alt

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবেশ দূষণ রোধে আমরা কী করছি

সায়েদুল হক

: বুধবার, ২৪ মে ২০২৩

গত আটান্ন বছরের মধ্যে এবার ঢাকায় ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ১৯৯৫ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকার বনভূমি ক্রমাগত কমেছে তো কমছেই। ঢাকাসহ সারাদেশের পানিতে পাওয়া যাচ্ছে আর্সেনিক। পানি ও বায়ুবাহিত রোগে নাকাল নগরবাসী। পরিবেশ দূষণের কারণে ঢাকাসহ দেশের বড় নগরগুলো বসবাসের জন্য প্রায় অযোগ্য। কেন এ বিপর্যয়? কী এর প্রতিকার?

পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার জন্য রয়েছে- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট প্রভৃতি। পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিপ্তর, পূর্ত অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও সরকারের নানা সংস্থা। নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে আইন বিভাগ, প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ। তারপরও প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলছে।

ঢাকা শহরে প্রতিবছর পানির স্তর হু হু করে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী- ‘ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে পানি পাওয়া যেত। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২২ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৯শ ছাড়িয়ে গেছে আর পানির স্তর নেমেছে অন্তত ৮০ মিটারে।’

সরকারি হিসাবমতে, সারা দেশের নানা জায়গায় পানির স্তর ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এটা কিন্তু ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। নগরবাসী, দেশবাসী বা নীতিনির্ধারকদের দেখে বুঝার উপায় নেই বিষয়টি জানেন কিনা।

হাসপাতালের দিকে নজর রাখলে যে কেউ দেখতে পাবেন, সারা বছর ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস জাতীয় নানাপ্রকার পানিবাহিত রোগ এবং যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো বায়ুবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা আতঙ্কজনক পর্যায়ে রয়েছে। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়াও কিন্তু আমাদের পরিবেশ দূষণের ফলাফল। নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা দূষণের অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমাদের পরিবেশ দূষণ এখন মহাবিপযর্য়ের দিকে ধাবমান। এত সচেতনতার পরও কেন মহাবিপর্যয়?

বছর বছর ধরে এত উদ্যোগ নিয়ে, এত বিনিয়োগ করে আমরা পারিনি বৃক্ষ নিধন ও বনভূমি ধ্বংস করা বন্ধ করতে। পারিনি অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন-শিল্পায়ন বন্ধ করতে। পারিনি যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও উচ্চশব্দ বন্ধ করতে। পারিনি কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে। পারিনি ভারতের সঙ্গে সব নদ-নদীর পানি বণ্টনের সমস্যা সমাধান করতে, কমাতে পারিনি ভূগর্ভস্থ পানি আহরণ, পারিনি অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ বন্ধ করতে; পারিনি পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে।

অধিকাংশ মানুষ জানেন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক। সরকারের তথ্য অনুযায়ী এখন বনভূমি রয়েছে ১৭ শতাংশের মতো। অনেকের মতে এর পরিমাণ আরও কম। ঢাকার চিত্র তো আরও করুণ। ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল মাত্র ১২ শতাংশ আর এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ থেকে ৭ শতাংশে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণায় দেখা যায়, গত বিশ বছরে ঢাকা শহরে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ কমেছে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ দূষণ এবং সংরক্ষণে করণীয় সম্পর্কে বিশ বা ত্রিশ বছর আগে ঢাকার বাসিন্দারা জানতেন না এমনটা মনে করার কারণ নেই। ঢাকার পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কে? স্বীকার করি বা না করি এজন্য দায়ী কথিত শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, নগর কর্তৃপক্ষ এবং নীতিনির্ধারক রাজনীতিকরা।

বছর বছর ধরে এত উদ্যোগ নিয়ে, এত বিনিয়োগ করে আমরা পারিনি বৃক্ষনিধন ও বনভূমি ধ্বংস করা বন্ধ করতে। পারিনি অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ-শিল্পায়ন বন্ধ করতে। পারিনি যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও উচ্চশব্দ বন্ধ করতে

ঢাকা দূষণের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যক্ষেণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রতিদিন দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্যমতে, বাতাসের মান ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’। একিউআই ঢাকার বায়ুদূষণের পাঁচটি উপাদান- যথা নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, ওজোন গ্যাস এবং ক্ষতিকর ভারি বস্তুকণা; এসবের উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বাতাসের মানের স্কোর করে থাকে। বহুদিন যাবৎ ঢাকার স্কোর ১৫০ এর ঘরে আটকে আছে, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’। ঢাকার বাতাসে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ বিষাক্ত সিসা, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, কপার, ক্রোমিয়াম, সালফার ও ধূলিকণার উপস্থিতি রয়েছে। গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ নিশ্চিত সিসা সংবহনতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনি সিস্টেমকে আক্রান্ত করে। এটি শিশুদের অতিচঞ্চলতা সৃষ্টি করে এবং তাদের শিক্ষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়; যা ঢাকার শিশুদের আচরণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। ঢাকার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের শ্বাসকষ্ট এবং মাথাব্যথা হবার কারণও বায়ুদূষণ। নীতিমালা ও আইন থাকলেও বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ পরিবহন যান নির্গত ধোঁয়া, কারখানার ধোঁয়া এবং বিল্ডিং কোড অমান্য করে নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করা। সবুজের অভাব তো রয়েছেই।

প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাই নগরবাসীকে রক্ষা করার জন্য বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করছে। এত এত প্রতিষ্ঠান এত এত কাজ করার পরও প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- গত দুই-তিন দশকে নগরের বনভূমি, সবুজের পরিমাণ, জলাধার, খাল, উন্মুক্ত এলাকা, কী করে কমল? আর অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা গড়ে উঠল? ঢাকাকে এমন এক জনবসতিতে পরিণত করা হয়েছে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য এর সক্ষমতা অতি নগন্য।

অনেক দূষণের মধ্যে গত দেড় দুই দশক ধরে যোগ হয়েছে মেডিকেল বর্জ্যরে কারণে দূষণ। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মেডিকেল বর্জ্য অপসারণ করতে না পারলে যেকোনো সময় নগরবাসী কোভিড মহামারির মতো নতুন কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। সহজ করে বললে, ঢাকা মহানগরীতে পরিবেশের সব প্রাকৃতিক উপাদান- বায়ু, পানি, মাটি সবই অস্বাস্থ্যকর, বসবাসের অনুপযোগী। তাহলে জনগণের করের টাকায় প্রতি বছর নতুন নতুন প্রকল্প নেয়ার সার্থকতা কোথায়?

যেহেতু গত বিশ-ত্রিশ বছরে এতগুলো দপ্তর-অধিদপ্তর মিলে শিল্পকারখানার দূষণের হাত থেকে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে পারেনি; দখলমুক্ত করতে পারেনি এবং পরিবেশ দূষণের কোনো একটি কারণকে কমাতে পারেনি; তাই আগামী দশ-বিশ বছরে কী করতে পারবে তা বিশ্বাস করা কঠিন। অন্যদিকে নগরীতে লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তির কারণে নতুন নতুন দূষণের উপাদান ও কারণ যুক্ত হচ্ছে, যেমন ই-বর্জ্য।

ই-বর্জ্য ও মেডিকেল বর্জ্যে নানাবিধ কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক সামগ্রী আছে, যেসবের ক্ষতিকর প্রভাব শত শত বছর মাটিতে রয়ে যায়। ভয় তো শুধু ঢাকাকে নিয়ে নয়। সারাদেশে নদী দূষণ ও দখল, বনভূমি দখল নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ছোট ছোট দখলদার নিয়ে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ হলেও বড় বড় দখলদারের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই নিরব। দখলদাররা রক্ষা দেয়নি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদকে, জীবনানন্দের ধাঁনসিড়ি, অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাসকে। বিগত সাতান্ন বছরে ছোট বড় প্রায় শতাধিক নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায়, সংকটাপন্ন। অর্থাৎ এসব অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে। ঢাকায় শব্দদূষণও মাত্রাতিরিক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবল। অথচ ঢাকায় এলাকাভেদে ৬৭ থেকে ১০০ ডেসিবল।

পরিবেশ দূষণের ফলে সৃষ্ট রোগের কারণে চিকিৎসা খাতে ব্যয় কিভাবে বাড়ছে তা অননুমেয়। ফসল উৎপাদন খরচ বাড়ছে। উৎপাদিত ফসলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে শিল্পোন্নত দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও মিল নেই। মিল হবে না আমাদের কৃষির সঙ্গে বিশে^র অধিকাংশ দেশের কৃষি ব্যবস্থার। তাই সিঙ্গাপুর বা কানাডার সঙ্গে তুলনা না খোঁজে বাংলাদেশকে তার সমস্যা সমাধান করতে হবে নিজের মতো করে। যদি এখন থেকে সততার সঙ্গে চেষ্টা না করি, তাহলে আগামীতে বাংলদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা হবে পরিবেশ বিপর্যয় এবং বাজেটের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ চলে যাবে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে।

[লেখক : কৃষিবিদ]

রপ্তানি বহুমুখীকরণে তথ্যপ্রযুক্তি খাত

আদিবাসীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা ও পুলিশের ভূমিকা

ছবি

ডেঙ্গু রোধে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

ছবি

পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন

ছবি

বায়ুদূষণের ক্ষতি

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আর প্রয়োজন আছে কি

জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যাবে অগোচরে

বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস

ছবি

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠন কেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত মানুষ

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

ছবি

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়

হরিনামের মায়াময় আবেদন

ছবি

হাওর অর্থনীতি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

ছবি

ড. ইউনূসকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন

শিক্ষার কোনো গন্ডি নেই

দেশীয় গাছ কি গুরুত্ব হারাচ্ছে

বলা, শোনা এবং লেখার অধিকার

ছবি

আলুর দাম ও ভোক্তার ভোগান্তি

ছবি

ঘুরে দাঁড়ানো শ্রীলঙ্কার কাছে শেখার কি কিছু আছে

ছবি

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী হেমনগর জমিদার বাড়ি

আদিবাসীদের অর্জন

ছবি

ভাষা প্রশ্নে আমাদের আবেগ এবং কর্মপ্রয়াস

ছবি

অরিগ্যানোর উপকারিতা

একাত্তরের গণহত্যার খণ্ডচিত্র

প্রাথমিক চিকিৎসা ও জনসচেতনতা

মানবিক শিল্পবিপ্লব

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

বিমানবন্দরে লকার থেকে সোনা গায়েব

একটি সহজ সুযোগ হাতছাড়া হলো

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবেশ দূষণ রোধে আমরা কী করছি

সায়েদুল হক

বুধবার, ২৪ মে ২০২৩

গত আটান্ন বছরের মধ্যে এবার ঢাকায় ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ১৯৯৫ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকার বনভূমি ক্রমাগত কমেছে তো কমছেই। ঢাকাসহ সারাদেশের পানিতে পাওয়া যাচ্ছে আর্সেনিক। পানি ও বায়ুবাহিত রোগে নাকাল নগরবাসী। পরিবেশ দূষণের কারণে ঢাকাসহ দেশের বড় নগরগুলো বসবাসের জন্য প্রায় অযোগ্য। কেন এ বিপর্যয়? কী এর প্রতিকার?

পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার জন্য রয়েছে- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট প্রভৃতি। পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিপ্তর, পূর্ত অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও সরকারের নানা সংস্থা। নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে আইন বিভাগ, প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ। তারপরও প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলছে।

ঢাকা শহরে প্রতিবছর পানির স্তর হু হু করে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী- ‘ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে পানি পাওয়া যেত। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২২ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৯শ ছাড়িয়ে গেছে আর পানির স্তর নেমেছে অন্তত ৮০ মিটারে।’

সরকারি হিসাবমতে, সারা দেশের নানা জায়গায় পানির স্তর ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। এটা কিন্তু ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। নগরবাসী, দেশবাসী বা নীতিনির্ধারকদের দেখে বুঝার উপায় নেই বিষয়টি জানেন কিনা।

হাসপাতালের দিকে নজর রাখলে যে কেউ দেখতে পাবেন, সারা বছর ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস জাতীয় নানাপ্রকার পানিবাহিত রোগ এবং যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো বায়ুবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা আতঙ্কজনক পর্যায়ে রয়েছে। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়াও কিন্তু আমাদের পরিবেশ দূষণের ফলাফল। নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা দূষণের অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমাদের পরিবেশ দূষণ এখন মহাবিপযর্য়ের দিকে ধাবমান। এত সচেতনতার পরও কেন মহাবিপর্যয়?

বছর বছর ধরে এত উদ্যোগ নিয়ে, এত বিনিয়োগ করে আমরা পারিনি বৃক্ষ নিধন ও বনভূমি ধ্বংস করা বন্ধ করতে। পারিনি অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন-শিল্পায়ন বন্ধ করতে। পারিনি যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও উচ্চশব্দ বন্ধ করতে। পারিনি কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে। পারিনি ভারতের সঙ্গে সব নদ-নদীর পানি বণ্টনের সমস্যা সমাধান করতে, কমাতে পারিনি ভূগর্ভস্থ পানি আহরণ, পারিনি অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ বন্ধ করতে; পারিনি পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে।

অধিকাংশ মানুষ জানেন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক। সরকারের তথ্য অনুযায়ী এখন বনভূমি রয়েছে ১৭ শতাংশের মতো। অনেকের মতে এর পরিমাণ আরও কম। ঢাকার চিত্র তো আরও করুণ। ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল মাত্র ১২ শতাংশ আর এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ থেকে ৭ শতাংশে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণায় দেখা যায়, গত বিশ বছরে ঢাকা শহরে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ কমেছে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ দূষণ এবং সংরক্ষণে করণীয় সম্পর্কে বিশ বা ত্রিশ বছর আগে ঢাকার বাসিন্দারা জানতেন না এমনটা মনে করার কারণ নেই। ঢাকার পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কে? স্বীকার করি বা না করি এজন্য দায়ী কথিত শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, নগর কর্তৃপক্ষ এবং নীতিনির্ধারক রাজনীতিকরা।

বছর বছর ধরে এত উদ্যোগ নিয়ে, এত বিনিয়োগ করে আমরা পারিনি বৃক্ষনিধন ও বনভূমি ধ্বংস করা বন্ধ করতে। পারিনি অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ-শিল্পায়ন বন্ধ করতে। পারিনি যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও উচ্চশব্দ বন্ধ করতে

ঢাকা দূষণের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যক্ষেণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রতিদিন দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্যমতে, বাতাসের মান ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’। একিউআই ঢাকার বায়ুদূষণের পাঁচটি উপাদান- যথা নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, ওজোন গ্যাস এবং ক্ষতিকর ভারি বস্তুকণা; এসবের উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বাতাসের মানের স্কোর করে থাকে। বহুদিন যাবৎ ঢাকার স্কোর ১৫০ এর ঘরে আটকে আছে, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’। ঢাকার বাতাসে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ বিষাক্ত সিসা, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, কপার, ক্রোমিয়াম, সালফার ও ধূলিকণার উপস্থিতি রয়েছে। গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ নিশ্চিত সিসা সংবহনতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনি সিস্টেমকে আক্রান্ত করে। এটি শিশুদের অতিচঞ্চলতা সৃষ্টি করে এবং তাদের শিক্ষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়; যা ঢাকার শিশুদের আচরণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। ঢাকার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের শ্বাসকষ্ট এবং মাথাব্যথা হবার কারণও বায়ুদূষণ। নীতিমালা ও আইন থাকলেও বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ পরিবহন যান নির্গত ধোঁয়া, কারখানার ধোঁয়া এবং বিল্ডিং কোড অমান্য করে নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করা। সবুজের অভাব তো রয়েছেই।

প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাই নগরবাসীকে রক্ষা করার জন্য বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করছে। এত এত প্রতিষ্ঠান এত এত কাজ করার পরও প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- গত দুই-তিন দশকে নগরের বনভূমি, সবুজের পরিমাণ, জলাধার, খাল, উন্মুক্ত এলাকা, কী করে কমল? আর অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা গড়ে উঠল? ঢাকাকে এমন এক জনবসতিতে পরিণত করা হয়েছে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য এর সক্ষমতা অতি নগন্য।

অনেক দূষণের মধ্যে গত দেড় দুই দশক ধরে যোগ হয়েছে মেডিকেল বর্জ্যরে কারণে দূষণ। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মেডিকেল বর্জ্য অপসারণ করতে না পারলে যেকোনো সময় নগরবাসী কোভিড মহামারির মতো নতুন কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। সহজ করে বললে, ঢাকা মহানগরীতে পরিবেশের সব প্রাকৃতিক উপাদান- বায়ু, পানি, মাটি সবই অস্বাস্থ্যকর, বসবাসের অনুপযোগী। তাহলে জনগণের করের টাকায় প্রতি বছর নতুন নতুন প্রকল্প নেয়ার সার্থকতা কোথায়?

যেহেতু গত বিশ-ত্রিশ বছরে এতগুলো দপ্তর-অধিদপ্তর মিলে শিল্পকারখানার দূষণের হাত থেকে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে পারেনি; দখলমুক্ত করতে পারেনি এবং পরিবেশ দূষণের কোনো একটি কারণকে কমাতে পারেনি; তাই আগামী দশ-বিশ বছরে কী করতে পারবে তা বিশ্বাস করা কঠিন। অন্যদিকে নগরীতে লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তির কারণে নতুন নতুন দূষণের উপাদান ও কারণ যুক্ত হচ্ছে, যেমন ই-বর্জ্য।

ই-বর্জ্য ও মেডিকেল বর্জ্যে নানাবিধ কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক সামগ্রী আছে, যেসবের ক্ষতিকর প্রভাব শত শত বছর মাটিতে রয়ে যায়। ভয় তো শুধু ঢাকাকে নিয়ে নয়। সারাদেশে নদী দূষণ ও দখল, বনভূমি দখল নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ছোট ছোট দখলদার নিয়ে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ হলেও বড় বড় দখলদারের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই নিরব। দখলদাররা রক্ষা দেয়নি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদকে, জীবনানন্দের ধাঁনসিড়ি, অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাসকে। বিগত সাতান্ন বছরে ছোট বড় প্রায় শতাধিক নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায়, সংকটাপন্ন। অর্থাৎ এসব অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে। ঢাকায় শব্দদূষণও মাত্রাতিরিক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবল। অথচ ঢাকায় এলাকাভেদে ৬৭ থেকে ১০০ ডেসিবল।

পরিবেশ দূষণের ফলে সৃষ্ট রোগের কারণে চিকিৎসা খাতে ব্যয় কিভাবে বাড়ছে তা অননুমেয়। ফসল উৎপাদন খরচ বাড়ছে। উৎপাদিত ফসলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে শিল্পোন্নত দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও মিল নেই। মিল হবে না আমাদের কৃষির সঙ্গে বিশে^র অধিকাংশ দেশের কৃষি ব্যবস্থার। তাই সিঙ্গাপুর বা কানাডার সঙ্গে তুলনা না খোঁজে বাংলাদেশকে তার সমস্যা সমাধান করতে হবে নিজের মতো করে। যদি এখন থেকে সততার সঙ্গে চেষ্টা না করি, তাহলে আগামীতে বাংলদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা হবে পরিবেশ বিপর্যয় এবং বাজেটের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ চলে যাবে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে।

[লেখক : কৃষিবিদ]

back to top