alt

উপ-সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আরও জোর দিন

হীরেন পন্ডিত

: সোমবার, ১৫ মে ২০২৩

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন আশার সঞ্চার করছে কৃষিপণ্য। করোনা মহামারির মধ্যে গত অর্থবছরে এই খাত এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। চলতি অর্থবছরেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত চার বছর ধরে এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়ছে। তবে করোনার কারণে ২০২০ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি ৫ শতাংশ কমেছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যদিও করোনা মহামারির মধ্যে পুরো বছর কেটে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগটি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্যের বিপণনের সুবিধার্থে ট্রেডিং সিস্টেমের আইনি ও অবকাঠামোগত সংস্কার, পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন এবং ঝুঁকি-ভিত্তিক পণ্য ছাড়পত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন। রপ্তানি উনয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছিলো। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আড়াইগুণেরও বেশি বেড়ে ১০২ মিলিয়ন ৮১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। শিক্ষিত যুবক-যুব নারীদের রপ্তানির জন্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে ঝোঁক বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা আশার সৃষ্টি করেছে সবার মাঝে।

এখন বাংলাদেশ সবজি রপ্তানি থেকে প্রচুর আয় করছে। প্রতিবছর এ খাতের রপ্তানি বাড়ছে। গত অর্থবছরে সবজি রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ১১ কোটি ৮৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এবার লক্ষ্যমাত্রা ১২ কোটি ডলার। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসেছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার; যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০২.২৬ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৫.৪৩ শতাংশ বেশি। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ শতাধিক কোম্পানি কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ২০টি বড় ও মাঝারি শিল্প রয়েছে। সবই কমবেশি রপ্তানি করছে। বর্তমানে সরকার কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা (৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার), যা এ খাতের মোট রপ্তানির ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করা বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকা এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ ১৪৫টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। কোম্পানিটি ফলের পানীয়, পানীয়, বিস্কুট, সস, নুডুলস, জেলি, মশলা, সুগন্ধি চাল, আলু পটকা, চানাচুর, ঝাল-মুড়ি ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি করছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাবারের সম্ভাবনা বিশাল। মানুষ যেমন রেডিমেড কাপড় গ্রহণ করছে, তেমনি মানুষ রেডিমেড খাবারও কিনে খাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশই প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন করে না। তারা মূলত আমদানি নির্ভর। সব মিলিয়ে আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বাড়াব। পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করতে হবে।

ইপিবির তথ্য অনুসারে, উল্লেখযোগ্য কৃষি রপ্তানি হচ্ছে শাকসবজি, চা, ফুল, ফল, বিভিন্ন মসলা, তামাক, শুকনো খাবার ইত্যাদি। তবে শুষ্ক খাদ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত ১০০ মিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্যের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যের অংশই বেশি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পাঁচ শতাধিক কোম্পানি। এর মধ্যে ২০টি বড় ও মাঝারি শিল্প এবং ১০০টির বেশি কোম্পানি রপ্তানি করছে। কৃষিপণ্য রপ্তানি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য রপ্তানিতে কর রেয়াত ও ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফলে গত চার বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে। বিশ্ববাজারের চাহিদা মাথায় রেখে এ খাতের উদ্যোক্তারা নতুন পণ্য রপ্তানি শুরু করেছেন, যার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্ববাজারে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বেড়েছে। সরকার চায় দেশের উদ্যোক্তারা এ সুযোগ কাজে লাগান এবং সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, দেশীয় কোম্পানিগুলি বছরের কয়েক মাসে বিস্কুট এবং রুটির মতো শুকনো খাবার রপ্তানি করে ৮৮.৬ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চল। তবে এসব দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসীরা প্রধান ভোক্তা। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে। খরচ কমাতে তারা সাশ্রয়ী মূল্যের খাবার, বিশেষ করে শুকনো খাবারের দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে গত অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অর্জন করেছে তারা। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন এবং মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার ফলে বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রগতি করছে। এছাড়া কর রেয়াত ও নগদ সহায়তার মতো সরকারের নীতি সহায়তা কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের অনেক দেশই প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন করে না। তারা মূলত আমদানি নির্ভর। সব মিলিয়ে আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বাড়বে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করতে হবে। এ খাতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের এখনো শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়েছে।

সরকারকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এসব জটিলতা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এখন কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত’ সার্টিফিকেট। দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করে এমন সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে রপ্তানি ১০ গুণ বাড়াতে পারে এবং প্রতি বছর আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের সনদ দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আমদানি-রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে কৃষি পণ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশেও বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে; কিন্তু ‘মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত’ সার্টিফিকেট রপ্তানিতে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। মানের নিশ্চয়তা সনদ দেয়ার জন্য দেশে কোনো স্বীকৃত ল্যাব নেই। যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া রপ্তানি করা মিঠাপানির মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করেছে অনেক দেশ।

বাংলাদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মাছ রপ্তানির জন্য মৎস্য অধিদপ্তর এবং মাংস ও প্রাণিজ পণ্য রপ্তানির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রত্যয়নপত্র প্রদান করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য রপ্তানির জন্য হালাল সার্টিফিকেট জারি করে এবং বিএসটিআই উৎপাদন পর্যায়ে বাংলাদেশের মান অনুযায়ী ১৮১টি পণ্যকে সার্টিফিকেট দেয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটিরই ক্রেতা দেশগুলোর দ্বারা নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে ‘মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত’ প্রশংসাপত্র জারি করার ক্ষমতা নেই।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ বাণিজ্য ও ট্যারিফ কমিশন দেশে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধে আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত ল্যাব স্থাপনসহ মান নির্ধারণকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি একক ‘স্বাস্থ্য প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের সুপারিশ করেছে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে। এমন একটি সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব হলে সেক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ১০ গুণ বৃদ্ধি করে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

প্রবীণদের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা

একটি সুন্দর সমাজের আকুতি

বাংলাদেশের নির্বাচন ও আমেরিকার ভিসানীতি

কূটনীতি : তখন আর এখন

সেতু-কালভার্টে নদীপথে বাড়ছে সংকট

প্রসঙ্গ : দ্রব্যমূল্য

সম্ভাবনাময় ইকোট্যুরিজম

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

হিন্দু কন্যা সন্তানদের সমানাধিকার প্রসঙ্গে

ছবি

রাজনীতির দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া

নারী শিক্ষার গুরুত্ব

জমি জটিলতা ও ভূমি বিভাগ

ভরত থেকে ভারতবর্ষ অতঃপর হিন্দুস্তান ইন্ডিয়া হয়ে ভারত

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স

রপ্তানি বহুমুখীকরণে তথ্যপ্রযুক্তি খাত

আদিবাসীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা ও পুলিশের ভূমিকা

ছবি

ডেঙ্গু রোধে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

ছবি

পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন

ছবি

বায়ুদূষণের ক্ষতি

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আর প্রয়োজন আছে কি

জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যাবে অগোচরে

বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস

ছবি

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠন কেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত মানুষ

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

ছবি

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়

হরিনামের মায়াময় আবেদন

ছবি

হাওর অর্থনীতি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

ছবি

ড. ইউনূসকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন

শিক্ষার কোনো গন্ডি নেই

দেশীয় গাছ কি গুরুত্ব হারাচ্ছে

বলা, শোনা এবং লেখার অধিকার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আরও জোর দিন

হীরেন পন্ডিত

সোমবার, ১৫ মে ২০২৩

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন আশার সঞ্চার করছে কৃষিপণ্য। করোনা মহামারির মধ্যে গত অর্থবছরে এই খাত এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। চলতি অর্থবছরেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত চার বছর ধরে এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়ছে। তবে করোনার কারণে ২০২০ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি ৫ শতাংশ কমেছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ বেড়েছে এবং প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যদিও করোনা মহামারির মধ্যে পুরো বছর কেটে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগটি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্যের বিপণনের সুবিধার্থে ট্রেডিং সিস্টেমের আইনি ও অবকাঠামোগত সংস্কার, পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন এবং ঝুঁকি-ভিত্তিক পণ্য ছাড়পত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন। রপ্তানি উনয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছিলো। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আড়াইগুণেরও বেশি বেড়ে ১০২ মিলিয়ন ৮১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। শিক্ষিত যুবক-যুব নারীদের রপ্তানির জন্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে ঝোঁক বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা আশার সৃষ্টি করেছে সবার মাঝে।

এখন বাংলাদেশ সবজি রপ্তানি থেকে প্রচুর আয় করছে। প্রতিবছর এ খাতের রপ্তানি বাড়ছে। গত অর্থবছরে সবজি রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ১১ কোটি ৮৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এবার লক্ষ্যমাত্রা ১২ কোটি ডলার। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসেছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার; যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০২.২৬ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৫.৪৩ শতাংশ বেশি। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ শতাধিক কোম্পানি কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ২০টি বড় ও মাঝারি শিল্প রয়েছে। সবই কমবেশি রপ্তানি করছে। বর্তমানে সরকার কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা (৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার), যা এ খাতের মোট রপ্তানির ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করা বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকা এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ ১৪৫টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। কোম্পানিটি ফলের পানীয়, পানীয়, বিস্কুট, সস, নুডুলস, জেলি, মশলা, সুগন্ধি চাল, আলু পটকা, চানাচুর, ঝাল-মুড়ি ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি করছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাবারের সম্ভাবনা বিশাল। মানুষ যেমন রেডিমেড কাপড় গ্রহণ করছে, তেমনি মানুষ রেডিমেড খাবারও কিনে খাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশই প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন করে না। তারা মূলত আমদানি নির্ভর। সব মিলিয়ে আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বাড়াব। পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করতে হবে।

ইপিবির তথ্য অনুসারে, উল্লেখযোগ্য কৃষি রপ্তানি হচ্ছে শাকসবজি, চা, ফুল, ফল, বিভিন্ন মসলা, তামাক, শুকনো খাবার ইত্যাদি। তবে শুষ্ক খাদ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত ১০০ মিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্যের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যের অংশই বেশি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পাঁচ শতাধিক কোম্পানি। এর মধ্যে ২০টি বড় ও মাঝারি শিল্প এবং ১০০টির বেশি কোম্পানি রপ্তানি করছে। কৃষিপণ্য রপ্তানি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য রপ্তানিতে কর রেয়াত ও ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফলে গত চার বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে। বিশ্ববাজারের চাহিদা মাথায় রেখে এ খাতের উদ্যোক্তারা নতুন পণ্য রপ্তানি শুরু করেছেন, যার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্ববাজারে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বেড়েছে। সরকার চায় দেশের উদ্যোক্তারা এ সুযোগ কাজে লাগান এবং সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, দেশীয় কোম্পানিগুলি বছরের কয়েক মাসে বিস্কুট এবং রুটির মতো শুকনো খাবার রপ্তানি করে ৮৮.৬ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চল। তবে এসব দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসীরা প্রধান ভোক্তা। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে। খরচ কমাতে তারা সাশ্রয়ী মূল্যের খাবার, বিশেষ করে শুকনো খাবারের দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে গত অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অর্জন করেছে তারা। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন এবং মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার ফলে বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রগতি করছে। এছাড়া কর রেয়াত ও নগদ সহায়তার মতো সরকারের নীতি সহায়তা কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের অনেক দেশই প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন করে না। তারা মূলত আমদানি নির্ভর। সব মিলিয়ে আগামী দিনে প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বাড়বে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের দেশের কৃষিকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করতে হবে। এ খাতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের এখনো শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রয়েছে।

সরকারকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এসব জটিলতা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এখন কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত’ সার্টিফিকেট। দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করে এমন সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে রপ্তানি ১০ গুণ বাড়াতে পারে এবং প্রতি বছর আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের সনদ দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আমদানি-রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে কৃষি পণ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশেও বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে; কিন্তু ‘মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত’ সার্টিফিকেট রপ্তানিতে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। মানের নিশ্চয়তা সনদ দেয়ার জন্য দেশে কোনো স্বীকৃত ল্যাব নেই। যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া রপ্তানি করা মিঠাপানির মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করেছে অনেক দেশ।

বাংলাদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মাছ রপ্তানির জন্য মৎস্য অধিদপ্তর এবং মাংস ও প্রাণিজ পণ্য রপ্তানির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রত্যয়নপত্র প্রদান করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য রপ্তানির জন্য হালাল সার্টিফিকেট জারি করে এবং বিএসটিআই উৎপাদন পর্যায়ে বাংলাদেশের মান অনুযায়ী ১৮১টি পণ্যকে সার্টিফিকেট দেয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটিরই ক্রেতা দেশগুলোর দ্বারা নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে ‘মানুষের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত’ প্রশংসাপত্র জারি করার ক্ষমতা নেই।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ বাণিজ্য ও ট্যারিফ কমিশন দেশে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধে আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত ল্যাব স্থাপনসহ মান নির্ধারণকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি একক ‘স্বাস্থ্য প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের সুপারিশ করেছে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে। এমন একটি সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব হলে সেক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ১০ গুণ বৃদ্ধি করে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top