alt

উপ-সম্পাদকীয়

সাংবিধানিক সংকটে পাকিস্তান

এম এ কবীর

: রোববার, ২১ মে ২০২৩
image

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। দেশটিতে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সরকার পূর্ণমেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারেনি

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফের গ্রেপ্তারের শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, পুলিশ আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। তিনি দাবি করেন, তাকে ১০ বছর জেলে রাখতে চায় সেনাসমর্থিত সরকার। শুধু তা-ই নয়, তার মানহানির জন্য স্ত্রী বুশরা বিবিকেও কারাগারে পাঠাতে চায় ক্ষমতাসীনরা। আর এসব পরিকল্পনা লন্ডন থেকে এসেছে বলে দাবি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয় সেনাবাহিনীর। যার মূল কাজ সেই রাষ্ট্রের জনগণের জানমালের হেফাজত করা ও সীমান্ত রক্ষা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের জনগণের জন্য সেনাবাহিনী। এক্ষেত্রে পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ সম্ভবত পাকিস্তান। যেখানে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সামরিক শাসন থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সরকার পূর্ণমেয়াদে থাকতে পারেনি ক্ষমতায়।

ইমরান খানও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কারণে গ্রেপ্তার হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন, বরং এই তালিকা বেশ দীর্ঘ। পাকিস্তানের প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কারণ, তিনি জেনারেল আইয়ূব খানের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অভিযোগের বিচার ছাড়াই করাচির নির্জন কারাগারে রাখা হয়।

১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। কার্যত তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যই নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু গ্রেপ্তারই নয়, তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে সুসংগঠিত বিচার কার্যক্রম ছাড়াই বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর কাজ করেনি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের কারণে। কিন্তু এই নির্বাচনের ফল ধরে বিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ আহমদ সামদানি তাকে মুক্তি দেন। এই বিচারপতি বলেছিলেন, তাকে গ্রেপ্তারের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু মার্শাল ল রেগুলেশন-১২‘র অধীনে ৩ দিন পরে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। আইনটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সুরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বা সামরিক আইনের সুষ্ঠু পরিচালনার বিরুদ্ধে কাজ করে এমন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়। এই আইনকে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। অর্থাৎ এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে সেনাবাহিনীর আইন সর্বোচ্চ বিচারবিভাগের ক্ষমতারও ওপরে রাখা হয়েছে। অবশেষে ভুট্টোকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে করাচির এক সমাবেশে তৎকালীন সামরিক সরকারের নিন্দা করায় বেনজির ভুট্টোকেও গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৮৬ সালের আগস্টে। বর্তমানে পিটিআইয়ের ইমরান খানের মতোই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কাছে ‘বিষফোড়া’ হয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। কেননা পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবস্থান, দখল ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে জনসমর্থন পান তিনি।

বেনজির ভুট্টোকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ক্ষমতায় আসীন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। সামরিক শাসক হয়েও তিনি তার পূর্বসূরি আইয়ূব খানের মতোই ক্ষমতা দখলে বেশ পটু ছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তিনি যখন দেশটির রাজনীতির প্রতি মনোযোগী হন, তখনি বেঁকে বসে সামরিক বাহিনী। শেষ পর্যন্ত তাকেও ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কেননা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর স্বার্থে একচুল পরিমাণ আঘাত লাগলেও তারা বিষয়টি সহ্য করেনি। এর জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী।

নওয়াজ শরীফ ও শাহবাজ শরীফকেও গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হতে হয়। মূলত যখন যেই নেতা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখনি সেই নেতাকে গ্রেপ্তারের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। আর এ কারণেই পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হওয়া প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যকবার গ্রেপ্তার করা হয় বেনজির ভুট্টোকে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই গ্রেপ্তার থেকে মুক্তি মিললেও আবারও গ্রেপ্তার হতে পারেন ইমরান খান।

১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী যদি তার ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারতেন তাহলে ইমরান খান পাকিস্তানের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হতেন। কিন্তু, ইমরান খান ছিলেন দেশটির ২২তম প্রধানমন্ত্রী। তার একমাত্র কারণ নির্ধারিত মেয়াদের আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের নানা কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ির গুলিতে তিনি নিহত হন। মৃত্যুর আগে ৪ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ণমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার খুব কাছাকাছি ছিলেন। প্রায় ৪ বছরের বেশি সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। আর দেশটির জনগণ তাকে ভোট দিয়ে বেছে নেয়ার কারণেই স্বৈরশাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল হক ১৯৭৭ সালে প্রথমে তাকে কারাগারে বন্দী করেন এবং অনেকটা বিনা বিচারে ১৯৭৯ সালে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন। ইউসুফ রাজা গিলানি ও নওয়াজ শরীফও প্রায় ৪ বছর সময়কাল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কোনবারই তারা মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

১৯৪৭ সালে একদিন আগে-পরে জন্ম নেয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র। যেখানে ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন নরেন্দ মোদি, সেখানে পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। পাকিস্তানে সর্বোচ্চ ৪ বছর ২ মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। আর সর্বনিম্ন ১৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল আমিন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপের আরেকটি জায়গা হলো দেশটির বিচার বিভাগ। ইমরান খান মাত্র এক বছর আগে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন। নভেম্বরে তাকে হত্যা প্রচেষ্টায় গুলিবিদ্ধ হন।

সরকার ও সামরিক বাহিনী নির্বাচন না করার প্রচেষ্টার কারণে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে এবং গত মাসে একটি সুয়োমোটো নোটিস নিয়েছে, পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা ব্যবহার করে। আদালত এটির ওপর শুনানি শুরু করে। কিন্তু আদালত নিজেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। সরকার সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এখন সুয়োমোটো ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সংসদে একটি বিল পাস করেছে এবং শীর্ষ আদালতের কিছু বিচারক এই প্রস্তাব সমর্থনও করছেন। অর্থাৎ শুধু রাজনীতিই নয়, সমাজও গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এবং তাদের মধ্যে একটি কুৎসিত লড়াই শুরু হয়েছে।

বর্তমানে পাকিস্তান একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের সম্মুখীন। জনগণ এবং সরকার ও সামরিকজান্তার মধ্যে বিভাজন শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, আর্থিক ভাঙনের সঙ্গে বিচার বিভাগ, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়বে।

বর্তমানে পাকিস্তান একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের সম্মুখীন। জনগণ এবং সরকার ও সামরিকজান্তার মধ্যে বিভাজন শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, আর্থিক ভাঙনের সঙ্গে বিচার বিভাগ, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়বে

শুধু সাম্প্রতিক সময়েই নয়, পাকিস্তানের সব কটি সামরিক শাসনকে সে দেশের বিচার বিভাগ বৈধ বলে রায় দিয়েছে। ১৯৫৪ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পার্লামেন্টে ভেঙে দিলে স্পিকার তমিজউদ্দিন যে মামলা করেন, সে মামলার রায়ে সিন্ধু হাইকোর্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়াকে অবৈধ বলে রায় দেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুনিরের নেতৃত্বে ফেডারেল কোর্টে ওই রায় উল্টে দেয়। এই জাস্টিস মুনিরই সামরিক অভ্যুত্থান একটি ইন্টারন্যাশনাল মেথড বা হ্যনস কেলসেনের ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বলে ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনকেও বৈধ বলে ঘোষণা করেন। জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানকে পাকিস্তান কোর্ট, রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও জনগণের কল্যাণ বলে বৈধতা দেয়। আবার পারভেজ মোশারফের ‘ক্যু’ কে ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বলা হয়। এছাড়া আরও একটি সত্য হলো, কোর্টের মাধ্যমে নওয়াজ শরীফকে শাস্তি দিতে না পারলে ইমরান খানের নির্বাচনে ওই ১৫৫টি সিট পাওয়া বাস্তবে সম্ভব ছিল না। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাজনীতিবিদদের ধারধারেনি। তারা নিজেদের মতো করেই সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর অঞ্চলভেদে রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা দখলে রাখার তীব্র ইচ্ছার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে দেশটির সেনাবাহিনী। ফলে ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকেই সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন ছায়াতলে এগিয়ে যায় অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন এমনই শক্তিশালী যে, যে কোন রাজনৈতিক দলই তাদের সঙ্গে আপোষ না করে টিকে থাকতে পারে না। তবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা-কাঠামোর খুব কাছাকাছি থাকলেও, দেশটিতে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হয় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খানের নেতৃত্বে। পাকিস্তান জ্বলছে। এ জ্বলা সাধারণ জ্বলা নয়, জ্বলছে সেনানিবাস। ইমরান খানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদরের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে ইমরানের দলের কয়েকশ সমর্থক। পেশোয়ারের সেনা শিবিরে একই কায়দায় ঢুকে লাগানো হয় আগুন। হামলা হয় লাহোর এবং করাচির সেনানিবাসেও। একজন কমান্ডারের বাসভবনে নির্বিবাদে ভাঙচুর ও আগুন লাগাতে দেখা যায়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম রাজনৈতিক বিক্ষোভের স্পর্শ পড়ে সেনাদের স্থাপনায়, সেনাসদর দপ্তরে, সেনা কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকায়। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, নিরাপত্তায় মোতায়েন পাকিস্তানি সৈনিকরা শক্তি বা অস্ত্র প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের আটকাতে যায়নি।

পাকিস্তানের জন্ম থেকে দেশটি কোনো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখেনি এই সেনাবাহিনীর জন্য। বলা হয় পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন সেনাবাহিনী। প্রতিটি দেশের একটি সেনাবাহিনী থাকে,পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দেশ আছে। কখনো তারা নিজেরাই ক্ষমতা নিয়ে নেয়, আবার কখনো তাদের পছন্দমতো কোনো সরকার বসায়। তারাই ঠিক করে কে ক্ষমতায় বসবে আর কে ক্ষমতা হারাবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দেয়া, গুপ্তহত্যা করার নজির অনেক। ইমরান খান এ ইতিহাস জানেন। তবে অন্যসব নেতার তুলনায় তিনি জনগণকে আলোড়িত করতে পেরেছেন বেশি। বিশেষ করে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ যে তরুণ সমাজ, তারা ইমরানের বড় ভক্ত। এ তারুণ্য পাকিস্তানের রাজনীতির পরিবর্তন চায়, শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র প্রভাবের অবসান চায়। ইমরান তাই জেনেশুনেই ঝুঁকি নিয়েছেন। ইমরান খান সেই আধিপত্যে আঘাত করতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এত খোলামেলাভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। ইমরান কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের তরুণরা, নারী ও নাগরিক সমাজ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে দেশটির জনমত এখন প্রবলভাবে ইমরান খান ও তার দলের পক্ষে। অন্য দিকে প্রভাবশালী অধিকাংশ দল ইমরান খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এরই মধ্যে পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার অজুহাত তৈরির মতো একটি অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। কমিশন অভিযোগ করছে বিধিভঙ্গ করে পিটিআই বিদেশি সহায়তা নিয়েছে।

ইমরান খানের ঘটনা থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেয়ার আছে। রাজনীতিবিদদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে তার জনপ্রিয়তা কমানো যায় না। জোর করে কারও উত্থান ঠেকিয়ে রাখা যায় না, বরং একদিন তার বিস্ফোরণ ঘটবেই। কোনো শক্তি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এটাই স্বাভাবিক।

[লেখক: সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সাংবিধানিক সংকটে পাকিস্তান

এম এ কবীর

image

পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। দেশটিতে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সরকার পূর্ণমেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারেনি

রোববার, ২১ মে ২০২৩

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফের গ্রেপ্তারের শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, পুলিশ আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। তিনি দাবি করেন, তাকে ১০ বছর জেলে রাখতে চায় সেনাসমর্থিত সরকার। শুধু তা-ই নয়, তার মানহানির জন্য স্ত্রী বুশরা বিবিকেও কারাগারে পাঠাতে চায় ক্ষমতাসীনরা। আর এসব পরিকল্পনা লন্ডন থেকে এসেছে বলে দাবি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয় সেনাবাহিনীর। যার মূল কাজ সেই রাষ্ট্রের জনগণের জানমালের হেফাজত করা ও সীমান্ত রক্ষা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্রের জনগণের জন্য সেনাবাহিনী। এক্ষেত্রে পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ সম্ভবত পাকিস্তান। যেখানে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সামরিক শাসন থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সরকার পূর্ণমেয়াদে থাকতে পারেনি ক্ষমতায়।

ইমরান খানও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কারণে গ্রেপ্তার হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন, বরং এই তালিকা বেশ দীর্ঘ। পাকিস্তানের প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কারণ, তিনি জেনারেল আইয়ূব খানের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অভিযোগের বিচার ছাড়াই করাচির নির্জন কারাগারে রাখা হয়।

১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। কার্যত তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যই নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু গ্রেপ্তারই নয়, তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে সুসংগঠিত বিচার কার্যক্রম ছাড়াই বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর কাজ করেনি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের কারণে। কিন্তু এই নির্বাচনের ফল ধরে বিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ আহমদ সামদানি তাকে মুক্তি দেন। এই বিচারপতি বলেছিলেন, তাকে গ্রেপ্তারের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু মার্শাল ল রেগুলেশন-১২‘র অধীনে ৩ দিন পরে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। আইনটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সুরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বা সামরিক আইনের সুষ্ঠু পরিচালনার বিরুদ্ধে কাজ করে এমন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়। এই আইনকে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। অর্থাৎ এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে সেনাবাহিনীর আইন সর্বোচ্চ বিচারবিভাগের ক্ষমতারও ওপরে রাখা হয়েছে। অবশেষে ভুট্টোকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে করাচির এক সমাবেশে তৎকালীন সামরিক সরকারের নিন্দা করায় বেনজির ভুট্টোকেও গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৮৬ সালের আগস্টে। বর্তমানে পিটিআইয়ের ইমরান খানের মতোই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কাছে ‘বিষফোড়া’ হয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। কেননা পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবস্থান, দখল ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে জনসমর্থন পান তিনি।

বেনজির ভুট্টোকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ক্ষমতায় আসীন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। সামরিক শাসক হয়েও তিনি তার পূর্বসূরি আইয়ূব খানের মতোই ক্ষমতা দখলে বেশ পটু ছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তিনি যখন দেশটির রাজনীতির প্রতি মনোযোগী হন, তখনি বেঁকে বসে সামরিক বাহিনী। শেষ পর্যন্ত তাকেও ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কেননা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর স্বার্থে একচুল পরিমাণ আঘাত লাগলেও তারা বিষয়টি সহ্য করেনি। এর জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী।

নওয়াজ শরীফ ও শাহবাজ শরীফকেও গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হতে হয়। মূলত যখন যেই নেতা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখনি সেই নেতাকে গ্রেপ্তারের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। আর এ কারণেই পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হওয়া প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যকবার গ্রেপ্তার করা হয় বেনজির ভুট্টোকে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই গ্রেপ্তার থেকে মুক্তি মিললেও আবারও গ্রেপ্তার হতে পারেন ইমরান খান।

১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী যদি তার ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারতেন তাহলে ইমরান খান পাকিস্তানের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হতেন। কিন্তু, ইমরান খান ছিলেন দেশটির ২২তম প্রধানমন্ত্রী। তার একমাত্র কারণ নির্ধারিত মেয়াদের আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের নানা কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ির গুলিতে তিনি নিহত হন। মৃত্যুর আগে ৪ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ণমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার খুব কাছাকাছি ছিলেন। প্রায় ৪ বছরের বেশি সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন। আর দেশটির জনগণ তাকে ভোট দিয়ে বেছে নেয়ার কারণেই স্বৈরশাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল হক ১৯৭৭ সালে প্রথমে তাকে কারাগারে বন্দী করেন এবং অনেকটা বিনা বিচারে ১৯৭৯ সালে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন। ইউসুফ রাজা গিলানি ও নওয়াজ শরীফও প্রায় ৪ বছর সময়কাল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কোনবারই তারা মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

১৯৪৭ সালে একদিন আগে-পরে জন্ম নেয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র। যেখানে ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন নরেন্দ মোদি, সেখানে পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। পাকিস্তানে সর্বোচ্চ ৪ বছর ২ মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। আর সর্বনিম্ন ১৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল আমিন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপের আরেকটি জায়গা হলো দেশটির বিচার বিভাগ। ইমরান খান মাত্র এক বছর আগে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন। নভেম্বরে তাকে হত্যা প্রচেষ্টায় গুলিবিদ্ধ হন।

সরকার ও সামরিক বাহিনী নির্বাচন না করার প্রচেষ্টার কারণে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে এবং গত মাসে একটি সুয়োমোটো নোটিস নিয়েছে, পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা ব্যবহার করে। আদালত এটির ওপর শুনানি শুরু করে। কিন্তু আদালত নিজেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। সরকার সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এখন সুয়োমোটো ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সংসদে একটি বিল পাস করেছে এবং শীর্ষ আদালতের কিছু বিচারক এই প্রস্তাব সমর্থনও করছেন। অর্থাৎ শুধু রাজনীতিই নয়, সমাজও গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এবং তাদের মধ্যে একটি কুৎসিত লড়াই শুরু হয়েছে।

বর্তমানে পাকিস্তান একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের সম্মুখীন। জনগণ এবং সরকার ও সামরিকজান্তার মধ্যে বিভাজন শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, আর্থিক ভাঙনের সঙ্গে বিচার বিভাগ, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়বে।

বর্তমানে পাকিস্তান একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের সম্মুখীন। জনগণ এবং সরকার ও সামরিকজান্তার মধ্যে বিভাজন শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, আর্থিক ভাঙনের সঙ্গে বিচার বিভাগ, রাজনীতি ও সাংবিধানিক সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়বে

শুধু সাম্প্রতিক সময়েই নয়, পাকিস্তানের সব কটি সামরিক শাসনকে সে দেশের বিচার বিভাগ বৈধ বলে রায় দিয়েছে। ১৯৫৪ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পার্লামেন্টে ভেঙে দিলে স্পিকার তমিজউদ্দিন যে মামলা করেন, সে মামলার রায়ে সিন্ধু হাইকোর্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়াকে অবৈধ বলে রায় দেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুনিরের নেতৃত্বে ফেডারেল কোর্টে ওই রায় উল্টে দেয়। এই জাস্টিস মুনিরই সামরিক অভ্যুত্থান একটি ইন্টারন্যাশনাল মেথড বা হ্যনস কেলসেনের ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বলে ১৯৫৮ এর সামরিক শাসনকেও বৈধ বলে ঘোষণা করেন। জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানকে পাকিস্তান কোর্ট, রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও জনগণের কল্যাণ বলে বৈধতা দেয়। আবার পারভেজ মোশারফের ‘ক্যু’ কে ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বলা হয়। এছাড়া আরও একটি সত্য হলো, কোর্টের মাধ্যমে নওয়াজ শরীফকে শাস্তি দিতে না পারলে ইমরান খানের নির্বাচনে ওই ১৫৫টি সিট পাওয়া বাস্তবে সম্ভব ছিল না। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাজনীতিবিদদের ধারধারেনি। তারা নিজেদের মতো করেই সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর অঞ্চলভেদে রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা দখলে রাখার তীব্র ইচ্ছার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে দেশটির সেনাবাহিনী। ফলে ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকেই সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন ছায়াতলে এগিয়ে যায় অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন এমনই শক্তিশালী যে, যে কোন রাজনৈতিক দলই তাদের সঙ্গে আপোষ না করে টিকে থাকতে পারে না। তবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা-কাঠামোর খুব কাছাকাছি থাকলেও, দেশটিতে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হয় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খানের নেতৃত্বে। পাকিস্তান জ্বলছে। এ জ্বলা সাধারণ জ্বলা নয়, জ্বলছে সেনানিবাস। ইমরান খানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদরের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে ইমরানের দলের কয়েকশ সমর্থক। পেশোয়ারের সেনা শিবিরে একই কায়দায় ঢুকে লাগানো হয় আগুন। হামলা হয় লাহোর এবং করাচির সেনানিবাসেও। একজন কমান্ডারের বাসভবনে নির্বিবাদে ভাঙচুর ও আগুন লাগাতে দেখা যায়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম রাজনৈতিক বিক্ষোভের স্পর্শ পড়ে সেনাদের স্থাপনায়, সেনাসদর দপ্তরে, সেনা কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকায়। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, নিরাপত্তায় মোতায়েন পাকিস্তানি সৈনিকরা শক্তি বা অস্ত্র প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের আটকাতে যায়নি।

পাকিস্তানের জন্ম থেকে দেশটি কোনো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখেনি এই সেনাবাহিনীর জন্য। বলা হয় পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন সেনাবাহিনী। প্রতিটি দেশের একটি সেনাবাহিনী থাকে,পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দেশ আছে। কখনো তারা নিজেরাই ক্ষমতা নিয়ে নেয়, আবার কখনো তাদের পছন্দমতো কোনো সরকার বসায়। তারাই ঠিক করে কে ক্ষমতায় বসবে আর কে ক্ষমতা হারাবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দেয়া, গুপ্তহত্যা করার নজির অনেক। ইমরান খান এ ইতিহাস জানেন। তবে অন্যসব নেতার তুলনায় তিনি জনগণকে আলোড়িত করতে পেরেছেন বেশি। বিশেষ করে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ যে তরুণ সমাজ, তারা ইমরানের বড় ভক্ত। এ তারুণ্য পাকিস্তানের রাজনীতির পরিবর্তন চায়, শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র প্রভাবের অবসান চায়। ইমরান তাই জেনেশুনেই ঝুঁকি নিয়েছেন। ইমরান খান সেই আধিপত্যে আঘাত করতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এত খোলামেলাভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। ইমরান কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানের তরুণরা, নারী ও নাগরিক সমাজ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে দেশটির জনমত এখন প্রবলভাবে ইমরান খান ও তার দলের পক্ষে। অন্য দিকে প্রভাবশালী অধিকাংশ দল ইমরান খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এরই মধ্যে পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার অজুহাত তৈরির মতো একটি অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। কমিশন অভিযোগ করছে বিধিভঙ্গ করে পিটিআই বিদেশি সহায়তা নিয়েছে।

ইমরান খানের ঘটনা থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেয়ার আছে। রাজনীতিবিদদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে তার জনপ্রিয়তা কমানো যায় না। জোর করে কারও উত্থান ঠেকিয়ে রাখা যায় না, বরং একদিন তার বিস্ফোরণ ঘটবেই। কোনো শক্তি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এটাই স্বাভাবিক।

[লেখক: সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top