alt

উপ-সম্পাদকীয়

আনন্দ-উৎসবের উষ্ণতায় ভরা শীত

শেখর ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৩
image

শীতকালে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মনে কি দোলা দিয়ে যায় না?

দেশ, কালভেদে প্রকৃতিতে ঋতুর সৌন্দর্য ও প্রভাব ভিন্ন। শীতের কথা মনে হলেই হেমন্ত শেষে, ফসল তোলা মাঠে দিগন্ত বিস্মৃত শূন্যতা। মাটির স্পর্শ পেয়ে গাছের চারপাশে ঝরা পাতার এক ধরনের ক্রন্দন ধ্বনি। শূন্য ডাল যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষন্নতার নিঃশ্বাস ছাড়ে ক্রমাগত। প্রমত্তা নদীগুলো শুকিয়ে জীর্ণশীর্ণ। পত্র-পল্লব, জল, ফসল হারিয়ে প্রকৃতি রিক্ত হয়ে পড়ে। তাই বলে কী শীতকালে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মনে দোলা দিয়ে যায় না?

দীর্ঘ শীতের রাতে, বৃক্ষ, লতা, পাতা, দূর্বাঘাস সহ সমস্ত প্রকৃতি সিক্ত হয়ে ওঠে শিশিরের কমল ছোঁয়ায়। শীতের সকালে অপূর্ব মিঠে-কড়া রোদের স্পর্শে, হীরক দ্যুতির মতো ঝরা শিশির, ঝক-ঝকে মুক্তো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম সময়ে দূর্বাঘাস কিংবা গ্রামীণ কাঁচা মাটির পথে পদস্পর্শ এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। কালের বিবর্তনে, প্রকৃতিতে শীতের রূপ, রঙ ধীরে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন একদিক দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে। সে আলোচনায় আসছি পরে। অগ্রহায়ণ মাসে ফসল তোলা শেষ হয়ে গেলে, মেঘ বৃষ্টি ঝড়-ঝঞ্জাহীন এরকম সময়ে বাংলার আকাশে বাতাসে আনন্দ উৎসবের ছোঁয়ায় এক ভিন্ন রকম পরিবেশ তৈরি হয়। প্রকৃতিতে মনে হয় এক ধরনের বিষন্নতা তৈরি হয় তবে ভরা শীতে মানুষের মন যখন উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে পড়ে, তখন বিষন্নতার মেঘ মন থেকে দূরে কোথাও হারিয়ে যায়। শান্ত, স্নিগ্ধ শীতের রাত, সন্ধ্যা, বিকেল উৎসবের উষ্ণতায় তাই বর্ণিল হয়ে পড়ে।

ইউরোপ, আমেরিকার শীতকালের সঙ্গে বাংলার শীতকালের তুলনা চলে না। ভরা শীতে ইউরোপ, আমেরিকা শ্বেত শুভ্র, বরফের নিচে চাপা পড়ে। জীবন কিছুটা হলেও স্থবির হয়ে যায়। ধান কাটার পর বাংলার ঘরে ঘরে যে উৎসব আনন্দ সেরকম আনন্দ, উৎসব করার সুযোগ খুব সীমিত হয়ে পড়ে পশ্চিমে। পশ্চিমে তাই শীত হলো কিছুটা বিপন্নতার কাল। হেমন্ত শেষে বাংলার প্রতিটি ঘরের ধানের গোলায় কমবেশি ফসলের সমারোহ। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস তাই নানা আনন্দ, অনুষ্ঠান আয়োজন ও উপভোগে ব্যস্ত থাকে বাংলাদেশের নগর ও অজস্র গ্রামীণ জনপদ। আমাদের বাংলার কবি তাই পৌষবন্দনা করতে গিয়ে বলে উঠেন : ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয়, আয় আয়/ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায়, হায়।/ হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ বধূরা ধানের ক্ষেতে.../রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হায় হায় হায়।’ পৌষের এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় বাংলার পৌষ, বাঙালির পৌষের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের শীতকালের কত পার্থক্য। বাংলাদেশের আনন্দ উৎসবের এই সময়টাকে উনিশ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ কবি পি বি শেলীর কবিতায় প্রতীকী হলেও মনে হয় ‘শীত’ এক বিপন্ন সময়। শেলীর বিখ্যাত কবিতা ‘অড টু ওয়েস্ট উইন্ডে’ তাই আমরা শুনতে পাই, ‘যদি শীত আসে, তবে বসন্ত কী খুব দূরে থাকে?’ অর্থাৎ শীতের বিপন্নকাল যদি কাটানো যায় তাহলে বর্ণিল, আনন্দময় বসন্ত দিনের ছোঁয়া পাওয়া কঠিন কিছু নয়। বিপন্ন প্রহর কেটে গেলেই মুক্তি কিংবা আনন্দের কাল পাখা মেলে ওড়ে অসীম দিগন্তে ভেসে বেড়ানোর জন্য।

ওই যে বলেছিলাম দেশ, কাল ভেদে প্রকৃতির প্রভাব ভিন্ন হয়ে থাকে সে কথাতে আবার ফিরে আসি। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশের মানুষের দৃশ্যমান দারিদ্রতা অনেক কমেছে, এ কথাটি বলার জন্য এখন আর কোন গবেষণাপত্রের উল্লেখ করতে হয় না। বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে বস্ত্রহীন কিংবা পর্যাপ্ত বস্ত্রের অভাবে শীতকাতর মানুষের সংখ্যা এখন নগন্য। ফুটপাতে যারা শুয়ে থাকেন তাদের শরীরেও শীত নিবারণের বস্ত্র লক্ষ্য করা যায়। কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের (জন্ম ১৯২৬, মৃত্যু ১৯৪৭) জীবনকালে শীতের তীব্র হিম প্রবাহে মানুষের দুঃসহ দুঃখ কষ্ট লক্ষ্য করে তার প্রার্থনা কবিতায় লিখেছিলেন : ‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!/হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় আমরা থাকি/যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ/ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলো জন্যে।’ কালের আবর্তে প্রান্তিক, অতি দরিদ্র মানুষদের শীতকালে জীবনযাপনে বিপন্নতার তীব্রতা এখন অনেকটা কমে এসেছে।

মানুষের জীবনের ওপর শীতের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা কমে আসলেও প্রকৃতিতে শীতের প্রভাব এবং শীতের স্বতন্ত্র রূপ কিন্তু এখনও দৃশ্যমান। সকাল-সন্ধ্যা আকাশে কুয়াশার ঘনঘোর। কুয়াশার পাহাড় কেটে কেটে ভোর ও সন্ধ্যায় মানুষের জীবন এগিয়ে চলে। শরীরে স্পর্শ করে হিমেল হাওয়া। শীতের রাত অনেক দীর্ঘ। গভীর রাতে স্নিগ্ধ আলো কিংবা অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে প্রকৃতিতে নেমে আসে এক ধরনের স্তব্ধতা। এরকম সব্ধতার এক ভিন্ন ধরনের অনুভূতি আছে, আছে এক অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা। শীতের স্তব্ধ রাতে হিমেল হাওয়ায় দূর থেকে ভেসে আসে বনফুলের সৌরভ। শীতের রূপের অনেক বর্ণনা আছে রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায়। তবে রবীন্দ্রনাথ বাংলার অন্য ঋতু নিয়ে যত লিখেছেন সেই তুলনায় শীত নিয়ে যে খুব বেশি লিখেছেন সে কথা বলা যাবে না। শীতের ওপর কবিগুরুর জনপ্রিয় কবিতা ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে/ উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে/তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে।’ জীবনানন্দের কবিতায় শীতের রূপ ধরা পড়েছে নানাভাবে। যেমন- চালতার পাতা থেকে ঝরে পড়েছে শিশির বিন্দু, স্তব্ধ রাতের অন্ধকারে গাছের শাখায় শিকার ধরতে ওঁতপেতে আছে পেঁচা, মাকড়সার জালে জমেছে মুক্তোর মতো শিশির বিন্দু। শীতের রাতে ডানা ঝাপটে নৈশ অভিসারে যাত্রা শুরু করে বাদুড়ের ঝাঁক। এঁকেবেঁকে যাওয়া কোন নদীর মন্থর স্রোতে ঝিলমিল করে ওঠা কুয়াশার ভেতরে দূর দিগন্তে ডুবতে থাকা সূর্যের ম্লান আলো নিসর্গের আরেক রূপ হয়ে ধরা দেয়।

সংখ্যায় কম হলেও ভিন্ন আদলে, আঙ্গিকে ও বোধ ভাষ্যি নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন বাংলার কবিরা। এর মধ্যে বিষ্ণু দে-র কবিতায় প্রতীকী ব্যঞ্জনায় শীতের শব্দমালা পেয়েছে ভিন্নমাত্রা : ‘হিমের হাওয়া বয়ে তো গেল/দোঁহার মাঝে।/নীলোৎপল হয়েছে আজ কাঠগোলাপ।’ ঋতু হিসেবে শীতের উজ্জ্বল ঝলমলে রূপ না থাকলেও বাংলার শীতে শিশিরের নিরবতার মতো এক উচ্ছ্বল স্তব্ধতার রূপ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া বাংলার প্রকৃতিতে শীতের শুষ্কতা, রুক্ষতার অপবাদ ঘোচাতে অসংখ্য ফুলের সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। বিচিত্র রঙের গাঁদা মল্লিকা, গোলাপ, ডালিয়া, শীতের নিজস্ব একটি জৌলুস সৃষ্টি করে। এরকম ফুলের কমনীয় রঙটি কেবল শীতেই পাওয়া যায়, যা প্রকৃতিকে টেনে নিয়ে যায় বসন্তের দিকে। শীতের স্তব্ধতা, কমনীয় রূপ, মার্জিত ভাব এবং ঘন অন্ধকারের মধ্যে আসলে লুকিয়ে থাকে বসন্তের আলো ঝলমল সজীব প্রকৃতি সৃষ্টির বেদনা। শীত প্রকৃতিকে নতুন রূপে সজ্জিত করার জন্য পত্র-পল্লব হীনতার বেদনাকে সৃষ্টির প্রসব বেদনার মতো সহ্য করে নেয়।

কালের বিবর্তনে আমাদের এই বাংলাদেশে শীত এখন আর শূন্যতা, রিক্ততার ঋতু নয়। প্রকৃত অর্থে ফসলের মাঠ এখন আর সীমাহীন শূন্যতা বিরাজ করে না। নানা বর্ণ, নানা ধরনের ফসলের হাসিতে এখন বাংলার মাঠ উজ্জীবিত থাকে। শীত এখন ভিন্ন ধরণের উদযাপনের ঋতু। গ্রাম বাংলায় যেমন পিঠাপুলির উৎসব লেগে থাকে করপোরেট আধুনিক সমাজেও বাংলার আবাহমান উদযাপনকে তুলে ধরা হয়। গ্রামে গ্রামে যেমন পৌষপার্বন অনুষ্ঠিত হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিন ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়; একইভাবে শহরজুড়ে ‘সাকরাইন’ উৎসবে মেতে ওঠে মানুষ। বিশেষ করে ঐতিহ্যের পুনরুত্থানের জন্যে পুরান ঢাকাজুড়ে সাকরাইন এখন যেন জাতীয় অনুষ্ঠান। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ভিড় করেন ঘুড়ি উড়ানোর এক সর্বজনীন উৎসবে মিলিত হতে। শীতকাল এখন বাংলার মানুষের কাছে অনুজ্জ্বল, রিক্ততার কাল নয় বরঞ্চ সব শ্রেণীপেশার মানুষে মধ্যে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে সম্প্রীতি, মিলনের অপার্থিব এক আনন্দের কাল। শীতের আবাহমান রূপকে ধ্বংস না করে, শীতকে সব শ্রেণীর মানুষের উৎসব আনন্দের ঋতু হিসেবে আরও বর্ণিল ও উজ্জ্বল করে তোলার সুযোগ রয়েছে। এজন্য সব উন্নয়ন কর্মকান্ড হতে হবে প্রকৃতিবান্ধব। আর আমরা যদি প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে আমাদের শাশ্বত আনন্দ, উৎসবকে যেমন বাচিয়ে রাখতে পারব একইভাবে প্রকৃতির স্বকীয় রূপকেও ধরে রাখতে সমর্থ হব।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল : নিরাপদ যাত্রার প্রত্যাশা

কর ফাঁকি : অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় : উপকূলীয় সুরক্ষার শিক্ষা

যখন নদীগুলো অস্ত্র হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বজ্রপাত ও তালগাছ : প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা

কুষ্ঠ ও বৈষম্য : মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি অবহেলিত অধ্যায়

ছবি

প্রান্তজনের বাংলাদেশ

অতীতের ছায়ায় নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি, উগ্রপন্থা ও সরকারের দায়

সাইবার নিরাপত্তা : অদৃশ্য যুদ্ধের সামনে আমাদের প্রস্তুতি

ছবি

বাহান্নর গর্ভে জন্ম নেয়া এক ঝড়ের পাখি

প্রবাসী শ্রমিক : অর্থের যন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের সহযোদ্ধা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ

ভোগবাদের বিরুদ্ধে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু বার্তা

রম্যগদ্য : হাসি নিষেধ...

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : দাবি ও সমাধানের পথ

সিরিয়ার পতন কিভাবে আমেরিকার স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব ও করণীয়

শাসনব্যবস্থা : জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আনন্দ-উৎসবের উষ্ণতায় ভরা শীত

শেখর ভট্টাচার্য

image

শীতকালে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মনে কি দোলা দিয়ে যায় না?

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৩

দেশ, কালভেদে প্রকৃতিতে ঋতুর সৌন্দর্য ও প্রভাব ভিন্ন। শীতের কথা মনে হলেই হেমন্ত শেষে, ফসল তোলা মাঠে দিগন্ত বিস্মৃত শূন্যতা। মাটির স্পর্শ পেয়ে গাছের চারপাশে ঝরা পাতার এক ধরনের ক্রন্দন ধ্বনি। শূন্য ডাল যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষন্নতার নিঃশ্বাস ছাড়ে ক্রমাগত। প্রমত্তা নদীগুলো শুকিয়ে জীর্ণশীর্ণ। পত্র-পল্লব, জল, ফসল হারিয়ে প্রকৃতি রিক্ত হয়ে পড়ে। তাই বলে কী শীতকালে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মনে দোলা দিয়ে যায় না?

দীর্ঘ শীতের রাতে, বৃক্ষ, লতা, পাতা, দূর্বাঘাস সহ সমস্ত প্রকৃতি সিক্ত হয়ে ওঠে শিশিরের কমল ছোঁয়ায়। শীতের সকালে অপূর্ব মিঠে-কড়া রোদের স্পর্শে, হীরক দ্যুতির মতো ঝরা শিশির, ঝক-ঝকে মুক্তো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম সময়ে দূর্বাঘাস কিংবা গ্রামীণ কাঁচা মাটির পথে পদস্পর্শ এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। কালের বিবর্তনে, প্রকৃতিতে শীতের রূপ, রঙ ধীরে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন একদিক দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে। সে আলোচনায় আসছি পরে। অগ্রহায়ণ মাসে ফসল তোলা শেষ হয়ে গেলে, মেঘ বৃষ্টি ঝড়-ঝঞ্জাহীন এরকম সময়ে বাংলার আকাশে বাতাসে আনন্দ উৎসবের ছোঁয়ায় এক ভিন্ন রকম পরিবেশ তৈরি হয়। প্রকৃতিতে মনে হয় এক ধরনের বিষন্নতা তৈরি হয় তবে ভরা শীতে মানুষের মন যখন উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে পড়ে, তখন বিষন্নতার মেঘ মন থেকে দূরে কোথাও হারিয়ে যায়। শান্ত, স্নিগ্ধ শীতের রাত, সন্ধ্যা, বিকেল উৎসবের উষ্ণতায় তাই বর্ণিল হয়ে পড়ে।

ইউরোপ, আমেরিকার শীতকালের সঙ্গে বাংলার শীতকালের তুলনা চলে না। ভরা শীতে ইউরোপ, আমেরিকা শ্বেত শুভ্র, বরফের নিচে চাপা পড়ে। জীবন কিছুটা হলেও স্থবির হয়ে যায়। ধান কাটার পর বাংলার ঘরে ঘরে যে উৎসব আনন্দ সেরকম আনন্দ, উৎসব করার সুযোগ খুব সীমিত হয়ে পড়ে পশ্চিমে। পশ্চিমে তাই শীত হলো কিছুটা বিপন্নতার কাল। হেমন্ত শেষে বাংলার প্রতিটি ঘরের ধানের গোলায় কমবেশি ফসলের সমারোহ। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস তাই নানা আনন্দ, অনুষ্ঠান আয়োজন ও উপভোগে ব্যস্ত থাকে বাংলাদেশের নগর ও অজস্র গ্রামীণ জনপদ। আমাদের বাংলার কবি তাই পৌষবন্দনা করতে গিয়ে বলে উঠেন : ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয়, আয় আয়/ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায়, হায়।/ হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ বধূরা ধানের ক্ষেতে.../রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হায় হায় হায়।’ পৌষের এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় বাংলার পৌষ, বাঙালির পৌষের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের শীতকালের কত পার্থক্য। বাংলাদেশের আনন্দ উৎসবের এই সময়টাকে উনিশ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ কবি পি বি শেলীর কবিতায় প্রতীকী হলেও মনে হয় ‘শীত’ এক বিপন্ন সময়। শেলীর বিখ্যাত কবিতা ‘অড টু ওয়েস্ট উইন্ডে’ তাই আমরা শুনতে পাই, ‘যদি শীত আসে, তবে বসন্ত কী খুব দূরে থাকে?’ অর্থাৎ শীতের বিপন্নকাল যদি কাটানো যায় তাহলে বর্ণিল, আনন্দময় বসন্ত দিনের ছোঁয়া পাওয়া কঠিন কিছু নয়। বিপন্ন প্রহর কেটে গেলেই মুক্তি কিংবা আনন্দের কাল পাখা মেলে ওড়ে অসীম দিগন্তে ভেসে বেড়ানোর জন্য।

ওই যে বলেছিলাম দেশ, কাল ভেদে প্রকৃতির প্রভাব ভিন্ন হয়ে থাকে সে কথাতে আবার ফিরে আসি। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশের মানুষের দৃশ্যমান দারিদ্রতা অনেক কমেছে, এ কথাটি বলার জন্য এখন আর কোন গবেষণাপত্রের উল্লেখ করতে হয় না। বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে বস্ত্রহীন কিংবা পর্যাপ্ত বস্ত্রের অভাবে শীতকাতর মানুষের সংখ্যা এখন নগন্য। ফুটপাতে যারা শুয়ে থাকেন তাদের শরীরেও শীত নিবারণের বস্ত্র লক্ষ্য করা যায়। কবি কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্যের (জন্ম ১৯২৬, মৃত্যু ১৯৪৭) জীবনকালে শীতের তীব্র হিম প্রবাহে মানুষের দুঃসহ দুঃখ কষ্ট লক্ষ্য করে তার প্রার্থনা কবিতায় লিখেছিলেন : ‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!/হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় আমরা থাকি/যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ/ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলো জন্যে।’ কালের আবর্তে প্রান্তিক, অতি দরিদ্র মানুষদের শীতকালে জীবনযাপনে বিপন্নতার তীব্রতা এখন অনেকটা কমে এসেছে।

মানুষের জীবনের ওপর শীতের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা কমে আসলেও প্রকৃতিতে শীতের প্রভাব এবং শীতের স্বতন্ত্র রূপ কিন্তু এখনও দৃশ্যমান। সকাল-সন্ধ্যা আকাশে কুয়াশার ঘনঘোর। কুয়াশার পাহাড় কেটে কেটে ভোর ও সন্ধ্যায় মানুষের জীবন এগিয়ে চলে। শরীরে স্পর্শ করে হিমেল হাওয়া। শীতের রাত অনেক দীর্ঘ। গভীর রাতে স্নিগ্ধ আলো কিংবা অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে প্রকৃতিতে নেমে আসে এক ধরনের স্তব্ধতা। এরকম সব্ধতার এক ভিন্ন ধরনের অনুভূতি আছে, আছে এক অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা। শীতের স্তব্ধ রাতে হিমেল হাওয়ায় দূর থেকে ভেসে আসে বনফুলের সৌরভ। শীতের রূপের অনেক বর্ণনা আছে রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায়। তবে রবীন্দ্রনাথ বাংলার অন্য ঋতু নিয়ে যত লিখেছেন সেই তুলনায় শীত নিয়ে যে খুব বেশি লিখেছেন সে কথা বলা যাবে না। শীতের ওপর কবিগুরুর জনপ্রিয় কবিতা ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে/ উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে/তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে।’ জীবনানন্দের কবিতায় শীতের রূপ ধরা পড়েছে নানাভাবে। যেমন- চালতার পাতা থেকে ঝরে পড়েছে শিশির বিন্দু, স্তব্ধ রাতের অন্ধকারে গাছের শাখায় শিকার ধরতে ওঁতপেতে আছে পেঁচা, মাকড়সার জালে জমেছে মুক্তোর মতো শিশির বিন্দু। শীতের রাতে ডানা ঝাপটে নৈশ অভিসারে যাত্রা শুরু করে বাদুড়ের ঝাঁক। এঁকেবেঁকে যাওয়া কোন নদীর মন্থর স্রোতে ঝিলমিল করে ওঠা কুয়াশার ভেতরে দূর দিগন্তে ডুবতে থাকা সূর্যের ম্লান আলো নিসর্গের আরেক রূপ হয়ে ধরা দেয়।

সংখ্যায় কম হলেও ভিন্ন আদলে, আঙ্গিকে ও বোধ ভাষ্যি নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন বাংলার কবিরা। এর মধ্যে বিষ্ণু দে-র কবিতায় প্রতীকী ব্যঞ্জনায় শীতের শব্দমালা পেয়েছে ভিন্নমাত্রা : ‘হিমের হাওয়া বয়ে তো গেল/দোঁহার মাঝে।/নীলোৎপল হয়েছে আজ কাঠগোলাপ।’ ঋতু হিসেবে শীতের উজ্জ্বল ঝলমলে রূপ না থাকলেও বাংলার শীতে শিশিরের নিরবতার মতো এক উচ্ছ্বল স্তব্ধতার রূপ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া বাংলার প্রকৃতিতে শীতের শুষ্কতা, রুক্ষতার অপবাদ ঘোচাতে অসংখ্য ফুলের সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। বিচিত্র রঙের গাঁদা মল্লিকা, গোলাপ, ডালিয়া, শীতের নিজস্ব একটি জৌলুস সৃষ্টি করে। এরকম ফুলের কমনীয় রঙটি কেবল শীতেই পাওয়া যায়, যা প্রকৃতিকে টেনে নিয়ে যায় বসন্তের দিকে। শীতের স্তব্ধতা, কমনীয় রূপ, মার্জিত ভাব এবং ঘন অন্ধকারের মধ্যে আসলে লুকিয়ে থাকে বসন্তের আলো ঝলমল সজীব প্রকৃতি সৃষ্টির বেদনা। শীত প্রকৃতিকে নতুন রূপে সজ্জিত করার জন্য পত্র-পল্লব হীনতার বেদনাকে সৃষ্টির প্রসব বেদনার মতো সহ্য করে নেয়।

কালের বিবর্তনে আমাদের এই বাংলাদেশে শীত এখন আর শূন্যতা, রিক্ততার ঋতু নয়। প্রকৃত অর্থে ফসলের মাঠ এখন আর সীমাহীন শূন্যতা বিরাজ করে না। নানা বর্ণ, নানা ধরনের ফসলের হাসিতে এখন বাংলার মাঠ উজ্জীবিত থাকে। শীত এখন ভিন্ন ধরণের উদযাপনের ঋতু। গ্রাম বাংলায় যেমন পিঠাপুলির উৎসব লেগে থাকে করপোরেট আধুনিক সমাজেও বাংলার আবাহমান উদযাপনকে তুলে ধরা হয়। গ্রামে গ্রামে যেমন পৌষপার্বন অনুষ্ঠিত হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিন ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়; একইভাবে শহরজুড়ে ‘সাকরাইন’ উৎসবে মেতে ওঠে মানুষ। বিশেষ করে ঐতিহ্যের পুনরুত্থানের জন্যে পুরান ঢাকাজুড়ে সাকরাইন এখন যেন জাতীয় অনুষ্ঠান। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ভিড় করেন ঘুড়ি উড়ানোর এক সর্বজনীন উৎসবে মিলিত হতে। শীতকাল এখন বাংলার মানুষের কাছে অনুজ্জ্বল, রিক্ততার কাল নয় বরঞ্চ সব শ্রেণীপেশার মানুষে মধ্যে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে সম্প্রীতি, মিলনের অপার্থিব এক আনন্দের কাল। শীতের আবাহমান রূপকে ধ্বংস না করে, শীতকে সব শ্রেণীর মানুষের উৎসব আনন্দের ঋতু হিসেবে আরও বর্ণিল ও উজ্জ্বল করে তোলার সুযোগ রয়েছে। এজন্য সব উন্নয়ন কর্মকান্ড হতে হবে প্রকৃতিবান্ধব। আর আমরা যদি প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে আমাদের শাশ্বত আনন্দ, উৎসবকে যেমন বাচিয়ে রাখতে পারব একইভাবে প্রকৃতির স্বকীয় রূপকেও ধরে রাখতে সমর্থ হব।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top