alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রকৃতিবান্ধব ঢাকা ও শরতের অরুণ আলো

শেখর ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
image

শরতের প্রধান অনুষঙ্গ হলো কাশফুল

শরৎ আসার পদধ্বনি শুনলে মনে হয় নগর জীবনে প্রতিটি মানুষ কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। স্মৃতি-কাতরতা কেনো? শরতের যতো অনুষঙ্গ সব কিছু জমা থাকে মানুষের অবচেতন মনে, নগর জীবনে ঋতু হিসাবে শরৎ দৃশ্যমান হয়না তেমন, তবে উৎসব হিসাবে নাগরিকেরা শরতকে আবাহন করেন, আগমনী বার্তাকে উদযাপন করেন। আকাশ ছোঁয়া দালানের এই নগরের ফাঁকফোকর গলে কতটা আর পাওয়া যায় শরৎ, কতোটুকুই বা অনুভব করা যায় শরতের স্বচ্ছ প্রকৃতিকে। নগরে অদৃশ্য শরৎ, হৃদয়ের কোঠর থেকে বের হয়ে তাই শরৎ কালে নাগরিকদের মনে দোলা দিয়ে প্রকৃতির কাছে টেনে নিয়ে যায়।

শরতকে উপভোগ করা তো দূরের কথা, শরৎ কালের অপরূপ রূপ কিংবা শরতের আকাশকে কী কিছুটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারেন ঢাকার নাগরিকেরা। দুই দালানের মধ্য দিয়ে অনেক কসরত করে আকাশ ধরা দিলেও, আকাশকে দেখার কী সময় আছে? আকাশ দেখার কথা মনে আসলেই মনে হয়, মস্ত উঠানে শীতল পাটি বিছিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঝকঝকে জ্যোৎস্না রাতে, নক্ষত্র ভরা আকাশকে বিস্ময় মাখানো চোখ দিয়ে অবলোকন। আহা সে সময় হারিয়ে গেছে। গ্রাম বাংলার জীবনেও প্রকৃতি এখন সীমিত হয়ে আসছে। প্রকৃতিকে দখল করছে নানা রকম ছোটো বড় অবকাঠামো। শরতের ঝকে ঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় বুঁদ হওয়ার মতো বিলাসীতা বাংলাদেশের গ্রামের মানুষদেরও সীমিত হয়ে আসছে। নগর জীবনে মানুষ শরতের আকাশকে যদিও সেভাবে দেখতে পারেনা, তবে শরতের মাধুর্যকে কোন ভাবেই হারাতে চায়না। চায়না বলেই নগরের নানা প্রান্তে, স্নিগ্ধ সকালে নগরের মানুষ শরৎ উৎসবে সমবেত হয়।

শরত এলে মনে ও প্রকৃতিতে আসে এক জ্যোতির্ময় রূপ। বর্ষার জলে ভিজে স্বচ্ছ্ব হওয়া প্রকৃতি, বড় আপন হয়ে ধরা দেয় শরৎ কালে। জ্যোতির্ময় শরৎ। আকাশে মেঘের ভেলা। সুনীল রূপকান্তি, আলো ছায়ার লুকোচুরি। ঋতু পরিবর্তনের মায়াময় পথে নিয়ত উদ্ভাসিত রূপ, রং ও সুরের খেলা। এ খেলা হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। এরকম দোলা আছে বলেই মানুষ এখনও কবিতা পড়ে। গান শুনে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে অবগাহন করতে চায়। এরকম মন যতোদিন জীবিত থাকে মানুষের মধ্যে সুর থাকে, অসুরেরা কাছে আসতে পারে না।

শরতকে নববধূর সঙ্গে তুলনা করে কবি কালিদাস বলেছিলেন, প্রিয়তম আমার, ওই চেয়ে দেখো, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত। শরতকে কেনো নববধূ বলেছিলেন কালিদাস? এর কারন সম্ভবত বর্ষাবসানে শরত আসে। শরত তাই বড় স্নিগ্ধ, কোমল, শ্বেত, শুভ্র ঋতু । শরৎ আসে বাঙালি হৃদয় স্বচ্ছ করতে। শরতের অনুষঙ্গ গুলো মানুষকে উদার, ভাবালু করে তুলে। সূর্যের ঝলমলে আলোয় ভরে যায় চারদিক, কাশফুলে ভরে যায় বাংলার প্রকৃতি, দুর্বাঘাস ভিজে যায় হালকা শিশিরে, আকাশে শিমুল তুলোর মতো ভেসে চলে সাদা মেঘ, বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে লাল ও সাদা শাপলা, আমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় ভোরের হিমেল হাওয়া। স্বচ্ছ্ব নীল আকাশ, ফুলের পাপড়িতে দোল দিয়ে যায় মৃদু বাতাস, চারদিকে কাশফুল আর কাশফুল, মাটিতে যেন মিশে যায় তার গন্ধ, শুরু হয় গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা। চারদিকে মুগ্ধতা ছড়িয়ে শরৎ আসে বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের হৃদয়ের কোনে কোনে।

শরতের প্রধান অনুষঙ্গ হলো কাশফুল। নাগরিক সমাজের মানুষের কাছে কাশ ফুল বললেই সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির কাশ ফুলের বাগানের কথা মনে হয়। আহা কী অপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতি, শরৎ ও কাশ ফুলকে বিভূতিভূষণের উপন্যাসে আমরা পাই কল্পনায় আর সত্যজিতের পথের পাচালিতে পাই নয়ন মনোহর একটি দৃশ্য হিসাবে। চিরায়ত বাংলার অপরূপ আনন্দ-বেদনার আখ্যানে যে উপন্যাস রচনা করেন বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ সেলুলয়েডের মাধ্যমে তাকে নান্দনিক সুষমায় উদ্ভাসিত করেন। সে সুষমার একটি অনিন্দ্য সুন্দর অংশ ছিল- কাশ বাগানের মধ্য দিয়ে দুটি নিস্পাপ শিশুর ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ দৃশ্যটি সত্যজিৎ সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অক্ষয়, অমর করে রেখেছেন। দৃশ্যটির পটভূমি ছিলো এরকম, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় অপু, দুর্গা ভাই, বোন দূরাগত ট্রেনের বাঁশি শুনতে পেয়ে আনন্দে আকুল হয়ে ওঠে। একদিন তারা বাডড়তে না বলে অনেক দূরে চলে আসে ট্রেন দেখবে বলে। কাশের বনের ভেতর দিয়ে ট্রেন দেখার জন্য অপু-দুর্গা ছোটে চলে। এই কাশ বাগানের মধ্য দিয়ে তাদের ছোটে চলা আবাহমান বাংলার শরতের এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ। যারা সত্যজিতের পথের পাঁচালি দেখেছেন তাদের সবার জন্যই চলচ্চিত্রের এই অংশটি হৃদয়ে চিরদিনের জন্য গেঁথে আছে।

বাঙালির চোখ ও মনের সামনে শরতের অপার সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেছেন, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি’। কী অসাধারণ শরৎ বন্দনা। রবীন্দ্রনাথের আগে এতো চমৎকার করে শরতের সৌন্দর্যকে আবিস্কার করতে পারেননি কেউ। শরতের অনিন্দ্য-সুন্দর রূপ রবীন্দ্রনাথ যেনো ছবি এঁকে মোহনীয় করে গেছেন তাঁর কবিতা এবং গানের কলিতে। বাঙালি শরতকে অনুভব করে রবি ঠাকুরের চোখে, এ অনুভব প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে পুলক সৃষ্টি করে।

শরতে ঢাকার নাগরিকেরা অন্তরের টানে বেরিয়ে পড়েন। শৈশব জীবনকে খুঁজে বেড়ান, শরতের প্রকৃতি অবলোকনের মাধ্যমে। ঢাকার নাগরিকেরা প্রকৃতি বিমুখ নন, শরৎ আসলে সপ্তাহান্তে শহরতলী এবং শহরের কিছু অংশে ছোটে যান, ইট কাঠের এই শহর থেকে তারা মুক্তি চান। মানুষ প্রকৃতির দেখা পায়না নগরে তবে প্রকৃতির আহব্বান অনুভব করে হৃদয়ে। সপ্তাহান্তে তাই অগণিত নাগরিক ছোটে উত্তরার দিয়া বাড়ি, কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গার তীরে, আর ঢাকা থেকে বসুন্ধরা অভিমুখী রাস্তার দু’পাশে অজগ্র কাশের বাগানে। কাশের বাগানে ঢেউ ওঠে। শুভ্রতার ঢেউ, সঙ্গে নীল আকাশ এসে যুক্ত হয়।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে মানুষের ঢল নামে। একই রকম ঢল নামে বসুন্ধরা অভিমুখী পথে এবং বুড়ি গঙ্গার তীরে। দিয়াবাড়িতে দেখেছি নানা বয়সী মানূষের ঢল। সবাই আসেন তুরাগ নদীর তীরে শরতের শুভ্রতাকে উপভোগ করতে। এই শুভ্রতাকে তারা অনুভব করেন নদীর তীরের কাশ বাগাণের ভিতরে হারিয়ে গিয়ে।

দিয়াবাড়িতে দু’চোখে যেদিকে যায় সে দিকেই শুভ্র কাশফুল, বাতাসে কেপে কেপে ওঠে। মনে হয় শ্বেত শুভ্র কোন নদীর ঢেউ। ইটকাঠের এই নগরীর বুকে এমন কাশফুলের দেখা পেয়ে মানুষেরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেন! রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পের অংশ এই দিয়াবাড়ি। উত্তরার এই প্রকল্পে বালুমাটি ফেলে সমতল করায় বিশাল মাঠের মতো খোলা জায়গাটি এখন শরতের শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যায়। কাশবনের ভেতর দিয়ে পথ। নগরের যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে একটু প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা নগরবাসীর কাছে অন্যরকম ভালো লাগার জায়গা হয়ে উঠেছে দিয়াবাড়ি। বিকেলে পুরো এলাকা গ্রামীণ মেলায় রূপ নেয়। এক দিকে ঘুরছে নাগরদোলা। অন্য দিকে রকমারি খাবারের পসরা। বটতলা থেকে কিছুটা সামনে একটি সেতু। সেতুর দুই পাশে লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে বোট হাউজ। বাঁশ ও কাঠের কাঠামো দিয়ে বানানো হয়েছে বসার জায়গা। দুপুরের খরতাপ কমতেই লোকসমাগমে জমজমাট হয়ে ওঠে দিয়াবাড়ির কাশ বাগানে।

থোকা-থোকা শিউলী নেই ঢাকাতে, শিশিরে পা ভিজেনা ভরা শীতের রাতে শরৎ কালে শিশির কল্পনাও করা যায়না, ভোরবেলা হিমেল হাওয়া নেই , গাছ নেই , পাখি নেই, ফুল নেই। বাতাসে বিষের কনা ঘোরে। ঢাকার আশপাশের ধান ক্ষেত গুলোতে ডেভলপরদের লোভী চোখ। ঢাকার বাতাসের,মান ক্রমাগত অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠেছে। ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। একটি দেশের রাজধানী হলো তার বাইরের মোড়ক। ভিনদেশী মানূষদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ঢাকা থেকে কাজকর্ম সেরে নিজ দেশে ফিরে যান। তারা যদি প্রকৃতি বিমুখ, গাছপালাহীন এরকম একটি শহর দেখে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে ফিরে যান তাহলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।

প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে নগর পরিকল্পনাবিদরা কী ঢাকার জন্য নতুন কোন পরিকল্পনা করতে পারেননা? মিন্টুরোড, রমনা পার্ক, হাইকোর্টের রাস্তার দুপাশে কিন্তু এখনও কিছু গাছ অবশিষ্ট আছে। আমাদের এই ঋতু বৈচিত্র্যের দেশে প্রতিটি ঋতু দৃশ্যমান হোক তা সকলেরই কামনা। মানুষ উপভোগ করুক শরতের রূপ-মাধুর্য আগের মতো। মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসুক, প্রকৃতিও মানুষকে ভালোবাসবে। সমগ্র ঢাকা সবুজ হয়ে উঠুক। কী রকম সবুজ? ফুট ওভারব্রিজে মৃত প্রায় গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করার প্রয়োজন নেই। ঢাকার সকল নদী, খাল, নিচু জায়গা, রাস্তার দুপাশে সবুজের বেষ্টনী চাই। আমরা যদি তাই করতে পারি তাহলে ঢাকায় আবার শরৎ ফিরে আসবে। ফিরে আসবে সকল ঋতু। মানুষ শরতের রূপ মাধুর্য খুঁজতে আর ঢাকার বাইরে যাবে না। ঢাকার আকাশ, বাতাস, বৃক্ষ, লতা-পাতা শরতকে আবাহন করুক, এরকম একটি প্রকৃতিবান্ধব ঢাকা নগর দেখতে চাই।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রকৃতিবান্ধব ঢাকা ও শরতের অরুণ আলো

শেখর ভট্টাচার্য

image

শরতের প্রধান অনুষঙ্গ হলো কাশফুল

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

শরৎ আসার পদধ্বনি শুনলে মনে হয় নগর জীবনে প্রতিটি মানুষ কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। স্মৃতি-কাতরতা কেনো? শরতের যতো অনুষঙ্গ সব কিছু জমা থাকে মানুষের অবচেতন মনে, নগর জীবনে ঋতু হিসাবে শরৎ দৃশ্যমান হয়না তেমন, তবে উৎসব হিসাবে নাগরিকেরা শরতকে আবাহন করেন, আগমনী বার্তাকে উদযাপন করেন। আকাশ ছোঁয়া দালানের এই নগরের ফাঁকফোকর গলে কতটা আর পাওয়া যায় শরৎ, কতোটুকুই বা অনুভব করা যায় শরতের স্বচ্ছ প্রকৃতিকে। নগরে অদৃশ্য শরৎ, হৃদয়ের কোঠর থেকে বের হয়ে তাই শরৎ কালে নাগরিকদের মনে দোলা দিয়ে প্রকৃতির কাছে টেনে নিয়ে যায়।

শরতকে উপভোগ করা তো দূরের কথা, শরৎ কালের অপরূপ রূপ কিংবা শরতের আকাশকে কী কিছুটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারেন ঢাকার নাগরিকেরা। দুই দালানের মধ্য দিয়ে অনেক কসরত করে আকাশ ধরা দিলেও, আকাশকে দেখার কী সময় আছে? আকাশ দেখার কথা মনে আসলেই মনে হয়, মস্ত উঠানে শীতল পাটি বিছিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঝকঝকে জ্যোৎস্না রাতে, নক্ষত্র ভরা আকাশকে বিস্ময় মাখানো চোখ দিয়ে অবলোকন। আহা সে সময় হারিয়ে গেছে। গ্রাম বাংলার জীবনেও প্রকৃতি এখন সীমিত হয়ে আসছে। প্রকৃতিকে দখল করছে নানা রকম ছোটো বড় অবকাঠামো। শরতের ঝকে ঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় বুঁদ হওয়ার মতো বিলাসীতা বাংলাদেশের গ্রামের মানুষদেরও সীমিত হয়ে আসছে। নগর জীবনে মানুষ শরতের আকাশকে যদিও সেভাবে দেখতে পারেনা, তবে শরতের মাধুর্যকে কোন ভাবেই হারাতে চায়না। চায়না বলেই নগরের নানা প্রান্তে, স্নিগ্ধ সকালে নগরের মানুষ শরৎ উৎসবে সমবেত হয়।

শরত এলে মনে ও প্রকৃতিতে আসে এক জ্যোতির্ময় রূপ। বর্ষার জলে ভিজে স্বচ্ছ্ব হওয়া প্রকৃতি, বড় আপন হয়ে ধরা দেয় শরৎ কালে। জ্যোতির্ময় শরৎ। আকাশে মেঘের ভেলা। সুনীল রূপকান্তি, আলো ছায়ার লুকোচুরি। ঋতু পরিবর্তনের মায়াময় পথে নিয়ত উদ্ভাসিত রূপ, রং ও সুরের খেলা। এ খেলা হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। এরকম দোলা আছে বলেই মানুষ এখনও কবিতা পড়ে। গান শুনে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে অবগাহন করতে চায়। এরকম মন যতোদিন জীবিত থাকে মানুষের মধ্যে সুর থাকে, অসুরেরা কাছে আসতে পারে না।

শরতকে নববধূর সঙ্গে তুলনা করে কবি কালিদাস বলেছিলেন, প্রিয়তম আমার, ওই চেয়ে দেখো, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত। শরতকে কেনো নববধূ বলেছিলেন কালিদাস? এর কারন সম্ভবত বর্ষাবসানে শরত আসে। শরত তাই বড় স্নিগ্ধ, কোমল, শ্বেত, শুভ্র ঋতু । শরৎ আসে বাঙালি হৃদয় স্বচ্ছ করতে। শরতের অনুষঙ্গ গুলো মানুষকে উদার, ভাবালু করে তুলে। সূর্যের ঝলমলে আলোয় ভরে যায় চারদিক, কাশফুলে ভরে যায় বাংলার প্রকৃতি, দুর্বাঘাস ভিজে যায় হালকা শিশিরে, আকাশে শিমুল তুলোর মতো ভেসে চলে সাদা মেঘ, বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে লাল ও সাদা শাপলা, আমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় ভোরের হিমেল হাওয়া। স্বচ্ছ্ব নীল আকাশ, ফুলের পাপড়িতে দোল দিয়ে যায় মৃদু বাতাস, চারদিকে কাশফুল আর কাশফুল, মাটিতে যেন মিশে যায় তার গন্ধ, শুরু হয় গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা। চারদিকে মুগ্ধতা ছড়িয়ে শরৎ আসে বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের হৃদয়ের কোনে কোনে।

শরতের প্রধান অনুষঙ্গ হলো কাশফুল। নাগরিক সমাজের মানুষের কাছে কাশ ফুল বললেই সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির কাশ ফুলের বাগানের কথা মনে হয়। আহা কী অপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতি, শরৎ ও কাশ ফুলকে বিভূতিভূষণের উপন্যাসে আমরা পাই কল্পনায় আর সত্যজিতের পথের পাচালিতে পাই নয়ন মনোহর একটি দৃশ্য হিসাবে। চিরায়ত বাংলার অপরূপ আনন্দ-বেদনার আখ্যানে যে উপন্যাস রচনা করেন বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ সেলুলয়েডের মাধ্যমে তাকে নান্দনিক সুষমায় উদ্ভাসিত করেন। সে সুষমার একটি অনিন্দ্য সুন্দর অংশ ছিল- কাশ বাগানের মধ্য দিয়ে দুটি নিস্পাপ শিশুর ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এ দৃশ্যটি সত্যজিৎ সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অক্ষয়, অমর করে রেখেছেন। দৃশ্যটির পটভূমি ছিলো এরকম, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় অপু, দুর্গা ভাই, বোন দূরাগত ট্রেনের বাঁশি শুনতে পেয়ে আনন্দে আকুল হয়ে ওঠে। একদিন তারা বাডড়তে না বলে অনেক দূরে চলে আসে ট্রেন দেখবে বলে। কাশের বনের ভেতর দিয়ে ট্রেন দেখার জন্য অপু-দুর্গা ছোটে চলে। এই কাশ বাগানের মধ্য দিয়ে তাদের ছোটে চলা আবাহমান বাংলার শরতের এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ। যারা সত্যজিতের পথের পাঁচালি দেখেছেন তাদের সবার জন্যই চলচ্চিত্রের এই অংশটি হৃদয়ে চিরদিনের জন্য গেঁথে আছে।

বাঙালির চোখ ও মনের সামনে শরতের অপার সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেছেন, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি’। কী অসাধারণ শরৎ বন্দনা। রবীন্দ্রনাথের আগে এতো চমৎকার করে শরতের সৌন্দর্যকে আবিস্কার করতে পারেননি কেউ। শরতের অনিন্দ্য-সুন্দর রূপ রবীন্দ্রনাথ যেনো ছবি এঁকে মোহনীয় করে গেছেন তাঁর কবিতা এবং গানের কলিতে। বাঙালি শরতকে অনুভব করে রবি ঠাকুরের চোখে, এ অনুভব প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে পুলক সৃষ্টি করে।

শরতে ঢাকার নাগরিকেরা অন্তরের টানে বেরিয়ে পড়েন। শৈশব জীবনকে খুঁজে বেড়ান, শরতের প্রকৃতি অবলোকনের মাধ্যমে। ঢাকার নাগরিকেরা প্রকৃতি বিমুখ নন, শরৎ আসলে সপ্তাহান্তে শহরতলী এবং শহরের কিছু অংশে ছোটে যান, ইট কাঠের এই শহর থেকে তারা মুক্তি চান। মানুষ প্রকৃতির দেখা পায়না নগরে তবে প্রকৃতির আহব্বান অনুভব করে হৃদয়ে। সপ্তাহান্তে তাই অগণিত নাগরিক ছোটে উত্তরার দিয়া বাড়ি, কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গার তীরে, আর ঢাকা থেকে বসুন্ধরা অভিমুখী রাস্তার দু’পাশে অজগ্র কাশের বাগানে। কাশের বাগানে ঢেউ ওঠে। শুভ্রতার ঢেউ, সঙ্গে নীল আকাশ এসে যুক্ত হয়।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে মানুষের ঢল নামে। একই রকম ঢল নামে বসুন্ধরা অভিমুখী পথে এবং বুড়ি গঙ্গার তীরে। দিয়াবাড়িতে দেখেছি নানা বয়সী মানূষের ঢল। সবাই আসেন তুরাগ নদীর তীরে শরতের শুভ্রতাকে উপভোগ করতে। এই শুভ্রতাকে তারা অনুভব করেন নদীর তীরের কাশ বাগাণের ভিতরে হারিয়ে গিয়ে।

দিয়াবাড়িতে দু’চোখে যেদিকে যায় সে দিকেই শুভ্র কাশফুল, বাতাসে কেপে কেপে ওঠে। মনে হয় শ্বেত শুভ্র কোন নদীর ঢেউ। ইটকাঠের এই নগরীর বুকে এমন কাশফুলের দেখা পেয়ে মানুষেরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেন! রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি প্রকল্পের অংশ এই দিয়াবাড়ি। উত্তরার এই প্রকল্পে বালুমাটি ফেলে সমতল করায় বিশাল মাঠের মতো খোলা জায়গাটি এখন শরতের শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যায়। কাশবনের ভেতর দিয়ে পথ। নগরের যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে একটু প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা নগরবাসীর কাছে অন্যরকম ভালো লাগার জায়গা হয়ে উঠেছে দিয়াবাড়ি। বিকেলে পুরো এলাকা গ্রামীণ মেলায় রূপ নেয়। এক দিকে ঘুরছে নাগরদোলা। অন্য দিকে রকমারি খাবারের পসরা। বটতলা থেকে কিছুটা সামনে একটি সেতু। সেতুর দুই পাশে লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে বোট হাউজ। বাঁশ ও কাঠের কাঠামো দিয়ে বানানো হয়েছে বসার জায়গা। দুপুরের খরতাপ কমতেই লোকসমাগমে জমজমাট হয়ে ওঠে দিয়াবাড়ির কাশ বাগানে।

থোকা-থোকা শিউলী নেই ঢাকাতে, শিশিরে পা ভিজেনা ভরা শীতের রাতে শরৎ কালে শিশির কল্পনাও করা যায়না, ভোরবেলা হিমেল হাওয়া নেই , গাছ নেই , পাখি নেই, ফুল নেই। বাতাসে বিষের কনা ঘোরে। ঢাকার আশপাশের ধান ক্ষেত গুলোতে ডেভলপরদের লোভী চোখ। ঢাকার বাতাসের,মান ক্রমাগত অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠেছে। ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। একটি দেশের রাজধানী হলো তার বাইরের মোড়ক। ভিনদেশী মানূষদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ঢাকা থেকে কাজকর্ম সেরে নিজ দেশে ফিরে যান। তারা যদি প্রকৃতি বিমুখ, গাছপালাহীন এরকম একটি শহর দেখে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে ফিরে যান তাহলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।

প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে নগর পরিকল্পনাবিদরা কী ঢাকার জন্য নতুন কোন পরিকল্পনা করতে পারেননা? মিন্টুরোড, রমনা পার্ক, হাইকোর্টের রাস্তার দুপাশে কিন্তু এখনও কিছু গাছ অবশিষ্ট আছে। আমাদের এই ঋতু বৈচিত্র্যের দেশে প্রতিটি ঋতু দৃশ্যমান হোক তা সকলেরই কামনা। মানুষ উপভোগ করুক শরতের রূপ-মাধুর্য আগের মতো। মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসুক, প্রকৃতিও মানুষকে ভালোবাসবে। সমগ্র ঢাকা সবুজ হয়ে উঠুক। কী রকম সবুজ? ফুট ওভারব্রিজে মৃত প্রায় গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করার প্রয়োজন নেই। ঢাকার সকল নদী, খাল, নিচু জায়গা, রাস্তার দুপাশে সবুজের বেষ্টনী চাই। আমরা যদি তাই করতে পারি তাহলে ঢাকায় আবার শরৎ ফিরে আসবে। ফিরে আসবে সকল ঋতু। মানুষ শরতের রূপ মাধুর্য খুঁজতে আর ঢাকার বাইরে যাবে না। ঢাকার আকাশ, বাতাস, বৃক্ষ, লতা-পাতা শরতকে আবাহন করুক, এরকম একটি প্রকৃতিবান্ধব ঢাকা নগর দেখতে চাই।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top