মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
বৃক্ষপ্রেমী, মানবতাবাদী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা, আমার প্রিয় শর্মা স্যার। ষাটের দশকের শুরুতে বরিশালের বিএম কলেজে ভর্তি হয়ে বোটানির শিক্ষক হিসেবে দ্বিজেন শর্মাকে পাই। তিনি ছিলেন বোটানির উদ্ভিদ বিজ্ঞান পর্বের শিক্ষক। কলেজে পড়ানোর সুবাদেই সে সময়কার ছাত্র-শিক্ষক তার জ্ঞানের পরিধি সম্বন্ধে অবগত হয়ে যায়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রকৃতির প্রতি দ্বিজেন স্যারের অসীম ভালোবাসা কারও অজানা থাকে না। অবসর সময়েও তিনি থাকতেন প্রকৃতি ভাবনায় নিমগ্ন। গাছপালা, ফুল-ফল নিয়েই ছিল দ্বিজেন শর্মার একমাত্র বিশাল ভুবন।
২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকৃতির সবাই মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেলেন। স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হতবাক হয়ে যাই, চোখে বেয়ে ঝরে পড়ে লোনা জল। ছুটে যাই তার সিদ্ধেস্বরীর বাসায়। মানুষে গিজ গিজ করছে স্যারের বাসার চারিধার। মিডিয়ার লোকজন, চেনা বন্ধু-বান্ধব, স্যারের প্রিয় শিক্ষার্থী অনেকে। কারো মনে তেমন কোনো কথা নেই, শুধু অনন্ত জিজ্ঞাসা। কী হলো স্যারের, শিশুর মতো মানুষটা এমন করে চলে গেলেন! এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
‘নিসর্গসখা’ দ্বিজেন শর্মার জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলা অন্তর্গত গাছগাছালিতে ভরা এক নিভৃত গ্রাম শিমুলিয়ায়। তার বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা, পেশায় ছিলেন স্বনামধন্য কবিরাজ। মা প্রখ্যাত সমাজকর্মী মগ্নময়ী দেবী। কবিরাজ বাবার সঙ্গে নিভৃত গাঁয়ের বনে-জঙ্গলে, গাঁয়ের অদূরে পাহাড়ে ঘুরে চিনতে, জানতে শুরু করেছিলেন গাছ-লতাপাতার রহস্যময় জগত। জীবনের শেষ অবধি সেই জানাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বরিশাল বিএম কলেজে চাকরিকালীন দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৬০ সালের ২৭ নভেম্বরে। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে। দ্বিজেন শর্মা ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৯ সালে আগরতলা বীরবিক্রম কলেজ থেকে আইএসসি। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর দ্বিজেন শর্মা বিএম কলেজে ডেমুনেস্ট্রেটর পদে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করে বিএম কলেজে আবার অধ্যাপনা শুরু করেন।
ক্যাম্পাসে তিনি লাইব্রেরি, মিউজিয়াম ও একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি করেন, লাগান দেশ-বিদেশের নানা ফুল ও ফলের গাছ। গাছ, লতাপাতা ও ফলের দ্রব্যগুণ সম্পর্কে স্যারের জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অফুরান। বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় কিছুকাল আত্মগোপনে থাকেন এবং ১৯৬২ সালের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-অন্দোলনে তিন মাস নিরাপত্তাবন্দী হিসাবে বরিশাল জেলে কারাভোগ করেন। ১৯৬২ সালেই তিনি বিএম কলেজ ছেড়ে ঢাকায় নটরডেম কলেজে চলে আসেন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। নটরডেম কলেজ, রমনা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ ঢাকার বহু জায়গায়ও দ্বিজেন শর্মার লাগানো নানা দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়ে গেছে আজও। তিনি গাছকে পেয়েছিলেন জীবনের পরম বন্ধু হিসাবে। মিশে যেতে চেয়েছিলেন প্রকৃতির অফুরন্ত সম্ভারের সঙ্গে। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃক্ষের সতেজতা, সরলতা। সবুজের হাতছানি দিয়ে তিনি মানুষকে ডেকে গেছেন।
প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা ১৯৭৪ সালে নটরডেম কলেজ ছেড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে মস্কোতে প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজে যোগ দেন। সেখানে শিশুতোষ সাহিত্য অনুবাদ করে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে সেখানকার প্রকাশনী সংস্থা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দুবছর মস্কোস্থ বাংলাদেশ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। প্রায় ২০ বছর পর ১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং ২০০০ সালে এশিয়াটিক সোটাইটির ন্যাশনাল এনসাইক্লোপেডিয়া অব বাংলাদেশে (বাংলাপিডিয়া) ৩ বছর কাজ করেন। সেখানে জীববিজ্ঞানের অনুবাদক-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের কাজ শুরু করেন এবং ২০০৯ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। সেখানে তিন বছর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বিজ্ঞান ও প্রকৃতিকে সম্বল করে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন অসংখ্য বই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শ্যামলী নিসর্গ, সমাজতন্ত্রে বসবাস, মম দুঃখের সাধন, আমার একাত্তর, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণী বিন্যাস, গহন কোন বনের ধারে, বাংলার বৃক্ষ, জীবনের শেষ নেই, ফুলগুলো যেন কথা, এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি, হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার, ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ, নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, কিশোর সমগ্র এবং প্রকৃতি সমগ্র। লেখালেখির জন্য তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। কুদরত-ই-খুদা স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমি পদক (১৯৮৭), শিশু একাডেমি পদক, প্রকৃতি ফাউন্ডেশন পদক, চ্যানেল আই পদক (২০১১), এম নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পদক ও একুশে পদক (২০১৫) উল্লেখযোগ্য।
প্রকৃতির দুর্বার আকর্ষণে তিনি ছিলেন নিমগ্ন। যেখানে গেছেন সেখানেই দেখতে পেয়েছেন নিখাদ প্রকৃতির অপূর্ব সম্ভারের পরিপূর্ণতা। গাছকে লালন করেছেন আপন সন্তানের মতো। দেশব্যাপী লাগিয়েছেন দুর্লভ প্রজাতির অনেক গাছ। রমনা পার্কের একটিমাত্র পারুল ও আগর গাছ তারই লাগানো। নিজের সিদ্ধেশ্ব^রীর ভাড়া বাসার ছাদবাগানে লাগানো গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন। বিএম কলেজের প্রধান গেট ধরে হেঁটে যেতে দেয়ালঘেঁষা দুর্লভ নাগলিঙ্গম গাছটি শুধু দ্বিজেন শর্মাকে মনে করিয়ে দেয়। একটি স্বপ্নময় উর্বর উদ্যানভরা বাংলাদেশের স্বপ্নে নিমগ্ন ছিলেন। ‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ...’ এই আহ্বান আমৃত্যু জানিয়ে গেছেন স্বভাবজাত প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা। প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য জীবনভর লড়াই করেছেন। সবুজ দেশ আর সবুজ মানুষ গড়তে কাজ করে গেছেন তিনি। লাগিয়েছেন গাছ, করেছেন পরিচর্যা, মানুষকে গাছ চিনিয়েছেন। নিসর্গবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা ছিলেন আজীবন নির্মোহ। বিত্ত-বৈভব কখনোই তাকে আকৃষ্ট করেনি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার অধিকারী, সৎ, সহজ-সরল, সাদাসিদে মানুষটি শিশুর মতো কাটিয়ে গেলেন ৮৮ বছরের একটি পরিপূর্ণ জীবন।
রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নজরুল গীতি ছিল তার বড্ড প্রিয়। রবীন্দ্র রচনার মাঝে তিনি জীবন খুঁজে ফিরেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি লালন করেছেন জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে। প্রকৃতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের অবাধ উন্নয়নের সংঘাত তাকে বরাবর ব্যথিত করেছে। প্রকৃতিকে না বাঁচিয়ে উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তার আশা ছিল, নতুন প্রজন্ম এমন এক পন্থা খুঁজে বের করবে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার কোনো সংঘাত থাকবে না। আজীবন লড়েছেন সবুজ প্রকৃতির জন্য। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতিকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে সমাজ ও মানবিকতার পরিচয় বহন করে গেছেন। দ্বিজেন শর্মা বেঁচে থাকবেন বাংলার প্রকৃতির মাঝে। রমনার পারুল; বিএম কলেজের নাগলিঙ্গম নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মাকে মনে করিয়ে দেবে।
তার লেখা অসংখ্য বিজ্ঞান ও প্রকৃতি-বিষয়ক বইয়ের মাঝে দেশের মানুষ খুঁজে নেবে দ্বিজেন শর্মাকে। এ বছর একটি সংগঠন দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী দেবী শর্মাকে দিয়ে রমনা পার্কে বিরল প্রজাতির গাছ লাগিয়ে তার জন্মবার্ষিকীকে স্মরণ করে জাতিকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। এ ধরনের কর্মকান্ড অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার কর্মময় জীবন, প্রকৃতি প্রেমকে জাগরুক রেখে ভবিষ্যৎ সভ্যতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। পিতৃতুল্য শিক্ষক দ্বিজেন শর্মার প্রিয় ‘তুমি চলে গেছ বকুল বিছানো পথে’ গানের কলি দিয়ে তার জন্মদিন স্মরণে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আর অফুরন্ত ভালোবাসা।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
রোববার, ০৪ জুন ২০২৩
বৃক্ষপ্রেমী, মানবতাবাদী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা, আমার প্রিয় শর্মা স্যার। ষাটের দশকের শুরুতে বরিশালের বিএম কলেজে ভর্তি হয়ে বোটানির শিক্ষক হিসেবে দ্বিজেন শর্মাকে পাই। তিনি ছিলেন বোটানির উদ্ভিদ বিজ্ঞান পর্বের শিক্ষক। কলেজে পড়ানোর সুবাদেই সে সময়কার ছাত্র-শিক্ষক তার জ্ঞানের পরিধি সম্বন্ধে অবগত হয়ে যায়। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রকৃতির প্রতি দ্বিজেন স্যারের অসীম ভালোবাসা কারও অজানা থাকে না। অবসর সময়েও তিনি থাকতেন প্রকৃতি ভাবনায় নিমগ্ন। গাছপালা, ফুল-ফল নিয়েই ছিল দ্বিজেন শর্মার একমাত্র বিশাল ভুবন।
২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকৃতির সবাই মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেলেন। স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হতবাক হয়ে যাই, চোখে বেয়ে ঝরে পড়ে লোনা জল। ছুটে যাই তার সিদ্ধেস্বরীর বাসায়। মানুষে গিজ গিজ করছে স্যারের বাসার চারিধার। মিডিয়ার লোকজন, চেনা বন্ধু-বান্ধব, স্যারের প্রিয় শিক্ষার্থী অনেকে। কারো মনে তেমন কোনো কথা নেই, শুধু অনন্ত জিজ্ঞাসা। কী হলো স্যারের, শিশুর মতো মানুষটা এমন করে চলে গেলেন! এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
‘নিসর্গসখা’ দ্বিজেন শর্মার জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলা অন্তর্গত গাছগাছালিতে ভরা এক নিভৃত গ্রাম শিমুলিয়ায়। তার বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা, পেশায় ছিলেন স্বনামধন্য কবিরাজ। মা প্রখ্যাত সমাজকর্মী মগ্নময়ী দেবী। কবিরাজ বাবার সঙ্গে নিভৃত গাঁয়ের বনে-জঙ্গলে, গাঁয়ের অদূরে পাহাড়ে ঘুরে চিনতে, জানতে শুরু করেছিলেন গাছ-লতাপাতার রহস্যময় জগত। জীবনের শেষ অবধি সেই জানাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বরিশাল বিএম কলেজে চাকরিকালীন দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৬০ সালের ২৭ নভেম্বরে। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে। দ্বিজেন শর্মা ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৯ সালে আগরতলা বীরবিক্রম কলেজ থেকে আইএসসি। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর দ্বিজেন শর্মা বিএম কলেজে ডেমুনেস্ট্রেটর পদে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাস করে বিএম কলেজে আবার অধ্যাপনা শুরু করেন।
ক্যাম্পাসে তিনি লাইব্রেরি, মিউজিয়াম ও একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি করেন, লাগান দেশ-বিদেশের নানা ফুল ও ফলের গাছ। গাছ, লতাপাতা ও ফলের দ্রব্যগুণ সম্পর্কে স্যারের জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অফুরান। বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় কিছুকাল আত্মগোপনে থাকেন এবং ১৯৬২ সালের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-অন্দোলনে তিন মাস নিরাপত্তাবন্দী হিসাবে বরিশাল জেলে কারাভোগ করেন। ১৯৬২ সালেই তিনি বিএম কলেজ ছেড়ে ঢাকায় নটরডেম কলেজে চলে আসেন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। নটরডেম কলেজ, রমনা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ ঢাকার বহু জায়গায়ও দ্বিজেন শর্মার লাগানো নানা দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়ে গেছে আজও। তিনি গাছকে পেয়েছিলেন জীবনের পরম বন্ধু হিসাবে। মিশে যেতে চেয়েছিলেন প্রকৃতির অফুরন্ত সম্ভারের সঙ্গে। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃক্ষের সতেজতা, সরলতা। সবুজের হাতছানি দিয়ে তিনি মানুষকে ডেকে গেছেন।
প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা ১৯৭৪ সালে নটরডেম কলেজ ছেড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে মস্কোতে প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজে যোগ দেন। সেখানে শিশুতোষ সাহিত্য অনুবাদ করে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে সেখানকার প্রকাশনী সংস্থা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দুবছর মস্কোস্থ বাংলাদেশ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। প্রায় ২০ বছর পর ১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং ২০০০ সালে এশিয়াটিক সোটাইটির ন্যাশনাল এনসাইক্লোপেডিয়া অব বাংলাদেশে (বাংলাপিডিয়া) ৩ বছর কাজ করেন। সেখানে জীববিজ্ঞানের অনুবাদক-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের কাজ শুরু করেন এবং ২০০৯ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। সেখানে তিন বছর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বিজ্ঞান ও প্রকৃতিকে সম্বল করে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন অসংখ্য বই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শ্যামলী নিসর্গ, সমাজতন্ত্রে বসবাস, মম দুঃখের সাধন, আমার একাত্তর, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণী বিন্যাস, গহন কোন বনের ধারে, বাংলার বৃক্ষ, জীবনের শেষ নেই, ফুলগুলো যেন কথা, এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি, হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার, ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ, নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, কিশোর সমগ্র এবং প্রকৃতি সমগ্র। লেখালেখির জন্য তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। কুদরত-ই-খুদা স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমি পদক (১৯৮৭), শিশু একাডেমি পদক, প্রকৃতি ফাউন্ডেশন পদক, চ্যানেল আই পদক (২০১১), এম নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পদক ও একুশে পদক (২০১৫) উল্লেখযোগ্য।
প্রকৃতির দুর্বার আকর্ষণে তিনি ছিলেন নিমগ্ন। যেখানে গেছেন সেখানেই দেখতে পেয়েছেন নিখাদ প্রকৃতির অপূর্ব সম্ভারের পরিপূর্ণতা। গাছকে লালন করেছেন আপন সন্তানের মতো। দেশব্যাপী লাগিয়েছেন দুর্লভ প্রজাতির অনেক গাছ। রমনা পার্কের একটিমাত্র পারুল ও আগর গাছ তারই লাগানো। নিজের সিদ্ধেশ্ব^রীর ভাড়া বাসার ছাদবাগানে লাগানো গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন। বিএম কলেজের প্রধান গেট ধরে হেঁটে যেতে দেয়ালঘেঁষা দুর্লভ নাগলিঙ্গম গাছটি শুধু দ্বিজেন শর্মাকে মনে করিয়ে দেয়। একটি স্বপ্নময় উর্বর উদ্যানভরা বাংলাদেশের স্বপ্নে নিমগ্ন ছিলেন। ‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ...’ এই আহ্বান আমৃত্যু জানিয়ে গেছেন স্বভাবজাত প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা। প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য জীবনভর লড়াই করেছেন। সবুজ দেশ আর সবুজ মানুষ গড়তে কাজ করে গেছেন তিনি। লাগিয়েছেন গাছ, করেছেন পরিচর্যা, মানুষকে গাছ চিনিয়েছেন। নিসর্গবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা ছিলেন আজীবন নির্মোহ। বিত্ত-বৈভব কখনোই তাকে আকৃষ্ট করেনি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার অধিকারী, সৎ, সহজ-সরল, সাদাসিদে মানুষটি শিশুর মতো কাটিয়ে গেলেন ৮৮ বছরের একটি পরিপূর্ণ জীবন।
রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নজরুল গীতি ছিল তার বড্ড প্রিয়। রবীন্দ্র রচনার মাঝে তিনি জীবন খুঁজে ফিরেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তিনি লালন করেছেন জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে। প্রকৃতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের অবাধ উন্নয়নের সংঘাত তাকে বরাবর ব্যথিত করেছে। প্রকৃতিকে না বাঁচিয়ে উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তার আশা ছিল, নতুন প্রজন্ম এমন এক পন্থা খুঁজে বের করবে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার কোনো সংঘাত থাকবে না। আজীবন লড়েছেন সবুজ প্রকৃতির জন্য। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতিকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে সমাজ ও মানবিকতার পরিচয় বহন করে গেছেন। দ্বিজেন শর্মা বেঁচে থাকবেন বাংলার প্রকৃতির মাঝে। রমনার পারুল; বিএম কলেজের নাগলিঙ্গম নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মাকে মনে করিয়ে দেবে।
তার লেখা অসংখ্য বিজ্ঞান ও প্রকৃতি-বিষয়ক বইয়ের মাঝে দেশের মানুষ খুঁজে নেবে দ্বিজেন শর্মাকে। এ বছর একটি সংগঠন দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী দেবী শর্মাকে দিয়ে রমনা পার্কে বিরল প্রজাতির গাছ লাগিয়ে তার জন্মবার্ষিকীকে স্মরণ করে জাতিকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। এ ধরনের কর্মকান্ড অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার কর্মময় জীবন, প্রকৃতি প্রেমকে জাগরুক রেখে ভবিষ্যৎ সভ্যতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। পিতৃতুল্য শিক্ষক দ্বিজেন শর্মার প্রিয় ‘তুমি চলে গেছ বকুল বিছানো পথে’ গানের কলি দিয়ে তার জন্মদিন স্মরণে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আর অফুরন্ত ভালোবাসা।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]