alt

উপ-সম্পাদকীয়

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

সাদেকুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩

(গতকালের পর)

কোদালিয়া শহিদনগর গণহত্যা : একাত্তরের ১ জুন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় কোদালিয়া শহিদনগর ইউনিয়নে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা সংঘটিত করে। সেদিন সকাল আনুমানিক ৯টার সময় ভাঙ্গা ফরিদপুর সদর মুকসুদপুর হতে পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়া, ছোটশ্রীবর্দী, বাস্তপুট্টি, কানফরদী, রঘুরদিয়া, বাগাট, ঘোনাপাড়াসহ নগরকান্দার ৯টি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং তাদের সৈন্যদের লাশ উদ্ধার করার জন্য ঘোড়ামারা বিলের কাছে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ সৈন্য একত্র হয়।

পাকিস্তানি সৈন্যদের আসতে দেখে নগরকান্দার আশপাশের আতঙ্কিত গ্রামবাসী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কোদালিয়া গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৪০-৬০ জন মিয়াবাড়ির পাশের জঙ্গলে একটি ডোবার মধ্যে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। কৌশলগত কারণে আব্দুল আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন করেন।

শত্রুসেনারা মিয়াবাড়ির জঙ্গল ঘেরাও করে সেখান থেকে সবাইকে বের করে আনে। এরপর তারা নারী ও তিন বছরের নিচের শিশুদের একটি, চার থেকে ১৫ বছরের শিশুদের একটি এবং পুরুষদের একটি মোট তিন ভাগে ভাগ করে। নারীদের কোদালিয়া মসজিদ-মাদরাসায় নিয়ে রাখে। পুরুষদের দিয়ে ২৯ মে মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ ও লুটের মালামাল মাথায় তুলে দিয়ে নগরকান্দা থানায় পাঠিয়ে দেয়, আর কিছু লোককে মাদ্রাসার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে।

খানসেনারা ৪ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের বিলের ওপর একটি জায়গায় অপেক্ষায় রেখে বলে, তোমাদের মা রান্না করছে। রান্না শেষ হলে তোমাদের যার যার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তাদের অনাহারে বন্দি করে রাখা হয়। এদিকে নারী ও তাদের শিশুদের (তিন বছরের নিচে) মাদ্রাসার মাঠে বসিয়ে রেখে নারীদের বলা হয় তোমরা কুরআন-তসবিহ পড়। অনেকে বলে- আমাদের সঙ্গে কুরআন নেই, বাড়িতে আমরা গিয়ে নিয়ে আসি; কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা বলে- এখন আনতে হবে না, যা জান তাই পড়।

সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো ধরনের খাবার পানি না দিয়ে তাদের মাঠে প্রখর রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। শিশুদের পানি খেতে দেয়া হয়নি।

বিকেল সাড়ে ৩টায় হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনারা সবাইকে পানি খাওয়াতে থাকে। সবাইকে গোল করে মাদ্রাসার মাঠের এক কোনায় বসিয়ে তাদের কালেমা পড়ানো হয়। এরপর তাদের মাথা নিচু করে বসিয়ে মেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করা হয়। তাদের নিথর দেহগুলো মোটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ঠান্ডা মাথার নরঘাতক পাকিস্তানি সেনারা বন্দি থাকা শিশুদের ছেড়ে দিয়ে মিথ্যা কথা বলে- ‘তোমার মা মাদ্রাসা মাঠে ভাত রান্না করে রেখেছে তোমরা যাও।’ শিশুরা এসে দেখে তাদের মা এবং ছোট ভাইবোনদের লাশ কম্বল দিয়ে মোড়ানো। গুলিতে কোদালিয়া গ্রামের নারী-শিশুসহ ১৭ জন শহিদ হয়। দুজন নারী ও তিনজন শিশু আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। আর অগ্নিসংযোগ করে তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

সেদিন কোদালিয়া শহিদনগর ইউনিয়নের বেশিরভাগ পুরুষ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কারণে গণহত্যা থেকে বেঁচে যায়। একই দিন পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অনেক নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। তারা অনেক বয়স্ক গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায় ও তাদের বলে দুই দিন আগের যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্য যারা নিহত হয়েছে তাদের লাশ খুঁজে দাও, নয় তো তোমাদের হত্যা করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘নগরকান্দা গণহত্যা’ নামেও পরিচিত।

পরবর্তীতে সেই হত্যা-তান্ডব স্থানে নির্মিত হয়েছে শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ এবং উক্ত স্থানে কোদালিয়া শহিদনগর নামে একটি নতুন ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়। সেদিন থেকেই প্রতি বছর নগরকান্দায় পহেলা জুন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে আসছে।

তারাকান্দার গণহত্যা : একাত্তরের এদিন (বাংলা মাসের ১৯ জ্যৈষ্ঠ) হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মিলে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের তারাকান্দর গ্রামের দুই শতাধিক নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল।

১৯৭১ সালের এদিনের সকালটা ছিল অন্যান্য দিনের মতো শুভ্র। কিন্তু, দিনের বাকিটা সময় যে রক্তের হলিখেলায় শুভ্র সকালটা রক্ত ধারণ করবে তা বুঝতে পারেননি সেই গ্রামের মানুষ। কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গান বোটে করে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন খানসেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার। এরপরই রাজাকারদের সহযোগিতায় হিন্দু প্রধান এলাকা তারাকান্দার গ্রামে এসে শুরু করে হত্যাতান্ডব।

এ সময়, মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরের কচুরিপানার মধ্যে। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তারাকান্দর গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেয় তারা। এরপর দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ফেলে রেখে চলে যায়।

সকাল থেকে শুরু হয়ে এ হত্যাতান্ডব চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ হত্যাকান্ডে পরিচয় পাওয়া রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু মন্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মন্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রীসহ শিশু-নারী এবং নাম না জানা বহু মানুষকে তারাকান্দার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। মাঠে ও পুকুর পাড়ে পড়ে থাকে সারি সারি লাশ।

পাকিস্তানি হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার সাক্ষী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া নটবর রায় (৭৭) বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তাড়া খেয়ে ওইদিন একটি কচুরিপানা ভর্তি ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের পাশের একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। পাকিস্তানি সেনারা এই গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছিল। নিজেকে কোনো রকমে বাঁচাতে পেরেছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলে যাবার পর উপরে উঠে আসি তখন দেখি সারি সারি লাশের স্তূপ। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে আঁতকে উঠি।’

তারাকান্দার গ্রামের ৬৭ বছরের বৃদ্ধা সবিতা রানী রায় বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী যখন এ গ্রামে হত্যাতান্ডব চালায় তখন আমার বিয়ে হয়নি। প্রাণ বাঁচাতে বাবার সঙ্গে খাল ঝাঁপিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমার বিয়ে হলে এখানে ফিরে আসি। তখন পুকুর, খাল ও ডোবার মধ্যে সারি সারি মাথার খুলি, হাড় পড়েছিল।’

ছাতনী গণহত্যা : একাত্তরের ৪ জুন ছাতনীতে শহিদ হন চার শতাধিক বাঙালি। সেদিন রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী নাটোরের ছাতনীতে নির্মম হত্যাতান্ডব চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। রাজাকার হাফেজ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৪ জুন গভীর রাতে নাটোরের ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে হানা দেয়। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমন্ত লোকজনকে ধরে পিঠমোড়া করে বেঁধে ছাতনী স্লুইসগেটে এনে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর লাশগুলো অ্যাসিডে ঝলসে দেয় ঘাতকরা। তারা চলে গেলে গ্রামবাসী লাশগুলোকে ছাতনী স্লুইসগেটসহ আশপাশের পুকুর ও ডোবায় কোনো রকমে মাটি চাপা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর উত্তরাঞ্চলের সদর দফতর ছিল নাটোরে। নয় মাস হানাদার বাহিনী ও তাদের পালিত রাজাকার-আল বদররা নাটোরের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছে। এর মধ্যে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামের গণহত্যা ছিল ভয়াল, নৃশংস ও হৃদয়বিদারক। ছাতনী গ্রামের অবস্থান নাটোর শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমসিএ শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর বাড়ি ছাতনী গ্রামে হওয়ায় এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর অবাঙালি বিহারিদের আক্রোশে পড়ে এই এলাকা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীসহ কয়েক শ বিহারি ৪ জুন গভীর রাতে ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষদের তুলে নিয়ে এসে হত্যা করে। ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে কিছু লোক বিষয়টি টের পাওয়ায় এলাকার অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পায়। শহিদ মনির সরকারের পুকুর রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যারা ফিরে আসে তারা কয়েকজন মিলে ৫-৬টি করে লাশ একসঙ্গে চাপা দিয়ে রাখে। অনেক লাশ শনাক্ত করাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

টাউন শ্রীপুর গণহত্যা : ৭ জুন টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ-সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেবহাটা উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে টাউন শ্রীপুর গ্রামে ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টারের নেতৃত্বে ৩২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রাম করছিলেন। তারা প্রায় সবাই যুদ্ধক্লান্ত ছিলেন। ভোর রাতে স্থানীয় একজন মুয়াজ্জিন ফজরের নামাজ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে খান সেনাদের ক্যাম্পে খবর দেয়। খানসেনারা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধ শুরু করে। এই ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে শামছুজ্জোহা খান কাজল, নাজমুল আবেদীন খোকন, নারায়ন চন্দ্র হোড়, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ সহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী হাবলু ও আব্দুর রশিদ, কানাইদিয়া। স.ম. বাবর আলী এ যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

কাঁঠালবাড়ী গণহত্যা : ১৯৭১ সালে জুন মাসের ৯ তারিখ। কুড়িগ্রাম শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে কাঁঠালবাড়ী বাজার ও আশপাশের ৬টি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় হত্যা করে ৩৫ জন নিরপরাধ বাঙালিকে। সেই সঙ্গে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল এসব গ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনী ওইদিন সকালে কাঁঠালবাড়ী বাজারের তিন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে, অগ্নিসংযোগ করে বাজার ও কয়েকটি গ্রামে। এতে বাজারের শতাধিক দোকান ও শিবরাম, সর্দারপাড়া, সন্ন্যাসী, ফকিরপাড়া, প্রামাণিকটারী ও খামার গ্রামের ৫ শতাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘর পুড়ে যায়। এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার পর কাউকে কাউকে আগুনে পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা।

পাবনার মাওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদকে হত্যা : ১০ জুন পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ বাসে করে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পথে মোসলেম খাঁর তেমাথা মোড়ে মিলিটারিরা চেকপোস্টে তাকে বাস থেকে নামিয়ে নূরপুর সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের পর দুজন সঙ্গীসহ সাঁথিয়া থানার মাধপুরের ইছামতি পাড়ের এক নিভৃত বাঁশঝাড়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

গোলাহাট গণহত্যা : ১৯৭১ সালে তৎকালীন নীলফামারী মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সৈয়দপুর থানায় (বর্তমানে উপজেলা) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দুটি নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। একটি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ফার্নেস চুল্লিতে কয়েক শ বাঙালিকে ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে ছাই করে মারা, অপরটি ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাট নামক স্থানে ট্রেনে করে নিয়ে বিহারিদের সহযোগিতায় ৪১৩ জনকে (মতান্তরে ৪৭৮ জন) ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ১৩ জুন গোলাহাটে মূলত হিন্দু মাড়োয়ারি ও বাঙালি হিন্দু তরুণ ও যুবকরা এ হত্যাকান্ডের শিকার হন। এ হত্যাকান্ডে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বিহারি জনগোষ্ঠী। সৈয়দপুরের ‘গোলাহাট গণহত্যা’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা। ঘাতক পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ এ গণহত্যার নাম দিয়েছিল, ‘অপারেশন খরচাখাতা।’

সৈয়দপুর ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই রেলওয়ে শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৮৭০ সালে ইংরেজ সরকার সৈয়দপুরে একটি রেল কারখানা স্থাপন করলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ শহরটি সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই সৈয়দপুর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই তারা এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেও অনেকেই থেকে যান এবং ব্যবসার পাশাপাশি সমাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।

অপরদিকে সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানা স্থাপন করে ইংরেজরা ভারতের বিহার রাজ্য থেকে প্রায় সাত হাজার বিহারিকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই সৈয়দপুরে বিহারিদের বসবাস শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের কারণে ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বিহারে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আনুমানিক ৩০ হাজারেরও বেশি বিহারিকে হত্যা করা হয়েছিল। এর ফলে ভারত ভাগের পরবর্তী দুই দশকে প্রায় ১৫ লাখ মুসলিম বিহারি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বর্তমানে রংপুর বিভাগীয় অঞ্চলে চলে আসে। ১৯৭১ সালে সৈয়দপুর শহরে প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল বিহারিদের বসবাস। (চলবে)

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

সাদেকুর রহমান

বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩

(গতকালের পর)

কোদালিয়া শহিদনগর গণহত্যা : একাত্তরের ১ জুন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় কোদালিয়া শহিদনগর ইউনিয়নে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা সংঘটিত করে। সেদিন সকাল আনুমানিক ৯টার সময় ভাঙ্গা ফরিদপুর সদর মুকসুদপুর হতে পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়া, ছোটশ্রীবর্দী, বাস্তপুট্টি, কানফরদী, রঘুরদিয়া, বাগাট, ঘোনাপাড়াসহ নগরকান্দার ৯টি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং তাদের সৈন্যদের লাশ উদ্ধার করার জন্য ঘোড়ামারা বিলের কাছে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ সৈন্য একত্র হয়।

পাকিস্তানি সৈন্যদের আসতে দেখে নগরকান্দার আশপাশের আতঙ্কিত গ্রামবাসী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কোদালিয়া গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৪০-৬০ জন মিয়াবাড়ির পাশের জঙ্গলে একটি ডোবার মধ্যে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। কৌশলগত কারণে আব্দুল আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন করেন।

শত্রুসেনারা মিয়াবাড়ির জঙ্গল ঘেরাও করে সেখান থেকে সবাইকে বের করে আনে। এরপর তারা নারী ও তিন বছরের নিচের শিশুদের একটি, চার থেকে ১৫ বছরের শিশুদের একটি এবং পুরুষদের একটি মোট তিন ভাগে ভাগ করে। নারীদের কোদালিয়া মসজিদ-মাদরাসায় নিয়ে রাখে। পুরুষদের দিয়ে ২৯ মে মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ ও লুটের মালামাল মাথায় তুলে দিয়ে নগরকান্দা থানায় পাঠিয়ে দেয়, আর কিছু লোককে মাদ্রাসার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে।

খানসেনারা ৪ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের বিলের ওপর একটি জায়গায় অপেক্ষায় রেখে বলে, তোমাদের মা রান্না করছে। রান্না শেষ হলে তোমাদের যার যার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তাদের অনাহারে বন্দি করে রাখা হয়। এদিকে নারী ও তাদের শিশুদের (তিন বছরের নিচে) মাদ্রাসার মাঠে বসিয়ে রেখে নারীদের বলা হয় তোমরা কুরআন-তসবিহ পড়। অনেকে বলে- আমাদের সঙ্গে কুরআন নেই, বাড়িতে আমরা গিয়ে নিয়ে আসি; কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা বলে- এখন আনতে হবে না, যা জান তাই পড়।

সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো ধরনের খাবার পানি না দিয়ে তাদের মাঠে প্রখর রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। শিশুদের পানি খেতে দেয়া হয়নি।

বিকেল সাড়ে ৩টায় হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনারা সবাইকে পানি খাওয়াতে থাকে। সবাইকে গোল করে মাদ্রাসার মাঠের এক কোনায় বসিয়ে তাদের কালেমা পড়ানো হয়। এরপর তাদের মাথা নিচু করে বসিয়ে মেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করা হয়। তাদের নিথর দেহগুলো মোটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ঠান্ডা মাথার নরঘাতক পাকিস্তানি সেনারা বন্দি থাকা শিশুদের ছেড়ে দিয়ে মিথ্যা কথা বলে- ‘তোমার মা মাদ্রাসা মাঠে ভাত রান্না করে রেখেছে তোমরা যাও।’ শিশুরা এসে দেখে তাদের মা এবং ছোট ভাইবোনদের লাশ কম্বল দিয়ে মোড়ানো। গুলিতে কোদালিয়া গ্রামের নারী-শিশুসহ ১৭ জন শহিদ হয়। দুজন নারী ও তিনজন শিশু আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। আর অগ্নিসংযোগ করে তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

সেদিন কোদালিয়া শহিদনগর ইউনিয়নের বেশিরভাগ পুরুষ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কারণে গণহত্যা থেকে বেঁচে যায়। একই দিন পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অনেক নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। তারা অনেক বয়স্ক গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায় ও তাদের বলে দুই দিন আগের যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্য যারা নিহত হয়েছে তাদের লাশ খুঁজে দাও, নয় তো তোমাদের হত্যা করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘নগরকান্দা গণহত্যা’ নামেও পরিচিত।

পরবর্তীতে সেই হত্যা-তান্ডব স্থানে নির্মিত হয়েছে শহিদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ এবং উক্ত স্থানে কোদালিয়া শহিদনগর নামে একটি নতুন ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়। সেদিন থেকেই প্রতি বছর নগরকান্দায় পহেলা জুন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে আসছে।

তারাকান্দার গণহত্যা : একাত্তরের এদিন (বাংলা মাসের ১৯ জ্যৈষ্ঠ) হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মিলে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের তারাকান্দর গ্রামের দুই শতাধিক নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল।

১৯৭১ সালের এদিনের সকালটা ছিল অন্যান্য দিনের মতো শুভ্র। কিন্তু, দিনের বাকিটা সময় যে রক্তের হলিখেলায় শুভ্র সকালটা রক্ত ধারণ করবে তা বুঝতে পারেননি সেই গ্রামের মানুষ। কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গান বোটে করে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন খানসেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার। এরপরই রাজাকারদের সহযোগিতায় হিন্দু প্রধান এলাকা তারাকান্দার গ্রামে এসে শুরু করে হত্যাতান্ডব।

এ সময়, মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরের কচুরিপানার মধ্যে। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তারাকান্দর গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেয় তারা। এরপর দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ফেলে রেখে চলে যায়।

সকাল থেকে শুরু হয়ে এ হত্যাতান্ডব চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ হত্যাকান্ডে পরিচয় পাওয়া রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু মন্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মন্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রীসহ শিশু-নারী এবং নাম না জানা বহু মানুষকে তারাকান্দার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। মাঠে ও পুকুর পাড়ে পড়ে থাকে সারি সারি লাশ।

পাকিস্তানি হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার সাক্ষী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া নটবর রায় (৭৭) বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের তাড়া খেয়ে ওইদিন একটি কচুরিপানা ভর্তি ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের পাশের একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। পাকিস্তানি সেনারা এই গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছিল। নিজেকে কোনো রকমে বাঁচাতে পেরেছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলে যাবার পর উপরে উঠে আসি তখন দেখি সারি সারি লাশের স্তূপ। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে আঁতকে উঠি।’

তারাকান্দার গ্রামের ৬৭ বছরের বৃদ্ধা সবিতা রানী রায় বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী যখন এ গ্রামে হত্যাতান্ডব চালায় তখন আমার বিয়ে হয়নি। প্রাণ বাঁচাতে বাবার সঙ্গে খাল ঝাঁপিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমার বিয়ে হলে এখানে ফিরে আসি। তখন পুকুর, খাল ও ডোবার মধ্যে সারি সারি মাথার খুলি, হাড় পড়েছিল।’

ছাতনী গণহত্যা : একাত্তরের ৪ জুন ছাতনীতে শহিদ হন চার শতাধিক বাঙালি। সেদিন রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী নাটোরের ছাতনীতে নির্মম হত্যাতান্ডব চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। রাজাকার হাফেজ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৪ জুন গভীর রাতে নাটোরের ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে হানা দেয়। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমন্ত লোকজনকে ধরে পিঠমোড়া করে বেঁধে ছাতনী স্লুইসগেটে এনে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর লাশগুলো অ্যাসিডে ঝলসে দেয় ঘাতকরা। তারা চলে গেলে গ্রামবাসী লাশগুলোকে ছাতনী স্লুইসগেটসহ আশপাশের পুকুর ও ডোবায় কোনো রকমে মাটি চাপা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর উত্তরাঞ্চলের সদর দফতর ছিল নাটোরে। নয় মাস হানাদার বাহিনী ও তাদের পালিত রাজাকার-আল বদররা নাটোরের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছে। এর মধ্যে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামের গণহত্যা ছিল ভয়াল, নৃশংস ও হৃদয়বিদারক। ছাতনী গ্রামের অবস্থান নাটোর শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমসিএ শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর বাড়ি ছাতনী গ্রামে হওয়ায় এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর অবাঙালি বিহারিদের আক্রোশে পড়ে এই এলাকা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীসহ কয়েক শ বিহারি ৪ জুন গভীর রাতে ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষদের তুলে নিয়ে এসে হত্যা করে। ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে কিছু লোক বিষয়টি টের পাওয়ায় এলাকার অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পায়। শহিদ মনির সরকারের পুকুর রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যারা ফিরে আসে তারা কয়েকজন মিলে ৫-৬টি করে লাশ একসঙ্গে চাপা দিয়ে রাখে। অনেক লাশ শনাক্ত করাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

টাউন শ্রীপুর গণহত্যা : ৭ জুন টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ-সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেবহাটা উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে টাউন শ্রীপুর গ্রামে ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টারের নেতৃত্বে ৩২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রাম করছিলেন। তারা প্রায় সবাই যুদ্ধক্লান্ত ছিলেন। ভোর রাতে স্থানীয় একজন মুয়াজ্জিন ফজরের নামাজ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে খান সেনাদের ক্যাম্পে খবর দেয়। খানসেনারা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধ শুরু করে। এই ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে শামছুজ্জোহা খান কাজল, নাজমুল আবেদীন খোকন, নারায়ন চন্দ্র হোড়, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ সহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী হাবলু ও আব্দুর রশিদ, কানাইদিয়া। স.ম. বাবর আলী এ যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

কাঁঠালবাড়ী গণহত্যা : ১৯৭১ সালে জুন মাসের ৯ তারিখ। কুড়িগ্রাম শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে কাঁঠালবাড়ী বাজার ও আশপাশের ৬টি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় হত্যা করে ৩৫ জন নিরপরাধ বাঙালিকে। সেই সঙ্গে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল এসব গ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনী ওইদিন সকালে কাঁঠালবাড়ী বাজারের তিন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে, অগ্নিসংযোগ করে বাজার ও কয়েকটি গ্রামে। এতে বাজারের শতাধিক দোকান ও শিবরাম, সর্দারপাড়া, সন্ন্যাসী, ফকিরপাড়া, প্রামাণিকটারী ও খামার গ্রামের ৫ শতাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘর পুড়ে যায়। এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার পর কাউকে কাউকে আগুনে পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা।

পাবনার মাওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদকে হত্যা : ১০ জুন পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাওলানা কসিমুদ্দিন আহমেদ বাসে করে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পথে মোসলেম খাঁর তেমাথা মোড়ে মিলিটারিরা চেকপোস্টে তাকে বাস থেকে নামিয়ে নূরপুর সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের পর দুজন সঙ্গীসহ সাঁথিয়া থানার মাধপুরের ইছামতি পাড়ের এক নিভৃত বাঁশঝাড়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

গোলাহাট গণহত্যা : ১৯৭১ সালে তৎকালীন নীলফামারী মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সৈয়দপুর থানায় (বর্তমানে উপজেলা) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দুটি নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। একটি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ফার্নেস চুল্লিতে কয়েক শ বাঙালিকে ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে ছাই করে মারা, অপরটি ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাট নামক স্থানে ট্রেনে করে নিয়ে বিহারিদের সহযোগিতায় ৪১৩ জনকে (মতান্তরে ৪৭৮ জন) ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ১৩ জুন গোলাহাটে মূলত হিন্দু মাড়োয়ারি ও বাঙালি হিন্দু তরুণ ও যুবকরা এ হত্যাকান্ডের শিকার হন। এ হত্যাকান্ডে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বিহারি জনগোষ্ঠী। সৈয়দপুরের ‘গোলাহাট গণহত্যা’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা। ঘাতক পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ এ গণহত্যার নাম দিয়েছিল, ‘অপারেশন খরচাখাতা।’

সৈয়দপুর ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই রেলওয়ে শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৮৭০ সালে ইংরেজ সরকার সৈয়দপুরে একটি রেল কারখানা স্থাপন করলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ শহরটি সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই সৈয়দপুর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই তারা এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেও অনেকেই থেকে যান এবং ব্যবসার পাশাপাশি সমাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।

অপরদিকে সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানা স্থাপন করে ইংরেজরা ভারতের বিহার রাজ্য থেকে প্রায় সাত হাজার বিহারিকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই সৈয়দপুরে বিহারিদের বসবাস শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের কারণে ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বিহারে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আনুমানিক ৩০ হাজারেরও বেশি বিহারিকে হত্যা করা হয়েছিল। এর ফলে ভারত ভাগের পরবর্তী দুই দশকে প্রায় ১৫ লাখ মুসলিম বিহারি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বর্তমানে রংপুর বিভাগীয় অঞ্চলে চলে আসে। ১৯৭১ সালে সৈয়দপুর শহরে প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল বিহারিদের বসবাস। (চলবে)

back to top