alt

উপ-সম্পাদকীয়

অসচেতনতায় ডিজিটালি প্রতারিত হবেন না

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ২২ মে ২০২৩

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই প্রতারণা চলে আসছে। তবে প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতারণার প্রযুক্তি বদল হয়েছে- বদলেছে প্রতারণার ধরন। প্রচলিত ধারার প্রতারণা ধরন ধারণ আমরা সবাই প্রায় জানি। নতুন করে জানতে হচ্ছে ডিজিটাল প্রতারণার ধরন। অবশ্য ডিজিটাল মাধ্যম কেবল প্রতারণারই হাতিয়ার নয়, হয়রানি, গুজব, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার, মানহানি এসব কি নেই এই মাধ্যমে! কাজের সূত্রে দিনে-রাতে এসব মোকাবেল করতে হয়। এছাড়াও আছে পর্নো ও জুয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিনে শত শত লিঙ্ক, আইডি, পেজ রিপোর্ট করে সমাজকে নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না। হাজার হাজার সাইট বন্ধ করে এক মুহূর্তও স্থির থাকা যাচ্ছে না। যত বেশি ডিজিটাইজেশন ততো বেশি ডিজিটাল অপরাধের মাত্রা বাড়ছে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়। এসব প্রযুক্তির যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে তেমনি প্রযুক্তির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রমেই বেড়ে চলেছে ডিজিটাল প্রতারণা। কেউ যদি প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং সচেতন না হয় তাহলে এসব প্রতারকের কাছ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়। আগে তাদের প্রতারণার ধরণ ছিল একরকম। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে প্রতারকদের প্রতারণার ধরনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নানা ধরনের ভয়ংকর সব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তারা নিঃস্ব করছে সাধারণ মানুষকে। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। বলা যায়, জীবন যত ডিজিটাল হচ্ছে ততই বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণা। সক্রিয় হচ্ছে অসংখ্য ডিজিটাল প্রতারক চক্র। আমি গুগলে বাংলায় ডিজিটাল প্রতারণা লিখে অনুসন্ধান করে দেখতে পাই ৯ লাখ ৭৭ হাজার তথ্য এসেছে মাত্র ৪৬ সেকেন্ডে। নিচে দেশের প্রায় সকল পত্রিকার খবরের লিঙ্ক আছে ডিজিটাল প্রতারণার। সম্পাদকীয় আছে, মতামত আছে, খবর আছে, সচেতনতামূলক নিবন্ধ আছে। এমনকি টিভির ভিডিও বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে বেশ কিছু সচেতনতামূলক পোস্ট রয়েছে। যারা এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। বস্তুত এটি বাস্তব সত্য যে ডিজিটালের নামে অপকর্ম বন্ধ না হলে মানুষ পুরো বিষয়টি নিয়েই শঙ্কিত হয়ে পড়বে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বার্থেই ডিজিটাল অপকর্ম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে।

সাধারণত সহজ-সরল মানুষরাই এদের প্রধান টার্গেট হয়ে থাকে। সুযোগ বুঝেই অভিনব কৌশল আর মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা প্রতারণা করে চলেছে। এসব প্রতারণার মধ্যে চাকরি, কম খরচে বিদেশ পাঠানোর প্রলোভন, বড় পুরস্কার জেতা, অনলাইনে বিনিয়োগ করে অল্প সময়ে বেশি লাভ, বিদেশ থেকে পার্সেল, ভাগ্যপরিবর্তনসহ বিচিত্র কৌশলে প্রতারণা করে আসছে এসব চক্র। এদের খপ্পর থেকে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সচেতন থাকা ও লোভ পরিহার করা। সাধারণ মানুষ আরো বেশি সতর্ক হলে এসব ডিজিটাল প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কমিয়ে ফেলা যেতে পারে।

ডিজিটাল প্রতারকদের ফাদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারানোর বহু ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। আজ দুটি অভিনব ও সাম্প্রতিক প্রতারণার সত্য উদাহরণ সবাইকে জানাতে চাই। একজন ভুক্তভোগী গাজীপুরের শিরিন আক্তার। শিরিনের সাথে ফেসবুকে বন্ধু হয় লোকমানের। ছবি ও প্রফাইলে সরকারি কর্মচারী দেখে শিরিন তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে কথাও বলা শুরু করে। লোকমান শিরিনের সাথে মোবাইল নাম্বারও শেয়ার করেনি। ওদের মুখে কথাও হয়নি। শিরিন তাকে যাচাই করার জন্য ভিডিও কলে লোকমানের চেহারাও দেখেনি। অন্যদিকে ফেসবুকে শিরিনের সব পরিচয়ই দেয়া ছিল। স্বামী পরিত্যক্তা ও এক সন্তানের অসহায় মায়ের পক্ষে-নামমাত্র একটা চাকরি করে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব নিয়ে লোকমানের সাথে বেশ কথা হয়। লোকমান তার মক্কেল শনাক্ত করে এবং শিরিনকে সরকারি চাকরির লোভ দেখায়। বেতনও জানায় ৩৫ হাজার টাকা। গাজীপুরে থেকেই সে সরকারি চাকরিটা করতে পারবে সেই তথ্যও দেয়। বিশ^াস অর্জনের জন্য ওই ব্যাক্তি নিজেকে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে দাবি করে। শিরিন ভাবে এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সে জানতে চায় চাকরিটা পেতে হলে তার কী করতে হবে। লোকমান জানায় তাকে ৪ লাখ টাকা দিতে হবে। শিরিন মনে মনে খুশি হয়। সে শুনে আসছে সরকারি চাকরির বাজার নাকি এখন ১০-১২ লাখ টাকা। কিছুদিন কথাবার্তা বলার পর চাকরি নিশ্চিত করতে লোকমান ওই নারীকে দুই লাখ টাকা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে বলে। সে জানায় যে, বাকি টাকা চাকরির নিয়োগপত্র পাবার পর দিলেই হবে। সরকারি চাকরির লোভে ওই নারীও কিছু না ভেবে লোকমানের দেয়া গাজীপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দুই লাখ টাকা জমা দিয়ে দেয়। শিরিন নিজে থেকেই যাচাই করে দেখে যে ব্যাংক হিসাবের নাম লোকমান নয় আজমান। এরপর সে ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিয়ে দেয়। ভাববে বিষয়টা পরিষ্কার করবে- তাই মেসেঞ্জারে লোকমানকে নক করতে চায়। শিরিন দেখে লোকমানকে আর পাওয়া যায় না। তার ফেসবুক হিসাব নেই। শিরিন বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে। উন্নত জীবনের আশায় আর্থিক সচ্ছলতার প্রলোভনে পড়ে গাজীপুরের আক্তারের মত বহু মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে প্রতারিত হচ্ছেন।

ডিজিটাল মাধ্যমেই ভিন্ন ধরনের প্রতারণা শিকার হয়েছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকতা সানজিদা আক্তার। একদিন হঠাৎ ফিলিপ নামে একটি বিদেশি ফেসবুক আইডি থেকে তার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। সানজিদা তা গ্রহণও করে। সানজিদার কাছে ফিলিপ তাকে জাতিসংঘের বড় কর্মকর্তা এবং মার্কিন নাগরিক বলে পরিচয় দেয়। কিছুদিন কথা বলার পর ফিলিপ সানজিদাকে গিফট পাঠানোর কথা বলে। সানজিদার বিশ^াস অর্জনের জন্য তার পাঠানো ব্যাগভর্তি গিফটের ছবি এবং মালামালের রশিদের কপি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায় ফিলিপ। আইফোন, স্বর্ণের চেইন এবং ডলারের ছবি পাঠিয়ে সানজিদার বিশ^াস অর্জন করা হয়। এর কয়েক দিন পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে একজন সানজিদাকে ফোন করে। বিমানবন্দরে তার নামে একটি পার্সেল রয়েছে বলে সে জানায়। সে আরও জানায় যে, পার্সেলটি ছাড়াতে কাস্টমসে ৬৫ হাজার টাকা ফি জমা দিতে হবে। তাকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব নাম্বারও দেয়া হয়। ব্যাগভর্তি ডলার, আইফোন, সোনা রয়েছে বলে সানজিদাও লোভের তাড়নায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬৫ হাজার টাকা জমা দেয়। এরপর মালামাল না পাওয়ায় সানজিদা বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন।

দুটি দৃষ্টান্তই সত্য কাহিনীভিত্তিক কেবল পাত্র-পাত্রীর নাম ও ঘটনাস্থল বদলানো হয়েছে। আমাদের চারপাশে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রতারিতের সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে এসব ঘটনার তদন্ত ও শাস্তি হতে পারে। তবে দুঃখজনক হচ্ছে শিরিন বা সানজিদার কেউই একটি জিডিও করেনি। ওদের ধারণা তাতে হয়রানি বাড়বে।

এভাবে অভিনব কায়দায় প্রতারকরা সহজ-সরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করছে। সানজিদা ও শিরিন আক্তারের মতো প্রতিনিয়ত অনেকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের ফাঁদে পড়ে ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে প্রতারিত হচ্ছে। কেউ নিজেকে মোবাইল অপারেটরের কর্মকর্তা দাবি করে গ্রাহকদের মোবাইল নাম্বারের মেসেজ পাঠিয়ে সু-কৌশলে পিন কোড জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ ভুলে টাকা পাঠানো হয়েছে বলে মিথ্যাচার করছে। কেউ কেউ বৃত্তির-উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের পথে হাঁটছে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়। এসব প্রযুক্তির যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে তেমনি প্রযুক্তির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রমেই বেড়ে চলেছে ডিজিটাল প্রতারণা

কেউ ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে অল্প সময়ে অধিক অর্থ উপার্জনের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদ পাতে। বেকার ও উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা এতে আকৃষ্ট হয়ে তাদের অর্থ হারায়। কেউ কেউ পেইড টু ক্লিক অর্থাৎ ক্লিক করার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের লোভ দেখিয়ে ফাঁদ পাতে। রেজিস্ট্রেশনের নামে মানুষ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করা হয়। এগুলোতে কাজ করতে কোন দক্ষতার প্রয়োজন হয় না বলে তরুণ-তরুণীরাও সহজে এসবে ঝুঁকে পড়ে প্রতারিত হয়। অনেকে ফেসবুকে ই-কমার্স পেজ খুলে বিশাল ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে অগ্রিম টাকা নিয়ে ব্লক করে দেয়। অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা এসব বেপরোয়া ডিজিটাল প্রতারক চক্রের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারি। মনে রাখা দরকার যে, একবার প্রতারিত হয়ে গেলে প্রতারকদের কাছ থেকে অর্থ ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কেবল তা-ই নয় প্রতারকরা নিত্যনতুন কৌশল বের করছে। ফলে আপনার প্রতারিত হবার বিপদ আরও বাড়ছে।

আসুন ডিজিটাল প্রতারণা থেকে বাঁচি ও অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করি। যাই ঘটুক আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান ও তাদের সহায়তা করুন। আমি প্রতিদিনই প্রতারক ও অপরাধীদের ধরা পড়া ও শাস্তি হবার সফলতার খবর পাই। আসুন সচেতন হই।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অসচেতনতায় ডিজিটালি প্রতারিত হবেন না

মোস্তাফা জব্বার

সোমবার, ২২ মে ২০২৩

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই প্রতারণা চলে আসছে। তবে প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতারণার প্রযুক্তি বদল হয়েছে- বদলেছে প্রতারণার ধরন। প্রচলিত ধারার প্রতারণা ধরন ধারণ আমরা সবাই প্রায় জানি। নতুন করে জানতে হচ্ছে ডিজিটাল প্রতারণার ধরন। অবশ্য ডিজিটাল মাধ্যম কেবল প্রতারণারই হাতিয়ার নয়, হয়রানি, গুজব, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার, মানহানি এসব কি নেই এই মাধ্যমে! কাজের সূত্রে দিনে-রাতে এসব মোকাবেল করতে হয়। এছাড়াও আছে পর্নো ও জুয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিনে শত শত লিঙ্ক, আইডি, পেজ রিপোর্ট করে সমাজকে নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না। হাজার হাজার সাইট বন্ধ করে এক মুহূর্তও স্থির থাকা যাচ্ছে না। যত বেশি ডিজিটাইজেশন ততো বেশি ডিজিটাল অপরাধের মাত্রা বাড়ছে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়। এসব প্রযুক্তির যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে তেমনি প্রযুক্তির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রমেই বেড়ে চলেছে ডিজিটাল প্রতারণা। কেউ যদি প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং সচেতন না হয় তাহলে এসব প্রতারকের কাছ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়। আগে তাদের প্রতারণার ধরণ ছিল একরকম। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে প্রতারকদের প্রতারণার ধরনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নানা ধরনের ভয়ংকর সব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তারা নিঃস্ব করছে সাধারণ মানুষকে। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। বলা যায়, জীবন যত ডিজিটাল হচ্ছে ততই বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণা। সক্রিয় হচ্ছে অসংখ্য ডিজিটাল প্রতারক চক্র। আমি গুগলে বাংলায় ডিজিটাল প্রতারণা লিখে অনুসন্ধান করে দেখতে পাই ৯ লাখ ৭৭ হাজার তথ্য এসেছে মাত্র ৪৬ সেকেন্ডে। নিচে দেশের প্রায় সকল পত্রিকার খবরের লিঙ্ক আছে ডিজিটাল প্রতারণার। সম্পাদকীয় আছে, মতামত আছে, খবর আছে, সচেতনতামূলক নিবন্ধ আছে। এমনকি টিভির ভিডিও বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে বেশ কিছু সচেতনতামূলক পোস্ট রয়েছে। যারা এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। বস্তুত এটি বাস্তব সত্য যে ডিজিটালের নামে অপকর্ম বন্ধ না হলে মানুষ পুরো বিষয়টি নিয়েই শঙ্কিত হয়ে পড়বে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বার্থেই ডিজিটাল অপকর্ম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে।

সাধারণত সহজ-সরল মানুষরাই এদের প্রধান টার্গেট হয়ে থাকে। সুযোগ বুঝেই অভিনব কৌশল আর মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা প্রতারণা করে চলেছে। এসব প্রতারণার মধ্যে চাকরি, কম খরচে বিদেশ পাঠানোর প্রলোভন, বড় পুরস্কার জেতা, অনলাইনে বিনিয়োগ করে অল্প সময়ে বেশি লাভ, বিদেশ থেকে পার্সেল, ভাগ্যপরিবর্তনসহ বিচিত্র কৌশলে প্রতারণা করে আসছে এসব চক্র। এদের খপ্পর থেকে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সচেতন থাকা ও লোভ পরিহার করা। সাধারণ মানুষ আরো বেশি সতর্ক হলে এসব ডিজিটাল প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কমিয়ে ফেলা যেতে পারে।

ডিজিটাল প্রতারকদের ফাদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারানোর বহু ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। আজ দুটি অভিনব ও সাম্প্রতিক প্রতারণার সত্য উদাহরণ সবাইকে জানাতে চাই। একজন ভুক্তভোগী গাজীপুরের শিরিন আক্তার। শিরিনের সাথে ফেসবুকে বন্ধু হয় লোকমানের। ছবি ও প্রফাইলে সরকারি কর্মচারী দেখে শিরিন তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে কথাও বলা শুরু করে। লোকমান শিরিনের সাথে মোবাইল নাম্বারও শেয়ার করেনি। ওদের মুখে কথাও হয়নি। শিরিন তাকে যাচাই করার জন্য ভিডিও কলে লোকমানের চেহারাও দেখেনি। অন্যদিকে ফেসবুকে শিরিনের সব পরিচয়ই দেয়া ছিল। স্বামী পরিত্যক্তা ও এক সন্তানের অসহায় মায়ের পক্ষে-নামমাত্র একটা চাকরি করে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব নিয়ে লোকমানের সাথে বেশ কথা হয়। লোকমান তার মক্কেল শনাক্ত করে এবং শিরিনকে সরকারি চাকরির লোভ দেখায়। বেতনও জানায় ৩৫ হাজার টাকা। গাজীপুরে থেকেই সে সরকারি চাকরিটা করতে পারবে সেই তথ্যও দেয়। বিশ^াস অর্জনের জন্য ওই ব্যাক্তি নিজেকে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে দাবি করে। শিরিন ভাবে এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সে জানতে চায় চাকরিটা পেতে হলে তার কী করতে হবে। লোকমান জানায় তাকে ৪ লাখ টাকা দিতে হবে। শিরিন মনে মনে খুশি হয়। সে শুনে আসছে সরকারি চাকরির বাজার নাকি এখন ১০-১২ লাখ টাকা। কিছুদিন কথাবার্তা বলার পর চাকরি নিশ্চিত করতে লোকমান ওই নারীকে দুই লাখ টাকা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে বলে। সে জানায় যে, বাকি টাকা চাকরির নিয়োগপত্র পাবার পর দিলেই হবে। সরকারি চাকরির লোভে ওই নারীও কিছু না ভেবে লোকমানের দেয়া গাজীপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দুই লাখ টাকা জমা দিয়ে দেয়। শিরিন নিজে থেকেই যাচাই করে দেখে যে ব্যাংক হিসাবের নাম লোকমান নয় আজমান। এরপর সে ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিয়ে দেয়। ভাববে বিষয়টা পরিষ্কার করবে- তাই মেসেঞ্জারে লোকমানকে নক করতে চায়। শিরিন দেখে লোকমানকে আর পাওয়া যায় না। তার ফেসবুক হিসাব নেই। শিরিন বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে। উন্নত জীবনের আশায় আর্থিক সচ্ছলতার প্রলোভনে পড়ে গাজীপুরের আক্তারের মত বহু মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে প্রতারিত হচ্ছেন।

ডিজিটাল মাধ্যমেই ভিন্ন ধরনের প্রতারণা শিকার হয়েছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকতা সানজিদা আক্তার। একদিন হঠাৎ ফিলিপ নামে একটি বিদেশি ফেসবুক আইডি থেকে তার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। সানজিদা তা গ্রহণও করে। সানজিদার কাছে ফিলিপ তাকে জাতিসংঘের বড় কর্মকর্তা এবং মার্কিন নাগরিক বলে পরিচয় দেয়। কিছুদিন কথা বলার পর ফিলিপ সানজিদাকে গিফট পাঠানোর কথা বলে। সানজিদার বিশ^াস অর্জনের জন্য তার পাঠানো ব্যাগভর্তি গিফটের ছবি এবং মালামালের রশিদের কপি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায় ফিলিপ। আইফোন, স্বর্ণের চেইন এবং ডলারের ছবি পাঠিয়ে সানজিদার বিশ^াস অর্জন করা হয়। এর কয়েক দিন পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে একজন সানজিদাকে ফোন করে। বিমানবন্দরে তার নামে একটি পার্সেল রয়েছে বলে সে জানায়। সে আরও জানায় যে, পার্সেলটি ছাড়াতে কাস্টমসে ৬৫ হাজার টাকা ফি জমা দিতে হবে। তাকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব নাম্বারও দেয়া হয়। ব্যাগভর্তি ডলার, আইফোন, সোনা রয়েছে বলে সানজিদাও লোভের তাড়নায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬৫ হাজার টাকা জমা দেয়। এরপর মালামাল না পাওয়ায় সানজিদা বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন।

দুটি দৃষ্টান্তই সত্য কাহিনীভিত্তিক কেবল পাত্র-পাত্রীর নাম ও ঘটনাস্থল বদলানো হয়েছে। আমাদের চারপাশে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রতারিতের সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে এসব ঘটনার তদন্ত ও শাস্তি হতে পারে। তবে দুঃখজনক হচ্ছে শিরিন বা সানজিদার কেউই একটি জিডিও করেনি। ওদের ধারণা তাতে হয়রানি বাড়বে।

এভাবে অভিনব কায়দায় প্রতারকরা সহজ-সরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করছে। সানজিদা ও শিরিন আক্তারের মতো প্রতিনিয়ত অনেকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের ফাঁদে পড়ে ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে প্রতারিত হচ্ছে। কেউ নিজেকে মোবাইল অপারেটরের কর্মকর্তা দাবি করে গ্রাহকদের মোবাইল নাম্বারের মেসেজ পাঠিয়ে সু-কৌশলে পিন কোড জেনে নিয়ে অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ ভুলে টাকা পাঠানো হয়েছে বলে মিথ্যাচার করছে। কেউ কেউ বৃত্তির-উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের পথে হাঁটছে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়। এসব প্রযুক্তির যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে তেমনি প্রযুক্তির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রমেই বেড়ে চলেছে ডিজিটাল প্রতারণা

কেউ ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে অল্প সময়ে অধিক অর্থ উপার্জনের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদ পাতে। বেকার ও উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা এতে আকৃষ্ট হয়ে তাদের অর্থ হারায়। কেউ কেউ পেইড টু ক্লিক অর্থাৎ ক্লিক করার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের লোভ দেখিয়ে ফাঁদ পাতে। রেজিস্ট্রেশনের নামে মানুষ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করা হয়। এগুলোতে কাজ করতে কোন দক্ষতার প্রয়োজন হয় না বলে তরুণ-তরুণীরাও সহজে এসবে ঝুঁকে পড়ে প্রতারিত হয়। অনেকে ফেসবুকে ই-কমার্স পেজ খুলে বিশাল ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে অগ্রিম টাকা নিয়ে ব্লক করে দেয়। অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা এসব বেপরোয়া ডিজিটাল প্রতারক চক্রের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারি। মনে রাখা দরকার যে, একবার প্রতারিত হয়ে গেলে প্রতারকদের কাছ থেকে অর্থ ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কেবল তা-ই নয় প্রতারকরা নিত্যনতুন কৌশল বের করছে। ফলে আপনার প্রতারিত হবার বিপদ আরও বাড়ছে।

আসুন ডিজিটাল প্রতারণা থেকে বাঁচি ও অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করি। যাই ঘটুক আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান ও তাদের সহায়তা করুন। আমি প্রতিদিনই প্রতারক ও অপরাধীদের ধরা পড়া ও শাস্তি হবার সফলতার খবর পাই। আসুন সচেতন হই।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী]

back to top