ডোরিন চৌধুরি
পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। এতে কেএনএফ পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। অভিযানের ফলে কেএনএফ তার শক্তি হারালেও তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি সরব মিডিয়া উপস্থিতি বজায় রাখছে। অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলও উদ্বুত পরিস্থিতিকে পুঁজি করে অপপ্রচারে নিয়োজিত রয়েছে।
কয়েক মাস আগেও কেএনএফকে একটি ক্ষুদ্র সংগঠন বলে মনে করা হতো। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে কেএনএফ দ্রুত বড় হচ্ছে। এই মুহূর্তে কেএনএফ একটি অত্যন্ত সংগঠিত সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর দুটি শাখা রয়েছে- সশস্ত্র শাখা, যা কেএনএ নামে পরিচিত এবং রাজনৈতিক শাখা, যা কেএনএফ নামে পরিচিত।
কেএনএফ প্রথম নজরে আসে কয়েকজন চাকমা নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এছাড়া চাঁদাবাজির মতো নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডেও জড়িয়েছে সংগঠনটির নাম। সম্প্রতি বাংলাদেশ কেএনএফের একটি নতুন কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে, যা এদেশে প্রায় অভূতপূর্ব। কেএনএফ একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করছে। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল শারকিয়াকে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ। কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সংঘাতপ্রবণ অঞ্চল। এটি তিনটি দেশ- ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মধ্যে একটি জটিল সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এখানে অনেক উপজাতি বাস করে। এসব সম্প্রদায়ের একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং অনেক সম্প্রদায় তিনটি দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- মিজো সম্প্রদায় আরাকানের রাখাইন সম্প্রদায়কে তাদের জাতিগত ভাই হিসেবে বিবেচনা করে। আবার কুকি-চিন এবং মিজোও একে অপরের খুব কাছাকাছি। ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে কুকি-চিন এবং মিজো জনসংখ্যা রয়েছে। বাংলাদেশে এরা ‘বম’ নামে পরিচিত।
তিন দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করা এই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- মিজোরামভিত্তিক জো রিইউনিফিকেশন অর্গানাইজেশনের (জোরো) নাম। সংগঠনটি তিনটি দেশের কুকি-চীন-মিজো সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করার জন্য কাজ করে থাকে।
সেনা অভিযানের কারণে আপাতত কেএনএফের পিছু হটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই; কিন্তু মনে হচ্ছে কেএনএফ এত সহজে হাল ছাড়বে না। যেহেতু কুকি-চীন এবং মিজো সম্প্রদায় ভারত এবং মায়ানমার উভয় দেশেই বসবাস করে, তাই সেখানেও কেএনএফ শাখা খোলার চেষ্টা করতে পারে এমন প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও তাদের দুর্গম আবাসস্থল, মূলধারার কেএনএফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমাগত প্রোপাগান্ডা প্রচার করছে। অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলও এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পরিস্থিতিকে পুঁজি করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কেএনএফের একটি ট্রান্সন্যাশনাল বা আন্তঃদেশীয় সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাই এটি কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত ও মায়ানমারের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এ দেশগুলোর সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো তথা- মিজোরাম এবং চীন রাজ্য ইতোমধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যা মোকাবেলা করছে। একটি নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের আগমন শুধু সমস্যা বাড়িয়েই দেবে।
যেহেতু কেএনএফের কার্যক্রম আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে- ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের এটিকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে অস্ত্র ও মাদক পাচার এবং অন্যান্য অপরাধেরও সমীকরণ রয়েছে। তাছাড়া জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কেএনএফের ব্যবসায়িক সংযোগও সবার জন্যই উদ্বেগজনক। তাই দেশগুলোর জন্য এ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ মোকাবেলার সময় এসেছে।
[লেখক : ডক্টরাল গবেষক, গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]
ডোরিন চৌধুরি
সোমবার, ২৮ নভেম্বর ২০২২
পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। এতে কেএনএফ পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। অভিযানের ফলে কেএনএফ তার শক্তি হারালেও তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি সরব মিডিয়া উপস্থিতি বজায় রাখছে। অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলও উদ্বুত পরিস্থিতিকে পুঁজি করে অপপ্রচারে নিয়োজিত রয়েছে।
কয়েক মাস আগেও কেএনএফকে একটি ক্ষুদ্র সংগঠন বলে মনে করা হতো। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে কেএনএফ দ্রুত বড় হচ্ছে। এই মুহূর্তে কেএনএফ একটি অত্যন্ত সংগঠিত সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর দুটি শাখা রয়েছে- সশস্ত্র শাখা, যা কেএনএ নামে পরিচিত এবং রাজনৈতিক শাখা, যা কেএনএফ নামে পরিচিত।
কেএনএফ প্রথম নজরে আসে কয়েকজন চাকমা নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এছাড়া চাঁদাবাজির মতো নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডেও জড়িয়েছে সংগঠনটির নাম। সম্প্রতি বাংলাদেশ কেএনএফের একটি নতুন কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে, যা এদেশে প্রায় অভূতপূর্ব। কেএনএফ একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করছে। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল শারকিয়াকে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ। কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সংঘাতপ্রবণ অঞ্চল। এটি তিনটি দেশ- ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মধ্যে একটি জটিল সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এখানে অনেক উপজাতি বাস করে। এসব সম্প্রদায়ের একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং অনেক সম্প্রদায় তিনটি দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- মিজো সম্প্রদায় আরাকানের রাখাইন সম্প্রদায়কে তাদের জাতিগত ভাই হিসেবে বিবেচনা করে। আবার কুকি-চিন এবং মিজোও একে অপরের খুব কাছাকাছি। ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে কুকি-চিন এবং মিজো জনসংখ্যা রয়েছে। বাংলাদেশে এরা ‘বম’ নামে পরিচিত।
তিন দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করা এই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- মিজোরামভিত্তিক জো রিইউনিফিকেশন অর্গানাইজেশনের (জোরো) নাম। সংগঠনটি তিনটি দেশের কুকি-চীন-মিজো সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করার জন্য কাজ করে থাকে।
সেনা অভিযানের কারণে আপাতত কেএনএফের পিছু হটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই; কিন্তু মনে হচ্ছে কেএনএফ এত সহজে হাল ছাড়বে না। যেহেতু কুকি-চীন এবং মিজো সম্প্রদায় ভারত এবং মায়ানমার উভয় দেশেই বসবাস করে, তাই সেখানেও কেএনএফ শাখা খোলার চেষ্টা করতে পারে এমন প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও তাদের দুর্গম আবাসস্থল, মূলধারার কেএনএফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমাগত প্রোপাগান্ডা প্রচার করছে। অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলও এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পরিস্থিতিকে পুঁজি করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কেএনএফের একটি ট্রান্সন্যাশনাল বা আন্তঃদেশীয় সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাই এটি কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত ও মায়ানমারের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এ দেশগুলোর সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো তথা- মিজোরাম এবং চীন রাজ্য ইতোমধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যা মোকাবেলা করছে। একটি নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের আগমন শুধু সমস্যা বাড়িয়েই দেবে।
যেহেতু কেএনএফের কার্যক্রম আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে- ভারত, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের এটিকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে অস্ত্র ও মাদক পাচার এবং অন্যান্য অপরাধেরও সমীকরণ রয়েছে। তাছাড়া জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কেএনএফের ব্যবসায়িক সংযোগও সবার জন্যই উদ্বেগজনক। তাই দেশগুলোর জন্য এ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ মোকাবেলার সময় এসেছে।
[লেখক : ডক্টরাল গবেষক, গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]