মিকাইল হোসেন
পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ, ধর্ম, শিক্ষা- এককথায় সবকিছুকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা। যেকোন মূল্যে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। নীতি-নৈতিকতা আদর্শ সেখানে গৌণ। ব্যবসাই মুখ্য। সেই সুত্রমতে, শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেট বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রযাত্রাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছে।
অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের কারণে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশ ও বাস্তবায়ন সম্ভভ হচ্ছে না। ২০১০ সালে থেকে বহুবার চেষ্টার পরও আজও আলোর মুখ দেখেনি জাতীয় শিক্ষানীতিমালা। কারণ সেখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থবিরোধী কিন্তু ছাত্রদের অনুকূলে বহু আইন রয়েছে। যুগের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য সময়ে সময়ে পাঠ্যক্রম, শিক্ষাক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন একটি সাধারণ বিষয়। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে নতুন ধারার শিক্ষাক্রম। এবছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে এটি বাস্তবায়িত হবে। ২০২৪ এ তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে চালু হবে। পর্যায়ক্রমে এটি ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলতে থাকবে।
নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ এ বই থেকে শুরু করে শিখন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ সবকিছুতে থাকছে আমূল পরিবর্তন। নতুন কারিকুলামে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে, যার নাম সামষ্টিক মূল্যায়ন। ষষ্ট ও সপ্তম শ্রেণীতে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। নবম ও দশম শ্রেণীতে কয়েকটি বিষয়ে শিখনকালীন অর্ধেক মূল্যায়ন হবে এবং বাকি অর্ধেক সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ৩০ ভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৭০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা নামে আর কোনো বিভাগ থাকবে না।
একাদশ শ্রেণীতে বিভাগ আলাদা হবে। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে অর্থাৎ প্রতি বর্ষে হবে পাবলিক পরীক্ষা। আর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন দুটিই থাকবে।
প্রতিটি কারিকুলাম পরিবর্তনের সময় কিছু নতুন ধারণা প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ কারিকুলাম পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিশাল কর্মকান্ড এবং আর্থিক বিষয়। এছাড়া সামাজিকভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে থাকে কিছু চ্যালেঞ্জ। ২০২৩ সালোর বাস্তবায়নাধীন নতুন শিক্ষাক্রমের ও কিছু সুফল কতৃপক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাইভেট পড়া লাগবে না। কোচিংয়ে যাওয়া লাগবে না। নোট বা গাইড কেনা লাগবে না।
কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে চালু হতে না হতেই নানান আঙ্গিকে অবৈধ নোট বা গাইড বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেটে গভীর মনোযোগী হয়েছে। কোচিং সেন্টারের ব্যবসা রমরমা। একের ভেতর সব নামে চলছে এসব গাইড। ক্ষেত্রবিশেষ প্রধান শিক্ষক, শ্রেণী শিক্ষক বা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের উপঢৌকনের বিনিময়ে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এসব গাইড বিক্রি করছে। প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আগের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তদারকির কেউ নেই। দেখার কেউ নেই।
তদারকি না করলে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য সফল হবে না। প্রকাশনা জগতের বিখ্যাত প্রায় সব কোম্পানিই এই গাইড ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এদের কাছে জিম্মি। সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায় এই গাইড ব্যবসায়ীরা। কারণ গাইডে সব প্রশ্নের উত্তর সাজানো থাকার কারণে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হতে পারেনি। চোখের সামনে দিন-দুপুরে তারা ব্যবসা করে গেলেও সবাই চোখ বন্ধ রাখে বিশেষ কারণে। তা নাহলে অবৈধ নোট, গাইড, কোচিং, প্রাইভেট চলে কিভাবে? এমনকি তারা প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে নানান নামে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। সুযোগ থাকলে সবাই সুযোগ নেবে। যেকোন মূল্যে অবৈধ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। যদিও এ বিষয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে নোট বা গাইড অবৈধ।
শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে স্পষ্ট বলেছেন, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাক্রম চলবে। কেউ কেউ ভাবছেন তাদের কোচিং ব্যবসা চলবে না, নোট বা গাইডের ব্যবসা চলবে না। সেই কারণে তারা বিরোধিতা করছেন। আমরা সেটিও লক্ষ্য রাখছি। তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে নোট-গাইড-প্রাইভেট-কোচিং ব্যবসায়ীরা সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়। যেকোন মূল্যে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। অন্যথায় সব আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হবে।
[লেখক: উপাধ্যক্ষ (শিক্ষা), পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কলেজ, সাভার]
মিকাইল হোসেন
বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩
পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ, ধর্ম, শিক্ষা- এককথায় সবকিছুকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা। যেকোন মূল্যে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। নীতি-নৈতিকতা আদর্শ সেখানে গৌণ। ব্যবসাই মুখ্য। সেই সুত্রমতে, শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেট বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রযাত্রাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছে।
অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের কারণে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশ ও বাস্তবায়ন সম্ভভ হচ্ছে না। ২০১০ সালে থেকে বহুবার চেষ্টার পরও আজও আলোর মুখ দেখেনি জাতীয় শিক্ষানীতিমালা। কারণ সেখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থবিরোধী কিন্তু ছাত্রদের অনুকূলে বহু আইন রয়েছে। যুগের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য সময়ে সময়ে পাঠ্যক্রম, শিক্ষাক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন একটি সাধারণ বিষয়। এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে নতুন ধারার শিক্ষাক্রম। এবছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে এটি বাস্তবায়িত হবে। ২০২৪ এ তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে চালু হবে। পর্যায়ক্রমে এটি ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলতে থাকবে।
নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ এ বই থেকে শুরু করে শিখন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ সবকিছুতে থাকছে আমূল পরিবর্তন। নতুন কারিকুলামে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে, যার নাম সামষ্টিক মূল্যায়ন। ষষ্ট ও সপ্তম শ্রেণীতে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। নবম ও দশম শ্রেণীতে কয়েকটি বিষয়ে শিখনকালীন অর্ধেক মূল্যায়ন হবে এবং বাকি অর্ধেক সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ৩০ ভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৭০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা নামে আর কোনো বিভাগ থাকবে না।
একাদশ শ্রেণীতে বিভাগ আলাদা হবে। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে অর্থাৎ প্রতি বর্ষে হবে পাবলিক পরীক্ষা। আর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন দুটিই থাকবে।
প্রতিটি কারিকুলাম পরিবর্তনের সময় কিছু নতুন ধারণা প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ কারিকুলাম পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিশাল কর্মকান্ড এবং আর্থিক বিষয়। এছাড়া সামাজিকভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে থাকে কিছু চ্যালেঞ্জ। ২০২৩ সালোর বাস্তবায়নাধীন নতুন শিক্ষাক্রমের ও কিছু সুফল কতৃপক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাইভেট পড়া লাগবে না। কোচিংয়ে যাওয়া লাগবে না। নোট বা গাইড কেনা লাগবে না।
কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে চালু হতে না হতেই নানান আঙ্গিকে অবৈধ নোট বা গাইড বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেটে গভীর মনোযোগী হয়েছে। কোচিং সেন্টারের ব্যবসা রমরমা। একের ভেতর সব নামে চলছে এসব গাইড। ক্ষেত্রবিশেষ প্রধান শিক্ষক, শ্রেণী শিক্ষক বা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের উপঢৌকনের বিনিময়ে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এসব গাইড বিক্রি করছে। প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আগের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তদারকির কেউ নেই। দেখার কেউ নেই।
তদারকি না করলে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য সফল হবে না। প্রকাশনা জগতের বিখ্যাত প্রায় সব কোম্পানিই এই গাইড ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এদের কাছে জিম্মি। সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায় এই গাইড ব্যবসায়ীরা। কারণ গাইডে সব প্রশ্নের উত্তর সাজানো থাকার কারণে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হতে পারেনি। চোখের সামনে দিন-দুপুরে তারা ব্যবসা করে গেলেও সবাই চোখ বন্ধ রাখে বিশেষ কারণে। তা নাহলে অবৈধ নোট, গাইড, কোচিং, প্রাইভেট চলে কিভাবে? এমনকি তারা প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে নানান নামে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। সুযোগ থাকলে সবাই সুযোগ নেবে। যেকোন মূল্যে অবৈধ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। যদিও এ বিষয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে নোট বা গাইড অবৈধ।
শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে স্পষ্ট বলেছেন, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাক্রম চলবে। কেউ কেউ ভাবছেন তাদের কোচিং ব্যবসা চলবে না, নোট বা গাইডের ব্যবসা চলবে না। সেই কারণে তারা বিরোধিতা করছেন। আমরা সেটিও লক্ষ্য রাখছি। তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে নোট-গাইড-প্রাইভেট-কোচিং ব্যবসায়ীরা সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়। যেকোন মূল্যে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। অন্যথায় সব আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হবে।
[লেখক: উপাধ্যক্ষ (শিক্ষা), পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কলেজ, সাভার]