জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেছে। এই বাড়তি নিরাপত্তা চারটি দেশের বাংলাদেশস্থ দূতাবাসকে নিয়মিত দেয়া হতো এবং আরও দুয়েকটি দেশের দূতাবাসকে তাদের চাহিদা মোতাবেক মাঝে মাঝে দেয়া হতো। গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশ সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে কয়েকটি দূতাবাসকে বাড়তি নিরাপত্তা দিয়েছিল, দূতাবাস থেকে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার কোনো অনুরোধ ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য থেকে জানা যায়, প্রত্যাহারের পূর্বে বাড়তি নিরাপত্তা কর্মীদের দূতাবাসের সম্মুখে ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ ছিল না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট, পৃথিবীর কোন দেশ আমাদের দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয় না। তবে নতুন সিদ্ধান্ত মোতাবেক নিজস্ব খরচে বিদেশি কূটনীতিকরা ইচ্ছে করলে এসকর্ট ভাড়া করতে পারবেন।
দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা বিধান করার বাধ্যবাধকতা পৃথিবীর কোনো সরকার অস্বীকার করতে পারে না। কোনো দেশের সরকারের অবহেলায় কোনো দূতাবাসের ক্ষতি হলে, রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনো দেশই সেই দেশে দূতাবাস খুলবে না। তাই রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার আপস করতে পারে না। এক সময় বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল, দূতাবাসগুলোর কেন্দ্রস্থল গুলশান হোলি আর্টিজানে জঙ্গিদের আক্রমণে বহু বিদেশি হত্যার শিকার হন। তখন গুলশানে সাধারণ মানুষও ঢুকতে পারতো না। গুলশানে প্রবেশের প্রতিটি পথে প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে চেক করা হতো। রাস্তার অর্ধকের চেয়ে বেশি অংশে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গুলশানে যাওয়া ছিল বিরক্তিকর। তখন সংবেদনশীল কয়েকটি দূতাবাসের নিরাপত্তা বিধানে অতিরিক্ত ফোর্স নিয়োজিত করা হয়। শুধু তাই নয়, সিলেটে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের উপরও বোমা হামলা হয়েছিল।দূতদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এখন কম, কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, জঙ্গি তৎপরতা কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। তাই সরকার বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করেছে।
বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হলেও মূল নিরাপত্তার কোনো হেরফের হয়নি। সরকারি খরচে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়া হবে না মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কোন প্রতিক্রিয়া এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। যাদের বাড়তি এসকর্ট প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদের মাথা ব্যথা না থাকলেও কিছু বাঙালি দেশ-বিদেশ থেকে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিরোধী দল বিএনপিও এই সিদ্ধান্তে মর্মাহত। তাদের ধারণা, বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে সরকার সংশ্লিষ্ট পশ্চিমা দেশগুলোর রোষানলে পড়বে। মূল নিরাপত্তার হেরফের হোক বা না হোক, নিরাপত্তা প্রহরী প্রত্যাহার করায় বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলামও মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। এই প্রত্যাহারকে তিনি সরকারের দায়িত্বহীনতা এবং আত্মম্ভরিতার বহির্প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। তার ধারণা এই প্রত্যাহারের ফলাফল বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে।
ফখরুল সাহেব একটি ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে যথাযথ প্রটোকল না পেয়ে নিরাপত্তা প্রহরী প্রত্যাহার করে প্রতিশোধ নিয়েছেন। ফখরুল সাহেবকে এত অপরিপক্ক কথা আগে বলতে শুনিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা গিয়েছেন বিশ্ব ব্যাংকের আমন্ত্রণে এবং ব্রিটেন গেছেন নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে। ব্রিটেনে প্রায় দুইশ দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। যে স্বল্পসংখ্যক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দেখা করেছেন তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। প্রটোকলের ক্ষেত্রে এক এক দেশ এক এক রকম নীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। বিএনপি কয়েকবার দেশ শাসন করেছে, তাই ফখরুল সাহেবের জানা থাকার কথা যে, আমাদের মতো গরিব দেশগুলো যেভাবে বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়ন করি, প্রটোকল দিয়ে থাকি তা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো দেয় না। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেলে বোঝা যায় আমাদের গুরুত্ব কতটুকু। আজ পর্যন্ত কোন সরকার সৌদি বাদশাহকে বাংলাদেশে আনতে পারেনি, অথচ তারা ভারতে যাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধবিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য নিয়ে বিরোধী দল ট্রল করা শুরু করেছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, কোন দেশ আমাদের ওপর অবরোধ আরোপ করলে বাংলাদেশও তাদের কাছ থেকে কিছু কিনবে না। বিরোধী দলের ধারণা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রদত্ত বিদেশি চাপ সহ্য করতে না পেরে শেখ হাসিনা সজ্ঞানে নেই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিদেশি শক্তি প্রেসার থাকলেও তারা দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলবে না; কারণ পাকিস্তান ছাড়া এমন সরকার পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। দ্বিতীয়ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি না থাকায় এই সরকার সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থি এবং পরিপন্থি বলেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। এই অবস্থায় কোন দেশ দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলবে না। তাই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কোনো চাপ বর্তমান সরকারের ওপর থাকার কথা নয়। তবে গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক এটা প্রত্যাশা করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবরোধ আরোপ বা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যা বলেছেন তা ফলপ্রসূ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ শুধু অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী না হওয়ার কারণে বা সামরিক শক্তি অন্যের মধ্যে ভীতি সৃষ্টিতে অক্ষম বলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো অন্যদেশের ব্যাপারে কোন মতামত গোপনে বা প্রকাশ্যে দেয়ার অধিকার রাখে না অথবা মতামত দিলে তা কোনো গুরুত্ব বহন করে না। শুধু তাই নয়, যে কয়েকটি দেশ আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতিতে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে সেই দেশগুলো হচ্ছে জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ব্রিটেন। এই দেশগুলো কখনো আমেরিকা এবং ইউরোপের কথার বাইরে যাবে না। আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমেরিকার প্রভাব অনস্বীকার্য। তাই পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধকে ভয় ও সমীহ করে থাকে। স্বার্বভৌম ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে আমাদের মতো দেশের পক্ষে অন্য প্রভাবশালী দেশকে অগ্রাহ্য করার অহংবোধ তাই অচল।
ইউরোপ, কানাডা এবং আমেরিকা থেকে আমরা যা কিনি তার চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি করি। আমাদের আমদানির ওপর এই সবাই দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল নয়, কিন্তু আমাদের অর্থনীতি ওই সব দেশে রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ আমদানি হয় চীন এবং ভারত থেকে, মোট আমদানির ৪৩ শতাংশ; চীন থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার, আর ভারত থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে থাকি। অন্যদিকে এই দুটি দেশে আমরা রপ্তানি করি আমাদের মোট রপ্তানির মাত্র ৫ শতাংশ। আমেরিকা থেকে বছরে আমদানি করি মাত্র আড়াই শত কোটি ডলারের পণ্য। আমাদের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, মোট রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ; আর ইউরোপের ২৭টি দেশে হয় মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু বিনিয়োগ নয়, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে সৌদির আরবের পরই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। আমাদের রপ্তানির ৮২ শতাংশ হচ্ছে পোষাক- আর এই পোষাক কিনে আমেরিকা, ইউরোপ এবং কানাডা। আমাদের আমদানি পণ্যের মূল্য এত বেশি যে, রপ্তানি এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দিয়েও তার পুনর্ভরণ করা সম্ভব হয় না।
ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে শর্তহীন প্রশ্রয় দেয়ার কারণে আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের জনগণ দলমত নির্বিশেষে ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু সম্প্রতি আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের মৃদু সমর্থন থাকায়, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় আমেরিকা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় বিএনপি খুব খুশি এবং এটা স্বাভাবিক। এই প্রেসার যাতে আরো জোরালো হয় সেজন্য বিএনপি বাড়তি নিরাপত্তা প্রহরী প্রত্যাহারে রঙ লাগাচ্ছে, এটাও বিএনপির জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপি বুঝতে পারছে না যে, আমেরিকার ইউটার্ন নিতে বেশি সময় লাগে না। বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারে আমেরিকার মাথা ব্যথার কোনো কারণ নেই, কারণ আমেরিকা জানে তাদের দূতাবাস ও দূতদের নিরাপত্তা বিধান সরকার যে কোনো পরিস্থিতিতে সতর্ক ও সজাগ থাকবে। আর নিষেধাজ্ঞা! সরকারকে চাপে রাখতে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞার কৌশল নিতেই পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই চাপ অবশ্যই বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন তাদের ফোকাস নয়। আমেরিকার অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা কখনো সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সম্পর্কিত হলে গণতন্ত্রবিহীন সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান প্রভৃতি দেশের সঙ্গে তাদের এত দহরম মহরম সম্পর্ক থাকত না।
[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৭ মে ২০২৩
সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেছে। এই বাড়তি নিরাপত্তা চারটি দেশের বাংলাদেশস্থ দূতাবাসকে নিয়মিত দেয়া হতো এবং আরও দুয়েকটি দেশের দূতাবাসকে তাদের চাহিদা মোতাবেক মাঝে মাঝে দেয়া হতো। গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশ সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে কয়েকটি দূতাবাসকে বাড়তি নিরাপত্তা দিয়েছিল, দূতাবাস থেকে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার কোনো অনুরোধ ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য থেকে জানা যায়, প্রত্যাহারের পূর্বে বাড়তি নিরাপত্তা কর্মীদের দূতাবাসের সম্মুখে ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্সের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ ছিল না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট, পৃথিবীর কোন দেশ আমাদের দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয় না। তবে নতুন সিদ্ধান্ত মোতাবেক নিজস্ব খরচে বিদেশি কূটনীতিকরা ইচ্ছে করলে এসকর্ট ভাড়া করতে পারবেন।
দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা বিধান করার বাধ্যবাধকতা পৃথিবীর কোনো সরকার অস্বীকার করতে পারে না। কোনো দেশের সরকারের অবহেলায় কোনো দূতাবাসের ক্ষতি হলে, রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনো দেশই সেই দেশে দূতাবাস খুলবে না। তাই রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার আপস করতে পারে না। এক সময় বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল, দূতাবাসগুলোর কেন্দ্রস্থল গুলশান হোলি আর্টিজানে জঙ্গিদের আক্রমণে বহু বিদেশি হত্যার শিকার হন। তখন গুলশানে সাধারণ মানুষও ঢুকতে পারতো না। গুলশানে প্রবেশের প্রতিটি পথে প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে চেক করা হতো। রাস্তার অর্ধকের চেয়ে বেশি অংশে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গুলশানে যাওয়া ছিল বিরক্তিকর। তখন সংবেদনশীল কয়েকটি দূতাবাসের নিরাপত্তা বিধানে অতিরিক্ত ফোর্স নিয়োজিত করা হয়। শুধু তাই নয়, সিলেটে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের উপরও বোমা হামলা হয়েছিল।দূতদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এখন কম, কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, জঙ্গি তৎপরতা কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। তাই সরকার বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করেছে।
বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হলেও মূল নিরাপত্তার কোনো হেরফের হয়নি। সরকারি খরচে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়া হবে না মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কোন প্রতিক্রিয়া এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। যাদের বাড়তি এসকর্ট প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদের মাথা ব্যথা না থাকলেও কিছু বাঙালি দেশ-বিদেশ থেকে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিরোধী দল বিএনপিও এই সিদ্ধান্তে মর্মাহত। তাদের ধারণা, বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে সরকার সংশ্লিষ্ট পশ্চিমা দেশগুলোর রোষানলে পড়বে। মূল নিরাপত্তার হেরফের হোক বা না হোক, নিরাপত্তা প্রহরী প্রত্যাহার করায় বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলামও মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। এই প্রত্যাহারকে তিনি সরকারের দায়িত্বহীনতা এবং আত্মম্ভরিতার বহির্প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। তার ধারণা এই প্রত্যাহারের ফলাফল বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে।
ফখরুল সাহেব একটি ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে যথাযথ প্রটোকল না পেয়ে নিরাপত্তা প্রহরী প্রত্যাহার করে প্রতিশোধ নিয়েছেন। ফখরুল সাহেবকে এত অপরিপক্ক কথা আগে বলতে শুনিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা গিয়েছেন বিশ্ব ব্যাংকের আমন্ত্রণে এবং ব্রিটেন গেছেন নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে। ব্রিটেনে প্রায় দুইশ দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। যে স্বল্পসংখ্যক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দেখা করেছেন তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। প্রটোকলের ক্ষেত্রে এক এক দেশ এক এক রকম নীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। বিএনপি কয়েকবার দেশ শাসন করেছে, তাই ফখরুল সাহেবের জানা থাকার কথা যে, আমাদের মতো গরিব দেশগুলো যেভাবে বিদেশি অতিথিদের আপ্যায়ন করি, প্রটোকল দিয়ে থাকি তা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো দেয় না। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেলে বোঝা যায় আমাদের গুরুত্ব কতটুকু। আজ পর্যন্ত কোন সরকার সৌদি বাদশাহকে বাংলাদেশে আনতে পারেনি, অথচ তারা ভারতে যাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধবিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য নিয়ে বিরোধী দল ট্রল করা শুরু করেছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, কোন দেশ আমাদের ওপর অবরোধ আরোপ করলে বাংলাদেশও তাদের কাছ থেকে কিছু কিনবে না। বিরোধী দলের ধারণা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রদত্ত বিদেশি চাপ সহ্য করতে না পেরে শেখ হাসিনা সজ্ঞানে নেই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিদেশি শক্তি প্রেসার থাকলেও তারা দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলবে না; কারণ পাকিস্তান ছাড়া এমন সরকার পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। দ্বিতীয়ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধি না থাকায় এই সরকার সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থি এবং পরিপন্থি বলেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। এই অবস্থায় কোন দেশ দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলবে না। তাই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কোনো চাপ বর্তমান সরকারের ওপর থাকার কথা নয়। তবে গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক এটা প্রত্যাশা করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবরোধ আরোপ বা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যা বলেছেন তা ফলপ্রসূ করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ শুধু অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী না হওয়ার কারণে বা সামরিক শক্তি অন্যের মধ্যে ভীতি সৃষ্টিতে অক্ষম বলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো অন্যদেশের ব্যাপারে কোন মতামত গোপনে বা প্রকাশ্যে দেয়ার অধিকার রাখে না অথবা মতামত দিলে তা কোনো গুরুত্ব বহন করে না। শুধু তাই নয়, যে কয়েকটি দেশ আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতিতে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে সেই দেশগুলো হচ্ছে জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ব্রিটেন। এই দেশগুলো কখনো আমেরিকা এবং ইউরোপের কথার বাইরে যাবে না। আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমেরিকার প্রভাব অনস্বীকার্য। তাই পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধকে ভয় ও সমীহ করে থাকে। স্বার্বভৌম ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে আমাদের মতো দেশের পক্ষে অন্য প্রভাবশালী দেশকে অগ্রাহ্য করার অহংবোধ তাই অচল।
ইউরোপ, কানাডা এবং আমেরিকা থেকে আমরা যা কিনি তার চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি করি। আমাদের আমদানির ওপর এই সবাই দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল নয়, কিন্তু আমাদের অর্থনীতি ওই সব দেশে রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ আমদানি হয় চীন এবং ভারত থেকে, মোট আমদানির ৪৩ শতাংশ; চীন থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার, আর ভারত থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে থাকি। অন্যদিকে এই দুটি দেশে আমরা রপ্তানি করি আমাদের মোট রপ্তানির মাত্র ৫ শতাংশ। আমেরিকা থেকে বছরে আমদানি করি মাত্র আড়াই শত কোটি ডলারের পণ্য। আমাদের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, মোট রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ; আর ইউরোপের ২৭টি দেশে হয় মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু বিনিয়োগ নয়, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে সৌদির আরবের পরই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। আমাদের রপ্তানির ৮২ শতাংশ হচ্ছে পোষাক- আর এই পোষাক কিনে আমেরিকা, ইউরোপ এবং কানাডা। আমাদের আমদানি পণ্যের মূল্য এত বেশি যে, রপ্তানি এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দিয়েও তার পুনর্ভরণ করা সম্ভব হয় না।
ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে শর্তহীন প্রশ্রয় দেয়ার কারণে আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের জনগণ দলমত নির্বিশেষে ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু সম্প্রতি আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের মৃদু সমর্থন থাকায়, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় আমেরিকা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় বিএনপি খুব খুশি এবং এটা স্বাভাবিক। এই প্রেসার যাতে আরো জোরালো হয় সেজন্য বিএনপি বাড়তি নিরাপত্তা প্রহরী প্রত্যাহারে রঙ লাগাচ্ছে, এটাও বিএনপির জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপি বুঝতে পারছে না যে, আমেরিকার ইউটার্ন নিতে বেশি সময় লাগে না। বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারে আমেরিকার মাথা ব্যথার কোনো কারণ নেই, কারণ আমেরিকা জানে তাদের দূতাবাস ও দূতদের নিরাপত্তা বিধান সরকার যে কোনো পরিস্থিতিতে সতর্ক ও সজাগ থাকবে। আর নিষেধাজ্ঞা! সরকারকে চাপে রাখতে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞার কৌশল নিতেই পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই চাপ অবশ্যই বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন তাদের ফোকাস নয়। আমেরিকার অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা কখনো সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সম্পর্কিত হলে গণতন্ত্রবিহীন সৌদি আরব, মিশর, জর্ডান প্রভৃতি দেশের সঙ্গে তাদের এত দহরম মহরম সম্পর্ক থাকত না।
[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]