alt

উপ-সম্পাদকীয়

আগুন আর ভূমিকম্পের বিপদ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: বুধবার, ১৫ মার্চ ২০২৩

জাতিসংঘের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা দুটি শহরের একটি ঢাকা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশ ভূগঠনের কারণে যে কোনো সময় প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। মনে রাখতে হবে, তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশে একইরকম ভূমিকম্প হলে এর ক্ষয়ক্ষতি হবে বহুগুণ বেশি। কেননা ক্ষতি কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করে জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর মান এবং নগরায়ণ কতটা পরিকল্পিত, উদ্ধার ও ত্রাণকাজে প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ওপর। এর সবকিছুতেই আমরা অন্যদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছি।

শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৪০ হাজারের অধিক ভবন রয়েছে যেগুলো যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। যার ফলে ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণ ঘটবে এবং বিদ্যুতের লাইন থেকেও অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে। বাংলাদেশের কি এ বিপর্যয় মোকাবিলা করার সামর্থ্য আছে?

প্রতি বছর কোনো না কোনো দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ব্যাপকতা প্রমাণ করে দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকিহ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগপূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে আগাম সতর্কবার্তা উপকূলীয় সম্ভাব্য উপদ্রুত এলাকার জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে উপকূলে আমাদের ৭৬,১৪০ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। বন্যাপ্রবণ এলাকায় অনুরূপ স্বেচ্ছাসেবক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

দেশে ঘনঘন ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। মাঝে-মধ্যেই মাঝারি ও মৃদু ভূকম্পে কেঁপে উঠছে পুরো দেশ। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও সুনামির আশঙ্কার কথা। সুতরাং প্রশ্ন হলো ভূকম্পের ধকল সামলাতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত? পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, সীতাকুন্ডের কনটেইনার ডিপোতে আগুন কিংবা রানা প্লাজা ধসের চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আসলেই আমাদের সক্ষমতা কতখানি। বড় ভূকম্প হলে এরকম রানা প্লাজার মতো বিপর্যয় ঘটবে ঢাকা শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ও সড়কে।

ভূকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এটি এমন একটি দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেয়ার উপায় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি। তবে বড় ধরনের ভূকম্পের কিছু পূর্বাভাস রয়েছে, যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষণ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্প হচ্ছে বেশ কিছু দিন পরপরই। মূলত ভূকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুটি। প্রথমত, ভূকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে যতটা নিম্নমুখী রাখা যায় এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় কতটা সামাল দেয়া যায়। সাধারণত ভূমিকম্পে বিল্ডিং দুমড়ে-মুচড়ে গায়ে পড়ে না, বরং হেলে পড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অনেকেই মনে করেন বহুতল ভবন থেকে নিচে নেমে গেলেই হয়তো সাবধানে থাকা যাবে, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা অথবা জানালা দিয়ে লাফ দেয়া আরো বেশি অনিরাপদ। যেহেতু ভূকম্প খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়, তাই তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় গিয়ে তেমন উপকার হয় না। কেননা বিল্ডিং হেলে গিয়ে তো সে রাস্তার ওপরেই পতিত হয়।

ঢাকাবাসীর এক বিশাল অংশ বাস করছে যেন হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অগ্নিকান্ডের বিপদ থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এ প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে

মনে রাখতে হবে, ভূকম্পের সময় যত বেশি মুভ করবেন তত বেশি আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং যেখানে অবস্থান করছেন সেখানেই ভিম বা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর কাছে থাকতে হবে। যেমন খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিলের পাশে অবস্থান নিলে ভালো হয়। ভূকম্পের বিপর্যয় এড়াতে সরকারকে আরো দৃশ্যমান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার প্রস্তুতিতে যে আমাদের ঘাটতি রয়েছে, সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। দেশের প্রতিটি শহরে যেন যথাযথ আইন ও বিধি অনুযায়ী স্থাপনা নির্মিত হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভূকম্প হলে করণীয় কীÍএমন প্রচারাভিযান চালাতে হবে যেন মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি হয়। ফায়ার সার্ভিস, ভূকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, ভূমিকম্প হলে উত্তেজিত না হয়ে সাবধানে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

গুলশানের এক বহুতল ভবনে আগুন লাগল; প্রাণহানিও হলো। প্রাণহানি হলো শুধু আতঙ্কের কারণে উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে। এই ভবনেই আগুন লাগার পর কয়েকজন বাসিন্দা লিফটে উঠেছিলেন তাড়াতাড়ি নিচে নামার জন্য। লিফটে আটকে পড়েন তারা। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচেন। তার মানে তারা জানতেন না যে বাড়িতে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্পসহ যে কোনো বিপদের সময় কখনও লিফটে উঠতে হয় না। তার মানে এই বাড়িতে কখনও অগ্নি নির্বাপণের মহড়া হয়নি। গুলশানে বহুতল ভবনের একটি অফিসে আমি চাকরি করি দুই বছরের বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে একবারও অগ্নিনির্বাপণ বা অগ্নিকান্ড হলে কী করতে হবে এ ধরনের কোনো মহড়া হয়নি। আমার জানামতে, বাংলাদেশের কোনো বহুতল ভবনেই সেটা হয় না। ভূমিকম্প হোক বা আগুন লাগা।

যেকোনো বিপদ কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় সেই শিক্ষাটা সবার থাকা জরুরি। বিদেশে থাকার সময় দেখেছি, প্রায়ই বিভিন্ন এলাকার উঁচু ভবন, হোস্টেল, হোটেল ইত্যাদি ভবনে এ ধরনের মহড়া ও প্রশিক্ষণ হয়; কিন্তু আমাদের সেসব বালাই নেই। আমরা হাত-পা গুটিয়ে মৃত্যুকবলিত হওয়ার জন্য বসে থাকি। বাঁচার চেষ্টা কিভাবে করব সেই জ্ঞানটুকুও আমাদের কখনও দেয়া হয় না। এবার আসি পুরান ঢাকার প্রসঙ্গে। পুরান ঢাকার যে কী বেহাল অবস্থা সেটা সেখানকার বাসিন্দা মাত্রই জানেন। দুটি বাড়ির মধ্যে এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়া হয়নি। গায়ে গা লাগিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে সব ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকম্প হলে একটির ওপর আরেকটি যেভাবে পড়বে তাতে কোনো উদ্ধার কাজও চালানো যাবে বলে মনে হয় না। পুরান ঢাকায় আগুন লাগাটাও ভয়াবহ।

নিমতলী আর চুড়িহাট্টার ভয়বহ অগ্নিকান্ডের স্মৃতি নিশ্চয়ই মন থেকে মুছে যায়নি। সেই সব ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পরও কি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? কিছুই না। এখনও জুতার কারখানা আর কেমিক্যাল কারখানাগুলো অলিতে গলিতে রয়েই গেছে। মারাত্মক দাহ্য পদার্থ নিয়ে কাজ-কারবার চলছে আবাসিক এলাকার ভিতরেই। পুরান ঢাকার অবস্থা এমন যে আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢোকার জায়গাটুকুও নেই। আশপাশে কোথাও বড় জলাশয়ও নেই।আগে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় একটি বা দুটি পুকুর থাকতো। সেসব কবে ভরাট হয়ে গেছে। পুরান ঢাকায় বৈদ্যুতিক সংযোগের অবস্থাও ভয়াবহ। পুরান ঢাকার যে কোনো রাস্তায় চোখে পড়ে বৈদ্যুতিক তারের ভয়াবহ জট মাথার ওপর ঝুলছে। অবৈধ সংযোগে পুরো এলাকা ভরপুর। শর্টসার্কিট থেকে ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারে যেকোনো সময়। অধিকাংশ বাড়িতেই সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার চলছে; যেগুলো কোনো সঠিক বা নিরাপদ নিয়মে নয় বরং খেয়াল খুশিমতো ব্যবহার করা হচ্ছে।

পুরান ঢাকাকে বিপদমুক্ত বা নিরাপদ করার কোনরকম উদ্যোগই চোখে পড়েনি কখনও। ঢাকাবাসীর এক বিশাল অংশ বাস করছে যেন হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অগ্নিকান্ডের বিপদ থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এ প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিপদ ঘটলে কিভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো হবে সেই বিষয়ে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা কারও কাছে আছে কিনা তাও জানা যায় না। দুই নগরপিতার কী বলার আছে এ বিষয়ে জানি না। বিপদ ঘটার পরে নয় বরং আগে সতর্ক থাকাটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। হাজার হাজার প্রাণহানির পর তখন চোখের জলে কোনো সুরাহা হবে না। এদিকে কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন কি?

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী]

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আগুন আর ভূমিকম্পের বিপদ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বুধবার, ১৫ মার্চ ২০২৩

জাতিসংঘের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা দুটি শহরের একটি ঢাকা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশ ভূগঠনের কারণে যে কোনো সময় প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। মনে রাখতে হবে, তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশে একইরকম ভূমিকম্প হলে এর ক্ষয়ক্ষতি হবে বহুগুণ বেশি। কেননা ক্ষতি কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করে জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর মান এবং নগরায়ণ কতটা পরিকল্পিত, উদ্ধার ও ত্রাণকাজে প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ওপর। এর সবকিছুতেই আমরা অন্যদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছি।

শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৪০ হাজারের অধিক ভবন রয়েছে যেগুলো যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। যার ফলে ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণ ঘটবে এবং বিদ্যুতের লাইন থেকেও অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে। বাংলাদেশের কি এ বিপর্যয় মোকাবিলা করার সামর্থ্য আছে?

প্রতি বছর কোনো না কোনো দুর্যোগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ব্যাপকতা প্রমাণ করে দুর্যোগের পূর্ব সতর্কীকরণ ও ঝুঁকিহ্রাসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল হওয়া উচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় জনগণের জন্য দুর্যোগপূর্ব পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাস কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে আগাম সতর্কবার্তা উপকূলীয় সম্ভাব্য উপদ্রুত এলাকার জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে উপকূলে আমাদের ৭৬,১৪০ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। বন্যাপ্রবণ এলাকায় অনুরূপ স্বেচ্ছাসেবক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

দেশে ঘনঘন ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। মাঝে-মধ্যেই মাঝারি ও মৃদু ভূকম্পে কেঁপে উঠছে পুরো দেশ। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও সুনামির আশঙ্কার কথা। সুতরাং প্রশ্ন হলো ভূকম্পের ধকল সামলাতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত? পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, সীতাকুন্ডের কনটেইনার ডিপোতে আগুন কিংবা রানা প্লাজা ধসের চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আসলেই আমাদের সক্ষমতা কতখানি। বড় ভূকম্প হলে এরকম রানা প্লাজার মতো বিপর্যয় ঘটবে ঢাকা শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ও সড়কে।

ভূকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এটি এমন একটি দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেয়ার উপায় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি। তবে বড় ধরনের ভূকম্পের কিছু পূর্বাভাস রয়েছে, যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষণ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্প হচ্ছে বেশ কিছু দিন পরপরই। মূলত ভূকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুটি। প্রথমত, ভূকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে যতটা নিম্নমুখী রাখা যায় এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় কতটা সামাল দেয়া যায়। সাধারণত ভূমিকম্পে বিল্ডিং দুমড়ে-মুচড়ে গায়ে পড়ে না, বরং হেলে পড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অনেকেই মনে করেন বহুতল ভবন থেকে নিচে নেমে গেলেই হয়তো সাবধানে থাকা যাবে, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা অথবা জানালা দিয়ে লাফ দেয়া আরো বেশি অনিরাপদ। যেহেতু ভূকম্প খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়, তাই তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় গিয়ে তেমন উপকার হয় না। কেননা বিল্ডিং হেলে গিয়ে তো সে রাস্তার ওপরেই পতিত হয়।

ঢাকাবাসীর এক বিশাল অংশ বাস করছে যেন হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অগ্নিকান্ডের বিপদ থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এ প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে

মনে রাখতে হবে, ভূকম্পের সময় যত বেশি মুভ করবেন তত বেশি আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং যেখানে অবস্থান করছেন সেখানেই ভিম বা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর কাছে থাকতে হবে। যেমন খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিলের পাশে অবস্থান নিলে ভালো হয়। ভূকম্পের বিপর্যয় এড়াতে সরকারকে আরো দৃশ্যমান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার প্রস্তুতিতে যে আমাদের ঘাটতি রয়েছে, সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। দেশের প্রতিটি শহরে যেন যথাযথ আইন ও বিধি অনুযায়ী স্থাপনা নির্মিত হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভূকম্প হলে করণীয় কীÍএমন প্রচারাভিযান চালাতে হবে যেন মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি হয়। ফায়ার সার্ভিস, ভূকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, ভূমিকম্প হলে উত্তেজিত না হয়ে সাবধানে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

গুলশানের এক বহুতল ভবনে আগুন লাগল; প্রাণহানিও হলো। প্রাণহানি হলো শুধু আতঙ্কের কারণে উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে। এই ভবনেই আগুন লাগার পর কয়েকজন বাসিন্দা লিফটে উঠেছিলেন তাড়াতাড়ি নিচে নামার জন্য। লিফটে আটকে পড়েন তারা। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচেন। তার মানে তারা জানতেন না যে বাড়িতে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্পসহ যে কোনো বিপদের সময় কখনও লিফটে উঠতে হয় না। তার মানে এই বাড়িতে কখনও অগ্নি নির্বাপণের মহড়া হয়নি। গুলশানে বহুতল ভবনের একটি অফিসে আমি চাকরি করি দুই বছরের বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে একবারও অগ্নিনির্বাপণ বা অগ্নিকান্ড হলে কী করতে হবে এ ধরনের কোনো মহড়া হয়নি। আমার জানামতে, বাংলাদেশের কোনো বহুতল ভবনেই সেটা হয় না। ভূমিকম্প হোক বা আগুন লাগা।

যেকোনো বিপদ কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় সেই শিক্ষাটা সবার থাকা জরুরি। বিদেশে থাকার সময় দেখেছি, প্রায়ই বিভিন্ন এলাকার উঁচু ভবন, হোস্টেল, হোটেল ইত্যাদি ভবনে এ ধরনের মহড়া ও প্রশিক্ষণ হয়; কিন্তু আমাদের সেসব বালাই নেই। আমরা হাত-পা গুটিয়ে মৃত্যুকবলিত হওয়ার জন্য বসে থাকি। বাঁচার চেষ্টা কিভাবে করব সেই জ্ঞানটুকুও আমাদের কখনও দেয়া হয় না। এবার আসি পুরান ঢাকার প্রসঙ্গে। পুরান ঢাকার যে কী বেহাল অবস্থা সেটা সেখানকার বাসিন্দা মাত্রই জানেন। দুটি বাড়ির মধ্যে এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়া হয়নি। গায়ে গা লাগিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে সব ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকম্প হলে একটির ওপর আরেকটি যেভাবে পড়বে তাতে কোনো উদ্ধার কাজও চালানো যাবে বলে মনে হয় না। পুরান ঢাকায় আগুন লাগাটাও ভয়াবহ।

নিমতলী আর চুড়িহাট্টার ভয়বহ অগ্নিকান্ডের স্মৃতি নিশ্চয়ই মন থেকে মুছে যায়নি। সেই সব ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পরও কি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? কিছুই না। এখনও জুতার কারখানা আর কেমিক্যাল কারখানাগুলো অলিতে গলিতে রয়েই গেছে। মারাত্মক দাহ্য পদার্থ নিয়ে কাজ-কারবার চলছে আবাসিক এলাকার ভিতরেই। পুরান ঢাকার অবস্থা এমন যে আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢোকার জায়গাটুকুও নেই। আশপাশে কোথাও বড় জলাশয়ও নেই।আগে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় একটি বা দুটি পুকুর থাকতো। সেসব কবে ভরাট হয়ে গেছে। পুরান ঢাকায় বৈদ্যুতিক সংযোগের অবস্থাও ভয়াবহ। পুরান ঢাকার যে কোনো রাস্তায় চোখে পড়ে বৈদ্যুতিক তারের ভয়াবহ জট মাথার ওপর ঝুলছে। অবৈধ সংযোগে পুরো এলাকা ভরপুর। শর্টসার্কিট থেকে ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারে যেকোনো সময়। অধিকাংশ বাড়িতেই সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার চলছে; যেগুলো কোনো সঠিক বা নিরাপদ নিয়মে নয় বরং খেয়াল খুশিমতো ব্যবহার করা হচ্ছে।

পুরান ঢাকাকে বিপদমুক্ত বা নিরাপদ করার কোনরকম উদ্যোগই চোখে পড়েনি কখনও। ঢাকাবাসীর এক বিশাল অংশ বাস করছে যেন হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অগ্নিকান্ডের বিপদ থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এ প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিপদ ঘটলে কিভাবে উদ্ধার অভিযান চালানো হবে সেই বিষয়ে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা কারও কাছে আছে কিনা তাও জানা যায় না। দুই নগরপিতার কী বলার আছে এ বিষয়ে জানি না। বিপদ ঘটার পরে নয় বরং আগে সতর্ক থাকাটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। হাজার হাজার প্রাণহানির পর তখন চোখের জলে কোনো সুরাহা হবে না। এদিকে কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন কি?

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী]

back to top