আলমগীর খান
একটি জাতির যেমন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি পরিচয় থাকে, তেমনি তার বৌদ্ধিক পরিচয়ও থাকে। জাতির বৌদ্ধিক সত্তা আসলে তার অন্যান্য সত্তার রূপ নির্ধারণ করে। এই বৌদ্ধিক সত্তার মূল ধারকবাহক সেই জাতির লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রমুখ নেশা ও পেশার মানুষেরা।
আহমদ ছফা এ বিষয়ে চমৎকার ভাষায় লিখেছিলেন- ‘কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার ভ্রুণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। ... কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কবি, সাহিত্যিক, তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই।’
তখন ছিল না আর এখনও নেই। কারণ একটি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সত্তা যেমন পশ্চাৎপদতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিতে পারে, বৌদ্ধিক সত্তার ক্ষেত্রেও তেমনটা হতে পারে। জাতির বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সৎ, দৃঢ়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক যেমন হতে পারেন, তেমনি তারা ক্ষয়িষ্ণু, তেলবাজ, অসৎ, বিশ্বাসঘাতক ও মিথ্যাচারীও হতে পারে। তবে সার্বিক চিত্র যেমনই হোক, তার মাঝে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব সবসময় ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন মোটের ওপর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল অংশের মাঝে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলমান থাকে।
এই দুঃখজনক শূন্যতার মাঝেও আহমদ ছফা ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি তার সময়ের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে অগ্রসর ছিলেন। সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ সবকিছুতেই ছফা নিঃসন্দেহে ছিলেন অনুসরণীয়; যা তিনি আজও। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট কথার ক্ষমতায় তিনি সেদিন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যে সমালোচনা করেছিলেন তা বহুল উদ্ধৃত। ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে তাঁর সমালোচনা কশাঘাতে পরিণত হয়েছে। ছফা বেঁচে থাকলে হয়তো এখন গাভীর চেয়েও কোনো ছোট প্রাণীর বিত্তান্ত লিখতেন। আর বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা এখন ছফার সময়ের চেয়েও অনেক খারাপ।
ব্যক্তিগতভাবে চেতনার আলোকবর্তিকা হয়ে এখনো অল্প কয়েকজন আছেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর বাজার বিরাট, সেখানে তো উনারা নেই। সেখানে যে যত বেশি দামে বিক্রি হতে পারেন সে তত বড় বুদ্ধিজীবী। তাদের আবার কোম্পানির পণ্যের মতই ব্র্যান্ডিং থাকে, পেছনে থাকে কর্পোরেট পুঁজির হাত। আলো ছড়ানোয় অদ্বিতীয় বলে যারা দাবিদার তাদের ব্র্যান্ডিং এখন বাজারে সবচেয়ে ভালো চলে ও বেশি দামে বিক্রি হয়। আরেকটা রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং, সেটাও অর্থনৈতিক-সামাজিক নানারকম বাড়তি, বৈধ ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য মোক্ষম। এই কর্পোরেট দৌরাত্ম্য ও দলীয় রাজনীতি এখন একাকার হওয়ার পথে। এই দুই ব্র্যান্ডিংয়ের মাঝে কর্পোরেট ব্র্যান্ডিংয়ে একটা এলিট এলিট ভাব থাকে। মোটের ওপর এই হলো আমাদের দেশে দুই প্রধান বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ক্যাটাগরি।
কর্পোরেট ও দলীয় আধিপত্যের বাইরে থেকে যারা জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সুস্থ চিন্তার চর্চা করছেন, তাদের বাজারমূল্য ও বাজারি একচেটিয়াত্ব কম। তখনকার আমলে আহমদ ছফা ছিলেন এই ধারার লেখক এবং সত্যিকার সৎ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও ব্যতিক্রমী চিন্তার বুদ্ধিজীবী। সে কারণে জীবদ্দশায় অভাব-অনটনে তার জীবন কেটেছে; কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন চিন্তাচর্চার বিরাট সম্পদ।
আহমদ ছফা যে বাক্যে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন, যা দিয়ে শুরু হয়েছিল তার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইটি তা বহুল উদ্ধৃত ও এখন কালজয়ী : ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইতে বলা তার অনেক কথা এখনও একইভাবে প্রযোজ্য, কেবল প্রেক্ষাপট বদলে। যেমন ধরুন :
‘রাষ্ট্রীয় দর্শন আওড়ালে, প্রশংসা করলে পয়সা পাওয়া যেত। তাই তারা দরাজ গলায় এমন একনিষ্ঠভাবে রাষ্ট্রীয় দর্শনের গুণ বাখান করতেন। ... শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় দর্শনকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য অনেক খ্যাতনামা পন্ডিত ব্যক্তি এবং বিদগ্ধজন কত অকাজ-কুকাজ করেছেন একটা দৃষ্টান্ত দিলেই পরিষ্কার হবে।’
ছফা ১৯৭২ সালে এ কথাগুলো লেখার পর পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা দিয়ে কত পানি গড়িয়ে গেল, অথচ কথাগুলো এখন আরও সত্যে পরিণত হয়েছে- রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আরও ন্যাক্কারজনক। তিনি লিখেছিলেন : ‘রাজনীতি হলো মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখলের অস্ত্র আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের, উড়নচন্ডী কবি-সাহিত্যিকদের বিলাসের, চিত্ত বিনোদনের উপায় হয়ে দেখা দিল।’
ছফার সময়ে রাজনীতিটা অন্তত ছিল মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতার জন্য ক্ষমতা দখলের অস্ত্র, এখন আর তাও দরকার হয় না। আর সংস্কৃতিচর্চায় তখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররা ছিলেন, এখন তারা নানারকম আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে অনেক বেশি খ্যাপ মারায় ব্যস্ত। এমনকি বেকার আধপেটা উড়নচন্ডী কবি-সাহিত্যিকরাও মাঠ ছেড়ে দিয়েছে কর্পোরেট পুঁজি ও দলীয় ক্ষমতার দাস সেয়ানা লেখক-ঔপন্যাসিকদের কাছে।
জ্ঞানচর্চায় আমাদের চরম দেউলিয়াত্বের কথা সেদিন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন ছফা। বলেছেন, ‘আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রকৃত লক্ষ্য কি সে সম্পর্কে বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাই শেষ পর্যন্ত অনবহিত থেকে যান।’
আমাদের বিজ্ঞানচর্চার অবস্থা এখন তার চেয়ে মোটেও ভালো নয়। হ্যাঁ, দামি সনদওয়ালা মিস্ত্রি আর বৈদ্য তৈরি হয়েছে অনেক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক আছেন যারা ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ান মাসিক বেতনটা তোলার জন্য, মনে মনে বিশ্বাস করেন বিবর্তনবাদ-পূর্ব কোন ধারণাকে। শুধু তাই নয়, পড়ানোর ফাঁকে আকারে ইঙ্গিতে ডারউইনকেও বদলে ফেলে পশ্চাদমুখী আত্মবিবর্তনের নজির স্থাপন করেন।
২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং ‘শিক্ষালোক’ যৌথভাবে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। যেখানে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ও বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকী এবং তাদের ‘অব্যক্ত’ ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে রোকেয়ার রচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, পূর্বপ্রজন্মের লেখকদের রচনাসমূহ অববিকৃত অবস্থায় উত্তরসূরীদের হাতে আসা উচিত; যা এখন নেই। এ অবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের আশা করে লাভ কী?
ছফার আমলের চেয়ে এখন বিজ্ঞানের কদর বাংলাদেশে অনেক বেশি। স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর বেহাল দশা ও উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানের বই এখনও বিদেশি ভাষায় পড়ানো হয়, তাতে কি? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েতো বলতে গেলে দেশ ছেয়ে গেছে; কিন্তু উচ্চনম্বরধারী উচ্চমেধাসম্পন্ন বলে খ্যাতি অর্জনকারী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের যেসব বিষয় পড়তে ইঁদুর দৌড় দৌড়াচ্ছে তাতে বিজ্ঞানচিন্তার চেয়ে অর্থলাভের সংযোগ হাজারগুণ বেশি। উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানের বিষয় নির্বাচনে এরা হিসাবশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের চেয়েও বেশি হিসাবি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো দেখে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র বলে ভ্রম হয়! নাকি ঠিকই মনে হয়! বিজ্ঞানচর্চার নামে এই নষ্টামি শুধু আমাদের মতো দেশেই সম্ভব যেখানে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা ছফার গাভীওয়ালা উপাচার্যের মতো।
‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’র উক্ত অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্বে সভাপতির ভাষণে তাই শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম অক্ষেপ করে বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বেশি অন্ধকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ, মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। হায় লজ্জা!
অহমদ ছফা পাকিস্তান আমলের একটি দৈনিক পত্রিকার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে আত্মবিক্রয় করেছিলেন যারা তারা যেমন বাংলা লিখতে পারতেন, তেমনি সাংবাদিকতায় হাত পাকা; আবার কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক ও বামপন্থী রাজনীতি-ঘেঁষা বলে খ্যাতি-অর্জনকারীও ছিলেন। এর রঙচঙে সাহিত্য পাতাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘সাহিত্যের কসাইখানা।’ একইরকম চরিত্রের আত্মবিক্রীত চৌকস লোকজন দ্বারা পরিচালিত এরকম পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আর রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনকে কসরত করতে হয় না। এই স্বাধীন রাষ্ট্র বহিঃশক্তির গোলামি করা যে পুঁজিকে অবাধ বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে এ দায়িত্ব এখন তারাই পালন করছে। ‘সর্ব মানুষের’ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন ছফা দেখেছিলেন তা এখন কর্পোরেট পুঁজির ও অন্ধদের তৈরি ‘কসাইখানা’য় শুয়ে আছে। হায় ছফা! হায় স্বদেশ!
তবু ছফার স্বপ্নের সর্বমানবের বাংলাদেশ তৈরির লড়াই চলছে, চলবে।
[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]
আলমগীর খান
শনিবার, ০৪ মার্চ ২০২৩
একটি জাতির যেমন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি পরিচয় থাকে, তেমনি তার বৌদ্ধিক পরিচয়ও থাকে। জাতির বৌদ্ধিক সত্তা আসলে তার অন্যান্য সত্তার রূপ নির্ধারণ করে। এই বৌদ্ধিক সত্তার মূল ধারকবাহক সেই জাতির লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রমুখ নেশা ও পেশার মানুষেরা।
আহমদ ছফা এ বিষয়ে চমৎকার ভাষায় লিখেছিলেন- ‘কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার ভ্রুণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। ... কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কবি, সাহিত্যিক, তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই।’
তখন ছিল না আর এখনও নেই। কারণ একটি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সত্তা যেমন পশ্চাৎপদতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিতে পারে, বৌদ্ধিক সত্তার ক্ষেত্রেও তেমনটা হতে পারে। জাতির বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সৎ, দৃঢ়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক যেমন হতে পারেন, তেমনি তারা ক্ষয়িষ্ণু, তেলবাজ, অসৎ, বিশ্বাসঘাতক ও মিথ্যাচারীও হতে পারে। তবে সার্বিক চিত্র যেমনই হোক, তার মাঝে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব সবসময় ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন মোটের ওপর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল অংশের মাঝে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলমান থাকে।
এই দুঃখজনক শূন্যতার মাঝেও আহমদ ছফা ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি তার সময়ের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে অগ্রসর ছিলেন। সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ সবকিছুতেই ছফা নিঃসন্দেহে ছিলেন অনুসরণীয়; যা তিনি আজও। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট কথার ক্ষমতায় তিনি সেদিন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যে সমালোচনা করেছিলেন তা বহুল উদ্ধৃত। ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে তাঁর সমালোচনা কশাঘাতে পরিণত হয়েছে। ছফা বেঁচে থাকলে হয়তো এখন গাভীর চেয়েও কোনো ছোট প্রাণীর বিত্তান্ত লিখতেন। আর বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা এখন ছফার সময়ের চেয়েও অনেক খারাপ।
ব্যক্তিগতভাবে চেতনার আলোকবর্তিকা হয়ে এখনো অল্প কয়েকজন আছেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর বাজার বিরাট, সেখানে তো উনারা নেই। সেখানে যে যত বেশি দামে বিক্রি হতে পারেন সে তত বড় বুদ্ধিজীবী। তাদের আবার কোম্পানির পণ্যের মতই ব্র্যান্ডিং থাকে, পেছনে থাকে কর্পোরেট পুঁজির হাত। আলো ছড়ানোয় অদ্বিতীয় বলে যারা দাবিদার তাদের ব্র্যান্ডিং এখন বাজারে সবচেয়ে ভালো চলে ও বেশি দামে বিক্রি হয়। আরেকটা রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং, সেটাও অর্থনৈতিক-সামাজিক নানারকম বাড়তি, বৈধ ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য মোক্ষম। এই কর্পোরেট দৌরাত্ম্য ও দলীয় রাজনীতি এখন একাকার হওয়ার পথে। এই দুই ব্র্যান্ডিংয়ের মাঝে কর্পোরেট ব্র্যান্ডিংয়ে একটা এলিট এলিট ভাব থাকে। মোটের ওপর এই হলো আমাদের দেশে দুই প্রধান বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ক্যাটাগরি।
কর্পোরেট ও দলীয় আধিপত্যের বাইরে থেকে যারা জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সুস্থ চিন্তার চর্চা করছেন, তাদের বাজারমূল্য ও বাজারি একচেটিয়াত্ব কম। তখনকার আমলে আহমদ ছফা ছিলেন এই ধারার লেখক এবং সত্যিকার সৎ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও ব্যতিক্রমী চিন্তার বুদ্ধিজীবী। সে কারণে জীবদ্দশায় অভাব-অনটনে তার জীবন কেটেছে; কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন চিন্তাচর্চার বিরাট সম্পদ।
আহমদ ছফা যে বাক্যে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন, যা দিয়ে শুরু হয়েছিল তার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইটি তা বহুল উদ্ধৃত ও এখন কালজয়ী : ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইতে বলা তার অনেক কথা এখনও একইভাবে প্রযোজ্য, কেবল প্রেক্ষাপট বদলে। যেমন ধরুন :
‘রাষ্ট্রীয় দর্শন আওড়ালে, প্রশংসা করলে পয়সা পাওয়া যেত। তাই তারা দরাজ গলায় এমন একনিষ্ঠভাবে রাষ্ট্রীয় দর্শনের গুণ বাখান করতেন। ... শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় দর্শনকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য অনেক খ্যাতনামা পন্ডিত ব্যক্তি এবং বিদগ্ধজন কত অকাজ-কুকাজ করেছেন একটা দৃষ্টান্ত দিলেই পরিষ্কার হবে।’
ছফা ১৯৭২ সালে এ কথাগুলো লেখার পর পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা দিয়ে কত পানি গড়িয়ে গেল, অথচ কথাগুলো এখন আরও সত্যে পরিণত হয়েছে- রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আরও ন্যাক্কারজনক। তিনি লিখেছিলেন : ‘রাজনীতি হলো মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখলের অস্ত্র আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের, উড়নচন্ডী কবি-সাহিত্যিকদের বিলাসের, চিত্ত বিনোদনের উপায় হয়ে দেখা দিল।’
ছফার সময়ে রাজনীতিটা অন্তত ছিল মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতার জন্য ক্ষমতা দখলের অস্ত্র, এখন আর তাও দরকার হয় না। আর সংস্কৃতিচর্চায় তখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররা ছিলেন, এখন তারা নানারকম আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে অনেক বেশি খ্যাপ মারায় ব্যস্ত। এমনকি বেকার আধপেটা উড়নচন্ডী কবি-সাহিত্যিকরাও মাঠ ছেড়ে দিয়েছে কর্পোরেট পুঁজি ও দলীয় ক্ষমতার দাস সেয়ানা লেখক-ঔপন্যাসিকদের কাছে।
জ্ঞানচর্চায় আমাদের চরম দেউলিয়াত্বের কথা সেদিন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন ছফা। বলেছেন, ‘আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রকৃত লক্ষ্য কি সে সম্পর্কে বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাই শেষ পর্যন্ত অনবহিত থেকে যান।’
আমাদের বিজ্ঞানচর্চার অবস্থা এখন তার চেয়ে মোটেও ভালো নয়। হ্যাঁ, দামি সনদওয়ালা মিস্ত্রি আর বৈদ্য তৈরি হয়েছে অনেক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক আছেন যারা ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ান মাসিক বেতনটা তোলার জন্য, মনে মনে বিশ্বাস করেন বিবর্তনবাদ-পূর্ব কোন ধারণাকে। শুধু তাই নয়, পড়ানোর ফাঁকে আকারে ইঙ্গিতে ডারউইনকেও বদলে ফেলে পশ্চাদমুখী আত্মবিবর্তনের নজির স্থাপন করেন।
২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং ‘শিক্ষালোক’ যৌথভাবে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। যেখানে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ও বেগম রোকেয়ার জন্মবার্ষিকী এবং তাদের ‘অব্যক্ত’ ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে রোকেয়ার রচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, পূর্বপ্রজন্মের লেখকদের রচনাসমূহ অববিকৃত অবস্থায় উত্তরসূরীদের হাতে আসা উচিত; যা এখন নেই। এ অবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের আশা করে লাভ কী?
ছফার আমলের চেয়ে এখন বিজ্ঞানের কদর বাংলাদেশে অনেক বেশি। স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর বেহাল দশা ও উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানের বই এখনও বিদেশি ভাষায় পড়ানো হয়, তাতে কি? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েতো বলতে গেলে দেশ ছেয়ে গেছে; কিন্তু উচ্চনম্বরধারী উচ্চমেধাসম্পন্ন বলে খ্যাতি অর্জনকারী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের যেসব বিষয় পড়তে ইঁদুর দৌড় দৌড়াচ্ছে তাতে বিজ্ঞানচিন্তার চেয়ে অর্থলাভের সংযোগ হাজারগুণ বেশি। উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানের বিষয় নির্বাচনে এরা হিসাবশাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের চেয়েও বেশি হিসাবি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো দেখে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র বলে ভ্রম হয়! নাকি ঠিকই মনে হয়! বিজ্ঞানচর্চার নামে এই নষ্টামি শুধু আমাদের মতো দেশেই সম্ভব যেখানে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা ছফার গাভীওয়ালা উপাচার্যের মতো।
‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’র উক্ত অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্বে সভাপতির ভাষণে তাই শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম অক্ষেপ করে বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বেশি অন্ধকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ, মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। হায় লজ্জা!
অহমদ ছফা পাকিস্তান আমলের একটি দৈনিক পত্রিকার কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে আত্মবিক্রয় করেছিলেন যারা তারা যেমন বাংলা লিখতে পারতেন, তেমনি সাংবাদিকতায় হাত পাকা; আবার কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক ও বামপন্থী রাজনীতি-ঘেঁষা বলে খ্যাতি-অর্জনকারীও ছিলেন। এর রঙচঙে সাহিত্য পাতাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘সাহিত্যের কসাইখানা।’ একইরকম চরিত্রের আত্মবিক্রীত চৌকস লোকজন দ্বারা পরিচালিত এরকম পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আর রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনকে কসরত করতে হয় না। এই স্বাধীন রাষ্ট্র বহিঃশক্তির গোলামি করা যে পুঁজিকে অবাধ বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে এ দায়িত্ব এখন তারাই পালন করছে। ‘সর্ব মানুষের’ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন ছফা দেখেছিলেন তা এখন কর্পোরেট পুঁজির ও অন্ধদের তৈরি ‘কসাইখানা’য় শুয়ে আছে। হায় ছফা! হায় স্বদেশ!
তবু ছফার স্বপ্নের সর্বমানবের বাংলাদেশ তৈরির লড়াই চলছে, চলবে।
[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]