alt

উপ-সম্পাদকীয়

সমাজ গঠনের এক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: শুক্রবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২২

বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মাণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সহননশীল সমাজ। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের যেমন প্রয়োজনীয়তা আছে, তেমনি কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, চামার ঝাড়ুদার, দর্জি ও কুটির শিল্পীরও প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রত্যেকেই আমরা প্রত্যেকের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য জাতিগত কুসংস্কার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি ভুলে গিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে।

সব শ্রেণীর ও পেশার মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দুর্বল ভাবলে চলবে না। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও সমঅধিকার দিয়েছে। সমাজে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিতে হবে। এজন্য শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সংগঠন তথা রাষ্ট্রের প্রয়োজন। আধুনিক জীবনযাপনের জন্য সব ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকবে। পরিবেশের উন্নয়ন হবে। মানুষের জীবনে শান্তি থাকবে। নরডিক দেশগুলোতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু আত্মহত্যার হার বেশি। তার মানে- মানুষের মধ্যে হতাশা বেশি। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত। এখানে কুসংস্কার থাকবে না। তাই যে কোন সরকারকেই উদারপন্থি গণতান্ত্রিক হতে হবে।

স্বাধীনতা লাভের পর ৫২ বছর অতিক্রম হতে চলছে- কিন্তু গণতন্ত্র আমাদের দেশে অসুস্থতায় ভুগছে। বাংলাদেশে ব্যক্তি বা দলীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় মিশ্র সাফল্য লক্ষণীয়। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেখানে বড় মাপের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার প্রতি তেমন কোনো উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না। সিভিল সমাজের ভূমিকাও প্রশ্নবোধক। তারা মূলত আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রবক্তা এবং দলীয়করণের দোষে দুষ্ট। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের ভাগ্য বাংলাদেশে এখনো তেমন সুপ্রসন্ন নয়। গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্তর্নিহিত বীজ উদারনীতির বিকাশমান ধারাতে বিদ্যমান থাকে। গুরুত্বের বিচারে উদারনীতির ভূমিকাকে লঘু ভাবা যায় না। একে অপরের প্রতি উদার না হলে নাগরিক সমাজে নানা মতের প্রসার ঘটে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ভিন্নমত মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়।

উদারবাদী মানসিকতা সমাজে এমনিতেই জন্ম নেয় না। তার বিকাশে সর্বজনীন শিক্ষার বিকাশ, মুক্ত মনের প্রসার, জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকেও উপেক্ষা করা যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষে নানা আইন প্রবর্তন করে উদারনীতির প্রসার ঘটানো সম্ভব হলেও সেসব উদ্যোগ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বর্তমানে হয় অনুপস্থিত নতুবা পুরোমাত্রায় নেই। উদারনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা প্রায় বলা হয়। মধ্যবিত্ত বলতে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী গোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বোঝানো হলেও বাংলাদেশে তাদের অবদান প্রশ্নসাপেক্ষ। সিভিল সমাজ নামে যারা রাষ্ট্র বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলেন এবং গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে যারা পরিচিত তাদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান পরিহার করে তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিচার করতে অভ্যস্ত নন। সিভিল সমাজের মধ্যে অনেকে নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদী কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় পর্যায়ে ওই কেন্দ্রের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তারা গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু তাদের বক্তব্য বা নীতিগত অবস্থানের প্রতি মানুষের তেমন কোনো আস্থা নেই। সে কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এর সূচনা। সদ্য স্বাধীন দেশে সমাজে উগ্রপন্থার বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। অথচ দলটির প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোকাবহ হত্যাকান্ডের আগে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল জাসদ। আবার জাসদের সশস্ত্র অঙ্গ-সংগঠন গণবাহিনীকে ঠেকাতে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করেছিল রাষ্ট্রীয় রক্ষীবাহিনী। অন্যদিকে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিও হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছিল। সিরাজ শিকদার গ্রেপ্তার হয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পরও কয়েক দশক দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল দলটি।

দেশ ও জনগণ কি অসাধু আমলা ও রাজনীতির দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি? বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কামনা হওয়া কি অযৌক্তিক? বৈষম্যমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ গঠনে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে অন্তত ১৭টি ক্যু চেষ্টা, অতঃপর তার হত্যাকান্ড এবং এর কিছুকাল পরই জেনারেল এইচএম এরশাদের প্রলম্বিত সামরিক শাসনেও কমবেশি উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে দেশে। এক সময় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বলতে বোঝাতো বোম-ককটেল ফাটিয়ে জনসনে ভীতি সঞ্চার করা কিংবা যানবাহন ভাংচুর ও রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকে। গত প্রায় এক দশকের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতার চরিত্র বদলে গেছে মৌলিকভাবে। বোমাবাজি করে ভয় দেখানো ছাড়াও এখন বেড়েছে টার্গেট কিলিং বা বেছে বেছে হত্যা। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং তা ঠেকাতে আন্দোলনে নেমেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তখন গাড়িতে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণসহ নাশকতার নানা ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে অনেক মানুষের।

দার্শনিক এরিস্টটলের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্রে সব মানুষ ও সমাজের নিরাপদ, সুখী ও সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা থাকার কথা ছিল। কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকের রাষ্ট্রের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার শর্ত তো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কখনো দেয়নি। বিলুপ্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভিন্নমতাবলম্বীদের অস্তিত্ব ইতিহাস দেখেছে কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে আজকে নিয়ন্ত্রণবাদীরা বিলুপ্ত। এক সময় ওই সব নিয়ন্ত্রণবাদীই ধর্মকে আফিম বলে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করে নতুন মাদক ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করেছিল। জনগণের মাঝে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার জন্য সমাজতন্ত্র নামে আরেক বটিকা চালু করেছিল ওই সময়কার নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা।

আজকে ইতিহাস সাক্ষী দেয় শেষপর্যন্ত ধর্মই নিয়ন্ত্রণবাদীদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে মুক্ত করে। সারা বিশ্বে এখন কোনো খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়েই ছুটে যাবেন গির্জায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত তো প্রকাশ্যেই হিন্দু রাষ্ট্র যেখানে ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। আসাম থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে অহিন্দুদের। অপর পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে ধর্মীয় কারণে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্য নেই। কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। তবে ধর্মের নামে গোঁড়ামিকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু ধর্মান্ধকে কেউ নিষিদ্ধও করে না। রাষ্ট্র ধর্মহীন নাস্তিক ও ধর্মান্ধতাকে একসঙ্গে তাদের অধিকার ভোগ করা নিশ্চিত রাখে। যার ফলে রাষ্ট্র নিরাপদ থাকে এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে।

নিয়ন্ত্রিত বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে জঙ্গিবাদের জন্ম হবেই; যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমনকি নিয়ন্ত্রিত বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে যাদের জঙ্গি দমনে নিয়োজিত করা হয় একদিন সময়ের প্রবাহে তারাই রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে যায়, যার বহু প্রমাণ বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এ পর্যন্ত বিবৃত লেখার প্রেক্ষিতে পাঠক সাধারণের মধ্যে কতিপয় জিজ্ঞাসা উদ্ভব হবে, যেমন- বৈষম্যমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠা কিভাবে সম্ভব? বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠনে রাজনৈতিক সহিংসতা কি বড় চ্যালেঞ্জ?

দেশ ও জনগণ কি অসাধু আমলা ও রাজনীতির দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি? বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কামনা হওয়া কি অযৌক্তিক? বৈষম্যমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ গঠনে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? উপরিউক্ত জিজ্ঞাসার সদুত্তর জনগণ অন্ততঃপক্ষে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আশা করে। যদিও জনগণের একটি অংশ এমনটাই মনে করেন যে, তার সরকারের কাছেই জনগণ নিরাপদ। কাজেই এ আশার গুড়েবালি হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকারাচ্ছন্নময়। সরকার একটি সহনশীল, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিয়ে সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে তার মহিমাকে বিশ্বের কাছে প্রতিভাত করে তুলবে- নতুন প্রজন্ম এটাই প্রত্যাশা করে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সমাজ গঠনের এক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

শুক্রবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২২

বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মাণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সহননশীল সমাজ। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের যেমন প্রয়োজনীয়তা আছে, তেমনি কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, চামার ঝাড়ুদার, দর্জি ও কুটির শিল্পীরও প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রত্যেকেই আমরা প্রত্যেকের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য জাতিগত কুসংস্কার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি ভুলে গিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে।

সব শ্রেণীর ও পেশার মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দুর্বল ভাবলে চলবে না। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ও সমঅধিকার দিয়েছে। সমাজে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিতে হবে। এজন্য শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সংগঠন তথা রাষ্ট্রের প্রয়োজন। আধুনিক জীবনযাপনের জন্য সব ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকবে। পরিবেশের উন্নয়ন হবে। মানুষের জীবনে শান্তি থাকবে। নরডিক দেশগুলোতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু আত্মহত্যার হার বেশি। তার মানে- মানুষের মধ্যে হতাশা বেশি। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত। এখানে কুসংস্কার থাকবে না। তাই যে কোন সরকারকেই উদারপন্থি গণতান্ত্রিক হতে হবে।

স্বাধীনতা লাভের পর ৫২ বছর অতিক্রম হতে চলছে- কিন্তু গণতন্ত্র আমাদের দেশে অসুস্থতায় ভুগছে। বাংলাদেশে ব্যক্তি বা দলীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় মিশ্র সাফল্য লক্ষণীয়। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেখানে বড় মাপের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার প্রতি তেমন কোনো উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না। সিভিল সমাজের ভূমিকাও প্রশ্নবোধক। তারা মূলত আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রবক্তা এবং দলীয়করণের দোষে দুষ্ট। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের ভাগ্য বাংলাদেশে এখনো তেমন সুপ্রসন্ন নয়। গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্তর্নিহিত বীজ উদারনীতির বিকাশমান ধারাতে বিদ্যমান থাকে। গুরুত্বের বিচারে উদারনীতির ভূমিকাকে লঘু ভাবা যায় না। একে অপরের প্রতি উদার না হলে নাগরিক সমাজে নানা মতের প্রসার ঘটে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ভিন্নমত মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়।

উদারবাদী মানসিকতা সমাজে এমনিতেই জন্ম নেয় না। তার বিকাশে সর্বজনীন শিক্ষার বিকাশ, মুক্ত মনের প্রসার, জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকেও উপেক্ষা করা যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষে নানা আইন প্রবর্তন করে উদারনীতির প্রসার ঘটানো সম্ভব হলেও সেসব উদ্যোগ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বর্তমানে হয় অনুপস্থিত নতুবা পুরোমাত্রায় নেই। উদারনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা প্রায় বলা হয়। মধ্যবিত্ত বলতে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী গোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বোঝানো হলেও বাংলাদেশে তাদের অবদান প্রশ্নসাপেক্ষ। সিভিল সমাজ নামে যারা রাষ্ট্র বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলেন এবং গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে যারা পরিচিত তাদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান পরিহার করে তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিচার করতে অভ্যস্ত নন। সিভিল সমাজের মধ্যে অনেকে নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদী কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় পর্যায়ে ওই কেন্দ্রের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তারা গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু তাদের বক্তব্য বা নীতিগত অবস্থানের প্রতি মানুষের তেমন কোনো আস্থা নেই। সে কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এর সূচনা। সদ্য স্বাধীন দেশে সমাজে উগ্রপন্থার বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। অথচ দলটির প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোকাবহ হত্যাকান্ডের আগে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল জাসদ। আবার জাসদের সশস্ত্র অঙ্গ-সংগঠন গণবাহিনীকে ঠেকাতে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করেছিল রাষ্ট্রীয় রক্ষীবাহিনী। অন্যদিকে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিও হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছিল। সিরাজ শিকদার গ্রেপ্তার হয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পরও কয়েক দশক দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল দলটি।

দেশ ও জনগণ কি অসাধু আমলা ও রাজনীতির দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি? বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কামনা হওয়া কি অযৌক্তিক? বৈষম্যমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ গঠনে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে অন্তত ১৭টি ক্যু চেষ্টা, অতঃপর তার হত্যাকান্ড এবং এর কিছুকাল পরই জেনারেল এইচএম এরশাদের প্রলম্বিত সামরিক শাসনেও কমবেশি উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে দেশে। এক সময় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বলতে বোঝাতো বোম-ককটেল ফাটিয়ে জনসনে ভীতি সঞ্চার করা কিংবা যানবাহন ভাংচুর ও রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকে। গত প্রায় এক দশকের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতার চরিত্র বদলে গেছে মৌলিকভাবে। বোমাবাজি করে ভয় দেখানো ছাড়াও এখন বেড়েছে টার্গেট কিলিং বা বেছে বেছে হত্যা। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং তা ঠেকাতে আন্দোলনে নেমেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তখন গাড়িতে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণসহ নাশকতার নানা ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে অনেক মানুষের।

দার্শনিক এরিস্টটলের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্রে সব মানুষ ও সমাজের নিরাপদ, সুখী ও সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা থাকার কথা ছিল। কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকের রাষ্ট্রের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার শর্ত তো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কখনো দেয়নি। বিলুপ্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভিন্নমতাবলম্বীদের অস্তিত্ব ইতিহাস দেখেছে কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে আজকে নিয়ন্ত্রণবাদীরা বিলুপ্ত। এক সময় ওই সব নিয়ন্ত্রণবাদীই ধর্মকে আফিম বলে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করে নতুন মাদক ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করেছিল। জনগণের মাঝে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার জন্য সমাজতন্ত্র নামে আরেক বটিকা চালু করেছিল ওই সময়কার নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা।

আজকে ইতিহাস সাক্ষী দেয় শেষপর্যন্ত ধর্মই নিয়ন্ত্রণবাদীদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে মুক্ত করে। সারা বিশ্বে এখন কোনো খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়েই ছুটে যাবেন গির্জায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত তো প্রকাশ্যেই হিন্দু রাষ্ট্র যেখানে ধর্মীয় কারণে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। আসাম থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে অহিন্দুদের। অপর পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে ধর্মীয় কারণে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্য নেই। কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। তবে ধর্মের নামে গোঁড়ামিকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু ধর্মান্ধকে কেউ নিষিদ্ধও করে না। রাষ্ট্র ধর্মহীন নাস্তিক ও ধর্মান্ধতাকে একসঙ্গে তাদের অধিকার ভোগ করা নিশ্চিত রাখে। যার ফলে রাষ্ট্র নিরাপদ থাকে এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে।

নিয়ন্ত্রিত বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে জঙ্গিবাদের জন্ম হবেই; যা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমনকি নিয়ন্ত্রিত বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে যাদের জঙ্গি দমনে নিয়োজিত করা হয় একদিন সময়ের প্রবাহে তারাই রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে যায়, যার বহু প্রমাণ বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এ পর্যন্ত বিবৃত লেখার প্রেক্ষিতে পাঠক সাধারণের মধ্যে কতিপয় জিজ্ঞাসা উদ্ভব হবে, যেমন- বৈষম্যমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ প্রতিষ্ঠা কিভাবে সম্ভব? বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠনে রাজনৈতিক সহিংসতা কি বড় চ্যালেঞ্জ?

দেশ ও জনগণ কি অসাধু আমলা ও রাজনীতির দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি? বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কামনা হওয়া কি অযৌক্তিক? বৈষম্যমুক্ত ও নিরাপদ সমাজ গঠনে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? উপরিউক্ত জিজ্ঞাসার সদুত্তর জনগণ অন্ততঃপক্ষে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আশা করে। যদিও জনগণের একটি অংশ এমনটাই মনে করেন যে, তার সরকারের কাছেই জনগণ নিরাপদ। কাজেই এ আশার গুড়েবালি হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকারাচ্ছন্নময়। সরকার একটি সহনশীল, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিয়ে সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে তার মহিমাকে বিশ্বের কাছে প্রতিভাত করে তুলবে- নতুন প্রজন্ম এটাই প্রত্যাশা করে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top