মাহমুদুল হাছান
শিক্ষণ ও শিখন কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা আসলেই কারিকুলাম ও সিলাবাসের কথা আসতেই হবে। কারণ এ দুটি ছাড়া কোন শিক্ষাই ফলপ্রসূ হয় না। শিক্ষার মান নির্ণয় ও মান নিয়ন্ত্রণ উভয়টিই নির্ভর করে কারিকুলাম ও সিলাবসের ওপর ভিত্তি করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ মানুষ বা শিক্ষিত অশিক্ষিতদের অধিকাংশই কারিকুলাম ও সিলেবাসকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকে। তারা সিলেবাস বলতে কারিকুলাম আবার কারিকুলাম বলতে সিলেবাস বুঝিয়ে থাকেন; কিন্তু দুটি যে সম্পূর্ণ আলাদা তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
কারিকুলামের অর্থ ও বিকাশ : ইংরেজি কারিকুলাম (Curriculum) শব্দটির বাংলা পরিভাষা হিসেবে শিক্ষাক্রম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কারিকুলাম কথাটি ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হল দৌড়ানো বা ঘোড়দৌড়ের নির্দিষ্ট পথ। আভিধানিক অর্থে শিক্ষাক্রম বলতে বোঝায়, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একটি কোর্স। শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা আসলে যুগে যুগে লেখকভেদে ক্রমাগত বিবর্তন লাভ করে চলেছে। তাই শিক্ষাক্রমের সর্বজনস্বীকৃত কোনো একক সংজ্ঞার উদ্ভব হয়নি। উন্নত দেশে শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে মূলত ‘কোর্স অব স্টাডি‘কে বোঝানো হতো। শিক্ষাক্রমকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু, কোর্স সীমারেখা, শিক্ষক নির্দেশিকা বা উৎপাদিত সামগ্রী (product) হিসেবে দেখা হতো। শিক্ষাক্রমের এই প্রাচীন ধারণা ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় প্রচলিত ছিল। প্রাচীনকালে জ্ঞান আহরণ করাই ছিল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এ জন্য শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্খলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হতো। ১৯৩০ সালের পর থেকে শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয় এবং শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এ সময় শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সব শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বুঝানো হল।
১৯৩৫ সালে ক্যাসওয়েল এবং ক্যাম্পবেল শিক্ষাক্রমের সনাতন ধারণার অবসান ঘটিয়ে আমেরিকায় একটি নতুন সংজ্ঞার প্রস্তাব করেন। তারা বলেন, ‘শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সব অভিজ্ঞতা।’ অন্যান্য লেখকও ক্যাসওয়েল ও ক্যাম্পবেলের অনুসরণে শিক্ষাক্রমকে ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের প্রভাব প্রকটরূপে দেখা দিল। এর ফলে ষাটের দশকে শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে আমেরিকায় অনেক শিক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু শিক্ষাবিদ শিক্ষাক্রমকে শিখন পরিকল্পনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।
এ প্রসঙ্গে টাবা বলেন, শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষার পরিকল্পনা। ষাটের দশকে এবং সত্তরের দশকের প্রথমে অনেকেই স্কুলের কাজকে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। শিল্প-কারখানায় যেমন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে নানারকম দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়, তেমনি স্কুলের কাজ হবে অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এ ধারণা অনুযায়ী স্কুলের সার্বিক ফলাফল, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পারদর্শিতা ও কৃতিত্বের মূল্যায়নের ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এর ফল হিসেবে মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করা এবং স্কুলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকে।
১৯৭০ সালে পোফাম ও বেকার শিক্ষাক্রমকে স্কুলের সেই সব পরিকল্পিত শিখন ফল হিসেবে উল্লেখ করেন, যা অর্জনের দায়দায়িত্ব স্কুলের ওপর বর্তায়। ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ লটন শিক্ষাক্রমের উপাদান নির্বাচনের ব্যাপারে সামাজিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের (যেমন- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ইত্যাদি) শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মসূচি সব কিছুই শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে। একটি নির্দিষ্ট বয়স ও শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা কী জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে- তার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল হচ্ছে শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম। কারিকুলাম হচ্ছে সমগ্র শিক্ষা কার্যক্রমের রূপরেখা। কারিকুলামের লক্ষ্য জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় নীতি, জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিবেশ এবং চাহিদা ও উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তার আলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়। এর লক্ষ্য থাকে অনেক ব্যাপক।
এসব লক্ষ্য অর্জন করার জন্য অনেকগুলো সাধারণ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে কোন কোন বিষয়বস্তুর মাধ্যমে অর্জন করতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। এখান থেকেই নির্ধারণ করা হয় বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্য। বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যসমূহকে আবার স্তরভিত্তিক উদ্দেশ্যে বিন্যাস করা হয়। অতঃপর স্তরের ওপর ভিত্তি করে বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য নির্ধারণ করা হয় শিখন ফল। একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশিজ ক্ষেত্রসমূহ বিবেচনা করে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও শিখন ফল প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট স্তর অনুযায়ী কী অর্জন করবে- তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনাই হলো শিখন ফল। শিখন ফলগুলো হবে সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য ও মূল্যায়নযোগ্য।
পাঠ্যসূচির অর্থ : সিলাবাস (Syllabus) শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। বাংলা পরিভাষায় সিলাবাস বলতে পাঠ্যসূচি, পাঠসূচি, শিক্ষাসূচি শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে সংজ্ঞায়িত করতে সিলেবাস বলা হয়- A summary outline of a discourse, treatise, or course of study or of examination requirements. অর্থাৎ কোন পাঠ বা কোর্সের পাঠদান প্রক্রিয়ার সারকথা বা পরীক্ষার জন্য প্রয়োসজনীয় দিকনির্দেশনা হলো সিলেবাস।
শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্য বিষয়াদির কোন কোন অংশ কোন শ্রেণিতে পড়ানো হবে তার নির্ধারিত রূপই হচ্ছে পাঠ্যসূচি। পাঠ্যসূচি শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। অনেক পাঠ্যসূচি নিয়েই শিক্ষাক্রম গঠিত। পাঠ্যসূচির গন্ডি শুধু শিক্ষণীয় বিষয়সমূহে সীমাবদ্ধ।
অর্থাৎ প্রতি শ্রেণীতে প্রতি বিষয়ে কিকি বিষয়বস্তু পড়ানো হবে তার একটি তালিকাই পাঠ্যসূচি। আমরা এটিকে যদি অন্যভাবে বলি, তাহলে বলতে হবে, পাঠ্যসূচি হলো শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। সাধারণত শিক্ষাক্রমের একটি বিশেষ উপাদান বিষয়বস্তু নিয়ে পাঠ্যসূচি গঠিত হয়। কোনো শ্রেণীতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কী কী বিষয়বস্তু পড়ানো হবে, তারই বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা হল পাঠ্যসূচি। সাধারণত শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষাক্রম পৌঁছায় না। কোনো কোর্সের শুরুতেই পাঠ্যসূচি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে হবে। পাঠ্যসূচির লক্ষ্য হলো বিশেষ দিকের বিকাশ সাধন ও বিশেষ বিষয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন। পাঠ্যসূচি পঠিতব্য বিষয়সমূহের ওপর পৃথকভাবে প্রণীত হয়।
কারিকুলাম ও সিলেবাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য : কারিকুলাম হলো এমন এক শিক্ষাক্রম; যা নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোন কোর্স অথবা কোন পাঠ্যপুস্তক কিভাবে পড়ানো হবে বা কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তার পদ্ধতির সামগ্রিক আলোচনা। পক্ষান্তরে সিলেবাস হলো পূর্ণ শিক্ষাবর্ষে বা নির্দিষ্ট কোন সময়ের মধ্যে কি পড়ান হবে বা কতটুকু পড়ানো হবে তার সারসংক্ষেপ আলোচনা।
কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বা সরকার কিংবা কোন সংস্থা দ্বারা গঠিত টিমের মাধ্যমে আর সিলেবাস প্রস্তুত করা হয় একজন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দ্বারা।
কারিকুলাম ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছাপানো আকারে বা সফট কপিতে দেয়া হয় না বরং তা পান্ডুলিপি আকারে কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে। পক্ষান্তরে সিলেবাস ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষকদের কাছে দেয়া হয়, যাতে তারা সময়মতো তা পড়িয়ে শেষ করতে পারে।
কারিকুলাম শব্দটি ল্যাটিন আর সিলেবাস শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। কারিকুলাম নির্দেশনামূলোক বা Prescriptive আর সিলেবাস বর্ণনামূলোক বা Descriptive।
কারিকুলামের পরিসর ব্যাপক আর সিলেবাসের পরিসর সীমিত।
কারিকুলাম একটি কোর্স বা পাঠ্যবই কেন্দ্রিক আর সিলেবাস উক্ত কোর্স ও বইয়ের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কন্টেন্টস বা বিষয়ভিত্তিক।
কারিকুলাম সম্পূর্ণ শিক্ষাবর্ষ বা সেমিস্টার অনুযায়ী আর সিলেবাস নির্দিষ্ট কোন পরীক্ষা অনুযায়ী হয়ে থাকে।
কারিকুলাম পরিবর্তন ও পরিমার্জনের ক্ষমতা একমাত্র কর্তৃপক্ষের অধীন, পক্ষান্তরে সিলেবাসের উন্নয়ন বা পরিবর্তন বা পরিমার্জনের এখতিয়ার শিক্ষকের।
কারিকুলাম শিক্ষার বিষয়, ধরন, প্রকৃতি ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে, পক্ষান্তরে সিলেবাস শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা তার মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
মোটকথা, শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামকে একটি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে, পাঠ্যসূচি বা Syllabus হবে ওই বৃক্ষের একটি শাখা। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনের বিকাশ সাধন, পক্ষান্তরে পাঠ্যসূচি শিক্ষার্থীর একটি বিশেষ দিকের বিকাশ সাধন করে থাকে। শিক্ষার্থীদের অর্জন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে মূল্যায়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক আন্তরিকতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ যেন উভয়ের মধ্যে একটি সুসমন্বয় থাকে এবং শিক্ষণ ও শিখন কার্যক্রম বাস্তবধর্মী হয়।
[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]
মাহমুদুল হাছান
রোববার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৩
শিক্ষণ ও শিখন কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা আসলেই কারিকুলাম ও সিলাবাসের কথা আসতেই হবে। কারণ এ দুটি ছাড়া কোন শিক্ষাই ফলপ্রসূ হয় না। শিক্ষার মান নির্ণয় ও মান নিয়ন্ত্রণ উভয়টিই নির্ভর করে কারিকুলাম ও সিলাবসের ওপর ভিত্তি করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ মানুষ বা শিক্ষিত অশিক্ষিতদের অধিকাংশই কারিকুলাম ও সিলেবাসকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকে। তারা সিলেবাস বলতে কারিকুলাম আবার কারিকুলাম বলতে সিলেবাস বুঝিয়ে থাকেন; কিন্তু দুটি যে সম্পূর্ণ আলাদা তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
কারিকুলামের অর্থ ও বিকাশ : ইংরেজি কারিকুলাম (Curriculum) শব্দটির বাংলা পরিভাষা হিসেবে শিক্ষাক্রম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কারিকুলাম কথাটি ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হল দৌড়ানো বা ঘোড়দৌড়ের নির্দিষ্ট পথ। আভিধানিক অর্থে শিক্ষাক্রম বলতে বোঝায়, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য একটি কোর্স। শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা আসলে যুগে যুগে লেখকভেদে ক্রমাগত বিবর্তন লাভ করে চলেছে। তাই শিক্ষাক্রমের সর্বজনস্বীকৃত কোনো একক সংজ্ঞার উদ্ভব হয়নি। উন্নত দেশে শিক্ষাক্রম নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে মূলত ‘কোর্স অব স্টাডি‘কে বোঝানো হতো। শিক্ষাক্রমকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু, কোর্স সীমারেখা, শিক্ষক নির্দেশিকা বা উৎপাদিত সামগ্রী (product) হিসেবে দেখা হতো। শিক্ষাক্রমের এই প্রাচীন ধারণা ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় প্রচলিত ছিল। প্রাচীনকালে জ্ঞান আহরণ করাই ছিল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এ জন্য শিক্ষাক্রম প্রণয়নে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্খলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হতো। ১৯৩০ সালের পর থেকে শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয় এবং শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এ সময় শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সব শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বুঝানো হল।
১৯৩৫ সালে ক্যাসওয়েল এবং ক্যাম্পবেল শিক্ষাক্রমের সনাতন ধারণার অবসান ঘটিয়ে আমেরিকায় একটি নতুন সংজ্ঞার প্রস্তাব করেন। তারা বলেন, ‘শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সব অভিজ্ঞতা।’ অন্যান্য লেখকও ক্যাসওয়েল ও ক্যাম্পবেলের অনুসরণে শিক্ষাক্রমকে ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের প্রভাব প্রকটরূপে দেখা দিল। এর ফলে ষাটের দশকে শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে আমেরিকায় অনেক শিক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু শিক্ষাবিদ শিক্ষাক্রমকে শিখন পরিকল্পনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।
এ প্রসঙ্গে টাবা বলেন, শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষার পরিকল্পনা। ষাটের দশকে এবং সত্তরের দশকের প্রথমে অনেকেই স্কুলের কাজকে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। শিল্প-কারখানায় যেমন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে নানারকম দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়, তেমনি স্কুলের কাজ হবে অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এ ধারণা অনুযায়ী স্কুলের সার্বিক ফলাফল, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পারদর্শিতা ও কৃতিত্বের মূল্যায়নের ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এর ফল হিসেবে মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করা এবং স্কুলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকে।
১৯৭০ সালে পোফাম ও বেকার শিক্ষাক্রমকে স্কুলের সেই সব পরিকল্পিত শিখন ফল হিসেবে উল্লেখ করেন, যা অর্জনের দায়দায়িত্ব স্কুলের ওপর বর্তায়। ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ লটন শিক্ষাক্রমের উপাদান নির্বাচনের ব্যাপারে সামাজিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের (যেমন- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ইত্যাদি) শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মসূচি সব কিছুই শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে। একটি নির্দিষ্ট বয়স ও শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা কী জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে- তার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল হচ্ছে শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম। কারিকুলাম হচ্ছে সমগ্র শিক্ষা কার্যক্রমের রূপরেখা। কারিকুলামের লক্ষ্য জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় নীতি, জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিবেশ এবং চাহিদা ও উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তার আলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়। এর লক্ষ্য থাকে অনেক ব্যাপক।
এসব লক্ষ্য অর্জন করার জন্য অনেকগুলো সাধারণ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে কোন কোন বিষয়বস্তুর মাধ্যমে অর্জন করতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। এখান থেকেই নির্ধারণ করা হয় বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্য। বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যসমূহকে আবার স্তরভিত্তিক উদ্দেশ্যে বিন্যাস করা হয়। অতঃপর স্তরের ওপর ভিত্তি করে বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য নির্ধারণ করা হয় শিখন ফল। একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশিজ ক্ষেত্রসমূহ বিবেচনা করে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও শিখন ফল প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট স্তর অনুযায়ী কী অর্জন করবে- তার সুনির্দিষ্ট বর্ণনাই হলো শিখন ফল। শিখন ফলগুলো হবে সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য ও মূল্যায়নযোগ্য।
পাঠ্যসূচির অর্থ : সিলাবাস (Syllabus) শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। বাংলা পরিভাষায় সিলাবাস বলতে পাঠ্যসূচি, পাঠসূচি, শিক্ষাসূচি শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে সংজ্ঞায়িত করতে সিলেবাস বলা হয়- A summary outline of a discourse, treatise, or course of study or of examination requirements. অর্থাৎ কোন পাঠ বা কোর্সের পাঠদান প্রক্রিয়ার সারকথা বা পরীক্ষার জন্য প্রয়োসজনীয় দিকনির্দেশনা হলো সিলেবাস।
শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্য বিষয়াদির কোন কোন অংশ কোন শ্রেণিতে পড়ানো হবে তার নির্ধারিত রূপই হচ্ছে পাঠ্যসূচি। পাঠ্যসূচি শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। অনেক পাঠ্যসূচি নিয়েই শিক্ষাক্রম গঠিত। পাঠ্যসূচির গন্ডি শুধু শিক্ষণীয় বিষয়সমূহে সীমাবদ্ধ।
অর্থাৎ প্রতি শ্রেণীতে প্রতি বিষয়ে কিকি বিষয়বস্তু পড়ানো হবে তার একটি তালিকাই পাঠ্যসূচি। আমরা এটিকে যদি অন্যভাবে বলি, তাহলে বলতে হবে, পাঠ্যসূচি হলো শিক্ষাক্রমের অংশবিশেষ। সাধারণত শিক্ষাক্রমের একটি বিশেষ উপাদান বিষয়বস্তু নিয়ে পাঠ্যসূচি গঠিত হয়। কোনো শ্রেণীতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কী কী বিষয়বস্তু পড়ানো হবে, তারই বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা হল পাঠ্যসূচি। সাধারণত শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষাক্রম পৌঁছায় না। কোনো কোর্সের শুরুতেই পাঠ্যসূচি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে হবে। পাঠ্যসূচির লক্ষ্য হলো বিশেষ দিকের বিকাশ সাধন ও বিশেষ বিষয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন। পাঠ্যসূচি পঠিতব্য বিষয়সমূহের ওপর পৃথকভাবে প্রণীত হয়।
কারিকুলাম ও সিলেবাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য : কারিকুলাম হলো এমন এক শিক্ষাক্রম; যা নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোন কোর্স অথবা কোন পাঠ্যপুস্তক কিভাবে পড়ানো হবে বা কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তার পদ্ধতির সামগ্রিক আলোচনা। পক্ষান্তরে সিলেবাস হলো পূর্ণ শিক্ষাবর্ষে বা নির্দিষ্ট কোন সময়ের মধ্যে কি পড়ান হবে বা কতটুকু পড়ানো হবে তার সারসংক্ষেপ আলোচনা।
কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বা সরকার কিংবা কোন সংস্থা দ্বারা গঠিত টিমের মাধ্যমে আর সিলেবাস প্রস্তুত করা হয় একজন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দ্বারা।
কারিকুলাম ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছাপানো আকারে বা সফট কপিতে দেয়া হয় না বরং তা পান্ডুলিপি আকারে কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে। পক্ষান্তরে সিলেবাস ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষকদের কাছে দেয়া হয়, যাতে তারা সময়মতো তা পড়িয়ে শেষ করতে পারে।
কারিকুলাম শব্দটি ল্যাটিন আর সিলেবাস শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। কারিকুলাম নির্দেশনামূলোক বা Prescriptive আর সিলেবাস বর্ণনামূলোক বা Descriptive।
কারিকুলামের পরিসর ব্যাপক আর সিলেবাসের পরিসর সীমিত।
কারিকুলাম একটি কোর্স বা পাঠ্যবই কেন্দ্রিক আর সিলেবাস উক্ত কোর্স ও বইয়ের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কন্টেন্টস বা বিষয়ভিত্তিক।
কারিকুলাম সম্পূর্ণ শিক্ষাবর্ষ বা সেমিস্টার অনুযায়ী আর সিলেবাস নির্দিষ্ট কোন পরীক্ষা অনুযায়ী হয়ে থাকে।
কারিকুলাম পরিবর্তন ও পরিমার্জনের ক্ষমতা একমাত্র কর্তৃপক্ষের অধীন, পক্ষান্তরে সিলেবাসের উন্নয়ন বা পরিবর্তন বা পরিমার্জনের এখতিয়ার শিক্ষকের।
কারিকুলাম শিক্ষার বিষয়, ধরন, প্রকৃতি ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে, পক্ষান্তরে সিলেবাস শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা তার মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
মোটকথা, শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামকে একটি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে, পাঠ্যসূচি বা Syllabus হবে ওই বৃক্ষের একটি শাখা। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনের বিকাশ সাধন, পক্ষান্তরে পাঠ্যসূচি শিক্ষার্থীর একটি বিশেষ দিকের বিকাশ সাধন করে থাকে। শিক্ষার্থীদের অর্জন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে মূল্যায়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক আন্তরিকতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ যেন উভয়ের মধ্যে একটি সুসমন্বয় থাকে এবং শিক্ষণ ও শিখন কার্যক্রম বাস্তবধর্মী হয়।
[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]