শেখর ভট্টাচার্য
আসামের শিলচর শহরের রেলস্টেশনটির নাম ভাষাশহিদ স্টেশন
ভাষাশহিদ স্টেশন। আসাম রাজ্যের ‘রাজ্য ভাষা’ হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যেখানে এগারোজন বাঙালি অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ভাষাশহিদ স্টেশন কোথায়? ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের রেলস্টেশনটির নাম ভাষাশহিদ স্টেশন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সকাল থেকেই আন্দোলনকারীরা আসাম রাজ্যের রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি লাভের জন্য অহিংস ভাবে হরতাল পালন করছিলেন, আসামের বরাক উপত্যকার তিন জেলাতে। জেলাগুলো হলো শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি।
বরাক উপতক্যার প্রধান শহর হলো শিলচর। শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনে শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল অবরোধ। ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তারক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন নয়জন ভাষাসৈনিক। পরে আরো দুজনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরো একজন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর ’৬১ সালের ১৯ মে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিলেন বাঙালি সাধারণ মানুষ। শহিদ হলেন কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। এ আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা আসামের সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। এই ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাংলাভাষীদের দাবির মুখে শিলচরের তারাপুরে অবস্থিত রেলস্টেশনটির নামকরণ করা হয় ভাষাশহিদ স্টেশন।
১১ জন ভাষাশহিদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। ভাষা আন্দোলনে পৃথিবীর নানা প্রান্তের অজস্র নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী একমাত্র নারী ১৬ বছরের এই কিশোরী, যার নাম কমলা ভট্টাচার্য। কমলা ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রামরামান ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যের আদিনিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তার পারিবারের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে চলে যান এবং শিলচর পাবলিক স্কুল রোডে বসবাস শুরু করেন। কমলা শিলচরের চোতি লাল সেন ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন।
সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর বৃহত্তর সিলেট থেকে বাংলাভাষী লাখ লাখ মানুষ বরাক উপত্যকার জেলাগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশের সিলেটের সঙ্গে বরাক উপত্যকার মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাকসহ কোন বিষয়ের অমিল নেই। গঙ্গা ও পদ্মা নদীর মতো বরাক ও সুরমা নদী। যেহেতু বাংলার, বাঙালির রক্ত ধারা বরাক উপত্যকার মানুষের মধ্যে প্রবাহিত তাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় তারাও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার হরণের উদ্যোগের কথা জেনে তারাও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
দুটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত পার্থক্য ছিল না বলে তারাও ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পূর্ব বাংলার ভাষা সংগ্রামীদের মতো জেগে উঠেছিলেন। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল কারণ- ‘একই আকাশ, একই বাতাস, এক হৃদয়ের একই তো শ্বাস।’ দেশ ভাগ করে ভূগোল পরিবর্তন করা হয়েছিল কিন্তু সংস্কৃতিকে বিভক্ত করা যায়নি। বরাক উপত্যকার আন্দোলনকারীদের মূল স্লোগান ছিল ‘জান দেবো তবু জবান দেবো না।’ বড় দৃঢ় ছিল তাদের উচ্চারণ। লক্ষ্যে ছিলেন তারা অবিচল।
কী প্রেক্ষাপটে বরাক উপত্যকায় ভাষার জন্য এই অদম্য আন্দোলন? পঞ্চাশের দশকে বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে আশি শতাংশই ছিল বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি। এছাড়া আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বিপুলসংখ্যক বাঙালির বসবাস ছিল। উল্লেখ্য, আসামে অন্য সব জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে অসমিয়াদের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবে ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা কিংবা আর্থসামাজিক বিচারে বাঙালিরা ছিল অগ্রসরমান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নীলনকশার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের ওপর ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদী’ ধ্যান-ধারণাকে চাপিয়ে দেয়ার বীজ রোপণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের উসকে দেয়া হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন মানসিক দুর্ভাবনা ও আশঙ্কা ভর করে যে, অগ্রসরমান বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া যুবকদের শুধু কর্মসংস্থান দখলই নয়, পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এ সময় তারা অসমিয়াদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে আসাম (অফিসিয়াল) ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট (অখঅ-১৯৬০) নামে একটি আইন আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়।
এই অ্যাক্ট পাসের পর বাঙালিরা নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত হতে থাকে। আন্দোলনকে কার্যকর ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা নামে বাংলাভাষীরা ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসে। ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব সংগঠন আসাম প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আসাম (অফিসিয়াল) ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট (অখঅ-১৯৬০) বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এমনকি জেলা কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক সংগঠিত ভাষা আন্দোলন সমিতিও এ প্রতিবাদে শামিল হয়। এছাড়াও সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা, নাগরিক-সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।
যে কোন আন্দোলনে যখন জন অংশগ্রহন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটতে থাকে তখন শাসক দল কোন অবস্থাতেই সে আন্দোলনকে দমাতে পারে না। আন্দোলনের প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণভাবে সভা, মিছিল, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, হরতাল এবং অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলনকে গতিশীল এবং সাধারণ মানুষের ভেতর বাংলা ভাষার দাবিকে আরও জোরালো করার লক্ষ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু করে। এ পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়। ২০০ মাইল পদযাত্রায় গণমানুষের অংশগ্রণের কারণে আন্দোলণ তৃণমূল পর্যায়ে সফলভাবে বিস্তৃতি লাভ করে।
তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অংশ গ্রহণের কারণেই বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। আন্দোলনের দাবির সঙ্গে বরাক উপত্যকার সবাই স্তরের মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে। মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিটি গণমানুষের প্রাণের দাবিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। পদযাত্রা কর্মসূচির কারণে বরাক উপত্যকায় ব্যাপক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করেন, ১৩ মে’র মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা না হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে।
আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় ১৯ মে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেই হরতালে জনজোয়ার এত তীব্র ছিল যে, শাসকগোষ্ঠী জনতার আন্দোলনকে নৃশংসভাবে দমন করতে গিয়ে ভাষা সংগ্রামীদের নির্বিচারে এবং নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে। শহিদের রক্ত স্রোতের ঢেউ এতই তীব্র ছিল, যা দেখে শাসকেরা বাংলাকে আসামের রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করতে বাধ্য হয়। সারাবিশ্বের বাঙালিদের জন্য এটা এক গর্বের ইতিহাস। ২১ ফেব্রুয়ারির মতো ১৯ মে’র ১১ জন ভাষাশহিদ সমগ্র বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের গর্ব ও অহংকার।
আশার বিষয় আসামের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী মানুষ এখন ১৯ মে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করেন প্রতি বছর। ভাষা দিবস পালন করতে গিয়ে তারা স্লোগান তুলেন- ‘আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় উনিশ’। পঁচিশে বৈশাখ থেকে শুরু হয় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আর শেষ হয় ১১ জ্যৈষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দুটি চোখের তারা করে বরাক উপত্যকার মানুষেরা এগিয়ে যাচ্ছেন ভাষা শহিদের রক্তের প্রতিদান দিতে। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় যেমন সারা বিশ্বের বাঙালিরা সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সমর্থ হয়, বরাক উপত্যকার ভাষা শহিদের অবদানও বাঙালিদের ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নেয়া যে কোন সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে সমর্থ হবে। বরাক উপত্যকা হলো ভাষা শহিদের রেলস্টেশন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে কোন অবিচারের বিরুদ্ধে কন্ঠ সরব করতে এই ভাষা শহিদ রেলস্টেশন হয়ে উঠুক সব প্রেরণার উৎস।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
আসামের শিলচর শহরের রেলস্টেশনটির নাম ভাষাশহিদ স্টেশন
শুক্রবার, ২৩ জুন ২০২৩
ভাষাশহিদ স্টেশন। আসাম রাজ্যের ‘রাজ্য ভাষা’ হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যেখানে এগারোজন বাঙালি অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ভাষাশহিদ স্টেশন কোথায়? ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের রেলস্টেশনটির নাম ভাষাশহিদ স্টেশন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সকাল থেকেই আন্দোলনকারীরা আসাম রাজ্যের রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি লাভের জন্য অহিংস ভাবে হরতাল পালন করছিলেন, আসামের বরাক উপত্যকার তিন জেলাতে। জেলাগুলো হলো শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি।
বরাক উপতক্যার প্রধান শহর হলো শিলচর। শিলচরের তারাপুর রেলস্টেশনে শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল অবরোধ। ভারতীয় সময় বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তারক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন নয়জন ভাষাসৈনিক। পরে আরো দুজনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরো একজন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর ’৬১ সালের ১৯ মে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিলেন বাঙালি সাধারণ মানুষ। শহিদ হলেন কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। এ আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা আসামের সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। এই ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাংলাভাষীদের দাবির মুখে শিলচরের তারাপুরে অবস্থিত রেলস্টেশনটির নামকরণ করা হয় ভাষাশহিদ স্টেশন।
১১ জন ভাষাশহিদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। ভাষা আন্দোলনে পৃথিবীর নানা প্রান্তের অজস্র নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী একমাত্র নারী ১৬ বছরের এই কিশোরী, যার নাম কমলা ভট্টাচার্য। কমলা ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রামরামান ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যের আদিনিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তার পারিবারের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে চলে যান এবং শিলচর পাবলিক স্কুল রোডে বসবাস শুরু করেন। কমলা শিলচরের চোতি লাল সেন ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন।
সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর বৃহত্তর সিলেট থেকে বাংলাভাষী লাখ লাখ মানুষ বরাক উপত্যকার জেলাগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশের সিলেটের সঙ্গে বরাক উপত্যকার মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাকসহ কোন বিষয়ের অমিল নেই। গঙ্গা ও পদ্মা নদীর মতো বরাক ও সুরমা নদী। যেহেতু বাংলার, বাঙালির রক্ত ধারা বরাক উপত্যকার মানুষের মধ্যে প্রবাহিত তাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় তারাও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার হরণের উদ্যোগের কথা জেনে তারাও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
দুটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত পার্থক্য ছিল না বলে তারাও ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পূর্ব বাংলার ভাষা সংগ্রামীদের মতো জেগে উঠেছিলেন। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল কারণ- ‘একই আকাশ, একই বাতাস, এক হৃদয়ের একই তো শ্বাস।’ দেশ ভাগ করে ভূগোল পরিবর্তন করা হয়েছিল কিন্তু সংস্কৃতিকে বিভক্ত করা যায়নি। বরাক উপত্যকার আন্দোলনকারীদের মূল স্লোগান ছিল ‘জান দেবো তবু জবান দেবো না।’ বড় দৃঢ় ছিল তাদের উচ্চারণ। লক্ষ্যে ছিলেন তারা অবিচল।
কী প্রেক্ষাপটে বরাক উপত্যকায় ভাষার জন্য এই অদম্য আন্দোলন? পঞ্চাশের দশকে বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে আশি শতাংশই ছিল বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি। এছাড়া আসামের অন্যান্য অঞ্চলেও বিপুলসংখ্যক বাঙালির বসবাস ছিল। উল্লেখ্য, আসামে অন্য সব জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে অসমিয়াদের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবে ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা কিংবা আর্থসামাজিক বিচারে বাঙালিরা ছিল অগ্রসরমান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নীলনকশার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের ওপর ‘অসমিয়া জাতীয়তাবাদী’ ধ্যান-ধারণাকে চাপিয়ে দেয়ার বীজ রোপণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের উসকে দেয়া হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের ভেতর এমন মানসিক দুর্ভাবনা ও আশঙ্কা ভর করে যে, অগ্রসরমান বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া যুবকদের শুধু কর্মসংস্থান দখলই নয়, পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এ ধরনের মানসিক ভীতি থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এ সময় তারা অসমিয়াদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে আসাম (অফিসিয়াল) ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট (অখঅ-১৯৬০) নামে একটি আইন আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়।
এই অ্যাক্ট পাসের পর বাঙালিরা নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত হতে থাকে। আন্দোলনকে কার্যকর ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা নামে বাংলাভাষীরা ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসে। ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি’, ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব সংগঠন আসাম প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আসাম (অফিসিয়াল) ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট (অখঅ-১৯৬০) বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এমনকি জেলা কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক সংগঠিত ভাষা আন্দোলন সমিতিও এ প্রতিবাদে শামিল হয়। এছাড়াও সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা, নাগরিক-সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।
যে কোন আন্দোলনে যখন জন অংশগ্রহন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটতে থাকে তখন শাসক দল কোন অবস্থাতেই সে আন্দোলনকে দমাতে পারে না। আন্দোলনের প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণভাবে সভা, মিছিল, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, হরতাল এবং অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলনকে গতিশীল এবং সাধারণ মানুষের ভেতর বাংলা ভাষার দাবিকে আরও জোরালো করার লক্ষ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু করে। এ পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়। ২০০ মাইল পদযাত্রায় গণমানুষের অংশগ্রণের কারণে আন্দোলণ তৃণমূল পর্যায়ে সফলভাবে বিস্তৃতি লাভ করে।
তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অংশ গ্রহণের কারণেই বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। আন্দোলনের দাবির সঙ্গে বরাক উপত্যকার সবাই স্তরের মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে। মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিটি গণমানুষের প্রাণের দাবিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। পদযাত্রা কর্মসূচির কারণে বরাক উপত্যকায় ব্যাপক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করেন, ১৩ মে’র মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা না হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে।
আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় ১৯ মে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেই হরতালে জনজোয়ার এত তীব্র ছিল যে, শাসকগোষ্ঠী জনতার আন্দোলনকে নৃশংসভাবে দমন করতে গিয়ে ভাষা সংগ্রামীদের নির্বিচারে এবং নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে। শহিদের রক্ত স্রোতের ঢেউ এতই তীব্র ছিল, যা দেখে শাসকেরা বাংলাকে আসামের রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করতে বাধ্য হয়। সারাবিশ্বের বাঙালিদের জন্য এটা এক গর্বের ইতিহাস। ২১ ফেব্রুয়ারির মতো ১৯ মে’র ১১ জন ভাষাশহিদ সমগ্র বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের গর্ব ও অহংকার।
আশার বিষয় আসামের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী মানুষ এখন ১৯ মে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করেন প্রতি বছর। ভাষা দিবস পালন করতে গিয়ে তারা স্লোগান তুলেন- ‘আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় উনিশ’। পঁচিশে বৈশাখ থেকে শুরু হয় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আর শেষ হয় ১১ জ্যৈষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দুটি চোখের তারা করে বরাক উপত্যকার মানুষেরা এগিয়ে যাচ্ছেন ভাষা শহিদের রক্তের প্রতিদান দিতে। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় যেমন সারা বিশ্বের বাঙালিরা সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সমর্থ হয়, বরাক উপত্যকার ভাষা শহিদের অবদানও বাঙালিদের ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নেয়া যে কোন সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে সমর্থ হবে। বরাক উপত্যকা হলো ভাষা শহিদের রেলস্টেশন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে কোন অবিচারের বিরুদ্ধে কন্ঠ সরব করতে এই ভাষা শহিদ রেলস্টেশন হয়ে উঠুক সব প্রেরণার উৎস।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]