বশীর আহমেদ
পশ্চিম বাংলার সর্বাধিক পাঠক নন্দিত বাংলা দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকার বর্তমান প্রচারসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ কপি। অবশ্য যে সময়ের কথা এখানে বলতে চাইছি সে সময় পরিস্থিতি এমন ছিল না।
আনন্দ বাজারের পাশাপাশি ছিল জনপ্রিয় আরও একাধিক ব্রডসিটের পত্রিকা- দৈনিক যুগান্তর, কালান্তর ইত্যাদি। যদিও পাঠক প্রিয়তায় সেই ১৯২২ সালে অর্থাৎ এখন থেকে ১০০ বছর আগে আত্মপ্রকাশিত আনন্দ বাজার পরে হয়ে উঠেছিল বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী; বরেণ্য লেখক এবং কলামিস্টের পদচারণায় মুখরিত এবং প্রগতিবাদের ধারক।
অবশ্য এখনকার আনন্দ বাজারকে স্থানীয় বোদ্ধা মহল গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির একনিষ্ঠ সমর্থক বলে সমালোচনা করে থাকেন।
সে যাই হোক, বর্ণিত ওই সময়ে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এর প্রকাশক তুষার ঘোষের অতিশয় বন্ধুস্থানীয় কেউ একজন-নামটি না হয় উহ্যই থাকুক।
তো, নীতিগত অথবা ব্যক্তিত্বের টানাপোড়েন-যাই হোক না কেন, হঠাৎ করে সম্পাদক মহাশয় এক দিন পদত্যাগ করে বসলেন।
ওদের দুজনার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে ওয়াকেবহাল ঘনিষ্ট মহল অনেক সুলুক সন্ধান করেও পদত্যাগের কোন কারণ খুঁজে পেলেন না। এ নিয়ে চললো চারিদিকে কানাঘুষা; ওঁরা দুজনাও যেন মুখে কুলুপ এঁটেই বসে থাকলেন। এভাবে কেটে গেল কিছুদিন।
এরই মধ্যে এক দিন সকালে ঘুম ভেঙে সবাই পত্রিকা মারফত জানলেন, সেই পদত্যাগী সম্পাদক মহাশয় যুগান্তর পত্রিকায় একই পদে যোগ দিয়েছেন। এরও বেশ কিছুদিন পর এক দুঁদে সাংবাদিকের প্রশ্নবাণে বেকায়দায় পড়ে আলোচিত সম্পাদক মহাশয় মুখ খুললেন।
‘আপনি অমন জনপ্রিয় পাঠকধন্য পত্রিকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় পত্রিকায় কেন এলেন’-এমন বেয়াড়া প্রশ্নে ধরাশায়ী সম্পাদক প্রথম পাবলিকলী জানালেন, ‘সবাই জানেন, গণবধূরা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে থাকেন; দুর্ভাগ্যবশত যদিও সমাজে তাদের কোন সম্মান নেই। পক্ষান্তরে গৃহবধূদের জনপ্রিয়তা অল্প যদিও, তথাপি তাদের সম্মান কিন্তু আকাশ ছোঁয়া। সুতরাং জনপ্রিয়তাই সব নয়, সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন মৌলিক বিষয়, কে কোন পথে হাঁটবেন।’
হ্যাঁ, সম্মান আর জনপ্রিয়তা এক সমানে পথ চলে না।
এই যে লেখালেখি, এ নিছক লেখা নয়; নিরেট সৃষ্টি। এই সৃষ্টি এবং তার প্রসব বেদনার রয়েছে নানা রকমফের। কেউ পথ চলতে হাসতে হাসতে সৃষ্টি করেন; কারও লাগে স্বস্তিকর পরিবেশ। সৃষ্টিকালে কেউ হোন ঘনঘন সিগারেটপায়ী; কেউ আবার তরলের সমঝদার। বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক কিষনচন্দর দামী কলম এবং রাইটিং প্যাড না হলে লিখতেন না। কাজী নজরুল ইসলাম পানের ডিব্বা, চুন-সুপারী এবং কেটলি ভর্তি চা নিয়ে কক্ষে ঢুকতেন; তালাবদ্ধ কক্ষের অর্গল খুললে পাওয়া যেতো অসাধারণ সব কবিতা ও গানের স্তূপ।
শোনা যায়, হুমায়ুন আহমেদ একরাতে লিখেছিলেন আস্ত এক উপন্যাস। এই লেখক শ্রেণীর কেউ কেউ রাত গভীর না হলে লেখার মুডে আসেন না। কারো আবার লেখার সময় ভোররাতে বা অরুণোদয় অন্তে। কারো লেখার জন্য দরকার শান্ত সমাহিত পরিবেশ; কারও আবার হই চই-এর ভেতরও তাল বিগড়োয় না। এই বিচিত্রতার কোন শেষ নেই।
সুদীর্ঘকাল পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বাসায় গেলে দেখতাম, ওনাদের মধ্যম ছেলেটি পড়ার সময় বই হাতে করে হেঁটে বেড়াত। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, সে ছোটবেলা থেকেই অমন; টেবিলে বসলে নাকি তার পড়া মনে থাকে না।
পঁচাত্তরে রাবি ক্যাম্পাসে এক সৃষ্টিছাড়া জিনিয়াস দেখেছি, যেন বৈচিত্র্যের সেরা এক বিচিত্রতার নমুনা তিনি। হাঁটতে হাঁটতেই রচনা করতেন অনবদ্য সাহিত্য। বসতি ছিল ওঁর রাজশাহী নগরীর সাগরপাড়ায় এক মেসে। কখনো পকেট শূন্য থাকলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন বাসের মাত্র ৫০ পয়সা ভাড়ার জন্য শহর রক্ষা বাঁধ ধরে পায়ে হেঁটে যেতেন তালাইমারি, অতঃপর রাজশাহী প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় পেরিয়ে রাবি ক্যাম্পাসে। বিনা ভাড়ায় তবু রাবির সহজ গণপরিবহনে উঠতেন না। একদিন তাৎক্ষণিক কবিতা উৎপাদনের জন্য চেপে ধরলে হাঁটার মধ্যেই জন্ম দিলেন-
‘নামটি আমার হরিপদ/ পদে পদে ঘোর বিপদ-/কখনো থাকি আমির আলী হলে/ কখনো থাকি গাছতলাতে/ এই কথা কি বলা চলে?’
এই না শুনে শ্রোতৃম-লীর দে মারকাট হাততালি; অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনে জম্পেশ চা সিঙ্গারা উৎসব।
লেখা সৃষ্টির উর্বর জমিনে চাষবাস এমনই; সেই জমিনের যিনি পরিশ্রমী কর্ষক তিনিই শুধু জানেন ক্যামনে প্রডাকশানটিকে এই দুনিয়ার আলো দেখনো গেল।
প্রয়াত সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে একদা এই লেখালেখি জন্মদানের শানে-নজুল জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি এর গোপন রহস্য কিছুতেই বলতে চাননি। কিন্তু নাম না জানা নাছোড়বান্দা সুরসিকা নারী প্রশ্নকারীর পুনঃপৌণিক/// তাগাদায় মুজতবা আলী তার স্বভাবসুলভ রসিকতা ঢেলে নাকি বলেছিলেন-হ্যাঁ, এটা এক রহস্যই বটে। দেখুন, আমরা সন্তান জন্মদাতারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিগুলো দেখাতে পারি। কিন্তু ওদের জন্মদান প্রক্রিয়াটা কখনো সবিস্তারে দেখাতে পারি না। বলুন তো, সেটা পারি কি?
এই উত্তর শুনে সেই নারী প্রশ্নকারীর মুখাবয়ব কেমন বর্ণ ধারণ করেছিল সেটা অবশ্য তিনি কখনো আর খোলাসা করে বলে যাননি।
[লেখক : সাংবাদিক]
বশীর আহমেদ
রোববার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
পশ্চিম বাংলার সর্বাধিক পাঠক নন্দিত বাংলা দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকার বর্তমান প্রচারসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ কপি। অবশ্য যে সময়ের কথা এখানে বলতে চাইছি সে সময় পরিস্থিতি এমন ছিল না।
আনন্দ বাজারের পাশাপাশি ছিল জনপ্রিয় আরও একাধিক ব্রডসিটের পত্রিকা- দৈনিক যুগান্তর, কালান্তর ইত্যাদি। যদিও পাঠক প্রিয়তায় সেই ১৯২২ সালে অর্থাৎ এখন থেকে ১০০ বছর আগে আত্মপ্রকাশিত আনন্দ বাজার পরে হয়ে উঠেছিল বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী; বরেণ্য লেখক এবং কলামিস্টের পদচারণায় মুখরিত এবং প্রগতিবাদের ধারক।
অবশ্য এখনকার আনন্দ বাজারকে স্থানীয় বোদ্ধা মহল গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির একনিষ্ঠ সমর্থক বলে সমালোচনা করে থাকেন।
সে যাই হোক, বর্ণিত ওই সময়ে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এর প্রকাশক তুষার ঘোষের অতিশয় বন্ধুস্থানীয় কেউ একজন-নামটি না হয় উহ্যই থাকুক।
তো, নীতিগত অথবা ব্যক্তিত্বের টানাপোড়েন-যাই হোক না কেন, হঠাৎ করে সম্পাদক মহাশয় এক দিন পদত্যাগ করে বসলেন।
ওদের দুজনার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে ওয়াকেবহাল ঘনিষ্ট মহল অনেক সুলুক সন্ধান করেও পদত্যাগের কোন কারণ খুঁজে পেলেন না। এ নিয়ে চললো চারিদিকে কানাঘুষা; ওঁরা দুজনাও যেন মুখে কুলুপ এঁটেই বসে থাকলেন। এভাবে কেটে গেল কিছুদিন।
এরই মধ্যে এক দিন সকালে ঘুম ভেঙে সবাই পত্রিকা মারফত জানলেন, সেই পদত্যাগী সম্পাদক মহাশয় যুগান্তর পত্রিকায় একই পদে যোগ দিয়েছেন। এরও বেশ কিছুদিন পর এক দুঁদে সাংবাদিকের প্রশ্নবাণে বেকায়দায় পড়ে আলোচিত সম্পাদক মহাশয় মুখ খুললেন।
‘আপনি অমন জনপ্রিয় পাঠকধন্য পত্রিকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় পত্রিকায় কেন এলেন’-এমন বেয়াড়া প্রশ্নে ধরাশায়ী সম্পাদক প্রথম পাবলিকলী জানালেন, ‘সবাই জানেন, গণবধূরা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে থাকেন; দুর্ভাগ্যবশত যদিও সমাজে তাদের কোন সম্মান নেই। পক্ষান্তরে গৃহবধূদের জনপ্রিয়তা অল্প যদিও, তথাপি তাদের সম্মান কিন্তু আকাশ ছোঁয়া। সুতরাং জনপ্রিয়তাই সব নয়, সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন মৌলিক বিষয়, কে কোন পথে হাঁটবেন।’
হ্যাঁ, সম্মান আর জনপ্রিয়তা এক সমানে পথ চলে না।
এই যে লেখালেখি, এ নিছক লেখা নয়; নিরেট সৃষ্টি। এই সৃষ্টি এবং তার প্রসব বেদনার রয়েছে নানা রকমফের। কেউ পথ চলতে হাসতে হাসতে সৃষ্টি করেন; কারও লাগে স্বস্তিকর পরিবেশ। সৃষ্টিকালে কেউ হোন ঘনঘন সিগারেটপায়ী; কেউ আবার তরলের সমঝদার। বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক কিষনচন্দর দামী কলম এবং রাইটিং প্যাড না হলে লিখতেন না। কাজী নজরুল ইসলাম পানের ডিব্বা, চুন-সুপারী এবং কেটলি ভর্তি চা নিয়ে কক্ষে ঢুকতেন; তালাবদ্ধ কক্ষের অর্গল খুললে পাওয়া যেতো অসাধারণ সব কবিতা ও গানের স্তূপ।
শোনা যায়, হুমায়ুন আহমেদ একরাতে লিখেছিলেন আস্ত এক উপন্যাস। এই লেখক শ্রেণীর কেউ কেউ রাত গভীর না হলে লেখার মুডে আসেন না। কারো আবার লেখার সময় ভোররাতে বা অরুণোদয় অন্তে। কারো লেখার জন্য দরকার শান্ত সমাহিত পরিবেশ; কারও আবার হই চই-এর ভেতরও তাল বিগড়োয় না। এই বিচিত্রতার কোন শেষ নেই।
সুদীর্ঘকাল পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বাসায় গেলে দেখতাম, ওনাদের মধ্যম ছেলেটি পড়ার সময় বই হাতে করে হেঁটে বেড়াত। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, সে ছোটবেলা থেকেই অমন; টেবিলে বসলে নাকি তার পড়া মনে থাকে না।
পঁচাত্তরে রাবি ক্যাম্পাসে এক সৃষ্টিছাড়া জিনিয়াস দেখেছি, যেন বৈচিত্র্যের সেরা এক বিচিত্রতার নমুনা তিনি। হাঁটতে হাঁটতেই রচনা করতেন অনবদ্য সাহিত্য। বসতি ছিল ওঁর রাজশাহী নগরীর সাগরপাড়ায় এক মেসে। কখনো পকেট শূন্য থাকলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন বাসের মাত্র ৫০ পয়সা ভাড়ার জন্য শহর রক্ষা বাঁধ ধরে পায়ে হেঁটে যেতেন তালাইমারি, অতঃপর রাজশাহী প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় পেরিয়ে রাবি ক্যাম্পাসে। বিনা ভাড়ায় তবু রাবির সহজ গণপরিবহনে উঠতেন না। একদিন তাৎক্ষণিক কবিতা উৎপাদনের জন্য চেপে ধরলে হাঁটার মধ্যেই জন্ম দিলেন-
‘নামটি আমার হরিপদ/ পদে পদে ঘোর বিপদ-/কখনো থাকি আমির আলী হলে/ কখনো থাকি গাছতলাতে/ এই কথা কি বলা চলে?’
এই না শুনে শ্রোতৃম-লীর দে মারকাট হাততালি; অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনে জম্পেশ চা সিঙ্গারা উৎসব।
লেখা সৃষ্টির উর্বর জমিনে চাষবাস এমনই; সেই জমিনের যিনি পরিশ্রমী কর্ষক তিনিই শুধু জানেন ক্যামনে প্রডাকশানটিকে এই দুনিয়ার আলো দেখনো গেল।
প্রয়াত সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে একদা এই লেখালেখি জন্মদানের শানে-নজুল জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি এর গোপন রহস্য কিছুতেই বলতে চাননি। কিন্তু নাম না জানা নাছোড়বান্দা সুরসিকা নারী প্রশ্নকারীর পুনঃপৌণিক/// তাগাদায় মুজতবা আলী তার স্বভাবসুলভ রসিকতা ঢেলে নাকি বলেছিলেন-হ্যাঁ, এটা এক রহস্যই বটে। দেখুন, আমরা সন্তান জন্মদাতারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিগুলো দেখাতে পারি। কিন্তু ওদের জন্মদান প্রক্রিয়াটা কখনো সবিস্তারে দেখাতে পারি না। বলুন তো, সেটা পারি কি?
এই উত্তর শুনে সেই নারী প্রশ্নকারীর মুখাবয়ব কেমন বর্ণ ধারণ করেছিল সেটা অবশ্য তিনি কখনো আর খোলাসা করে বলে যাননি।
[লেখক : সাংবাদিক]