিবর্তে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে। খনি উন্নয়নকারীকে খনি মুখে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সার উৎপাদন ও সিএনজি ছাড়া সব ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে গ্যাসের পরিবর্তে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ কয়লা নীতিতে খনি এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে দেশে জ্বালানির চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান ক্রমে বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এ ব্যবধান ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে।
পর্যাপ্ত জ্বালানি না পেয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না অনেক শিল্পকারখানা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানির সংস্থান না হওয়ায় বাড়ছে আমদানিনির্ভরতাও। অন্যদিকে দেশেই কয়লার পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও উত্তোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। কী প্রক্রিয়ায় উৎপাদন হবে, উৎপাদনের ফলে খনি এলাকার মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না- এমন নানা বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে দোটানা। দেশে জ্বালানির উৎস না থাকলে অবশ্যই আমদানি করে জোগান স্বাভাবিক রাখতে হবে। কিন্তু দেশীয় উৎস থাকলে সেখান থেকে উত্তোলনের ব্যবস্থা করা উচিত। নিজস্ব উৎসের অনুসন্ধান না করে কেবল আমদানির মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে দেশের পাঁচটি কয়লাখনিতে সাত হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ রয়েছে। দেশে যে কয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে কিংবা নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলো দীর্ঘ সময় মজুদকৃত কয়লা দিয়েই চালানো যাবে। অথচ এসব কয়লা উত্তোলনে সরকারের তেমন আগ্রহ নেই। এখন পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য কোন খনি থেকে কয়লা তোলেনি সরকার। ২০০৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। যদিও তা দিয়ে খনির পাশেই স্থাপিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বলছে, ছয় মাস আগেও যে কয়লার টন দেড়শ ডলার ছিল, সেটা এখন ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি টন ১৩০ ডলারে বিক্রি করছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কম্পানি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারত বিপুল কয়লা সংগ্রহ করছে। তাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরবরাহকারীরা হিমশিম খাচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি টের পাচ্ছে জ্বালানিতে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর দেশগুলো। এদিকে সরকারের কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত একটি উৎপাদনে যেতে পেরেছে। সেটি হলো পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখানকার সব কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। দেশের খনির কোন কয়লা কাজে লাগছে না। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে কয়লা আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার।
দেশে আবিষ্কৃত খনিগুলোর একটি হলো দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত। সেখানে প্রায় ৩৯ কোটি টন কয়লা মজুদ রয়েছে। তবে উত্তোলন করা যাবে ১৭ কোটি টন। সরকার সর্বশেষ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনর্সোটিয়ামের সঙ্গে চতুর্থ চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৬ বছরে এ খনি থেকে ৪৫ লাখ টন কয়লা উত্তোলন হবে। তবে আগামী ৩০ বছরে অন্তত ১৭ কোটি টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালের দীঘিপাড়া কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। সেই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। ১৯৯৭ সালের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লা খনি আবিষ্কার করা হয়। এ খনিতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলা যাচাই করে দেখেছে, আগামী ৩০ বছরে এ খনি থেকে ৩০ বছরে ৯০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। সেখানে প্রায় ৬৮ কোটি টন কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে।
এ ছাড়া জামালগঞ্জের একটি কয়লাখনিতে ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১০৫ কোটি টন কয়লার মজুদ রয়েছে। এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে এখনো সরকার ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বিষয়ে ভাবছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সেন্ট্রাল বেসিন থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য একটি জরিপ করা হয়েছে। সে জরিপ অনুযায়ী শুধু বড়পুকুরিয়া থেকেই বছরে প্রায় ১০ টন করে ৩০ বছর ১৭০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একটি স্টাডি করে যে তথ্য পেয়েছে তাদের মজুদ ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা থেকে বাৎসরিক তিন মিলিয়ন টন হারে প্রায় ৩০ বছরে ৯০ টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া জামালগঞ্জ কয়লাখনি থেকে প্রায় ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন এবং খালাসপীর কয়লা ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব।
দেশের খনিতে মজুদ থাকার পরও কেন কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হবে সেটা একটা প্রশ্ন। শুধু কয়লা নয়, অন্যান্য জ্বালানি আমদানি করতে আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। এলএনজি, জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে আগ্রহ লক্ষণীয়। যে কারণে দেশের খনিজসম্পদ উত্তোলন ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় চরম অবহেলা দৃশ্যমান। আমদানিতে হয়তো কোন লাভ আছে। তবে আমদানিনির্ভরতা বেশি দিন চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জ্বালানি সংকটে কোন এক দিন হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে দেশ।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]
এস এম জাহাঙ্গীর আলম
শনিবার, ১৩ আগস্ট ২০২২
অতীতে উদ্যোগ নেয়ার পরও কোন সরকারই কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার কাজটা এগিয়ে নেয় নাই। খসড়া নীতির ওপর পর্যালোচনা পর্ষদ করা হয়েছে কয়েকবার। এবং পরিষদের দেয়া সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সরকার কয়লা নীতি আবার পর্যালোচনা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। খসড়া নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলেটেশন সেন্টারকে (আইআইএফসি)। ২০০৬ সালে সংস্থাটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে খসড়া কয়লা নীতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। খসড়া নীতিতে ঢালাও রপ্তানি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রপ্তানি সীমিত করা হয়। একই সঙ্গে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের আগের ৬ শতাংশের (রয়্যালিটির) হার পরিবর্তন করে কয়লার আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়। এর ফলে জায়গা বিশেষে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের হার প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।
২০০৬ সালে ফুলবাড়ী কয়লা খনি এবং এশিয়া এনার্জিকে ঘিরে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের দুই শিক্ষকের কাছে খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। তারা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে খসড়াটি আবার পর্যালোচনার জন্য একটা পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব দেন। এরই মধ্যে জোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সামরিক বাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৭ সালে বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটা পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করে। ওই পর্ষদ পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দেয় ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি। প্রতিবেদনে বিতর্কিত খনন পদ্ধতি ও সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ সম্পর্কে সরাসরি কোন মতামত দেয়া হয়নি।
এ প্রতিবেদনের আলোকে খসড়া নীতি উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হলেও কয়লা নীতির অনুমোদন দেয়নি পর্ষদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টা নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়। মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগে কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু গত দেড় বছরে এ ব্যাপারে কোন কাজই দেখা যায় নাই। জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনকে প্রধান করে একটা পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করা হয়। বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা ‘কয়লা নীতি-২০০৮’ পর্যালোচনা করে নীতিটা চূড়ান্ত করবে এ পর্ষদ। এখনো পর্যন্ত কয়লা নীতি আগের অবস্থাতেই আছে। ফলে কবে নাগাদ এ কয়লা নীতি চূড়ান্ত হবে, সেটা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ তৈরি করা খসড়া কয়লা নীতিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে ‘কোল বাংলা’ নামে একটা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা কয়লা ওঠানোর সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কয়লা উন্নয়ন তহবিল নামে একটা স্থায় তহবিল গঠনের কথাও বলা হয়েছে এতে। এ খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন হলে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যৌথ মূলধনি উদ্যোগ নেয়া যাবে। এতে পরীক্ষামূলকভাবে খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিধান রাখা হয়েছে এবং বলা হয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তর দিকে পরীক্ষামূলকভাবে একটা খোলামুখের কয়লার খনি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সন্তোষজনকভাবে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে খোলামুখ খনন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা ওঠানো যাবে।
খসড়া নীতিতে কয়লা রপ্তানির কোন সুযোগ রাখা হয়নি। তবে উন্নতমানের ‘কোকিং কয়লা’ থেকে কোক তৈরি করে তা রপ্তানি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ, দেশে এ কয়লা ব্যবহারের সুযোগ নেই। এতে বলা হয়েছে, কয়লা খনির সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার তার প্রাপ্য লভ্যাংশের হার নির্ধারণ করবে। সরকার কয়লা খনি ভেদেই এ প্রাপ্য লভ্যাংশ নির্ধারণ করবে। তবে ‘কোল বাংলা’ কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করলে এবং সরকারি মালিকানা বা যৌথ মালিকানায় কয়লা তোলা হলে সেটা সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের পরিবর্তে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে। খনি উন্নয়নকারীকে খনি মুখে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সার উৎপাদন ও সিএনজি ছাড়া সব ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে গ্যাসের পরিবর্তে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ কয়লা নীতিতে খনি এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে দেশে জ্বালানির চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান ক্রমে বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এ ব্যবধান ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে।
পর্যাপ্ত জ্বালানি না পেয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না অনেক শিল্পকারখানা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানির সংস্থান না হওয়ায় বাড়ছে আমদানিনির্ভরতাও। অন্যদিকে দেশেই কয়লার পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও উত্তোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। কী প্রক্রিয়ায় উৎপাদন হবে, উৎপাদনের ফলে খনি এলাকার মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না- এমন নানা বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে দোটানা। দেশে জ্বালানির উৎস না থাকলে অবশ্যই আমদানি করে জোগান স্বাভাবিক রাখতে হবে। কিন্তু দেশীয় উৎস থাকলে সেখান থেকে উত্তোলনের ব্যবস্থা করা উচিত। নিজস্ব উৎসের অনুসন্ধান না করে কেবল আমদানির মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে দেশের পাঁচটি কয়লাখনিতে সাত হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ রয়েছে। দেশে যে কয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে কিংবা নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলো দীর্ঘ সময় মজুদকৃত কয়লা দিয়েই চালানো যাবে। অথচ এসব কয়লা উত্তোলনে সরকারের তেমন আগ্রহ নেই। এখন পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য কোন খনি থেকে কয়লা তোলেনি সরকার। ২০০৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। যদিও তা দিয়ে খনির পাশেই স্থাপিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বলছে, ছয় মাস আগেও যে কয়লার টন দেড়শ ডলার ছিল, সেটা এখন ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি টন ১৩০ ডলারে বিক্রি করছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কম্পানি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারত বিপুল কয়লা সংগ্রহ করছে। তাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরবরাহকারীরা হিমশিম খাচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি টের পাচ্ছে জ্বালানিতে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর দেশগুলো। এদিকে সরকারের কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত একটি উৎপাদনে যেতে পেরেছে। সেটি হলো পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখানকার সব কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। দেশের খনির কোন কয়লা কাজে লাগছে না। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে কয়লা আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার।
দেশে আবিষ্কৃত খনিগুলোর একটি হলো দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত। সেখানে প্রায় ৩৯ কোটি টন কয়লা মজুদ রয়েছে। তবে উত্তোলন করা যাবে ১৭ কোটি টন। সরকার সর্বশেষ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনর্সোটিয়ামের সঙ্গে চতুর্থ চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৬ বছরে এ খনি থেকে ৪৫ লাখ টন কয়লা উত্তোলন হবে। তবে আগামী ৩০ বছরে অন্তত ১৭ কোটি টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালের দীঘিপাড়া কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। সেই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। ১৯৯৭ সালের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লা খনি আবিষ্কার করা হয়। এ খনিতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলা যাচাই করে দেখেছে, আগামী ৩০ বছরে এ খনি থেকে ৩০ বছরে ৯০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। সেখানে প্রায় ৬৮ কোটি টন কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে।
এ ছাড়া জামালগঞ্জের একটি কয়লাখনিতে ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১০৫ কোটি টন কয়লার মজুদ রয়েছে। এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে এখনো সরকার ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বিষয়ে ভাবছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সেন্ট্রাল বেসিন থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য একটি জরিপ করা হয়েছে। সে জরিপ অনুযায়ী শুধু বড়পুকুরিয়া থেকেই বছরে প্রায় ১০ টন করে ৩০ বছর ১৭০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একটি স্টাডি করে যে তথ্য পেয়েছে তাদের মজুদ ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা থেকে বাৎসরিক তিন মিলিয়ন টন হারে প্রায় ৩০ বছরে ৯০ টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া জামালগঞ্জ কয়লাখনি থেকে প্রায় ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন এবং খালাসপীর কয়লা ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব।
দেশের খনিতে মজুদ থাকার পরও কেন কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হবে সেটা একটা প্রশ্ন। শুধু কয়লা নয়, অন্যান্য জ্বালানি আমদানি করতে আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। এলএনজি, জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে আগ্রহ লক্ষণীয়। যে কারণে দেশের খনিজসম্পদ উত্তোলন ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় চরম অবহেলা দৃশ্যমান। আমদানিতে হয়তো কোন লাভ আছে। তবে আমদানিনির্ভরতা বেশি দিন চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জ্বালানি সংকটে কোন এক দিন হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে দেশ।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.]