alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা জরুরি

হীরেন পন্ডিত

: শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

বৈষম্য আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরিচিত একটি শব্দ। আর্থিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য বা রাজনৈতিক বৈষম্য শব্দগুলো আমরা প্রতিনিয়ত শুনে থাকি। প্রযুক্তির চরম উন্নতির এই যুগে আমরা নতুন এক বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি আর তা হলো ডিজিটাল বৈষম্য। প্রযুক্তি অগণিত মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে বহু মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটিও মনে রাখতে হবে। করোনাকালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। ব্যক্তিগত ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বহু দেশ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিস- আদালত সব ক্ষেত্রেই বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে।

ডিজিটাল বৈষম্যের আলোচনা এখন তাই ব্যাপকভাবে হচ্ছে। বিশ্বে বহু মানুষ আছেন, যারা প্রযুক্তির নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস, অফিস প্রভৃতি একটি বিভীষিকার নাম। ডিজিটাল বৈষম্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা। উন্নত বিশ্বের বহু দেশ এ সমস্যায় ভুগছে। আমেরিকা ও ইউরোপেও দেখা যায়, বহু মানুষ প্রযুক্তি সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আবার এর সঙ্গে নানা সামাজিক শ্রেণিবিভাজনও যুক্ত হয়ে যায়। অঞ্চল, লিঙ্গ, আর্থসামাজিক অবস্থাও ডিজিটাল বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত থাকে।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা যে আরও খারাপ, তা সহজেই বোঝা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইন্টারনেট সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করার পাশাপাশি সবচেয়ে কম মূল্যে স্মার্ট ফোন সাধারণের নাগালে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জনিয়েছে সরকারি সূত্র। ইতোমধ্যেই ইন্টারনেটের একদেশ একরেট চালু হয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোন ইতোমধ্যেই শতকরা ৯৬ ভাগ চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেও দাবি করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য লাগসই ডিজিটাল সংযোগ ও ডিজিটাল ডিভাইস অপরিহার্য। ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেট এখন মানুষের জীবনধারায় অনিবার্য একটি বিষয় হিসেবে জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হচ্ছে ইন্টারনেট।

কাউকে এ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইতোমধ্যেই প্রাথমিক স্তরে বই ছাড়া ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে লেখা পড়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না দিলে আগামী পৃথিবীতে তারা টিকে থাকার জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে। ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি মানুষ ইন্টারনেটের উচ্চগতিও এখন প্রত্যাশা। ২০০৬ সালে দেশে প্রতি এমবিপিএস ইন্টানেটের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা, ২০০৮ সালে তা ২৭ হাজার টাকা এবং বর্তমানে তা ৬০ টাকায় নির্ধারিত হয়েছে। সে সময় দেশে মাত্র সাড়ে সাত জিবিপিএস ব্যান্ডউদথ ব্যবহৃত হতো তা বেড়ে বর্তমানে ৩৮ শত জিবিপিএস-এ উন্নীত হয়েছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।

এখন এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। ইন্টারনেট প্রযুক্তি দেশে নতুন অর্থনীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কৃষক-শ্রমিক, প্রবাসী এবং গার্মেন্টেসের কর্মীরাই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৬.৫০ লাখের মতো ফ্রিল্যান্সার আইটি তরুণ তরুণী। ইন্টারনেটকে অনেক দেশ মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছে আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার।

আমরা অনেকেই নানাভাবে শুনেছিÑকরোনাকালীন সময়ে বহু ছাত্রছাত্রীকে বাড়ি থেকে বহু দূরে গিয়ে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হয়েছে; আবার গাছের ওপর উঠেও বহু মানুষকে ক্লাস করতে হয়েছে। এগুলো ডিজিটাল বৈষম্যের কারণে তৈরি হওয়া সমস্যাগুলোর প্রতিফলন মাত্র। ডিজিটাল বৈষম্যের আরও বহু খারাপ দিক হয়তো সামনে আমরা দেখতে পাব। আমরা যদি এখনকার বড় বড় ব্যবসায় মাধ্যমগুলো দেখি, তাহলে দেখা যাবে- সেগুলোর ভালো একটা অংশ অনলাইননির্ভর হয়ে গেছে। গুগল, আমাজন, আলিবাবা, ফেসবুক প্রভৃতির কথা আমরা সবাই জানি। এসব কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে অনলাইনের ওপর নির্ভর করেই।

আমাদের দেশেও অনলাইননির্ভর কেনাকাটা শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু মানুষই এই শতকে এগিয়ে যাবে। তবে বহু মানুষ আছে, যারা প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে। এতে নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, এতে সন্দেহ নেই।

ডিজিটাল বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। ইন্টারনেট সহজলভ্য করা, প্রযুক্তি সম্পর্কিত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা, মানুষকে প্রযুক্তি-সাক্ষর হিসেবে গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপগুলো ডিজিটাল বৈষম্য রোধে ভালো ভূমিকা রাখবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যেমন দারিদ্র্য বিমোচনের সহায়ক একই সঙ্গে তা সুশাসন, গুণগত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অন্যতম কৌশল হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিতে সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে; যাতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যম সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসা।

তবে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু

সীমাবদ্ধতাও সবার সামনে আসছে। মূলত দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যারা গ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে, যাদের প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস বা সংযোগ নেই বা সেবা গ্রহণ করার জন্য যাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও দক্ষতা নেই তারা এই সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে।

বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। পাশাপাশি গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন নেই এবং ৪৯ শতাংশের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ একই সঙ্গে সেবাগুলোর সহজীকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতাও প্রয়োজনীয়। এ দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ঘাটতি রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু সম্পূর্ণ ধারণা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পরিবারের মধ্যকার যে বিভাজন আছে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামনে উঠে আসে না। যেমন পরিবারের নারী ও পুরুষের মধ্যকার বিভাজন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বয়স ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।

বর্তমান সময়ে তথ্য ও প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ যে কোন জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। তথ্যপ্রযুক্তি শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই না একই সঙ্গে তা নতুন নতুন ক্ষেত্র ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। করোনাকালে এর কিছু প্রয়োগ আমরা দেখতে পেয়েছি, যদিও তা সার্বিকভাবে ও সামগ্রিকভাবে নয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বোঝা। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ সৃষ্টি না করাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসমতা দেশের জনগণের মধ্যকার বর্তমান অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই আমাদের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সরকারি ও বেসরকারি সেবায় সবার সমান সুযোগ না পাওয়া একটি কঠিন বাস্তবতা। সরকার প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় ‘সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার’ অংশে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এখন এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে তথ্যপ্রযুক্তিকে সব জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তুলতে হবে।

পাশাপাশি কম খরচে বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নারীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা জরুরি

হীরেন পন্ডিত

শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

বৈষম্য আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরিচিত একটি শব্দ। আর্থিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য বা রাজনৈতিক বৈষম্য শব্দগুলো আমরা প্রতিনিয়ত শুনে থাকি। প্রযুক্তির চরম উন্নতির এই যুগে আমরা নতুন এক বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি আর তা হলো ডিজিটাল বৈষম্য। প্রযুক্তি অগণিত মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে বহু মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটিও মনে রাখতে হবে। করোনাকালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। ব্যক্তিগত ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বহু দেশ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিস- আদালত সব ক্ষেত্রেই বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে।

ডিজিটাল বৈষম্যের আলোচনা এখন তাই ব্যাপকভাবে হচ্ছে। বিশ্বে বহু মানুষ আছেন, যারা প্রযুক্তির নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস, অফিস প্রভৃতি একটি বিভীষিকার নাম। ডিজিটাল বৈষম্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা। উন্নত বিশ্বের বহু দেশ এ সমস্যায় ভুগছে। আমেরিকা ও ইউরোপেও দেখা যায়, বহু মানুষ প্রযুক্তি সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আবার এর সঙ্গে নানা সামাজিক শ্রেণিবিভাজনও যুক্ত হয়ে যায়। অঞ্চল, লিঙ্গ, আর্থসামাজিক অবস্থাও ডিজিটাল বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত থাকে।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা যে আরও খারাপ, তা সহজেই বোঝা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইন্টারনেট সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করার পাশাপাশি সবচেয়ে কম মূল্যে স্মার্ট ফোন সাধারণের নাগালে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জনিয়েছে সরকারি সূত্র। ইতোমধ্যেই ইন্টারনেটের একদেশ একরেট চালু হয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোন ইতোমধ্যেই শতকরা ৯৬ ভাগ চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেও দাবি করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য লাগসই ডিজিটাল সংযোগ ও ডিজিটাল ডিভাইস অপরিহার্য। ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেট এখন মানুষের জীবনধারায় অনিবার্য একটি বিষয় হিসেবে জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হচ্ছে ইন্টারনেট।

কাউকে এ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইতোমধ্যেই প্রাথমিক স্তরে বই ছাড়া ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে লেখা পড়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না দিলে আগামী পৃথিবীতে তারা টিকে থাকার জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে। ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি মানুষ ইন্টারনেটের উচ্চগতিও এখন প্রত্যাশা। ২০০৬ সালে দেশে প্রতি এমবিপিএস ইন্টানেটের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা, ২০০৮ সালে তা ২৭ হাজার টাকা এবং বর্তমানে তা ৬০ টাকায় নির্ধারিত হয়েছে। সে সময় দেশে মাত্র সাড়ে সাত জিবিপিএস ব্যান্ডউদথ ব্যবহৃত হতো তা বেড়ে বর্তমানে ৩৮ শত জিবিপিএস-এ উন্নীত হয়েছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।

এখন এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। ইন্টারনেট প্রযুক্তি দেশে নতুন অর্থনীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কৃষক-শ্রমিক, প্রবাসী এবং গার্মেন্টেসের কর্মীরাই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৬.৫০ লাখের মতো ফ্রিল্যান্সার আইটি তরুণ তরুণী। ইন্টারনেটকে অনেক দেশ মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছে আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার।

আমরা অনেকেই নানাভাবে শুনেছিÑকরোনাকালীন সময়ে বহু ছাত্রছাত্রীকে বাড়ি থেকে বহু দূরে গিয়ে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হয়েছে; আবার গাছের ওপর উঠেও বহু মানুষকে ক্লাস করতে হয়েছে। এগুলো ডিজিটাল বৈষম্যের কারণে তৈরি হওয়া সমস্যাগুলোর প্রতিফলন মাত্র। ডিজিটাল বৈষম্যের আরও বহু খারাপ দিক হয়তো সামনে আমরা দেখতে পাব। আমরা যদি এখনকার বড় বড় ব্যবসায় মাধ্যমগুলো দেখি, তাহলে দেখা যাবে- সেগুলোর ভালো একটা অংশ অনলাইননির্ভর হয়ে গেছে। গুগল, আমাজন, আলিবাবা, ফেসবুক প্রভৃতির কথা আমরা সবাই জানি। এসব কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে অনলাইনের ওপর নির্ভর করেই।

আমাদের দেশেও অনলাইননির্ভর কেনাকাটা শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু মানুষই এই শতকে এগিয়ে যাবে। তবে বহু মানুষ আছে, যারা প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে। এতে নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, এতে সন্দেহ নেই।

ডিজিটাল বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। ইন্টারনেট সহজলভ্য করা, প্রযুক্তি সম্পর্কিত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা, মানুষকে প্রযুক্তি-সাক্ষর হিসেবে গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপগুলো ডিজিটাল বৈষম্য রোধে ভালো ভূমিকা রাখবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যেমন দারিদ্র্য বিমোচনের সহায়ক একই সঙ্গে তা সুশাসন, গুণগত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অন্যতম কৌশল হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিতে সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে; যাতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যম সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসা।

তবে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু

সীমাবদ্ধতাও সবার সামনে আসছে। মূলত দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যারা গ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে, যাদের প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস বা সংযোগ নেই বা সেবা গ্রহণ করার জন্য যাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও দক্ষতা নেই তারা এই সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে।

বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। পাশাপাশি গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন নেই এবং ৪৯ শতাংশের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ একই সঙ্গে সেবাগুলোর সহজীকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতাও প্রয়োজনীয়। এ দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ঘাটতি রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু সম্পূর্ণ ধারণা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পরিবারের মধ্যকার যে বিভাজন আছে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামনে উঠে আসে না। যেমন পরিবারের নারী ও পুরুষের মধ্যকার বিভাজন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বয়স ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।

বর্তমান সময়ে তথ্য ও প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ যে কোন জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। তথ্যপ্রযুক্তি শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই না একই সঙ্গে তা নতুন নতুন ক্ষেত্র ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। করোনাকালে এর কিছু প্রয়োগ আমরা দেখতে পেয়েছি, যদিও তা সার্বিকভাবে ও সামগ্রিকভাবে নয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বোঝা। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ সৃষ্টি না করাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসমতা দেশের জনগণের মধ্যকার বর্তমান অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই আমাদের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সরকারি ও বেসরকারি সেবায় সবার সমান সুযোগ না পাওয়া একটি কঠিন বাস্তবতা। সরকার প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় ‘সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার’ অংশে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এখন এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে তথ্যপ্রযুক্তিকে সব জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তুলতে হবে।

পাশাপাশি কম খরচে বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নারীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

back to top