গৌতম রায়
গত বিশে সেপ্টেম্বর আনিস খানের খুনের বিচারের দাবিতে বামপন্থী ছাত্রযুবদের উদ্যোগে কলকাতা মহানগরীর বুকে অনুষ্ঠিত হলো, ‘ইনসাফ সভা’। আনিস খানের খুনি পুলিশকে শাস্তির বদলে আড়াল করে রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন। আনিস খুনের অল্প কয়েক দিন পরেই সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ সেলিম। আনিসের কবরের মাটি হাতে নিয়ে সেলিম ওয়াদা করেছিলেন, আনিস খুনের ইনসাফ নিয়ে ছাড়ব। কলকাতা মহানগরীর বুকে সেলিমের নেতৃত্বে বামপন্থী ছাত্রযুবরা আনিস খুনের বিচার চেয়ে যে জনপ্লাবন ঘটালো, ২০১১ সালে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এমন স্বতঃস্ফূর্ত বাম জনপ্লাবন কলকাতা মহানগরীর বুকে আর ঘটেনি।
মোদি-মমতার সীমাহীন দুর্নীতি এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খেলা-সেটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বভার নেয়ার শেষ মুহূর্ত থেকেই সেলিম অত্যন্ত দায়িত্বশীল পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তিনি রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম যে সাংবাদিক সম্মেলনটি করেন, সেখানে কিছু বাম ভেকধারী সাংবাদিক বিভাজনের অস্ত্রে শাণ দেয়ার তাগিদে তাকে কিছু প্রশ্ন করেন। যে বুদ্ধিমত্তা এবং অবশ্য ই শ্লেষাত্মক কৌতুকের ভেতর দিয়ে সেলিম সেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের মোকাবিলা করেছিলেন, সেখান থেকেই বোঝা গিয়েছিল; প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাসের পর দল, আদর্শ, মানুষের দাবি, অধিকারের প্রশ্ন-এসব কটিকে ঠান্ডা ঘর থেকে বের করে এনে রাজপথে-জনপদে মিছিলের মুখে পরিণত করবার হিম্মত রাখেন এই মানুষটি। বস্তুত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শারীরিক কারনে অন্তরালে চলে যাওয়ার পর শুধু বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের ভেতরেই নয়, যারা বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু দুর্নীতির সমর্থক নন, সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করেন, বিভাজনকে জীবনের নিকৃষ্ট পন্থা বলে মনে করেন-সেসব মানুষদের কাছেও জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর পরে সেলিমকে ঘিরে একটা নতুন রকমের আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। ‘ইনসাফ’ সভার দিন এমন কিছু ছাত্র যুব সেলিমের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে বলেছেন যে, তারা বামপন্থার সমর্থক নন। কিন্তু এই অরাজকতা চলতে পারে না। আপনার আন্দোলনের প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন আছে। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর পরে এভাবে বিরোধী শিবিরের সমর্থকদের কাছ থেকে নৈতিক সমর্থন পাওয়া-সেলিম ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো বামপন্থী নেতা পাননি।
‘ইনসাফ’ সভায় সেলিম কিন্তু নিজে দলের রাজ্য সম্পাদক বলে খবরদারি করেননি। গোটা বিষয়টি নিজে মনিটারিং করলেও পরিচালনার রাশ তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রযোব নেতানেত্রী মীনাক্ষী, ধ্রুব, ময়ূখ, প্রতিকুর, সৃজনদের হাতে। এটাও কিন্তু বামপন্থী যুব সংগঠনের এতবড় মিছিল, সভার একটা নতুন বিষয়। নেতৃত্বের তরফ থেকে ছাত্রযুবদের নিয়ন্ত্রণ করবার যে ‘খবরদারি’ সুলভ মানসিকতা, যেটা রাজনৈতিকভাবে অনেকেই প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, বাস্তবে জ্বলজ্বল করত, সেই প্রবণতার ন্যূনতম অনুবর্তন কিন্তু এত বড় সমাবেশ ঘিরে সেলিম করেননি। তাই বলে তিনি বা তার দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ছাত্রযুব নেতৃত্বকে প্রয়োজন মতো সঠিক বুদ্ধি জোগাননি, পরামর্শ দেননি-তা মনে করবার কোনো কারণ নেই।
আলিমুদ্দিন স্টিট থেকে দল পরিচালনা না করে বাংলার দহলিজ থেকে যথার্থ বিকেন্দ্রিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সেলিম তার সহযোগীদের নিয়ে দল পরিচালনা করছেন বলেই আজ আবার বামপন্থীরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেই নয়, গোটা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রেই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিগত প্রায় এক দশক ধরে একাংশের সংবাদমাধ্যম পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী নেতৃত্বকে শুধু পক্ককেশের মেলা বলে উপহাস করছিল। পক্ককেশ হলেই যে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, নেতৃত্ব দিতে পারবেন না বামপন্থী মহলে, আর মমতা প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে নানা ধরনের কসমেটিক, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের বয়স কম দেখিয়ে রাজনীতি করে যাবেন-এটা কখনো যুক্তির কথা হতে পারে না।
যুব সমাজের একটা বিরাট অংশ কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসকদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়েও বামপন্থী শিবিরে যথার্থ কোন নেতাকে না পেয়ে ক্রমশ রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহই হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলেন, সেই প্রজন্ম সেলিম নেতৃত্বে আসার পর আজ নতুন করে রাজনীতি সম্পর্কেই শুধু আগ্রহী হয়ে উঠছেন, তাইই নয়, রাজনীতির ময়দানে সরাসরি অবতীর্ণ হচ্ছেন। ফেসবুকে ছবি সাঁটার বদলে মিছিলে আসছেন। মিটিংয়ে আসছেন।
রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে গোটা পশ্চিমবঙ্গটা যেভাবে চষে বেড়াচ্ছেন সেলিম, বামফ্রন্ট ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেলিমের পূর্বসূরিদের কখনোই তেমনটা করতে দেখা যায়নি। ব্রিটেনের রাজনীতির মতো একটা প্রথাবদ্ধ, বিবৃতি আর ফেসবুক, টুইটার নির্ভর রাজনীতিতেই সেলিমের উত্তরসূরিরা বেশি যতœবান ছিলেন। সেখান থেকে রাজনীতিকে লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে আনা-এই কৃতিত্বেই সেলিম পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা ঘিরে একটা নতুন করে আশা ভরসা, নতুন করে প্রত্যাশার জন্ম দিতে পেরেছেন।
একজন রাজনীতিক তখনই সফল হতে পারেন, যখন তিনি রাজনীতির সমসাময়িকতা, সময়ের দাবি এবং চিরাচরিত ধারাকে অস্বীকার না করেও প্রজন্মান্তরের যে মানসিকতা, যাকে এক কথায় ‘পালস্’ বলা হয়, সেই ‘নাড়ি’র শব্দ অনুভব করতে পারেন। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন সেলিম। ভোটের ফলের নিরিখে সঙ্গীদের নিয়ে ধুতির কোঁচা নেড়ে রুচিহীন অঙ্গভঙ্গির রাজনীতির পথ দিয়ে কখনো হাঁটেননি বলেই আট থেকে আশির রাজনৈতিক নাড়ির স্পন্দন বোঝবার ‘জীবন মশাই’ (তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতনে’র মুখ্য চরিত্র) হয়ে উঠতে পেরেছেন সেলিম। বীরভূমের সেই ‘কালীগতি ডাক্তার’ যাকে মাথায় রেখেই ‘জীবন মশাই’ চরিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন তারাশঙ্কর, আজকের মানুষের রাজনৈতিক নাড়ি বোঝবার সেই ‘কালীগতি ডাক্তার’ই হলেন সেলিম।
রাজনীতির ভাষা কিন্তু আজ প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, প্রফুল্লচন্দ্র সেনদের যুগে নেই। আবার রাজনীতির ভাষা মানে তৃণমূলের সংসদ সদস্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৌগত রায়দের মতো খিস্তিখেউরও নয়। প্রমোদ দাশগুপ্ত তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, ‘বন্দুকের মুখে কনডোম বাধা থাকবে নাকি’র মতো কথাও বলেছিলেন। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, চরম খাদ্যাভাব-মানুষের যন্ত্রণাকে ব্যঙ্গ করে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে টেবিল বাজিয়ে, ‘শান্তিপুর ডুবুডুবু’ নদে ভেসে যায়- প্রফুল্লচন্দ্র সেন বলেছিলেন। হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতিকে, ‘লালা বাংলা ছেড়ে পালা’ বিমান বসু বলেছিলেন। কিন্তু মহঃ সেলিমের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাকে একটিও অসংযমী, অসংসদীয়, বিরোধীদের প্রতি ব্যক্তি আক্রমণাত্মক কথা বলতে শোনা যায়নি। এখানে সেলিমের সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে অতীতের জ্যোতি বসুর আর বর্তমানের সীতারাম ইয়েচুরির। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই চরম বিরোধীর কাছ থেকেও যে সম্মান, মর্যাদা, সমিহ সেলিম অর্জন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন, সেই পর্যায়ে বাংলার রাজনীতিতে বুদ্ধবাবু ব্যতীত সেলিমের সঙ্গে আর একমাত্র তুলনা চলে প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায়ের।
সেলিমের ভাষা কিন্তু আজকের ভাষা। শব্দচয়ন কিন্তু এই সময়ের যৌবন জলতরঙ্গের ব্যবহৃত লব্জের অনুরণন সমৃদ্ধ। তিনি অনিল বিশ্বাসের মতো থেমে থেমে কথা বলেন না। বেশ গতিময় তার কথ্যভঙ্গি। অথচ একটিও অশিষ্টাচারসূচক শব্দ তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা প্রকাশ্য জনসভায় হরবখনই যেসব শব্দ উচ্চারণ করেন, সেগুলো ছাপার অযোগ্যই শুধু নয়, বাড়ির সবার সঙ্গে বসে টেলিভিশনের পর্দায় শুনলে লজ্জায় কান লাল হয়ে ওঠে। সেখানে সেলিমের রাজনৈতিক শব্দচয়ন, কৌতুকে মোড়া সেসব শব্দের উপস্থাপনা রাজনীতি বিমুখ যুব সমাজকে রাজনীতির দিকে আকর্ষণ জাগাচ্ছে। বামপন্থীদের নীতিগত কারনে পছন্দ করেন না বা বামেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের আচার আচরণজনিত ব্যক্তিগত ক্ষোভের দ্বারা অপছন্দের তালিকায় আছে বামেরা- এমন মানুষজনদের কাছেও বামপন্থা এবং বামপন্থীর নতুন ডাইমেনশন তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছেন সেলিম।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
গত বিশে সেপ্টেম্বর আনিস খানের খুনের বিচারের দাবিতে বামপন্থী ছাত্রযুবদের উদ্যোগে কলকাতা মহানগরীর বুকে অনুষ্ঠিত হলো, ‘ইনসাফ সভা’। আনিস খানের খুনি পুলিশকে শাস্তির বদলে আড়াল করে রেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন। আনিস খুনের অল্প কয়েক দিন পরেই সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ সেলিম। আনিসের কবরের মাটি হাতে নিয়ে সেলিম ওয়াদা করেছিলেন, আনিস খুনের ইনসাফ নিয়ে ছাড়ব। কলকাতা মহানগরীর বুকে সেলিমের নেতৃত্বে বামপন্থী ছাত্রযুবরা আনিস খুনের বিচার চেয়ে যে জনপ্লাবন ঘটালো, ২০১১ সালে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এমন স্বতঃস্ফূর্ত বাম জনপ্লাবন কলকাতা মহানগরীর বুকে আর ঘটেনি।
মোদি-মমতার সীমাহীন দুর্নীতি এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খেলা-সেটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বভার নেয়ার শেষ মুহূর্ত থেকেই সেলিম অত্যন্ত দায়িত্বশীল পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তিনি রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম যে সাংবাদিক সম্মেলনটি করেন, সেখানে কিছু বাম ভেকধারী সাংবাদিক বিভাজনের অস্ত্রে শাণ দেয়ার তাগিদে তাকে কিছু প্রশ্ন করেন। যে বুদ্ধিমত্তা এবং অবশ্য ই শ্লেষাত্মক কৌতুকের ভেতর দিয়ে সেলিম সেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের মোকাবিলা করেছিলেন, সেখান থেকেই বোঝা গিয়েছিল; প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাসের পর দল, আদর্শ, মানুষের দাবি, অধিকারের প্রশ্ন-এসব কটিকে ঠান্ডা ঘর থেকে বের করে এনে রাজপথে-জনপদে মিছিলের মুখে পরিণত করবার হিম্মত রাখেন এই মানুষটি। বস্তুত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শারীরিক কারনে অন্তরালে চলে যাওয়ার পর শুধু বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের ভেতরেই নয়, যারা বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু দুর্নীতির সমর্থক নন, সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করেন, বিভাজনকে জীবনের নিকৃষ্ট পন্থা বলে মনে করেন-সেসব মানুষদের কাছেও জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর পরে সেলিমকে ঘিরে একটা নতুন রকমের আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। ‘ইনসাফ’ সভার দিন এমন কিছু ছাত্র যুব সেলিমের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে বলেছেন যে, তারা বামপন্থার সমর্থক নন। কিন্তু এই অরাজকতা চলতে পারে না। আপনার আন্দোলনের প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন আছে। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুর পরে এভাবে বিরোধী শিবিরের সমর্থকদের কাছ থেকে নৈতিক সমর্থন পাওয়া-সেলিম ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো বামপন্থী নেতা পাননি।
‘ইনসাফ’ সভায় সেলিম কিন্তু নিজে দলের রাজ্য সম্পাদক বলে খবরদারি করেননি। গোটা বিষয়টি নিজে মনিটারিং করলেও পরিচালনার রাশ তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রযোব নেতানেত্রী মীনাক্ষী, ধ্রুব, ময়ূখ, প্রতিকুর, সৃজনদের হাতে। এটাও কিন্তু বামপন্থী যুব সংগঠনের এতবড় মিছিল, সভার একটা নতুন বিষয়। নেতৃত্বের তরফ থেকে ছাত্রযুবদের নিয়ন্ত্রণ করবার যে ‘খবরদারি’ সুলভ মানসিকতা, যেটা রাজনৈতিকভাবে অনেকেই প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, বাস্তবে জ্বলজ্বল করত, সেই প্রবণতার ন্যূনতম অনুবর্তন কিন্তু এত বড় সমাবেশ ঘিরে সেলিম করেননি। তাই বলে তিনি বা তার দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ছাত্রযুব নেতৃত্বকে প্রয়োজন মতো সঠিক বুদ্ধি জোগাননি, পরামর্শ দেননি-তা মনে করবার কোনো কারণ নেই।
আলিমুদ্দিন স্টিট থেকে দল পরিচালনা না করে বাংলার দহলিজ থেকে যথার্থ বিকেন্দ্রিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সেলিম তার সহযোগীদের নিয়ে দল পরিচালনা করছেন বলেই আজ আবার বামপন্থীরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেই নয়, গোটা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রেই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিগত প্রায় এক দশক ধরে একাংশের সংবাদমাধ্যম পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী নেতৃত্বকে শুধু পক্ককেশের মেলা বলে উপহাস করছিল। পক্ককেশ হলেই যে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, নেতৃত্ব দিতে পারবেন না বামপন্থী মহলে, আর মমতা প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে নানা ধরনের কসমেটিক, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের বয়স কম দেখিয়ে রাজনীতি করে যাবেন-এটা কখনো যুক্তির কথা হতে পারে না।
যুব সমাজের একটা বিরাট অংশ কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসকদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়েও বামপন্থী শিবিরে যথার্থ কোন নেতাকে না পেয়ে ক্রমশ রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহই হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলেন, সেই প্রজন্ম সেলিম নেতৃত্বে আসার পর আজ নতুন করে রাজনীতি সম্পর্কেই শুধু আগ্রহী হয়ে উঠছেন, তাইই নয়, রাজনীতির ময়দানে সরাসরি অবতীর্ণ হচ্ছেন। ফেসবুকে ছবি সাঁটার বদলে মিছিলে আসছেন। মিটিংয়ে আসছেন।
রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে গোটা পশ্চিমবঙ্গটা যেভাবে চষে বেড়াচ্ছেন সেলিম, বামফ্রন্ট ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেলিমের পূর্বসূরিদের কখনোই তেমনটা করতে দেখা যায়নি। ব্রিটেনের রাজনীতির মতো একটা প্রথাবদ্ধ, বিবৃতি আর ফেসবুক, টুইটার নির্ভর রাজনীতিতেই সেলিমের উত্তরসূরিরা বেশি যতœবান ছিলেন। সেখান থেকে রাজনীতিকে লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে আনা-এই কৃতিত্বেই সেলিম পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা ঘিরে একটা নতুন করে আশা ভরসা, নতুন করে প্রত্যাশার জন্ম দিতে পেরেছেন।
একজন রাজনীতিক তখনই সফল হতে পারেন, যখন তিনি রাজনীতির সমসাময়িকতা, সময়ের দাবি এবং চিরাচরিত ধারাকে অস্বীকার না করেও প্রজন্মান্তরের যে মানসিকতা, যাকে এক কথায় ‘পালস্’ বলা হয়, সেই ‘নাড়ি’র শব্দ অনুভব করতে পারেন। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন সেলিম। ভোটের ফলের নিরিখে সঙ্গীদের নিয়ে ধুতির কোঁচা নেড়ে রুচিহীন অঙ্গভঙ্গির রাজনীতির পথ দিয়ে কখনো হাঁটেননি বলেই আট থেকে আশির রাজনৈতিক নাড়ির স্পন্দন বোঝবার ‘জীবন মশাই’ (তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতনে’র মুখ্য চরিত্র) হয়ে উঠতে পেরেছেন সেলিম। বীরভূমের সেই ‘কালীগতি ডাক্তার’ যাকে মাথায় রেখেই ‘জীবন মশাই’ চরিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন তারাশঙ্কর, আজকের মানুষের রাজনৈতিক নাড়ি বোঝবার সেই ‘কালীগতি ডাক্তার’ই হলেন সেলিম।
রাজনীতির ভাষা কিন্তু আজ প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, প্রফুল্লচন্দ্র সেনদের যুগে নেই। আবার রাজনীতির ভাষা মানে তৃণমূলের সংসদ সদস্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৌগত রায়দের মতো খিস্তিখেউরও নয়। প্রমোদ দাশগুপ্ত তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, ‘বন্দুকের মুখে কনডোম বাধা থাকবে নাকি’র মতো কথাও বলেছিলেন। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, চরম খাদ্যাভাব-মানুষের যন্ত্রণাকে ব্যঙ্গ করে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে টেবিল বাজিয়ে, ‘শান্তিপুর ডুবুডুবু’ নদে ভেসে যায়- প্রফুল্লচন্দ্র সেন বলেছিলেন। হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতিকে, ‘লালা বাংলা ছেড়ে পালা’ বিমান বসু বলেছিলেন। কিন্তু মহঃ সেলিমের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাকে একটিও অসংযমী, অসংসদীয়, বিরোধীদের প্রতি ব্যক্তি আক্রমণাত্মক কথা বলতে শোনা যায়নি। এখানে সেলিমের সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে অতীতের জ্যোতি বসুর আর বর্তমানের সীতারাম ইয়েচুরির। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই চরম বিরোধীর কাছ থেকেও যে সম্মান, মর্যাদা, সমিহ সেলিম অর্জন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন, সেই পর্যায়ে বাংলার রাজনীতিতে বুদ্ধবাবু ব্যতীত সেলিমের সঙ্গে আর একমাত্র তুলনা চলে প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায়ের।
সেলিমের ভাষা কিন্তু আজকের ভাষা। শব্দচয়ন কিন্তু এই সময়ের যৌবন জলতরঙ্গের ব্যবহৃত লব্জের অনুরণন সমৃদ্ধ। তিনি অনিল বিশ্বাসের মতো থেমে থেমে কথা বলেন না। বেশ গতিময় তার কথ্যভঙ্গি। অথচ একটিও অশিষ্টাচারসূচক শব্দ তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা প্রকাশ্য জনসভায় হরবখনই যেসব শব্দ উচ্চারণ করেন, সেগুলো ছাপার অযোগ্যই শুধু নয়, বাড়ির সবার সঙ্গে বসে টেলিভিশনের পর্দায় শুনলে লজ্জায় কান লাল হয়ে ওঠে। সেখানে সেলিমের রাজনৈতিক শব্দচয়ন, কৌতুকে মোড়া সেসব শব্দের উপস্থাপনা রাজনীতি বিমুখ যুব সমাজকে রাজনীতির দিকে আকর্ষণ জাগাচ্ছে। বামপন্থীদের নীতিগত কারনে পছন্দ করেন না বা বামেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের আচার আচরণজনিত ব্যক্তিগত ক্ষোভের দ্বারা অপছন্দের তালিকায় আছে বামেরা- এমন মানুষজনদের কাছেও বামপন্থা এবং বামপন্থীর নতুন ডাইমেনশন তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছেন সেলিম।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]