alt

উপ-সম্পাদকীয়

দেশভাগ ঘিরে চর্চার পণ্যায়ন

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিগত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগ ঘিরে যাবতীয় আলাপ-আলোচনার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত পণ্যায়নের অভিমাত্রা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই সময়কালে দেশভাগ ঘিরে বহু গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে। সেইসঙ্গে রচিত হয়েছে স্মৃতিকথন মূলক বহু আখ্যান। এই আখ্যানগুলো গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি যারা রচনা করছেন, সম্পাদনা করছেন, তাদের বেশিরভাগই দেশভাগজনিত ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ ভাগীদার নন। মূলত এরা দেশভাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্মের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ। দেশভাগের অব্যবহিত পরে যারা দুই বাংলার সেই বিচ্ছেদ মূলক ঘটনাক্রমের নানা কাহিনী লিখেছেন, ফিল্ম তৈরি করেছেন, সেই প্রজন্মের সৃষ্টির সঙ্গে গত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগ ঘিরে যে ধরনের চর্চা হয়েছে, সেই চর্চার মধ্যে সব থেকে বড় মৌলিক পার্থক্য হলো; দেশভাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্ম কিন্তু কখনো, কোনো অবস্থাতেই দেশভাগের জন্য, চ্ছিন্নমূল হওয়ার জন্য একমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করেননি।

আর বিগত পঁচিশ বছর ধরে দেশভাগ উত্তর প্রজন্ম, দেশভাগ ঘিরে যে সমস্ত চর্চা করছেন, তার বেশিরভাগটাই হলো কার্যত গোটা ঘটনাক্রমের জন্য শুধু মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করা। মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য দেশভাগ ঘটেছে, মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে গণহারে হিন্দু উৎখাত ঘটেছে-এই বিকৃত ইতিহাসকে বারংবার নানা ধরনের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলীর ভেতর দিয়ে, মৌখিক ইতিহাসের ভেতর দিয়ে, কোনোরকম তথ্য-প্রমাণ বা ইতিহাসগত কোনো বিচার বিশ্লেষণ ব্যতীত, পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার একটা অদ্ভুত প্রবণতা তারা দেখিয়ে চলেছেন।

আর এই ধরনের প্রবণতা সম্পন্ন বিকৃত ইতিহাস বোধ যুক্ত বইগুলো মুড়ি মুড়কির মতো বাংলাদেশের বাজারে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় সেগুলো থেকে বিশেষ রকম ভাবে নিজেদের ভাবনাপ্রসূত অবস্থান গ্রহণ করছেন। ফলে বাংলাদেশে সেখানকার সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা ভয়ংকর সামাজিক দেওয়াল তৈরি হচ্ছে। আর যার সুযোগ নিচ্ছে খুব ভালো রকম ভাবে, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়কে মৌলবাদী শিবির, বিএনপি-জামায়াতসহ সমস্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপ্রেমী শক্তিগুলো।

ভারতে বিগত প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে দেশভাগ ঘিরে মুসলমান সম্প্রদায়কে সমস্ত রকম ভাবে কাঠগড়ায় তুলে একটা বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টির এই যে প্রবণতা, তা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়।

যত দোষ নন্দ ঘোষ-অর্থাৎ; দেশভাগজনিত যা কিছু সমস্যা, সেই সমস্ত সমস্যার মূলে এক এবং একমাত্র বিষয়বস্তু হলো মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ-এইটা প্রতিপন্ন করার প্রবণতা বিগত পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগজনিত চর্চায় কার্যত প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশভাগের সময়কালে কিন্তু এই প্রবণতা আদৌ ছিল না। দেশভাগজনিত কালে, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান সম্প্রদায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা বহু ক্ষেত্রে সাহিত্য থেকে ফিল্ম সর্বত্র উঠে এসেছে। দেশভাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন কিন্তু দেশভাগের সময়কালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি একটা অভিমান বুকে রাখলেও মুসলমান বিদ্বেষ, এই জিনিসটি কিন্তু তাদের মধ্যে কখনোই গড়ে ওঠেনি। বরঞ্চ বলা যেতে পারে, বিভাজনের পর এপার বাংলায় ছিন্নমূল হয়ে থাকাকালীন সময়ও তারা অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু মুসলমানের সঙ্গে সম্মিলিত ধারা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে, যে সামাজিক স্রোতের ভেতর দিয়ে যাপন চিত্র প্রবাহিত করেছে, তার স্মৃতি রোমন্থন ঘিরে তাদের মধ্যে কোনরকম বিদ্বেষের মানসিকতা কিন্তু ছিল না।

বরঞ্চ পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের যে ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শোষণ, সেগুলোর মোকাবিলা করতেই দেশভাগের পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়কে বেশি সময় শ্রম, মেধা, মনন সবকিছু খরচ করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশভাগের অব্যবহিত পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়, বিশেষ করে অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের যে সার্বিক শোষণ, তা ঘিরে বাংলা সাহিত্যে সমরেশ বসুর সদাগর উপন্যাস, আর প্রতিভা বসুর ছোটগল্প দুকুলহারা ছাড়া সে অর্থে কোনো কথাসাহিত্যগত স্বাক্ষর পর্যন্ত নেই।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি মনুষ্য জনোচিত ব্যবহারের জন্য অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো দু-চারজন হাতেগোনা এপার বাংলার বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কোনো বুদ্ধিজীবী, কাউকে সেদিন সোচ্চার হতে আমরা দেখিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবর্তন, সেখানকার তথাকথিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট করে আইয়ুব খানের ফৌজি শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক জীবনের ওপরে পশ্চিমে সেই সামরিকজান্তা যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, যার জেরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের ভেতরে নানা ধরনের বিকৃত রাজনৈতিক মানসিকতা ধীরে ধীরে জন্ম নিতে শুরু করে, সে সম্পর্কে কিন্তু এপার বাংলায় গত পঁচিশ বছর ধরে যারা দেশভাগ ঘিরে চর্চা করছেন, তাদের মধ্যে শতকরা পাঁচজনও কোনো রকম সচেতনতার পরিচয় দেননি।

আইয়ুব খানের সময় থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সামরিক শাসনের নামে শোষণকে বজায় রাখবার জন্য বাঙালিকে আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক, সব দিক থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে যে স্টিমরোলার চালিয়েছিল, ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণ সম্পর্কে বিগত পঁচিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যারা পার্টিশন লিটারেচার নিয়ে চর্চা করেছেন, তাদের বেশিরভাগই কার্যত নীরব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের যাবতীয় বদমাইশির দায়টা একতরফাভাবে সমগ্র মুসলমান সমাজের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছেন।

দেশভাগের সময়কাল থেকে শুরু করে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগজনিত অর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট আর আইয়ুব খান গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে, তার তথাকথিত বেসিক ডেমোক্রেসি কায়েম করে কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক সন্ত্রাস, সংস্কৃতিক আগ্রাসন, গোটা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দেশভাগ জনিত সময়কালের মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে, ইসলামিকরণের মানসিকতা শিকার পূর্ব পাকিস্তানের গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে করতে চেয়েছিলেন, তার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস সম্মত বিশ্লেষণ দেশ ভাগের সময় কাল থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় গৌরী আইয়ুবের মতো হাতেগোনা দু-চারজন মানুষ ছাড়া আর কেউ করেননি। শুধু করেননি তাই নয়, দেশভাগের ইতিহাস চর্চার নাম করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মুসলমান বিদ্বেষের বীজ বপন করেছেন, যা আজ মহীরুহ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক অঙ্গনকে খেয়ে ফেলেছে।

আইয়ুব খান অবৈধভাবে গোটা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক বিন্যাসকে বিধ্বস্ত করে, মুসলিম জাতীয়তাবাদকে সমাজের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত বাঙালি সমাজকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যার জেরে মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি অংশ, যারা আইয়ুবী গণতন্ত্রের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশ থেকে তাড়িয়ে, তাদের সম্পত্তি গ্রাস করতেই সবথেকে বেশি উৎসাহী ছিলেন, এই বিষয়গুলো বিগত পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে যারা দেশভাগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করেছেন, তারা একটিবারের জন্য উল্লেখ করেননি।

’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন মুসলিম জাতীয়তার কবরে যে মাটি চাপা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিল, যা অবিভক্ত পাকিস্তানের ’৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ধরাশায়ী হওয়ার মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল, আইয়ুব খান তাকে ভেস্তে দিতে সব রকম প্রয়াস নিয়েছিল। সেই প্রয়াস যে বাঙালি সমাজকে কতখানি বিভ্রান্ত করেছিল, বাঙালি সমাজের অন্যতম স্তম্ভ, হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে আরেক স্তম্ভ, মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশকে ভুল বুঝিয়েছিল, তা ঘিরে বাংলাদেশে আহমদ ছফার মতো মানুষ ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস লিখেছেন। ‘মাটির ময়না’র মতো ফিল্ম সেখানে তৈরি হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হাতেগোনা দু-চারজন বুদ্ধিজীবী ছাঙা প্রায় সবাই শুধু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে গেছেন। আর সেই বিভ্রান্তির জেরেই আজ শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা ভারতেই হিন্দু সম্প্রদায়, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, সংগঠন আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের সব থেকে বড় যে দিক, সেই মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদনা করতে সমর্থ হয়েছে।

বিগত পঁচিশ বছরে শুধু দেশ ভাগই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও পশ্চিমবঙ্গে সমরেশ বসু ব্যতীত আর কোনো কথা সাহিত্যিক একটিও বস্তুনিষ্ঠ সৃষ্টি সমাজের বুকে রাখতে সক্ষম হননি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে কার্যত টোকা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাস হয়তো প্রচার মাধ্যমে দৌলাতে অনেক খ্যাতি পেয়েছে, বিক্রয়ের দিক থেকেও অনেক সাফল্য পেয়েছে, কিন্তু সমরেশ বসুর মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বড় গল্প ‘ধর্ষিতা’র সমতুল্য মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অমন সত্যনিষ্ঠ কথাসাহিত্য এপার বাংলার কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের হাত থেকে আর বের হয়নি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

দেশভাগ ঘিরে চর্চার পণ্যায়ন

গৌতম রায়

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিগত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগ ঘিরে যাবতীয় আলাপ-আলোচনার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত পণ্যায়নের অভিমাত্রা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই সময়কালে দেশভাগ ঘিরে বহু গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে। সেইসঙ্গে রচিত হয়েছে স্মৃতিকথন মূলক বহু আখ্যান। এই আখ্যানগুলো গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি যারা রচনা করছেন, সম্পাদনা করছেন, তাদের বেশিরভাগই দেশভাগজনিত ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ ভাগীদার নন। মূলত এরা দেশভাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্মের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ। দেশভাগের অব্যবহিত পরে যারা দুই বাংলার সেই বিচ্ছেদ মূলক ঘটনাক্রমের নানা কাহিনী লিখেছেন, ফিল্ম তৈরি করেছেন, সেই প্রজন্মের সৃষ্টির সঙ্গে গত কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগ ঘিরে যে ধরনের চর্চা হয়েছে, সেই চর্চার মধ্যে সব থেকে বড় মৌলিক পার্থক্য হলো; দেশভাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্ম কিন্তু কখনো, কোনো অবস্থাতেই দেশভাগের জন্য, চ্ছিন্নমূল হওয়ার জন্য একমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করেননি।

আর বিগত পঁচিশ বছর ধরে দেশভাগ উত্তর প্রজন্ম, দেশভাগ ঘিরে যে সমস্ত চর্চা করছেন, তার বেশিরভাগটাই হলো কার্যত গোটা ঘটনাক্রমের জন্য শুধু মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করা। মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য দেশভাগ ঘটেছে, মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে গণহারে হিন্দু উৎখাত ঘটেছে-এই বিকৃত ইতিহাসকে বারংবার নানা ধরনের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলীর ভেতর দিয়ে, মৌখিক ইতিহাসের ভেতর দিয়ে, কোনোরকম তথ্য-প্রমাণ বা ইতিহাসগত কোনো বিচার বিশ্লেষণ ব্যতীত, পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার একটা অদ্ভুত প্রবণতা তারা দেখিয়ে চলেছেন।

আর এই ধরনের প্রবণতা সম্পন্ন বিকৃত ইতিহাস বোধ যুক্ত বইগুলো মুড়ি মুড়কির মতো বাংলাদেশের বাজারে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় সেগুলো থেকে বিশেষ রকম ভাবে নিজেদের ভাবনাপ্রসূত অবস্থান গ্রহণ করছেন। ফলে বাংলাদেশে সেখানকার সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা ভয়ংকর সামাজিক দেওয়াল তৈরি হচ্ছে। আর যার সুযোগ নিচ্ছে খুব ভালো রকম ভাবে, বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়কে মৌলবাদী শিবির, বিএনপি-জামায়াতসহ সমস্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপ্রেমী শক্তিগুলো।

ভারতে বিগত প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে দেশভাগ ঘিরে মুসলমান সম্প্রদায়কে সমস্ত রকম ভাবে কাঠগড়ায় তুলে একটা বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টির এই যে প্রবণতা, তা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়।

যত দোষ নন্দ ঘোষ-অর্থাৎ; দেশভাগজনিত যা কিছু সমস্যা, সেই সমস্ত সমস্যার মূলে এক এবং একমাত্র বিষয়বস্তু হলো মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ-এইটা প্রতিপন্ন করার প্রবণতা বিগত পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগজনিত চর্চায় কার্যত প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশভাগের সময়কালে কিন্তু এই প্রবণতা আদৌ ছিল না। দেশভাগজনিত কালে, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান সম্প্রদায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা বহু ক্ষেত্রে সাহিত্য থেকে ফিল্ম সর্বত্র উঠে এসেছে। দেশভাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন কিন্তু দেশভাগের সময়কালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি একটা অভিমান বুকে রাখলেও মুসলমান বিদ্বেষ, এই জিনিসটি কিন্তু তাদের মধ্যে কখনোই গড়ে ওঠেনি। বরঞ্চ বলা যেতে পারে, বিভাজনের পর এপার বাংলায় ছিন্নমূল হয়ে থাকাকালীন সময়ও তারা অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু মুসলমানের সঙ্গে সম্মিলিত ধারা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে, যে সামাজিক স্রোতের ভেতর দিয়ে যাপন চিত্র প্রবাহিত করেছে, তার স্মৃতি রোমন্থন ঘিরে তাদের মধ্যে কোনরকম বিদ্বেষের মানসিকতা কিন্তু ছিল না।

বরঞ্চ পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের যে ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শোষণ, সেগুলোর মোকাবিলা করতেই দেশভাগের পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়কে বেশি সময় শ্রম, মেধা, মনন সবকিছু খরচ করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশভাগের অব্যবহিত পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়, বিশেষ করে অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের যে সার্বিক শোষণ, তা ঘিরে বাংলা সাহিত্যে সমরেশ বসুর সদাগর উপন্যাস, আর প্রতিভা বসুর ছোটগল্প দুকুলহারা ছাড়া সে অর্থে কোনো কথাসাহিত্যগত স্বাক্ষর পর্যন্ত নেই।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি মনুষ্য জনোচিত ব্যবহারের জন্য অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো দু-চারজন হাতেগোনা এপার বাংলার বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কোনো বুদ্ধিজীবী, কাউকে সেদিন সোচ্চার হতে আমরা দেখিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবর্তন, সেখানকার তথাকথিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট করে আইয়ুব খানের ফৌজি শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক জীবনের ওপরে পশ্চিমে সেই সামরিকজান্তা যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, যার জেরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের ভেতরে নানা ধরনের বিকৃত রাজনৈতিক মানসিকতা ধীরে ধীরে জন্ম নিতে শুরু করে, সে সম্পর্কে কিন্তু এপার বাংলায় গত পঁচিশ বছর ধরে যারা দেশভাগ ঘিরে চর্চা করছেন, তাদের মধ্যে শতকরা পাঁচজনও কোনো রকম সচেতনতার পরিচয় দেননি।

আইয়ুব খানের সময় থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সামরিক শাসনের নামে শোষণকে বজায় রাখবার জন্য বাঙালিকে আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক, সব দিক থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে যে স্টিমরোলার চালিয়েছিল, ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণ সম্পর্কে বিগত পঁচিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যারা পার্টিশন লিটারেচার নিয়ে চর্চা করেছেন, তাদের বেশিরভাগই কার্যত নীরব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের যাবতীয় বদমাইশির দায়টা একতরফাভাবে সমগ্র মুসলমান সমাজের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছেন।

দেশভাগের সময়কাল থেকে শুরু করে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগজনিত অর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট আর আইয়ুব খান গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে, তার তথাকথিত বেসিক ডেমোক্রেসি কায়েম করে কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক সন্ত্রাস, সংস্কৃতিক আগ্রাসন, গোটা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দেশভাগ জনিত সময়কালের মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে, ইসলামিকরণের মানসিকতা শিকার পূর্ব পাকিস্তানের গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে করতে চেয়েছিলেন, তার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস সম্মত বিশ্লেষণ দেশ ভাগের সময় কাল থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় গৌরী আইয়ুবের মতো হাতেগোনা দু-চারজন মানুষ ছাড়া আর কেউ করেননি। শুধু করেননি তাই নয়, দেশভাগের ইতিহাস চর্চার নাম করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মুসলমান বিদ্বেষের বীজ বপন করেছেন, যা আজ মহীরুহ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক অঙ্গনকে খেয়ে ফেলেছে।

আইয়ুব খান অবৈধভাবে গোটা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক বিন্যাসকে বিধ্বস্ত করে, মুসলিম জাতীয়তাবাদকে সমাজের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত বাঙালি সমাজকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যার জেরে মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি অংশ, যারা আইয়ুবী গণতন্ত্রের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশ থেকে তাড়িয়ে, তাদের সম্পত্তি গ্রাস করতেই সবথেকে বেশি উৎসাহী ছিলেন, এই বিষয়গুলো বিগত পঁচিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে যারা দেশভাগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করেছেন, তারা একটিবারের জন্য উল্লেখ করেননি।

’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন মুসলিম জাতীয়তার কবরে যে মাটি চাপা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিল, যা অবিভক্ত পাকিস্তানের ’৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ধরাশায়ী হওয়ার মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল, আইয়ুব খান তাকে ভেস্তে দিতে সব রকম প্রয়াস নিয়েছিল। সেই প্রয়াস যে বাঙালি সমাজকে কতখানি বিভ্রান্ত করেছিল, বাঙালি সমাজের অন্যতম স্তম্ভ, হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে আরেক স্তম্ভ, মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশকে ভুল বুঝিয়েছিল, তা ঘিরে বাংলাদেশে আহমদ ছফার মতো মানুষ ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস লিখেছেন। ‘মাটির ময়না’র মতো ফিল্ম সেখানে তৈরি হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হাতেগোনা দু-চারজন বুদ্ধিজীবী ছাঙা প্রায় সবাই শুধু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে গেছেন। আর সেই বিভ্রান্তির জেরেই আজ শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা ভারতেই হিন্দু সম্প্রদায়, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, সংগঠন আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের সব থেকে বড় যে দিক, সেই মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদনা করতে সমর্থ হয়েছে।

বিগত পঁচিশ বছরে শুধু দেশ ভাগই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও পশ্চিমবঙ্গে সমরেশ বসু ব্যতীত আর কোনো কথা সাহিত্যিক একটিও বস্তুনিষ্ঠ সৃষ্টি সমাজের বুকে রাখতে সক্ষম হননি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে কার্যত টোকা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাস হয়তো প্রচার মাধ্যমে দৌলাতে অনেক খ্যাতি পেয়েছে, বিক্রয়ের দিক থেকেও অনেক সাফল্য পেয়েছে, কিন্তু সমরেশ বসুর মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বড় গল্প ‘ধর্ষিতা’র সমতুল্য মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অমন সত্যনিষ্ঠ কথাসাহিত্য এপার বাংলার কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের হাত থেকে আর বের হয়নি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top