alt

উপ-সম্পাদকীয়

লিঙ্গ সমতার জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির সমন্বয়

হীরেন পন্ডিত

: শুক্রবার, ১০ মার্চ ২০২৩

প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য প্রসারিত করার ওপর ডিজিটাল লিঙ্গ ব্যবধানের প্রভাব অন্বেষণ করবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের অধিকার রক্ষা এবং অনলাইন এবং আইসিটি-সুবিধাযুক্ত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলার গুরুত্বকেও আলোকপাত করছে এই বিষয়গুলো।

প্রযুক্তির মধ্যে নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীকে আনার ফলে আরও সৃজনশীল সমাধান পাওয়া যায় এবং নারীর চাহিদা পূরণ করে এবং লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করে এমন উদ্ভাবনের সম্ভাবনাই বেশি। বিপরীতে, তাদের অন্তর্ভুক্তির অভাব ব্যাপক খরচের সঙ্গে আসে : ইউএন উইমেনস জেন্ডার স্ন্যাপশট ২০২২ রিপোর্ট অনুসারে, ডিজিটাল বিশ্ব থেকে নারীদের বাদ দেয়ায় গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন থেকে এক ট্রিলিয়ন কম হয়েছে একটি ক্ষতি যা ২০২৫ সাল নাগাদ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এই প্রবণতাকে উল্টাতে হলে অনলাইন সহিংসতার সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, যা ৫১টি দেশের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৩৮ শতাংশ মহিলা ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছেন।

উদ্ভাবন, প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার জন্য একটি জেন্ডার-প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি নারীরা তাদের অধিকার এবং নাগরিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতি উনয়ন এবং মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এবং ২০৩০ এজেন্ডার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচুর সুযোগ প্রদান করে। দুর্ভাগ্যবশত, ডিজিটাল বিপ্লবের সুযোগগুলো লিঙ্গবৈষম্যের বিদ্যমান নিদর্শনগুলোকে স্থায়ী করার ঝুঁকিও উপস্থাপন করে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ডিজিটাল দক্ষতা এবং প্রযুক্তির অ্যাক্সেসের প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমানভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এই ডিজিটাল লিঙ্গ বিভাজনের ফলে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং রূপান্তরমূলক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তাই একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা এবং জেন্ডার সমতা কর্মীদের একত্রিত করবে যাতে ডিজিটাল সরঞ্জামগুলোতে অ্যাক্সেসের উন্নতিতে সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা হাইলাইট করার সুযোগ প্রদান করা যায় এবং একটি উচ্চ স্তরের প্যানেল আলোচনা করা হবে।

যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এমনকি করোনাকালে সহিংসতা আরো বেড়েছে। করোনা সংকটের কারণে চলমান অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত পরিস্থিতিতে যেখানে নারীরা অধিক সহানুভূতি পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। এ সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাক শিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্পসংখ্যক নারীর মধ্যেই। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।

এরপরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই এর ৫ এবং ১০ অভীষ্ট অর্জনে সাফল্য দেখাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন আছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি? সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই।

বিংশ শতাব্দীতে লিঙ্গসমতাভিত্তিক যে সমাজ গঠনের ডাক দিয়েছিলেন রোকেয়া, সে সমাজ গঠনের পথে আজ ৫০-উত্তীর্ণ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিশ্বের নারীর ক্ষমতায়নে আজ বাংলাদেশ রোল মডেল। নারী ক্ষমতায়ন মূল্যায়নে যেসব অনুঘটক বা সূচক ব্যবহার করা হয় তার সবকটি সূচকে আজ বাংলাদেশ বিশ্বে এগিয়ে।

বাল্যবিয়ে নির্মূলের জন্য বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ সালে প্রণয়ন করা হয়। মেয়েদের শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত করা হয়েছে অবৈতনিক, চালু হয়েছে বৃত্তি, উপবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি। এর মাধ্যমে কমেছে নারী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার, বেড়েছে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এসব সুরক্ষা বলয় কর্মসূচির ফলে তৃণমূল ও প্রান্তিক নারীরা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছেন বহু প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, ট্যাবুর সংস্কার ও বেড়াজাল। বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় উপস্থিতি ও অসাধারণ সাফল্য এ বাস্তবতাকেই তুলে ধরে।

দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য এর চেয়ে বড় ইতিবাচক শর্ত আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেটের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও সুযোগের সমতা সৃষ্টি। জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, স্বাস্থ্য ও টিকাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়। এজন্য দরকার নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি? সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই

বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বিশ্ববাসীকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এর ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। তবে সব শ্রেণীর মানুষের যেহেতু প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার সমান নয়, তাই এ অগ্রগতির সুফল সব মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছেনি। বিদ্যমান প্রযুক্তি নারীবান্ধব কতটুকু সে প্রশ্ন সামনে আসছে। সেখানে প্রবেশাধিকার ও সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে নারীরা ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রয়েছে প্রায় ৫৫ ভাগ নারী এখনো প্রযুক্তির বাইরে রয়েছে।

প্রযুক্তি মানবসমাজকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। এমনকি নারী সমাজের যে অংশের প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা ছিল, তারাও এ সুবিধা পেয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা সমান দক্ষতা দেখিয়েছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পেরেছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরে বসেই পেশাগত কাজ চালিয়ে গেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তির নানা নেতিবাচক ব্যবহার মোকাবিলা করেছে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

লিঙ্গ সমতার জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির সমন্বয়

হীরেন পন্ডিত

শুক্রবার, ১০ মার্চ ২০২৩

প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য প্রসারিত করার ওপর ডিজিটাল লিঙ্গ ব্যবধানের প্রভাব অন্বেষণ করবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের অধিকার রক্ষা এবং অনলাইন এবং আইসিটি-সুবিধাযুক্ত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলার গুরুত্বকেও আলোকপাত করছে এই বিষয়গুলো।

প্রযুক্তির মধ্যে নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীকে আনার ফলে আরও সৃজনশীল সমাধান পাওয়া যায় এবং নারীর চাহিদা পূরণ করে এবং লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করে এমন উদ্ভাবনের সম্ভাবনাই বেশি। বিপরীতে, তাদের অন্তর্ভুক্তির অভাব ব্যাপক খরচের সঙ্গে আসে : ইউএন উইমেনস জেন্ডার স্ন্যাপশট ২০২২ রিপোর্ট অনুসারে, ডিজিটাল বিশ্ব থেকে নারীদের বাদ দেয়ায় গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন থেকে এক ট্রিলিয়ন কম হয়েছে একটি ক্ষতি যা ২০২৫ সাল নাগাদ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এই প্রবণতাকে উল্টাতে হলে অনলাইন সহিংসতার সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, যা ৫১টি দেশের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৩৮ শতাংশ মহিলা ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছেন।

উদ্ভাবন, প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার জন্য একটি জেন্ডার-প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি নারীরা তাদের অধিকার এবং নাগরিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতি উনয়ন এবং মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এবং ২০৩০ এজেন্ডার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচুর সুযোগ প্রদান করে। দুর্ভাগ্যবশত, ডিজিটাল বিপ্লবের সুযোগগুলো লিঙ্গবৈষম্যের বিদ্যমান নিদর্শনগুলোকে স্থায়ী করার ঝুঁকিও উপস্থাপন করে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ডিজিটাল দক্ষতা এবং প্রযুক্তির অ্যাক্সেসের প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমানভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এই ডিজিটাল লিঙ্গ বিভাজনের ফলে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং রূপান্তরমূলক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তাই একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিবিদ, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা এবং জেন্ডার সমতা কর্মীদের একত্রিত করবে যাতে ডিজিটাল সরঞ্জামগুলোতে অ্যাক্সেসের উন্নতিতে সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা হাইলাইট করার সুযোগ প্রদান করা যায় এবং একটি উচ্চ স্তরের প্যানেল আলোচনা করা হবে।

যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এমনকি করোনাকালে সহিংসতা আরো বেড়েছে। করোনা সংকটের কারণে চলমান অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত পরিস্থিতিতে যেখানে নারীরা অধিক সহানুভূতি পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। এ সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাক শিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্পসংখ্যক নারীর মধ্যেই। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।

এরপরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই এর ৫ এবং ১০ অভীষ্ট অর্জনে সাফল্য দেখাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন আছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি? সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই।

বিংশ শতাব্দীতে লিঙ্গসমতাভিত্তিক যে সমাজ গঠনের ডাক দিয়েছিলেন রোকেয়া, সে সমাজ গঠনের পথে আজ ৫০-উত্তীর্ণ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিশ্বের নারীর ক্ষমতায়নে আজ বাংলাদেশ রোল মডেল। নারী ক্ষমতায়ন মূল্যায়নে যেসব অনুঘটক বা সূচক ব্যবহার করা হয় তার সবকটি সূচকে আজ বাংলাদেশ বিশ্বে এগিয়ে।

বাল্যবিয়ে নির্মূলের জন্য বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ সালে প্রণয়ন করা হয়। মেয়েদের শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত করা হয়েছে অবৈতনিক, চালু হয়েছে বৃত্তি, উপবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি। এর মাধ্যমে কমেছে নারী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার, বেড়েছে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এসব সুরক্ষা বলয় কর্মসূচির ফলে তৃণমূল ও প্রান্তিক নারীরা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছেন বহু প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, ট্যাবুর সংস্কার ও বেড়াজাল। বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় উপস্থিতি ও অসাধারণ সাফল্য এ বাস্তবতাকেই তুলে ধরে।

দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য এর চেয়ে বড় ইতিবাচক শর্ত আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেটের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও সুযোগের সমতা সৃষ্টি। জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, স্বাস্থ্য ও টিকাদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়। এজন্য দরকার নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি? সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই

বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বিশ্ববাসীকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এর ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। তবে সব শ্রেণীর মানুষের যেহেতু প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার সমান নয়, তাই এ অগ্রগতির সুফল সব মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছেনি। বিদ্যমান প্রযুক্তি নারীবান্ধব কতটুকু সে প্রশ্ন সামনে আসছে। সেখানে প্রবেশাধিকার ও সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে নারীরা ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রয়েছে প্রায় ৫৫ ভাগ নারী এখনো প্রযুক্তির বাইরে রয়েছে।

প্রযুক্তি মানবসমাজকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। এমনকি নারী সমাজের যে অংশের প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা ছিল, তারাও এ সুবিধা পেয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা সমান দক্ষতা দেখিয়েছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পেরেছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরে বসেই পেশাগত কাজ চালিয়ে গেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তির নানা নেতিবাচক ব্যবহার মোকাবিলা করেছে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

back to top