গৌতম রায়
(গতকালের পর)
বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গোটা ভারতব্যাপী রাজনৈতিক ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাওয়া কংগ্রেস দলটিই এখনও বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এমনকি যেসব রাজ্যে বিজেপি এখনও দাঁত ফোটাতে পারেনি, সেসব রাজ্যেও কংগ্রেস দলের একটা পরিচিতি আছে, স্বল্প হলেও জনভিত্তি আজে। তাই কমিউনিস্টদের পাশাপাশি কংগ্রেসের প্রতিও ফ্যাসিবাদী কায়দায় বিজেপির আক্রমণের শেষ নেই। যে প্রক্রিয়াতে বিজেপি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করেছে, রাহুলের ছয় বছর ভোটে লড়বার অধিকার কেড়েছে, তা ইন্দিরা গান্ধীর আমলের জরুরি অবস্থার কালে গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করবার সব প্রচেষ্টাকেও হার মানায়। রাহুলকে যেভাবে তার সরকারি আবাসন থেকে উচ্ছেদ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, তাতে বিজেপির প্রশাসনিক মানসিকতার চাইতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছবি ই সবথেকে বেশি উঠে এসেছে।
রাহল গান্ধীর প্রতি এই প্রতিহিংসামূলক আচরণের ভিতর দিয়ে বিজেপি কার্যত কংগ্রেসের ঝিমিয়ে পড়া, নানা গোষ্ঠী, ব্যক্তি সংঘর্ষে জীর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে একটা জোয়ার এনে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে পথে বিজেপি গোবলয়ে হাঁটে, জাতপাতের ভিত্তিকে অনেকটা সেই আদলে দক্ষিণ ভারতে প্রয়োগ করে কংগ্রেস। উত্তর ভারতে সঙ্ঘ- বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলায় যে নরম হিন্দু অবয়বের পথে হাঁটে কংগ্রেস, সেই নরম হিন্দুত্বের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে লিঙ্গায়েতসহ নানা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের যে সংঘাত, সেই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কংগ্রেস যখন দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতায় ছিল, তখন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এই জাতপাতের লড়াই, উত্তর ভারতের জাতপাতের লড়াইয়ের থেকে কিছুটা ভিন্নমাত্রার হলেও, দক্ষিণের লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ টা অনেকটাই কংগ্রেস আর বাকিটা ডিএমকে, জনতা দল (সেকুলার), এআই এডিএমকে, তেলেগু দেশমের মতো আঞ্চলিক দলগুলোরও নিয়ন্ত্রণে। ফলে এই জাতপাতের লড়াইয়ের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার লড়াইয়ের যে বিষয়টা দক্ষিণ ভারতে রয়েছে, মহারাষ্ট্রে মারাঠি জাত্যাভিমান বা হায়দ্রাবাদে উচ্চবর্ণের মুসলমানদের সঙ্গে খেতে খাওয়া মুসলমানদের গোলমালকে উসকে দেওয়া- এসব পদ্ধতি আরএসএস, তার বিভিন্ন শাখা সংগঠনকে দিয়ে প্রয়োগের অনেক চেষ্টা করেও তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধার পেলেও উত্তর ভারতের মতো স্থায়ী কিছু সুবিধা পায় না।
তাই কর্নাটকে কংগ্রেসের জেতার পিছনে একটা শাসক বিজেপি বিরোধী হাওয়া থাকলেও রাহুলের প্রতি একটা সহানুভূতির হাওয়া (রাহুল কেরলেরই সাংসদ ছিলেন) এবং জাতপাতের রাজনীতিকে একটা ভোট কৌশল হিশেবে সফল ভাবে কংগ্রেসের কাজে লাগানোর বিষয়টিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতীতে কংগ্রেসের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে রামকৃষ্ণ হেডড়ে, এসআর বোম্মাই, এইচডি দেবগৌড়ারা যখন রাজ্যটি পরিচালনা করেছিলেন, তখন অবিভক্ত জনতা দল বা পরবর্তীতে সেটি ভেঙে জনতা দল (সেকুলার) তৈরি হওয়ার পরে যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ সেই রাজ্যে ছিল, সেটা ছিল কংগ্রেস দলের সঙ্গে। বিজেপির তখন কর্ণাটকে কার্যত কোনো উপস্থিতিই ছিল না।
অটলবিহারীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আয়ারাম গয়ারাম পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাজ্যে সরকার তৈরি করে বিজেপি। দক্ষিণ ভারতেও এ পদ্ধতিতে বিজেপির সরকার গঠনে বিরাম ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই বিজেপির পিছনের দরজা দিয়ে পাওয়া গরিষ্ঠতার জেরে তৈরি সরকারগুলো বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু যে যে রাজ্যে সময় বিশেষে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে বিজেপি, সেই সেই রাজ্যে প্রশাসনের ভিতরে আরএসএসীয় করণের কাজটা তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করতে সক্ষম হয়েছে। প্রশাসনের ভিতরে সঙ্ঘের নিজেদের লোকেদের ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রভাব বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটে পেয়েছে, ২০১৯ সালে পেয়েছে, এখনো পেয়ে চলেছে। এই যে মেরুকরণের রাজনীতি, যেটা ক্ষমতা ধরে রাখবার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির মূল টিআরপি, সেই কাজটা প্রশাসনে সঙ্ঘের নিজেদের লোকেদের ঢুকিয়ে দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে করে যেতে সক্ষম হয়েছে সঙ্ঘ।
এতকিছু সত্ত্বেও কর্নাটকে বিজেপির পরাজয়, আর ঠিক এক বছরের ভিতরে ভারতে যে সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই দেশের জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কিছুটা হলেও কোণঠাসা করবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষেত্রে কাছাকাছি আনবার সুযোগ করে দেবে। গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির যে কর্নাটকের ফল ঘিরে কিছুটা হলেও সিঁদুরে মেঘ দেখছে, তা তাদের অতি বিশ্বস্ত বন্ধু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণ দেখলেই বুঝতে পারা যাচ্ছে।
কর্নাটকের ফল প্রকাশের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের অবস্থান একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে কংগ্রেসের প্রতি ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। মমতাময়ী সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার, মমতার আবার নেওয়া নোতুন অবস্থানকে জোরদার প্রচার দিয়েছে। যে মমতা, গত এক বছরের ভিতরে ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে বিজেপির যাতে সুবিধা হয়, তার অনুকূলে যাবতীয় অবস্থান নিলেন, সেই মমতার হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? যে জগদীপ ধনকরের সঙ্গে মমতা একটা লোক দেখানো আদায় কাঁচকলা সম্পর্কের অভিনয় করতেন, সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ সেই ধনকরকে উপ-রাষ্ট্রপতি করতে দার্জিলিংয়ে আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে গোপন বৈঠক পর্যন্ত করে গোটা বিরোধী শিবিরের সঙ্গে অত্যন্ত অপমান জনক আচরণ করেছেন, কংগ্রেস দল, তাদের নেত্রী সোনিয়া, রাহুলকে ঘিরেও বিষোদগার করতে ছাড়েননি, হঠাৎ কেন সেই কংগ্রেস ঘিরে এতটা ইতিবাচক হয়ে উঠরেন মমতা?
মাইকেল মধুসূদনের কাব্য ধার করে- ‘এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’র রাজনৈতিক তাৎপর্য ঘিরে বলতে হয় যে, কর্নাটকে বিজেপি গোহারান হেরে যাওয়ার পর, আসন্ন লোকসভা ভোটকে ঘিরে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে যে নয়া সমীকরণের আভাস দেখা দিতে শুরু করেছে, সেই সমীকরণের যাবতীয় পরিকল্পনাকে আঁতুরে বিনষ্ট করতেই আর এস এসের অত্যন্ত আস্থাভাজন, গোপনকর্মী হিশেবে আসরে নেমে পড়ে মমতা এই কংগ্রেস স্তুতি করতে শুরু করেছেন। বিজেপি বিরোধী কোনোরকম বিরোধী দলের ঐক্য যাতে না তৈরি হতে পারে, সেজন্যে হাতে অনেক সময় নিয়েই আরএসএস তাদের বিশ্বস্ত দুর্দিনের ত্রাণকর্ত্রী মমতাকে ইতোমধ্যেই আসরে নামিয়ে দিয়েছে। বিয়ের প্রথম রাতে বেড়াল মারবার প্রবচনের মতোই, আরএসএস কোনো সময় অযথা নষ্ট করতে চায় না। কর্নাটকের ভোটের ফল ঘিরে তাদের গোপন মূল্যায়ন হলো, সেই রাজ্যে মুসলমান ভোট অনেকটা যুথবদ্ধ হয়ে কংগ্রেসে ফিরে যাওয়ার ফলে, গোটা দেশে বিজেপির পালে হিন্দু ভোটের সংহতির বিষয়টা অনেকটা সহজ হবে। পশ্চিমবঙ্গেও এই ফর্মুলা কাজে লাগাতে ইতোমধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছে সঙ্ঘ। তাই সময় যত এগোবে, মমতা তার প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির অঙ্ক আরও জোরদারভাবে কষতে শুরু করে দেবেন, যাতে অঙ্কের ইতিবাচক ভোটের ফল বিজেপির ঝুলিতেই যায়।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ২৭ মে ২০২৩
(গতকালের পর)
বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গোটা ভারতব্যাপী রাজনৈতিক ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাওয়া কংগ্রেস দলটিই এখনও বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এমনকি যেসব রাজ্যে বিজেপি এখনও দাঁত ফোটাতে পারেনি, সেসব রাজ্যেও কংগ্রেস দলের একটা পরিচিতি আছে, স্বল্প হলেও জনভিত্তি আজে। তাই কমিউনিস্টদের পাশাপাশি কংগ্রেসের প্রতিও ফ্যাসিবাদী কায়দায় বিজেপির আক্রমণের শেষ নেই। যে প্রক্রিয়াতে বিজেপি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করেছে, রাহুলের ছয় বছর ভোটে লড়বার অধিকার কেড়েছে, তা ইন্দিরা গান্ধীর আমলের জরুরি অবস্থার কালে গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করবার সব প্রচেষ্টাকেও হার মানায়। রাহুলকে যেভাবে তার সরকারি আবাসন থেকে উচ্ছেদ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, তাতে বিজেপির প্রশাসনিক মানসিকতার চাইতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছবি ই সবথেকে বেশি উঠে এসেছে।
রাহল গান্ধীর প্রতি এই প্রতিহিংসামূলক আচরণের ভিতর দিয়ে বিজেপি কার্যত কংগ্রেসের ঝিমিয়ে পড়া, নানা গোষ্ঠী, ব্যক্তি সংঘর্ষে জীর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে একটা জোয়ার এনে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে পথে বিজেপি গোবলয়ে হাঁটে, জাতপাতের ভিত্তিকে অনেকটা সেই আদলে দক্ষিণ ভারতে প্রয়োগ করে কংগ্রেস। উত্তর ভারতে সঙ্ঘ- বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলায় যে নরম হিন্দু অবয়বের পথে হাঁটে কংগ্রেস, সেই নরম হিন্দুত্বের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে লিঙ্গায়েতসহ নানা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের যে সংঘাত, সেই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কংগ্রেস যখন দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতায় ছিল, তখন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এই জাতপাতের লড়াই, উত্তর ভারতের জাতপাতের লড়াইয়ের থেকে কিছুটা ভিন্নমাত্রার হলেও, দক্ষিণের লড়াইয়ের নিয়ন্ত্রণ টা অনেকটাই কংগ্রেস আর বাকিটা ডিএমকে, জনতা দল (সেকুলার), এআই এডিএমকে, তেলেগু দেশমের মতো আঞ্চলিক দলগুলোরও নিয়ন্ত্রণে। ফলে এই জাতপাতের লড়াইয়ের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার লড়াইয়ের যে বিষয়টা দক্ষিণ ভারতে রয়েছে, মহারাষ্ট্রে মারাঠি জাত্যাভিমান বা হায়দ্রাবাদে উচ্চবর্ণের মুসলমানদের সঙ্গে খেতে খাওয়া মুসলমানদের গোলমালকে উসকে দেওয়া- এসব পদ্ধতি আরএসএস, তার বিভিন্ন শাখা সংগঠনকে দিয়ে প্রয়োগের অনেক চেষ্টা করেও তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধার পেলেও উত্তর ভারতের মতো স্থায়ী কিছু সুবিধা পায় না।
তাই কর্নাটকে কংগ্রেসের জেতার পিছনে একটা শাসক বিজেপি বিরোধী হাওয়া থাকলেও রাহুলের প্রতি একটা সহানুভূতির হাওয়া (রাহুল কেরলেরই সাংসদ ছিলেন) এবং জাতপাতের রাজনীতিকে একটা ভোট কৌশল হিশেবে সফল ভাবে কংগ্রেসের কাজে লাগানোর বিষয়টিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতীতে কংগ্রেসের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে রামকৃষ্ণ হেডড়ে, এসআর বোম্মাই, এইচডি দেবগৌড়ারা যখন রাজ্যটি পরিচালনা করেছিলেন, তখন অবিভক্ত জনতা দল বা পরবর্তীতে সেটি ভেঙে জনতা দল (সেকুলার) তৈরি হওয়ার পরে যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ সেই রাজ্যে ছিল, সেটা ছিল কংগ্রেস দলের সঙ্গে। বিজেপির তখন কর্ণাটকে কার্যত কোনো উপস্থিতিই ছিল না।
অটলবিহারীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আয়ারাম গয়ারাম পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাজ্যে সরকার তৈরি করে বিজেপি। দক্ষিণ ভারতেও এ পদ্ধতিতে বিজেপির সরকার গঠনে বিরাম ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই বিজেপির পিছনের দরজা দিয়ে পাওয়া গরিষ্ঠতার জেরে তৈরি সরকারগুলো বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু যে যে রাজ্যে সময় বিশেষে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে বিজেপি, সেই সেই রাজ্যে প্রশাসনের ভিতরে আরএসএসীয় করণের কাজটা তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করতে সক্ষম হয়েছে। প্রশাসনের ভিতরে সঙ্ঘের নিজেদের লোকেদের ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রভাব বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটে পেয়েছে, ২০১৯ সালে পেয়েছে, এখনো পেয়ে চলেছে। এই যে মেরুকরণের রাজনীতি, যেটা ক্ষমতা ধরে রাখবার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির মূল টিআরপি, সেই কাজটা প্রশাসনে সঙ্ঘের নিজেদের লোকেদের ঢুকিয়ে দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে করে যেতে সক্ষম হয়েছে সঙ্ঘ।
এতকিছু সত্ত্বেও কর্নাটকে বিজেপির পরাজয়, আর ঠিক এক বছরের ভিতরে ভারতে যে সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই দেশের জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কিছুটা হলেও কোণঠাসা করবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষেত্রে কাছাকাছি আনবার সুযোগ করে দেবে। গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির যে কর্নাটকের ফল ঘিরে কিছুটা হলেও সিঁদুরে মেঘ দেখছে, তা তাদের অতি বিশ্বস্ত বন্ধু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণ দেখলেই বুঝতে পারা যাচ্ছে।
কর্নাটকের ফল প্রকাশের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের অবস্থান একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে কংগ্রেসের প্রতি ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। মমতাময়ী সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার, মমতার আবার নেওয়া নোতুন অবস্থানকে জোরদার প্রচার দিয়েছে। যে মমতা, গত এক বছরের ভিতরে ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে বিজেপির যাতে সুবিধা হয়, তার অনুকূলে যাবতীয় অবস্থান নিলেন, সেই মমতার হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? যে জগদীপ ধনকরের সঙ্গে মমতা একটা লোক দেখানো আদায় কাঁচকলা সম্পর্কের অভিনয় করতেন, সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ সেই ধনকরকে উপ-রাষ্ট্রপতি করতে দার্জিলিংয়ে আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে গোপন বৈঠক পর্যন্ত করে গোটা বিরোধী শিবিরের সঙ্গে অত্যন্ত অপমান জনক আচরণ করেছেন, কংগ্রেস দল, তাদের নেত্রী সোনিয়া, রাহুলকে ঘিরেও বিষোদগার করতে ছাড়েননি, হঠাৎ কেন সেই কংগ্রেস ঘিরে এতটা ইতিবাচক হয়ে উঠরেন মমতা?
মাইকেল মধুসূদনের কাব্য ধার করে- ‘এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’র রাজনৈতিক তাৎপর্য ঘিরে বলতে হয় যে, কর্নাটকে বিজেপি গোহারান হেরে যাওয়ার পর, আসন্ন লোকসভা ভোটকে ঘিরে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে যে নয়া সমীকরণের আভাস দেখা দিতে শুরু করেছে, সেই সমীকরণের যাবতীয় পরিকল্পনাকে আঁতুরে বিনষ্ট করতেই আর এস এসের অত্যন্ত আস্থাভাজন, গোপনকর্মী হিশেবে আসরে নেমে পড়ে মমতা এই কংগ্রেস স্তুতি করতে শুরু করেছেন। বিজেপি বিরোধী কোনোরকম বিরোধী দলের ঐক্য যাতে না তৈরি হতে পারে, সেজন্যে হাতে অনেক সময় নিয়েই আরএসএস তাদের বিশ্বস্ত দুর্দিনের ত্রাণকর্ত্রী মমতাকে ইতোমধ্যেই আসরে নামিয়ে দিয়েছে। বিয়ের প্রথম রাতে বেড়াল মারবার প্রবচনের মতোই, আরএসএস কোনো সময় অযথা নষ্ট করতে চায় না। কর্নাটকের ভোটের ফল ঘিরে তাদের গোপন মূল্যায়ন হলো, সেই রাজ্যে মুসলমান ভোট অনেকটা যুথবদ্ধ হয়ে কংগ্রেসে ফিরে যাওয়ার ফলে, গোটা দেশে বিজেপির পালে হিন্দু ভোটের সংহতির বিষয়টা অনেকটা সহজ হবে। পশ্চিমবঙ্গেও এই ফর্মুলা কাজে লাগাতে ইতোমধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছে সঙ্ঘ। তাই সময় যত এগোবে, মমতা তার প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির অঙ্ক আরও জোরদারভাবে কষতে শুরু করে দেবেন, যাতে অঙ্কের ইতিবাচক ভোটের ফল বিজেপির ঝুলিতেই যায়।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]