alt

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিন

মিথুশিলাক মুরমু

: শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
image

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের গৌরবময় অবদান রয়েছে

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পূর্ব পর্যন্ত ৭টি মাইলফলক ঘটনা ঘটেছে- ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সংবিধান রচনা, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই সংগ্রাম আন্দোলনে আদিবাসীদের অংশায়নকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। আদিবাসী সাঁওতাল এমএলএ শ্রী জীবন কিস্কু (সিলেট থেকে ২ বার- ১৯৪৬ ও ১৯৫৪ খ্রি.) এবং শ্রী সাগরাম মাজহী (রাজশাহী থেকে ১ বার ১৯৫৪ খ্রি.) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কিংবা পরবর্তীকালের শোষণ ও বঞ্চনা, অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোতে সোচ্চার হওয়ার কথা আমরা শুনেছি। জীবন সাঁওতাল (কিস্কু) আসামের সংসদে চা শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বক্তব্যের পরই তার ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে তাকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল। দেশের ও জনসাধারণের অধিকার রক্ষার্থে তাদের কণ্ঠ ছিল সোচ্চারিত।

সাগরাম মাজহীর পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান সুধীর চন্দ্র মাজহী মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনা হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। সাগরাম মাজহীর (হাঁসদা) কন্যা শান্তিরাণী হাঁসদা। যুদ্ধকালীন সাগরামের পরিবারটি ভারতের লালগোলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। শান্তিরাণী হাঁসদা লালগোলার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রান্না-বান্নার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্যাম্পের রান্না-বান্না তত্ত্বাবধান ও তদারকি করতেন। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। এই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকের নামে রাজশাহী শহরে একটি রাস্তাও নামকরণ করা যায়নি; মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। স্বীকৃতি মেলেনি শান্তিরাণী হাঁসদারও।

জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আদিবাসীদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার হার বেশ ঊর্ধ্বেই রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ, পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন; অনেকে গেজেটভুক্ত হয়েছে, আবার কেউ কেউ ৫০ বছরেও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জানা যায়, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের অসহযোগিতা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত কোন্দল এবং পারস্পারিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতির কারণে রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিতকরণে সরকার, রাষ্ট্র চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা হতাশায়, ক্ষুব্ধতায় নিজের কপালের দিকে অঙুলি তুলে ধরে থাকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা যোসেফ টুডু স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশ ত্যাগ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র চালানো, দেশের অভ্যন্তরে অপারেশনে যোগদান, সার্টিফিকেট হারিয়ে যাওয়া, স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কর্তৃক অসহযোগিতা এবং ভাতাহীন জীবন সংগ্রাম তাকে হতাশ করে তুলেছে। তার পুত্রসন্তান রতন টুডুর তির্যক প্রশ্নে আমাদেরও অপ্রস্তুত করে তোলে। অষ্টাদশী যুবক যোসেফ টুডু গোদাগাড়ীর নবাই বড়তলাতে মা-বাবা নিয়ে থাকতেন। শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। অনেকের সঙ্গে যোসেফও সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নিলেন শরণার্থী শিবিরে। অতঃপর গৌড়বাগান মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সেখান থেকে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রেরণ করা হলো পানিহাটাতে এবং সর্বশেষ তরঙ্গপুরে অস্ত্র হাতে তুলে দেয়া হয়। অনেকের সঙ্গে তিনিও পৌঁছিয়েছিলেন গোদাগাড়ীর আদাড়পাড়াতে।

আশপাশের অনেক জায়গায় সম্মুখযুদ্ধে মুখোমুখি যোসেফ টুডু এখন স্মৃতিকেই ফেরি করে চলেছেন। যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে হাতে পেয়েছিলেন মূল্যবান সার্টিফিকেট, অসতর্কতায় হারিয়েছেন। এরপর পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক, যৌবনের গান শোনাতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন, তিনি ঘরজামাই হয়ে আসলেন আদাড়পাড়াতে। সত্যিই সংসার জীবনের বিশৃঙ্খলাই হারিয়েছেন জীবনের স্বীকৃতি, দুঃস্বপ্নের কালো অধ্যায়ে ছেয়ে গেছে সূর্যের প্রখর রৌদ্র। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় ও প্রমাণ দিতে হচ্ছে বারংবার। একজন নিরীহ আদিবাসী সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে জীবনযাপন করবে এটিতো কখনোই প্রত্যাশিত নয়! গোদাগাড়ীর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কার্যালয়ে ধরনা দিয়েছেন অনেকবার, কমান্ডার মহোদয় নানা অজুহাতে যোসেফ টুডুকে ফিরিয়েছেন বারবার। তাকে সহযোগিতার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করেছেন; একপ্রকার ভয় দেখিয়েছেন। কে তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে; কে তোমার পাশে দাঁড়াবে ইত্যাদি। তুমি তো তোমার সার্টিফিকেট হারিয়েছ; এটি আর পাওয়া যাবে না, তুমি আর পাওয়ার যোগ্য নও প্রভৃতি হতাশজনক বাক্যে জর্জরিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আক্ষেপের সুরেই বললেন, পকেটের পয়সা খরচ হয়েছে, পায়ের স্যান্ডেল ফুটো হয়েছে কিন্তু কমান্ডার মহোদয় আমার আবেদনকে গ্রাহ্যই করলেন না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জাতির জন্য লজ্জার, দেশবাসীর জন্য পীড়াদায়ক।

বার্নাবাস হাঁসদা এখন বসবাস করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর মিশনে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশিখা তাকেও ছুঁয়েছিল। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনীর বর্বরতাকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বার্নাবাস ঘর থেকে পালিয়ে পাশর্^বর্তী ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সময়টি ছিল এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে। খুঁজে পেয়েছিলেন তার মতো সোৎসাহী বেশ কয়েকজন দেশপ্রেমিককে। মে মাসের শেষান্তে দলবল নিয়ে মালন বাহ বাইল ইউথ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নাম লিখিয়েছেন। অতঃপর জুন মাসের শেষ দিকে বিহারের চাকুলিয়ায় বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে মালন ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করে। এখান থেকেই সোজা রণাঙ্গণে, পীরগঞ্জ-বোচাগঞ্জ অঞ্চলটিতে ডিফেন্সের সহযোগী হিসেবে। ’৭১-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মিত্র বাহিনী (ইন্ডিয়া আর্মি) দ্বারা বার্নাবাসদের দলটি রিক্রুট হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে দিনাজপুরের কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করতে আগুয়ান হয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে বিজীয় বেশে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বার্নাবাস হাঁসদা, মাইকেল মুরমু, মানুয়েল দীলিপ বেসরা, আলেকজান্ডার সরেন, মঙ্গল হাঁসদা, ফ্রান্সিস টুডু, লুংকিনুস টুডু, সেবাস্টিয়ান টুডুরা যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে শত্রুসেনাদের উৎখাতে জীবন বাজি রেখেছিলেন। প্রতিদানে রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্যবোধ করে চলেছে। বীরযোদ্ধা মাইকেল, আলেকজান্ডার, মঙ্গল দেহত্যাগ করেছেন, তাদের উত্তরসূরীদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হলেও; রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে একজন সাধারণ মানুষ। এরূপ অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিহীনভাবেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দু-একজন উত্তরসূরীর উপলব্ধি হচ্ছে, তারা কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা চাই না কিন্তু দেশের পক্ষে লড়াইয়ের স্বীকৃতি তো বড় কোন প্রত্যাশা নয়! স্বীকৃতির লড়াইয়ে আদিবাসীরা রাজনীতির ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে।

জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্ত আলো-বাতাসের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান সংকুলান করতে পারেনি। নিরাপত্তাহীনতায়, পারস্পারিক দ্বন্দ্ব, অভাবের তাড়নায় নিরবে নিভৃতে সীমান্ত অতিক্রম করেছে রহনপুরের মুক্তিযোদ্ধা মানুয়েল দীলিপ বেসরা, কাঁকনহাট ঝিনাফুলবাড়ির ভীম হেমব্রম, রংপুরের বুদু উরাঁওসহ আরও অনেকে। যে দেশের জন্য পরিবারের মায়া ত্যাগ করে, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল; স্বপ্ন ধরা দিলেও দেশ তাদের প্রয়োজন অনুভব করেনি। হয়তো তাদের বিশ^াসটিই সত্যি কিংবা নয় কিন্তু ৫১ বছর পরেও যে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির লক্ষ্যে, এটিকে কীভাবে বিচার করবেন? বীরযোদ্ধাদের দেশ ত্যাগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।

ব্যক্তিগতভাবে বহু বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলেছি, ঘটনা প্রবাহে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট ও আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র বেহাত হয়ে গেছে, হারিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় তো তাদের স্মৃতিশক্তি, সহযোদ্ধা, ঘটনার বিবরণ ইত্যাদি; তারপরও আদিবাসী যোদ্ধাদের বঞ্চনার শিকার ও উপেক্ষিত হতে হচ্ছে। কী নিদারুণ, কী কষ্টের, যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। অথচ একশ্রেণীর ব্যক্তি দেশবিরোধী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও বীর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পয়দা করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো, সুযোগ-সুবিধা করায়ত্ব করেছে। তারপরও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের টনক নড়েনি, তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি, কর্ণকুম্ভের ঘুম যেন অনন্তকালস্থায়ী। মুক্তিযুদ্ধ এখন সুযোগ-সন্ধানীদের হাতিয়ার, রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং সরকারের চেতনা।

অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর মুুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে, নেই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, নেই তাদের মধ্যে দূরভিসন্ধি; রয়েছে সদা হাস্যজ্জ্বল মুখ ও হৃদয়ের বিশালতা। সে জন্যই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির লক্ষ্যে অনশন করেনি, রাজপথে দাঁড়াননি; বরং সামাজিক সংগঠনগুলো অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, ফুলেল শুভেচ্ছা ও ক্রেস্ট দিয়ে উজ্জীবিত করেছে। রাষ্ট্র দূরত্ব বজায় রেখেছে কিন্তু জনমানুষ জেনেছে তাদের বীরত্বের কাহিনী, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং শত্রুমুক্ত করার দুঃসাহিক অবদান। তাহলে কেন সরকার উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।

আদিবাসী স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব, অকুতোভয় চেতনা, দেশপ্রেমের নির্দশন সত্যতা যাচাইয়ের দাবিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলে। সুবর্ণজয়ন্তী সময়কালে পুনর্বার অনুসন্ধান করা জরুরি। কারণ, ভিত্তিহীন হলে একজন আদিবাসী সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা কখনোই সাহসের সঙ্গে, বলিষ্ঠভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সাহস পাবে না। আদিবাসী সাঁওতালরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে ইতস্তবোধ করে; নীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ায় এড়িয়ে গিয়ে থাকে। অক্ষরজ্ঞান ও সহজ সরল হওয়ায় অবশ্যই তার মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ঘটনাগুলোকে যাচাই করার দাবি রাখে। আদিবাসী সাঁওতালরা সরকার, রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে থাকেন; সেক্ষেত্রে একটি মৌলিক প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা যোসেফ টুডু, বার্নাবাস হাঁসদা, মাইকেল মুরমু, মানুয়েল দীলিপ বেসরা, আলেকজান্ডার সরেন, মঙ্গল হাঁসদা, ফ্রান্সিস টুডু, লুংকিনুস টুডু, সেবাস্টিয়ান টুডুর দাবিকে সম্মান জানাতে হবে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও তাদের প্রতি সরকারের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যিক।

দেশের আনাচে-কানাচে অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিহীন অবস্থায় জীবনযাপন করে চলেছেন; সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যেন লম্বা না হয়। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছালে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে, যুদ্ধের বর্ণনায় নির্বাক হই কিন্তু পরক্ষণেই হতাশ হতে হয়। হতাশার মধ্যেও আশান্বিত হই ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণায় উল্লেখ করেছেন-,‘... দেশের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষা, ইতিহাস বিকৃতি রোধ এবং প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ, শহীদদের নাম পরিচয় সংগ্রহ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।’ আমরা প্রার্থনা করি, সরকারের দায়িত্ববানরা যেন দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কার্য সম্পাদন করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জাতির সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হই।

[লেখক : কলামিস্ট]

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলা

সড়কে কিশোর মোটরবাইকার : নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মব জাস্টিস আইনের শাসনের পরিপন্থি

ছবি

গভীর সংকট আর বড় সম্ভাবনা পাশাপাশি হাঁটছে

জ্ঞানদায়িনী মা সরস্বতী দেবী

‘সংখ্যাস্বল্প’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কেন প্রয়োজন?

সব ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাধান্য দিন

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

পাঠ্যবই সংকটে থমকে গেছে শিক্ষার চাকা

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

রম্যগদ্য : “ডক্টর.জ্বী-ভাগো...”

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিন

মিথুশিলাক মুরমু

image

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের গৌরবময় অবদান রয়েছে

শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পূর্ব পর্যন্ত ৭টি মাইলফলক ঘটনা ঘটেছে- ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সংবিধান রচনা, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই সংগ্রাম আন্দোলনে আদিবাসীদের অংশায়নকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। আদিবাসী সাঁওতাল এমএলএ শ্রী জীবন কিস্কু (সিলেট থেকে ২ বার- ১৯৪৬ ও ১৯৫৪ খ্রি.) এবং শ্রী সাগরাম মাজহী (রাজশাহী থেকে ১ বার ১৯৫৪ খ্রি.) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কিংবা পরবর্তীকালের শোষণ ও বঞ্চনা, অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোতে সোচ্চার হওয়ার কথা আমরা শুনেছি। জীবন সাঁওতাল (কিস্কু) আসামের সংসদে চা শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বক্তব্যের পরই তার ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে তাকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল। দেশের ও জনসাধারণের অধিকার রক্ষার্থে তাদের কণ্ঠ ছিল সোচ্চারিত।

সাগরাম মাজহীর পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান সুধীর চন্দ্র মাজহী মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনা হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। সাগরাম মাজহীর (হাঁসদা) কন্যা শান্তিরাণী হাঁসদা। যুদ্ধকালীন সাগরামের পরিবারটি ভারতের লালগোলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। শান্তিরাণী হাঁসদা লালগোলার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রান্না-বান্নার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্যাম্পের রান্না-বান্না তত্ত্বাবধান ও তদারকি করতেন। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। এই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকের নামে রাজশাহী শহরে একটি রাস্তাও নামকরণ করা যায়নি; মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। স্বীকৃতি মেলেনি শান্তিরাণী হাঁসদারও।

জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আদিবাসীদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার হার বেশ ঊর্ধ্বেই রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ, পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন; অনেকে গেজেটভুক্ত হয়েছে, আবার কেউ কেউ ৫০ বছরেও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জানা যায়, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের অসহযোগিতা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত কোন্দল এবং পারস্পারিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতির কারণে রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিতকরণে সরকার, রাষ্ট্র চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা হতাশায়, ক্ষুব্ধতায় নিজের কপালের দিকে অঙুলি তুলে ধরে থাকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা যোসেফ টুডু স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশ ত্যাগ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র চালানো, দেশের অভ্যন্তরে অপারেশনে যোগদান, সার্টিফিকেট হারিয়ে যাওয়া, স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কর্তৃক অসহযোগিতা এবং ভাতাহীন জীবন সংগ্রাম তাকে হতাশ করে তুলেছে। তার পুত্রসন্তান রতন টুডুর তির্যক প্রশ্নে আমাদেরও অপ্রস্তুত করে তোলে। অষ্টাদশী যুবক যোসেফ টুডু গোদাগাড়ীর নবাই বড়তলাতে মা-বাবা নিয়ে থাকতেন। শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। অনেকের সঙ্গে যোসেফও সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নিলেন শরণার্থী শিবিরে। অতঃপর গৌড়বাগান মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সেখান থেকে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রেরণ করা হলো পানিহাটাতে এবং সর্বশেষ তরঙ্গপুরে অস্ত্র হাতে তুলে দেয়া হয়। অনেকের সঙ্গে তিনিও পৌঁছিয়েছিলেন গোদাগাড়ীর আদাড়পাড়াতে।

আশপাশের অনেক জায়গায় সম্মুখযুদ্ধে মুখোমুখি যোসেফ টুডু এখন স্মৃতিকেই ফেরি করে চলেছেন। যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে হাতে পেয়েছিলেন মূল্যবান সার্টিফিকেট, অসতর্কতায় হারিয়েছেন। এরপর পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক, যৌবনের গান শোনাতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন, তিনি ঘরজামাই হয়ে আসলেন আদাড়পাড়াতে। সত্যিই সংসার জীবনের বিশৃঙ্খলাই হারিয়েছেন জীবনের স্বীকৃতি, দুঃস্বপ্নের কালো অধ্যায়ে ছেয়ে গেছে সূর্যের প্রখর রৌদ্র। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় ও প্রমাণ দিতে হচ্ছে বারংবার। একজন নিরীহ আদিবাসী সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে জীবনযাপন করবে এটিতো কখনোই প্রত্যাশিত নয়! গোদাগাড়ীর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কার্যালয়ে ধরনা দিয়েছেন অনেকবার, কমান্ডার মহোদয় নানা অজুহাতে যোসেফ টুডুকে ফিরিয়েছেন বারবার। তাকে সহযোগিতার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করেছেন; একপ্রকার ভয় দেখিয়েছেন। কে তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে; কে তোমার পাশে দাঁড়াবে ইত্যাদি। তুমি তো তোমার সার্টিফিকেট হারিয়েছ; এটি আর পাওয়া যাবে না, তুমি আর পাওয়ার যোগ্য নও প্রভৃতি হতাশজনক বাক্যে জর্জরিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আক্ষেপের সুরেই বললেন, পকেটের পয়সা খরচ হয়েছে, পায়ের স্যান্ডেল ফুটো হয়েছে কিন্তু কমান্ডার মহোদয় আমার আবেদনকে গ্রাহ্যই করলেন না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জাতির জন্য লজ্জার, দেশবাসীর জন্য পীড়াদায়ক।

বার্নাবাস হাঁসদা এখন বসবাস করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর মিশনে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশিখা তাকেও ছুঁয়েছিল। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনীর বর্বরতাকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বার্নাবাস ঘর থেকে পালিয়ে পাশর্^বর্তী ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সময়টি ছিল এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে। খুঁজে পেয়েছিলেন তার মতো সোৎসাহী বেশ কয়েকজন দেশপ্রেমিককে। মে মাসের শেষান্তে দলবল নিয়ে মালন বাহ বাইল ইউথ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নাম লিখিয়েছেন। অতঃপর জুন মাসের শেষ দিকে বিহারের চাকুলিয়ায় বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে মালন ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করে। এখান থেকেই সোজা রণাঙ্গণে, পীরগঞ্জ-বোচাগঞ্জ অঞ্চলটিতে ডিফেন্সের সহযোগী হিসেবে। ’৭১-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মিত্র বাহিনী (ইন্ডিয়া আর্মি) দ্বারা বার্নাবাসদের দলটি রিক্রুট হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে দিনাজপুরের কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করতে আগুয়ান হয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে বিজীয় বেশে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বার্নাবাস হাঁসদা, মাইকেল মুরমু, মানুয়েল দীলিপ বেসরা, আলেকজান্ডার সরেন, মঙ্গল হাঁসদা, ফ্রান্সিস টুডু, লুংকিনুস টুডু, সেবাস্টিয়ান টুডুরা যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে শত্রুসেনাদের উৎখাতে জীবন বাজি রেখেছিলেন। প্রতিদানে রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্যবোধ করে চলেছে। বীরযোদ্ধা মাইকেল, আলেকজান্ডার, মঙ্গল দেহত্যাগ করেছেন, তাদের উত্তরসূরীদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হলেও; রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে একজন সাধারণ মানুষ। এরূপ অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিহীনভাবেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দু-একজন উত্তরসূরীর উপলব্ধি হচ্ছে, তারা কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা চাই না কিন্তু দেশের পক্ষে লড়াইয়ের স্বীকৃতি তো বড় কোন প্রত্যাশা নয়! স্বীকৃতির লড়াইয়ে আদিবাসীরা রাজনীতির ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে।

জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্ত আলো-বাতাসের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান সংকুলান করতে পারেনি। নিরাপত্তাহীনতায়, পারস্পারিক দ্বন্দ্ব, অভাবের তাড়নায় নিরবে নিভৃতে সীমান্ত অতিক্রম করেছে রহনপুরের মুক্তিযোদ্ধা মানুয়েল দীলিপ বেসরা, কাঁকনহাট ঝিনাফুলবাড়ির ভীম হেমব্রম, রংপুরের বুদু উরাঁওসহ আরও অনেকে। যে দেশের জন্য পরিবারের মায়া ত্যাগ করে, মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল; স্বপ্ন ধরা দিলেও দেশ তাদের প্রয়োজন অনুভব করেনি। হয়তো তাদের বিশ^াসটিই সত্যি কিংবা নয় কিন্তু ৫১ বছর পরেও যে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির লক্ষ্যে, এটিকে কীভাবে বিচার করবেন? বীরযোদ্ধাদের দেশ ত্যাগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।

ব্যক্তিগতভাবে বহু বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলেছি, ঘটনা প্রবাহে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট ও আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র বেহাত হয়ে গেছে, হারিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় তো তাদের স্মৃতিশক্তি, সহযোদ্ধা, ঘটনার বিবরণ ইত্যাদি; তারপরও আদিবাসী যোদ্ধাদের বঞ্চনার শিকার ও উপেক্ষিত হতে হচ্ছে। কী নিদারুণ, কী কষ্টের, যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। অথচ একশ্রেণীর ব্যক্তি দেশবিরোধী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও বীর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পয়দা করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানো, সুযোগ-সুবিধা করায়ত্ব করেছে। তারপরও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের টনক নড়েনি, তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি, কর্ণকুম্ভের ঘুম যেন অনন্তকালস্থায়ী। মুক্তিযুদ্ধ এখন সুযোগ-সন্ধানীদের হাতিয়ার, রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং সরকারের চেতনা।

অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর মুুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে, নেই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, নেই তাদের মধ্যে দূরভিসন্ধি; রয়েছে সদা হাস্যজ্জ্বল মুখ ও হৃদয়ের বিশালতা। সে জন্যই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির লক্ষ্যে অনশন করেনি, রাজপথে দাঁড়াননি; বরং সামাজিক সংগঠনগুলো অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, ফুলেল শুভেচ্ছা ও ক্রেস্ট দিয়ে উজ্জীবিত করেছে। রাষ্ট্র দূরত্ব বজায় রেখেছে কিন্তু জনমানুষ জেনেছে তাদের বীরত্বের কাহিনী, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং শত্রুমুক্ত করার দুঃসাহিক অবদান। তাহলে কেন সরকার উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।

আদিবাসী স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব, অকুতোভয় চেতনা, দেশপ্রেমের নির্দশন সত্যতা যাচাইয়ের দাবিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলে। সুবর্ণজয়ন্তী সময়কালে পুনর্বার অনুসন্ধান করা জরুরি। কারণ, ভিত্তিহীন হলে একজন আদিবাসী সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা কখনোই সাহসের সঙ্গে, বলিষ্ঠভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সাহস পাবে না। আদিবাসী সাঁওতালরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে ইতস্তবোধ করে; নীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ায় এড়িয়ে গিয়ে থাকে। অক্ষরজ্ঞান ও সহজ সরল হওয়ায় অবশ্যই তার মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ঘটনাগুলোকে যাচাই করার দাবি রাখে। আদিবাসী সাঁওতালরা সরকার, রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে থাকেন; সেক্ষেত্রে একটি মৌলিক প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা যোসেফ টুডু, বার্নাবাস হাঁসদা, মাইকেল মুরমু, মানুয়েল দীলিপ বেসরা, আলেকজান্ডার সরেন, মঙ্গল হাঁসদা, ফ্রান্সিস টুডু, লুংকিনুস টুডু, সেবাস্টিয়ান টুডুর দাবিকে সম্মান জানাতে হবে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও তাদের প্রতি সরকারের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যিক।

দেশের আনাচে-কানাচে অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিহীন অবস্থায় জীবনযাপন করে চলেছেন; সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। স্বীকৃতিহীন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যেন লম্বা না হয়। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছালে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে, যুদ্ধের বর্ণনায় নির্বাক হই কিন্তু পরক্ষণেই হতাশ হতে হয়। হতাশার মধ্যেও আশান্বিত হই ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণায় উল্লেখ করেছেন-,‘... দেশের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্ষা, ইতিহাস বিকৃতি রোধ এবং প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ, শহীদদের নাম পরিচয় সংগ্রহ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।’ আমরা প্রার্থনা করি, সরকারের দায়িত্ববানরা যেন দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কার্য সম্পাদন করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জাতির সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হই।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top