alt

উপ-সম্পাদকীয়

কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩

৩ মার্চ, ২০২৩; কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের আরেকটি দিন। পঞ্চগড় শহরে বাংলাদেশের কাদিয়ানিদের উদ্যোগে আয়োজিত একটি জলসা বন্ধের দাবিতে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মুসল্লিরা দল বেঁধে জলসার দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয়; বেঁধে যায় সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে দুজন মারা যায় এবং আহত হয় শতাধিক, আহতদের মধ্যে ৩০ জন পুলিশ। যে দুইজন মারা গেছে তাদের মধ্যে একজন কাদিয়ানি, তাকে জ-বা-ই করে বা পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম। অন্যজন শিবির কর্মী, পুলিশের গুলিতে বা সংঘর্ষে মারা গেছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার ঘণ্টাব্যাপী চালানো তাণ্ডবে কাদিয়ানিদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, দোকানপাট সহায়-সম্পত্তি লুট করা হয়েছে। সুন্নি মুসল্লিদের আক্রমণে কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কাদিয়ানিরা প্রতি বছর পঞ্চগড়ে তাদের ধর্মীয় জলসা বা সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে এবং প্রায় প্রতি বছরই তাদের সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায়। সুন্নি আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে- কাদিয়ানিরা নিজেদের মুসলমান হিসেবে দাবি করতে পারবে না, কারণ তারা নবী মুহম্মদ (স.)কে শেষ নবী বলে স্বীকার করে না। কিন্ত কাদিয়ানি জামাতের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নতুন কোন ধর্ম নেই, তারা খাঁটি মুসলমান। তাদের কলেমা লা ইলাহা ইল্লালাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, তারা নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ পরিপালন করে, তারা কোরআন বিশ্বাস করে, তারা আল্লাহ ও নবী মুহাম্মদ (স.)-কে মানে। কাদিয়ানিরা মনে করে, তারা ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ কালেমায় বিশ্বাস করে বলে তাদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই।

অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের গ্রাম কাদিয়ানে ১৮৩৫ সালে মির্জা গোলাম আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮০ সালে তিনি দাবি করেন যে, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভুল পথে থাকা মুসলমান সমাজকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য’ তিনি ইসলামের একজন সংস্কারক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু ১৮৮৯ সালে তিনি প্রথমবার দাবি করেন যে, তিনি ইসলামের একজন নবী, ধর্মে যে ‘আহমদ’ নবীর কথা বলা হয়েছে তিনি সেই আহমদ নবী। এ কারণে কাদিয়ানিদের আহমদীও বলা হয়। তাদের দাবি মোতাবেক ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী যে ইমাম মাহাদী এবং ঈসা নবীর আগমনের কথা রয়েছে মির্জা গোলাম আহমদ হচ্ছেন সেই ইমাম মাহাদী এবং ঈসা নবী। কাদিয়ানি বা আহমদীদের সঙ্গে সুন্নি মুসলমানদের প্রধান বিরোধ হচ্ছে প্রতিশ্রুত মাহাদী ও ঈসা নবীর আগমন নিয়ে। সুন্নি মুসলমানরা মনে করেন প্রতিশ্রুত মাহাদী আসবেন, কিন্তু এখনো আসেননি। আহমদীদের অন্য বক্তব্য অনুযায়ী মির্জা গোলাম আহমদ পূর্ণাঙ্গ নবী নন, বরং ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স.)-এর বাণী প্রতিষ্ঠা করতে তিনি এসেছেন। তাই তার অনুসারীরা তাকে ‘উম্মতি নবী’ বলেও দাবি করেন। উম্মতি নবীর ধারণা কোরআন ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয় বিধায় সুন্নি মুসলমান তাদের ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করতে নারাজ।

জামায়াতে ইসলাম ও মাওলানা মওদুদী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করায় পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এই ভাবমূর্তি উদ্ধারে মাওলানা মওদুদী ‘কাদিয়ানি সমস্যা’ নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানি বা আহমদীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তেলেন। মওদুদী জানতেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা হলে জনসমর্থন পাওয়া যায়। নিজের ও তার দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে মাওলানা মওদুদী আহমদীদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা ১৯৫৩ সালে মারাত্মক দাঙ্গায় পর্যবসিত হয়, আহমদীদের কচুকাটা করা হয়। মওদুদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলনে তার বা তাদের দলের সংশ্লিষ্টতা ছিল না ঘোষণা দেয়ার পরও বিচারে মওদুদীকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করা হয়। কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলনে মওদুদী এবং তার দলের সংশ্লিষ্টতা না থাকার মিথ্যাচার করায় আন্দোলনের শরীক অন্য দল ‘খতমে নবুয়াত’ মাওলানা মওদুদীকে ‘ধর্মদ্রোহী’ এবং ‘আল্লাহতে অবিশ্বাসী’ বলে ফতোয়া প্রদান করে।

সহি মুসলমান প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা তার সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আহমদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত দাঙ্গার তদন্ত করতে পাকিস্তান সরকার দুজন বিচারপতিকে নিয়ে যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশন বিখ্যাত বিখ্যাত আলেমদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিল, ‘মুসলমান কারা’। এই কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, ওলামাদের একজনের সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানের সংজ্ঞা মেনে নেয়া হলে বাকি ওলামাদের অমুসলমান আখ্যা দিতে হয়

আহমদিয়া মুসলিম জামাতের অনুসারীরা নিজেদের অন্য সবাই মুসলমানের মতোই মুসলিম বলেই দাবি করে। এই সম্প্রদায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, পাকিস্তান হওয়ার পর ভারত থেকে বহু আহমদিয়া পাকিস্তান চলে আসে, তাদের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তানে তারা স্বাচ্ছন্দে ধর্ম পালন করতে পারবে। কিন্তু আহমদীরা এখন ভারতে নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করতে পারলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পারছে না। ধর্মীয় নেতাদের চাপে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সংবিধান সংশোধন করে আহমদীদের ‘অমুসলিম’ বলে ঘোষণা করেন। এক দশক পর আরেকটি আইন করে তাদের মসজিদে নামাজ পড়া বা প্রকাশ্যে ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করা হয়; অথচ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাকালীন অন্যতম নেতা ও প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান এবং পাকিস্তানের নোবেল বিজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম ছিলেন আহমদী সম্প্রদায়ের। সউদি আরবেও তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে; তাদের কেউ হজ করতে গেলে তাকে আটক করা হয় কিংবা দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আহমদিয়া জামাতের বিরুদ্ধে একাধিকবার বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু স্পেন থেকে মুসলমানদের ১৪৯২ সনে বিতাড়ায়নের পর সেই দেশে প্রথম মসজিদ স্থাপন করে আহমদীরাই। ভারতের কর্ণাটকে হিজাবের প্রতিবাদ করা শত শত গেরুয়াধারীর সামনে সাহসে দাঁড়িয়ে হিজাব পরা যে তরুণী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি তুলে মুসলিম বিশ্বের মন জয় করেছিল, সে ছিল একজন কাদিয়ানি বা আহমাদী।

মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে, ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। নবীজী বলেছেন, ‘বনী ইসরাইল ৭২ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত’। কিন্তু প্রতি ফেরকার লোক মনে করে তারা একমাত্র সঠিক। এক আলেম আরেক আলেমকে শুধু ধর্মীর ব্যাখ্যার ভিন্নতার জন্য যেভাবে অশ্লীল, নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গালি দেয়, যেভাবে পা থেকে জুতা নিয়ে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সম্মুখে প্রতিপক্ষের আলেমকে পেটানোর হুমকি দেয় তা কোন সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। শুধু তাই নয়, এক আলেম আরেক আলেমকে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ বলে অহরহ ফতোয়া দিচ্ছে। চার মাজহাবের অনুসরণ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকটি মাজহাব দলিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ইসলামের প্রধান দুটি ধারা হচ্ছে সুন্নি ইসলাম এবং শিয়া ইসলাম। সুন্নিরা নানাভাবে শিয়াদের কাফের ঘোষণা করেছে, আবার শিয়ারাও সুন্নিদের কাফের ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুই পক্ষই নিজেদের ইমান আকিদাকেই সহিহ ইসলাম বলে গণ্য করে। শিয়াদের মতে, হযরত আলী (রা.) যেই কোরআন সংকলন করেছিলেন সেই কোরআনই বিশুদ্ধ এবং দূষণমুক্ত; কিন্তু খলিফা উসমান (রা.) তা গ্রহণ করেননি। কোরআনের আয়াত সংখ্যা নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে প্রচুর মতভেদ আছে। আবু বকর (রা.) যে কোরআন সংকলন করেন তাকে আদি কোরআন বলা হয়; কিন্তু ওসমান (রা.)-এর সংকলিত কোরআনের সঙ্গে আবু বকর (রা.)-এর কোরআনের পার্থক্য লক্ষ্য করে আদি কোরআনটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে যে কোরআনকে আমরা বর্তমানে নিখুঁত ও অবিকৃত হিসেবে গণ্য করে থাকি সেই কোরআনকে আব্দুল্লাহ্? ইবনে মাসঊদ (রা) মানেননি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ছিলেন এমন সাহাবি যার কাছ থেকে কোরআন শিক্ষা নিতে স্বয়ং নবীজী (স.) বলে গেছেন। হযরত ওসমান (রা.)-এর সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন, কিন্তু কোরআন সংকলনে ওসমান (রা.) তাকে ডাকেননি। কোরআন বিকৃত করার অভিযোগে হযরত ওসমান (রা.)কে মুসলমানরা নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর সন্তান মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর (রা.) খলিফা উসমান (রা.)-কে কিতাবুল্লাহ বা কোরআন পরিবর্তনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে সর্বপ্রথম দাড়ি ধরে তীরের ভারী ফলা দিয়ে আঘাত করেছিলেন। অথচ আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, কোরআনের সংরক্ষণ করবেন তিনি নিজে। আল্লাহ যার সংরক্ষক তা বিকৃত করার ক্ষমতা মানুষের নেই।

সহি মুসলমান প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা তার সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আহমদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত দাঙ্গার তদন্ত করতে পাকিস্তান সরকার দুজন বিচারপতিকে নিয়ে যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশন বিখ্যাত বিখ্যাত আলেমদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিল, ‘মুসলমান কারা’। এই কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, ওলামাদের একজনের সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানের সংজ্ঞা মেনে নেয়া হলে বাকি ওলামাদের অমুসলমান আখ্যা দিতে হয়। এভাবে এক তরিকার মুসলমান অন্য তরিকার মুসলমানদের বাতিল করে দিলে পৃথিবীতে প্রকৃত মুসলমানের সংখ্যা শূন্যতে নেমে আসবে, দুইশ কোটি মুসলমানের সংখ্যা নিয়ে অহংকার করার সুযোগ থাকবে না। তাই আহমদিয়াদের ‘অমুসলিম’ আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া, তাদের সম্পদ লুট করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা আলেমেরাই পুনর্মূল্যায়ন করুক।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩

৩ মার্চ, ২০২৩; কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের আরেকটি দিন। পঞ্চগড় শহরে বাংলাদেশের কাদিয়ানিদের উদ্যোগে আয়োজিত একটি জলসা বন্ধের দাবিতে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মুসল্লিরা দল বেঁধে জলসার দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয়; বেঁধে যায় সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে দুজন মারা যায় এবং আহত হয় শতাধিক, আহতদের মধ্যে ৩০ জন পুলিশ। যে দুইজন মারা গেছে তাদের মধ্যে একজন কাদিয়ানি, তাকে জ-বা-ই করে বা পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম। অন্যজন শিবির কর্মী, পুলিশের গুলিতে বা সংঘর্ষে মারা গেছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার ঘণ্টাব্যাপী চালানো তাণ্ডবে কাদিয়ানিদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, দোকানপাট সহায়-সম্পত্তি লুট করা হয়েছে। সুন্নি মুসল্লিদের আক্রমণে কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কাদিয়ানিরা প্রতি বছর পঞ্চগড়ে তাদের ধর্মীয় জলসা বা সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে এবং প্রায় প্রতি বছরই তাদের সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায়। সুন্নি আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে- কাদিয়ানিরা নিজেদের মুসলমান হিসেবে দাবি করতে পারবে না, কারণ তারা নবী মুহম্মদ (স.)কে শেষ নবী বলে স্বীকার করে না। কিন্ত কাদিয়ানি জামাতের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নতুন কোন ধর্ম নেই, তারা খাঁটি মুসলমান। তাদের কলেমা লা ইলাহা ইল্লালাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, তারা নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ পরিপালন করে, তারা কোরআন বিশ্বাস করে, তারা আল্লাহ ও নবী মুহাম্মদ (স.)-কে মানে। কাদিয়ানিরা মনে করে, তারা ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ কালেমায় বিশ্বাস করে বলে তাদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই।

অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের গ্রাম কাদিয়ানে ১৮৩৫ সালে মির্জা গোলাম আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮০ সালে তিনি দাবি করেন যে, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভুল পথে থাকা মুসলমান সমাজকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য’ তিনি ইসলামের একজন সংস্কারক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু ১৮৮৯ সালে তিনি প্রথমবার দাবি করেন যে, তিনি ইসলামের একজন নবী, ধর্মে যে ‘আহমদ’ নবীর কথা বলা হয়েছে তিনি সেই আহমদ নবী। এ কারণে কাদিয়ানিদের আহমদীও বলা হয়। তাদের দাবি মোতাবেক ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী যে ইমাম মাহাদী এবং ঈসা নবীর আগমনের কথা রয়েছে মির্জা গোলাম আহমদ হচ্ছেন সেই ইমাম মাহাদী এবং ঈসা নবী। কাদিয়ানি বা আহমদীদের সঙ্গে সুন্নি মুসলমানদের প্রধান বিরোধ হচ্ছে প্রতিশ্রুত মাহাদী ও ঈসা নবীর আগমন নিয়ে। সুন্নি মুসলমানরা মনে করেন প্রতিশ্রুত মাহাদী আসবেন, কিন্তু এখনো আসেননি। আহমদীদের অন্য বক্তব্য অনুযায়ী মির্জা গোলাম আহমদ পূর্ণাঙ্গ নবী নন, বরং ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স.)-এর বাণী প্রতিষ্ঠা করতে তিনি এসেছেন। তাই তার অনুসারীরা তাকে ‘উম্মতি নবী’ বলেও দাবি করেন। উম্মতি নবীর ধারণা কোরআন ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয় বিধায় সুন্নি মুসলমান তাদের ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করতে নারাজ।

জামায়াতে ইসলাম ও মাওলানা মওদুদী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করায় পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এই ভাবমূর্তি উদ্ধারে মাওলানা মওদুদী ‘কাদিয়ানি সমস্যা’ নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানি বা আহমদীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তেলেন। মওদুদী জানতেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা হলে জনসমর্থন পাওয়া যায়। নিজের ও তার দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে মাওলানা মওদুদী আহমদীদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা ১৯৫৩ সালে মারাত্মক দাঙ্গায় পর্যবসিত হয়, আহমদীদের কচুকাটা করা হয়। মওদুদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলনে তার বা তাদের দলের সংশ্লিষ্টতা ছিল না ঘোষণা দেয়ার পরও বিচারে মওদুদীকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করা হয়। কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলনে মওদুদী এবং তার দলের সংশ্লিষ্টতা না থাকার মিথ্যাচার করায় আন্দোলনের শরীক অন্য দল ‘খতমে নবুয়াত’ মাওলানা মওদুদীকে ‘ধর্মদ্রোহী’ এবং ‘আল্লাহতে অবিশ্বাসী’ বলে ফতোয়া প্রদান করে।

সহি মুসলমান প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা তার সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আহমদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত দাঙ্গার তদন্ত করতে পাকিস্তান সরকার দুজন বিচারপতিকে নিয়ে যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশন বিখ্যাত বিখ্যাত আলেমদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিল, ‘মুসলমান কারা’। এই কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, ওলামাদের একজনের সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানের সংজ্ঞা মেনে নেয়া হলে বাকি ওলামাদের অমুসলমান আখ্যা দিতে হয়

আহমদিয়া মুসলিম জামাতের অনুসারীরা নিজেদের অন্য সবাই মুসলমানের মতোই মুসলিম বলেই দাবি করে। এই সম্প্রদায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, পাকিস্তান হওয়ার পর ভারত থেকে বহু আহমদিয়া পাকিস্তান চলে আসে, তাদের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তানে তারা স্বাচ্ছন্দে ধর্ম পালন করতে পারবে। কিন্তু আহমদীরা এখন ভারতে নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করতে পারলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পারছে না। ধর্মীয় নেতাদের চাপে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সংবিধান সংশোধন করে আহমদীদের ‘অমুসলিম’ বলে ঘোষণা করেন। এক দশক পর আরেকটি আইন করে তাদের মসজিদে নামাজ পড়া বা প্রকাশ্যে ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করা হয়; অথচ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাকালীন অন্যতম নেতা ও প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান এবং পাকিস্তানের নোবেল বিজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম ছিলেন আহমদী সম্প্রদায়ের। সউদি আরবেও তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে; তাদের কেউ হজ করতে গেলে তাকে আটক করা হয় কিংবা দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আহমদিয়া জামাতের বিরুদ্ধে একাধিকবার বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু স্পেন থেকে মুসলমানদের ১৪৯২ সনে বিতাড়ায়নের পর সেই দেশে প্রথম মসজিদ স্থাপন করে আহমদীরাই। ভারতের কর্ণাটকে হিজাবের প্রতিবাদ করা শত শত গেরুয়াধারীর সামনে সাহসে দাঁড়িয়ে হিজাব পরা যে তরুণী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি তুলে মুসলিম বিশ্বের মন জয় করেছিল, সে ছিল একজন কাদিয়ানি বা আহমাদী।

মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে, ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। নবীজী বলেছেন, ‘বনী ইসরাইল ৭২ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত’। কিন্তু প্রতি ফেরকার লোক মনে করে তারা একমাত্র সঠিক। এক আলেম আরেক আলেমকে শুধু ধর্মীর ব্যাখ্যার ভিন্নতার জন্য যেভাবে অশ্লীল, নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গালি দেয়, যেভাবে পা থেকে জুতা নিয়ে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সম্মুখে প্রতিপক্ষের আলেমকে পেটানোর হুমকি দেয় তা কোন সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। শুধু তাই নয়, এক আলেম আরেক আলেমকে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ বলে অহরহ ফতোয়া দিচ্ছে। চার মাজহাবের অনুসরণ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকটি মাজহাব দলিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ইসলামের প্রধান দুটি ধারা হচ্ছে সুন্নি ইসলাম এবং শিয়া ইসলাম। সুন্নিরা নানাভাবে শিয়াদের কাফের ঘোষণা করেছে, আবার শিয়ারাও সুন্নিদের কাফের ঘোষণা করেছে। কিন্তু দুই পক্ষই নিজেদের ইমান আকিদাকেই সহিহ ইসলাম বলে গণ্য করে। শিয়াদের মতে, হযরত আলী (রা.) যেই কোরআন সংকলন করেছিলেন সেই কোরআনই বিশুদ্ধ এবং দূষণমুক্ত; কিন্তু খলিফা উসমান (রা.) তা গ্রহণ করেননি। কোরআনের আয়াত সংখ্যা নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে প্রচুর মতভেদ আছে। আবু বকর (রা.) যে কোরআন সংকলন করেন তাকে আদি কোরআন বলা হয়; কিন্তু ওসমান (রা.)-এর সংকলিত কোরআনের সঙ্গে আবু বকর (রা.)-এর কোরআনের পার্থক্য লক্ষ্য করে আদি কোরআনটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে যে কোরআনকে আমরা বর্তমানে নিখুঁত ও অবিকৃত হিসেবে গণ্য করে থাকি সেই কোরআনকে আব্দুল্লাহ্? ইবনে মাসঊদ (রা) মানেননি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ছিলেন এমন সাহাবি যার কাছ থেকে কোরআন শিক্ষা নিতে স্বয়ং নবীজী (স.) বলে গেছেন। হযরত ওসমান (রা.)-এর সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন, কিন্তু কোরআন সংকলনে ওসমান (রা.) তাকে ডাকেননি। কোরআন বিকৃত করার অভিযোগে হযরত ওসমান (রা.)কে মুসলমানরা নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর সন্তান মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর (রা.) খলিফা উসমান (রা.)-কে কিতাবুল্লাহ বা কোরআন পরিবর্তনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে সর্বপ্রথম দাড়ি ধরে তীরের ভারী ফলা দিয়ে আঘাত করেছিলেন। অথচ আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, কোরআনের সংরক্ষণ করবেন তিনি নিজে। আল্লাহ যার সংরক্ষক তা বিকৃত করার ক্ষমতা মানুষের নেই।

সহি মুসলমান প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা তার সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আহমদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত দাঙ্গার তদন্ত করতে পাকিস্তান সরকার দুজন বিচারপতিকে নিয়ে যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশন বিখ্যাত বিখ্যাত আলেমদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিল, ‘মুসলমান কারা’। এই কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, ওলামাদের একজনের সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানের সংজ্ঞা মেনে নেয়া হলে বাকি ওলামাদের অমুসলমান আখ্যা দিতে হয়। এভাবে এক তরিকার মুসলমান অন্য তরিকার মুসলমানদের বাতিল করে দিলে পৃথিবীতে প্রকৃত মুসলমানের সংখ্যা শূন্যতে নেমে আসবে, দুইশ কোটি মুসলমানের সংখ্যা নিয়ে অহংকার করার সুযোগ থাকবে না। তাই আহমদিয়াদের ‘অমুসলিম’ আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া, তাদের সম্পদ লুট করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা আলেমেরাই পুনর্মূল্যায়ন করুক।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top